পাতা:সমাজ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
সমাজ

করিলাম এবং তাহার পরিবর্ত্তে একটা প্রত্যুপকার আমার পাওনা রহিল ইহাই ভুলিতে না পারিয়া আমরা দেবভক্তি সম্বন্ধে এমন দোকানদারীব কথা বলিয়া থাকি। পূজাটা দেবতাব হস্তগত হওয়াই যখন বিষয়, এবং সেটা ঠিকমত তাঁহার ঠিকানায় পৌঁছিলেই যখন আমার কিঞ্চিৎ লাভ আছে, তখন যত অল্প ব্যয়ে অল্প চেষ্টায় সেটা চালান করা যায় ধর্ম্ম ব্যবসায়ে ততই আমার জিৎ। দরকার কি ঈশ্বরের স্বরূপ ধারণা চেষ্টায়, দরকার কি কঠোর সত্যানুসন্ধানে; সম্মুখে কাষ্ঠ, প্রস্তর, যাহা উপস্থিত থাকে তাহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা নিবেদন করিয়া দিলে যাঁহার পূজা তিনি আপনি ব্যগ্র হইয়া আসিয়া হাত বাড়াইয়া লইবেন।

 আমাদের পুরাণে ও প্রচলিত কাব্যে যেরূপ বর্ণনা আছে তাহাতে মনে হয় দেবতারা যেন আপনাদের পূজা গ্রহণের জন্য মৃতদেহের উপর শকুনী গৃধিনীর ন্যায় কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছেন। অতএব আমাদের নিকট হইতে ভক্তিগ্রহণের লোলুপতা যে ঈশ্বরেরই একথা আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনেও অলক্ষ্যে বিবাজ করিতেছে।

 কিন্তু, কি মনুষ্যপূজায় এবং কি দেবপূজায়, ভক্তি ভক্তেরই লাভ। যাঁহাকে ভক্তি করি তিনি না জানিলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু তাঁহাকেই আমার জানা চাই, তবেই আমার ভক্তির সার্থকতা। পূজ্য ব্যক্তির আদর্শকে আমাদের প্রকৃতির সহিত সম্পূর্ণ মিশাইয়া লইতে চাহিলে ভক্তি ছাড়া আর কোনো উপায়ই নাই। আমরা যাঁহাকে পূজা করি তাঁহাকেই যদি বস্তুত চাই তবে তাঁহার প্রকৃতির আদর্শ তাঁহার সত্যস্বরূপ একান্ত ভক্তিযোগে হৃদয়ে স্থাপনা করিতে হয়। সেরূপ অবস্থায় ফাঁকি দিতে স্বতই প্রবৃত্তি হয় না,—তাঁহার সহিত বৈসাদৃশ্য ও দূরত্ব যতই দীনত্বের সহিত অনুভব করি ততই ভক্তি বাড়িয়া উঠিয়া ক্ষুদ্র আপনাকে তাঁহার সহিত লীন করিবার চেষ্টা করে।