[ ১৪ ]

 নিদাঘের উত্তপ্ত প্রবল বায়ুর সম্মুখে বালুকাস্তূপের ন্যায় হর্ষের সাম্রাজ্য কেথায় উড়িয়া গেল তাহা কেহ বলিতে পারিল না। আর্য্যাবর্ত্ত পুনরায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হইয়া গেল। ক্রমে সমৃদ্ধিশালী জনপদ সমূহে পরিপূর্ণ হইয়া ক্ষুদ্র আটবিকরাজ্য মহাকোশল আখ্যা লাভ করিল। হর্ষের সময়ে যে রাজকর্ম্মচারী কোশল শাসন করিতেন তিনি যথাসময়ে রাজোপাধি গ্রহণ করিয়া কোশলের সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ধনভূতির নগরের বহির্দ্দেশে স্তূপের সন্নিধানে নূতন রাজবংশের নূতন রাজধানী স্থাপিত হইল। আর্য্যাবর্ত্তের ইতিহাসে এই নূতন রাজবংশের নাম এখনও অজ্ঞাত। নূতন রাজার বংশধরগণ বর্ব্বর কন্যা বিবাহ করিয়া যে মিশ্রজাতি উৎপাদন করিয়াছিলেন তাহারা উত্তরকালে, ইতিহাসে, চন্দ্রাত্রেয় বা চন্দেল্ল নামে পরিচিত হইয়াছিল। আটবিক প্রদেশের উন্নতির সহিত মঠেরও উন্নতি হইতেছিল। মঠবাসিগণ রাজ্য পরিচালনা পরিত্যাগ করিলেও প্রভূত শক্তিশালী ছিলেন। রাজগণ ও বর্বর দলপতিগণ সর্ব্বদা প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও ভূমিদানে তাঁহাদিগকে সন্তুষ্ট রাখিবার চেষ্টা করিতেন; ক্রমে ধনশালী, শক্তিশালী শৈব মঠবাসিগণ কোশল রাজ্যের রাজশক্তির সমান বলশালী হইয়াছিলেন। মঠের উন্নতির সহিত মঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারও উন্নতি হইয়াছিল। আমার মস্তকের উপরে বহুদূর দেশ হইতে আনীত নানা বর্ণের পাষাণখণ্ডসমূহ যোজনা করিয়া মঠবাসিগণ এক অত্যদ্ভুত বিশাল প্রাসাদ নির্ম্মাণ করিয়াছিল। তাহার গগনস্পর্শী চূড়ায় শুভ্র রজতনির্ম্মিত ত্রিশূল ভগবান দেবাদিদেবের মহিমা ঘোষণা করিত। প্রতিদিন শত শত নরনারী আমাকে দর্শন করিতে আসিত। পুষ্পচন্দন ও বিল্বপত্রে আমাকে আচ্ছাদিত করিত, দধিদুগ্ধঘৃতমধু ও জলধারায় আমার দেহ পিচ্ছিল করিয়া রাথিত, সুবর্ণ ও রজত খণ্ড বর্ষণে আমাকে আচ্ছন্ন করিয়া মঠের কোষ পরিপূর্ণ করিত। বন্ধ্যা আমার নিকট পুত্র কামনা করিত, কুমারী ভর্ত্তা কামনা করিত, নির্ধন ধনকামনা করিত, যোদ্ধা জয়কামনা করিত। কাহারও কামনা যদি অকস্মাৎ দৈববলে পূর্ণ হইত, তাহা হইলে আমার শক্তির উপরে মহাকোশলবাসিগণের বিশ্বাস শতগুণ বর্দ্ধিত হইত, আমি তাহাদিগকে বলিতাম যে আমি চলচ্ছক্তিহীন পাষাণ খণ্ড, আমাতে দেবত্বের কোন চিহ্ন নাই। বাসনাপূর্ণ করিবার ক্ষমতা যদি আমার থাকিত তাহা হইলে আমি বৌদ্ধস্তূপের বেষ্টনীর স্তম্ভ হইতে দেবাদিদেব মহাদেবে পরিণত হইতাম না, তাহা হইলে মহাস্থবিরের সযত্ন নির্ম্মিত স্তূপে ধ্বংসাবশেষের উপরে ব্রাহ্মণের দেবতার মন্দির নির্ম্মিত হইতে পারিত না, ধনভূতির নগরশীর্ষে আভীর রমণী মেষচারণ করিতে পারিত না। কিন্তু আমার কথায় কেহ কর্ণপাত করিত না, আমার ভাষা হৃদয়ঙ্গম করিবার শক্তি বা ইচ্ছা তাহাদিগের ছিল না। শত শত বৃহৎ ঘণ্টার ঘোর রোলে শত শত নরনারীর মুখনিঃসৃত “শিব শিব শম্ভো” “হর হর মহাদেব” শব্দে বৃহৎ মন্দিরের ভিত্তি পর্য্যন্ত কম্পিত হইত, নিশ্চল পাষাণের অস্ফুট ভাষা জনসঙ্ঘের শ্রুতিগোচর হইত না। ক্রমে অবিশ্রান্ত জল বর্ষণে আমার তৈলাক্তদেহ দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেল। এক দিন রাত্রিকালে মঠবাসিগণ গোপনে দুইজন তরুণ শিল্পির সাহায্যে আমার জীর্ণদেহ তাম্রমিশ্রিত রজতখণ্ডের দ্বারা যোজনা করিল, ও রজনী শেষ হইবার পূর্ব্বে তাহাদিগকে নিহত করিয়া, মন্দির তলে আচ্ছাদনের পাষাণনিম্নে তাহাদিগের শবদেহ সমাহিত করিল। এই রূপে কত দিন অতিবাহিত হইল তাহা বলিতে পারি না। শুনিয়াছিলাম হর্ষের মাতুলপুত্র ভণ্ডির বংশ কান্যকুব্জে সিংহাসনারোহণ করিয়া সম্রাট উপাধি ধারণ করিয়াছিল। তাহার পর কি হইল তাহা শুনিতে পাই নাই। শুনিয়াছিলাম মগধে প্রভাকরবর্দ্ধনের মাতুলপুত্র সম্রাট উপাধি ধারণ করিয়া কিছুদিন আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। কিছুদিন গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে সম্রাট দেখিতে পাওয়া যাইত। আর্য্যাবর্ত্তে যত নগর ছিল তাহা অপেক্ষা সাম্রাজ্যের সংখ্যা অধিক হইয়াছিল, দেশের লোকে সম্রাট বলিলে সামান্য ভূস্বামী বুঝিত।

