পাতা:স্বামী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
স্বামী

দিয়েই পেয়েছিলুম। তবে কেন তাতে আমার মন উঠ্‌ল না। তাই যে দামটা আমাকে দিতে হ’ল, আমার অতি বড় শত্রুর জন্যেও তা এক দিনের জন্যেও কামনা করিনে। কিন্তু দাম আমাকে দিতে হ’ল। যিনি সমস্ত পাপ-পুণ্য, লাভ-ক্ষতি, ন্যায়-অন্যায়ের মালিক, তিনি আমাকে একবিন্দু রেহাই দিলেন না। কড়ায় ক্রান্তিতে আদায় ক’রে সর্ব্বস্বাস্ত ক’রে যখন আমাকে পথে বার কোরে দিলেন—লজ্জা-সরমের আর যখন কোথাও কিছু অবশিষ্ট রাখলেন না।—তখনই শুধু দেখিয়ে দিলেন, ওরে সর্ব্বনাশী, এ তুই করেছিস্ কি? স্বামী যে তোর আত্মা। তাঁকে ছেড়ে তুই যাবি কোথায়? একদিন না একদিন তোর ঐ শূন্য বুকের মধ্যে তাঁকে যে তোর পেতেই হবে। এ জন্মে হোক্, আগামী জন্মে হোক্, কোটি জন্ম পরে হোক্, তাঁকে যে তোর চাই-ই। তুই যে তাঁরই।

 জানি যা হারিয়েছি, তার অনন্ত গুণ আজ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু তবু যে এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনে, এটা আমার নারীদেহ। আজ আমার আনন্দ রাখবার জায়গা নেই, কিন্তু ব্যথা রাখ্‌বারও যে ঠাঁই দেখি না প্রভু! এ দেহের প্রত্যেক অণু-পরমাণু যে অহোরাত্র কাঁদ্‌ছে—ওরে অস্পৃশ্যা, ওরে পতিতা, আমাদের আর বেঁধে পোড়াস্‌নে—আমাদের ছুটি দে, আমরা একবার ম’রে বাঁচি!

 কিন্তু থাক্ সে কথা।

 বাবা মারা গেলেন, এক বছরের মেয়ে নিয়ে মা বাপের বাড়ী চ’লে এলেন। মামার ছেলেপিলে ছিল না, তাই গরীবের ঘর হলেও আমার আদর যত্নের ত্রুটি হ’ল না। বড় বয়স পর্য্যন্ত তাঁর কাছে ব’সে ইংরাজি বাঙলা কত বই না আমি পড়েছিলুম।

 কিন্তু মামা ছিলেন ঘোর নাস্তিক। ঠাকুর দেবতা কিছুই মান্‌তেন না। বাড়ীতে একটা পূজা-অর্চ্চনা, কি বার-ব্রতও কোন দিন হ’তে দেখিনি—এ সব, তিনি দু’চক্ষে দেখতে পার্‌তেন না।