পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ইহজীবনে যে কিছু আশা, যে কিছু ভরসা, যে কিছু কামনা, যে কিছু মানস করিয়াছি,—আমি যদি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, সকলই যেন নিষ্ফল হয়। মহারাজ ! নারীজন্মে স্বামিসন্দর্শনের তুল্য পুণ্যও নাই, মুখও নাই—যদি আমি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, যেন ইহজন্মে আমি সে সুখে চিরবঞ্চিত হই। যে পুত্রের জন্য আমি এই কলঙ্ক রটাইয়াছি—যাহার তুলনায় জগতে আমার আর কিছুই নাই—যদি আমি অবিশ্বাসিনী হই, আমি যেন সেই পুত্রমুখদর্শনে চিরবঞ্চিত হই। মহারাজ। আর কি বলিব—যদি আমি অবিশ্বাসিনী হইয়া থাকি, তবে জন্মে জন্মে যেন নারীজন্ম গ্রহণ করিয়া, জন্মে জন্মে স্বামিপুত্রের মুখদর্শনে চিরবঞ্চিত হই।” . রম। আর বলিতে পারিল না—ছিন্ন লতার মত সভাতলে পড়িয়া গিয়া মূচ্ছিত৷ হইল—ধাত্রীগণে ধরাধরি করিয়া অন্তঃপুরে বহিয়া লইয়া গেল। ধাত্ৰীক্রোড়স্থ শিশু মার সঙ্গে সঙ্গে কাদিতে কঁাদিতে গেল ; সভাতলস্থ সকলে অশ্রুমোচন করিল। গঙ্গারামের করচরণস্থিত শৃঙ্খলে ঝঞ্চনা বাজিয়া উঠিল। দর্শকমণ্ডলী বাত্যাপীড়িত সমুদ্রের ন্যায় চঞ্চল হইয়া মহান কোলাহল সমুথিত করিল—রক্ষিবর্গ কিছুই নিবারণ করিতে পারিল না। তখন “গঙ্গারাম কি বলে ?” “গঙ্গারাম কি এ কথা মিছ বলে ?” “গঙ্গারাম যদি মিছা বলে, তবে আইস, আমরা সকলে মিলিয়া গঙ্গারামকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলি।” এইরূপ রব চারি দিক্ হইতে উঠিতে লাগিল। গঙ্গারাম দেখিল, এই সময়ে লোকের মন ফিরাইতে না পারিলে, তাহার আর রক্ষা নাই। গঙ্গারাম বুদ্ধিমান, বুঝিয়াছিল যে, প্রজাবৰ্গ যেমন নিষ্পত্তি করিবে, রাজাও সেই মত করিবেন। তখন সে রাজাকে সম্বোধন করিয়া লোকের মনভুলান কথা বলিতে আরম্ভ করিল, “মহারাজ ! কথাটা এই যে, স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিবেন—না আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন ? প্রভু! আপনার এই রাজ্য কি স্ত্রীলোকে সংস্থাপিত করিয়াছে—ন আমার ন্যায় রাজভৃত্যদিগের বাহুবলে স্থাপিত হইয়াছে ? মহারাজ ! সকল স্ত্রীলোকেই বিপথগামিনী হইতে পারে, রাজরাণীরাও বিপথগামিনী হইয়া থাকেন ; রাজরাণী বিপথগামিনী হইলে রাজার কৰ্ত্তব্য যে, তাহাকে পরিত্যাগ করেন। বিশ্বাসী ভূত্য কখনও বিপথগামী হয় না ; তবে স্ত্রীলোকে আপনার দোষ ক্ষালন জন্য ভূত্যের ঘাড়ে চাপ দিতে পারে। এই মহারাণী রাত্রিতে কাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আমাকে দোষী করিতেছেন, তাহার স্থিরতা—মহারাজ, রক্ষা কর । রক্ষা কর।” কথা কহিতে কহিতে গঙ্গারাম কথা সমাপ্ত না করিয়া,—অতিশয় ভীত হইয়া, “মহারাজ, রক্ষা কর । রক্ষা কর!” এই শব্দ করিয়া স্তম্ভিত বিহালের মত হইয়া নীরব হইয়া দাড়াইয়া রহিল। সকলে দেখিল, গঙ্গারাম থর থর কঁাপিতেছে। তখন সমস্ত