পাতা:সিরাজদ্দৌলা - অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়.pdf/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সিরাজদ্দৌলা।

পুরাণ-শ্রবণে ভক্তি-গদগদ-হৃদয়ে নিমগ্ন হইতেন। সমাজের যাঁহারা লক্ষ্মীরূপিণী-অৰ্দ্ধাঙ্গিনী, তাঁহারা দেবতা, ব্রাহ্মণ, অতিথি ও পোষ্যবর্গের সেবা করিয়া, সময়ে অসময়ে ছেলে ঠেঙ্গাইয়া, নথ নাড়িয়া, চুল খুলিয়া, সন্ধ্যার শীতল বাতাসে পুকুর-ঘাঠ আলো করিয়া বসিতেন; কত কথা কত রঙ্গরস—তার সঙ্গে প্রৌঢ়ার সগর্ব্ব-হস্তসঞ্চালন, নবীনার অবগুণ্ঠনজড়িত অস্ফুট সখি-সম্ভাষণ, এবং স্থবিরার স্থলদ্-বচনে শিবমহিম স্তোত্রের বিকৃত-আবৃত্তি সান্ধ্যসম্মিলনকে কতই মধুময় করিয়া তুলিত!

 সে দিন। আর নাই;—এখন আমরা সভ্য হইয়াছি। বালকেরা দন্তোদগমের পূর্বেই ক, খ, ধরিয়া পাঁচ ঘণ্টা স্কুলের কঠিন কাষ্ঠাসনে কখন দাড়াইয়া, কখন বা বসিয়া, বৈকালে গৃহশিক্ষকের তীব্রতাড়না সহা করিয়া, আহার না করিতেই ঘুমাইয়া পড়ে; যুবারা হ। অন্ন! হা অন্ন! করিয়া চাকুরীর আশায়, উমেদারীর আশায়, কখন বা শুধু একখানি প্রশংসাপত্র পাইবার আশায়, দেশে দেশে ছুটিাছুটি করিয়া অল্পদিনেই অধ্যয়ন ক্লিষ্ট দুর্বলদেহে নিতান্ত অসময়েই স্থবিরত্ব লাভ করে; বৃদ্ধের অনাবশ্যক উৎসাহে সেকালের জীর্ণ খুঁটার সঙ্গে উড্ডীয়মান জাতীয় জীবনকে বাঁধিয়া রাখিবার জন্য পাড়ায় পাড়ায় দলাদলির বৈঠক কারিয়া ক্ষুধাবৃদ্ধি করেন; আর সমাজের যাঁহারা লক্ষীরূপিণী,—সেই অর্দ্ধাঙ্গিনীগণ অৰ্দ্ধ অবগুণ্ঠনে স্বামিপুত্রের সঙ্গে দেশে দেশে ফিরিয়া কেবল অনাবশ্যকরূপে চিকিৎসকের এবং স্বর্ণকারের-ঋণজালে জড়িত হইয়া পড়েন। এ সকল যদি একালের সুখের চিত্র বলিয়া গর্ব্ব করিতে পারি, তবে সেকালে দেশের লোকের সুখশান্তির একেবারেই অভাব ছিল বলিয়া উপহাস করা শোভা পায় না।