পাতা:স্বামী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
স্বামী

 মামা হেসে বলতেন, “ভাবিসনে বোন সে সব আমি জানি। এই যেমন তোকে হেসে উড়িয়ে দিচ্চি, ঠিক এমনি করে আমাদেয় নচ্ছার সমাজটাকেও হেসে উড়িয়ে দেব।”

 মা মুখ ভার ক’রে বিড় বিড় ক’রে বকৃতে বকৃতে উঠে যেতেন! মামা গ্রাহ্য করতেন না বটে, কিন্তু আমার ভারি ভয় হ’ত। কেমন ক’রে যেন বুঝতে পারতুম, মামা যাই বলুন, মার কাছ থেকে আমাকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন না।


 কেন যে বিয়ের কথায় ভয় হ’তে সুরু হ’য়েছিল, তা বল্চি। আমাদের পশ্চিম-পাড়ার বুক চিরে যে নালাটা গ্রামের সমস্ত বর্ষার জল নদীতে ঢেলে দিত, তার দুই পাড়ে যে দু’ঘরের বাস ছিল, তার এক ঘর আমরা, অন্য ঘর গ্রামের জমিদার বিপিন মজুমদার। এই মজুমদারবংশ যেমন ধনী, তেমনি দুর্দ্দান্ত। গাঁয়ের ভেতরে-বাইরে এদের প্রতাপের সীমা ছিল না। নরেন ছিল এই বংশের একমাত্র বংশধর।

 আজ এত বড় মিথ্যেটা মুখে আনতে আমার যে কি হচ্চে, সে আমার অন্তর্যামী ছাড়া আর কে জানবে বল, কিন্তু তখন ভেবেছিলুম, এ বুঝি সত্যি একটা জিনিস,—সত্যই বুঝি নরেনকে ভালবাসি।

 কবে যে এই মোহটা প্রথম জন্মেছিল, সে আমি বল্তে পারি না। কলকাতায় সে বি-এ পড়্ত, কিন্তু ছুটীর সময় বাড়ী এলে মামার সঙ্গে ফিলজফি আলোচনা করতে প্রায়ই আসত। তখনকার দিনে Agnoticism'ই ছিল বোধ করি লেখাপড়া-জানাদের ফ্যাসান! এই নিয়েই বেশিভাগ তর্ক হ’ত। কতদিন মামা তার গৌরব দেখাবার জন্য নরেনবাবুর তর্কের জবাব দিতে আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কতদিন সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত্রি হয়ে যেত, দু’জনের তর্কের কোন মীমাংসা হ’ত না। কিন্তু, আমিই প্রায় জিত্ তুম, তার কারণও আর আজ আমার অবিদিত নেই।