 ক্রমে মন্দির জীর্ণ হইল, মঠবাসিগণ অতুল সম্পতির অধীশ্বর ছইয়া বিলাসিতার স্রোতে নিমগ্ন হইলেন। যে ক্ষমতার বলে তাঁহাদিগের পূর্ব্ববর্ত্তীগণ বর্ব্বর জাতির মনোহরণ করিয়াছিলেন সে ক্ষমতা অন্তর্হিত হইল। অন্যান্য ভূসম্পত্তির ন্যায় দেবাদিদেব মহাদেব আমিও অর্থাগমের উপায়ের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিলাম। ব্রাহ্মণদিগের ভাষানুসারে আমি জগতের ঈশ্বর হইয়াও ইদানীং কারারুদ্ধ হইয়াছিলাম, অর্থলোলুপ মঠবাসিগণ আমার দেহ কাঞ্চন নির্ম্মিত আবরণে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিত, আমার দরিদ্র ভক্তগণ আবরণের উপরে পুষ্প বিল্বপত্র ও বারিবর্ষণ করিত। কেবল যাহারা সুবর্ণ বর্ষণে আমার গৌরীপট্ট মগ্ন করিতে পারিত তাহারাই আমার পাষাণ স্বরূপের সাক্ষাৎ পাইত। এইরূপে ক্ষুদ্র আটবিক রাজ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়া গেল।

 বহুদিন পরে শ্রুত হইল যে আর্য্যাবর্ত্তে পুনরায় যবন প্রবেশ করিয়াছে, পুনরায় গান্ধারে ও পঞ্চনদে যবনের অধিকার দৃষ্ট হইয়াছে। নূতন বলে বলীয়ান্ হইয়া যবন জাতি প্রাচীন পারসিক রাজ্য ধ্বংস করিয়াছে, তাহাদিগের সম্মুখে প্রাচীন রাজ্য সমূহ ধূলিসাৎ হইতেছে। বহুকাল পূর্ব্বে যবনেরা যখন আর একবার পঞ্চনদ অধিকার করিয়াছিল তখন তাহাদিগের যেরূপ আচার ব্যবহার ছিল এখন আর সেরূপ নাই। কেহ কেহ বলিত যে ইহারা যে যবন জাতি নহে, ইহারা সম্পূর্ণ বিভিন্ন। তাহাদিগের নাম শুনিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম যে যাহাদিগের শিল্পকুশলতার ফলে জীবনের প্রারম্ভে আমাদিগের আকারের পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছিল ইহারা তাহাদিগেরই বংশধর। আমার কৌতূহল অতি শীঘ্রই নিবৃত্ত হইয়াছিল। দেখিতে দেখিতে যবনসেনা আর্য্যাবর্ত্ত গ্রাস করিয়া ফেলিল। ত্রস্ত হইয়া আটবিক নগরবাসিগণ শুনিল যে যবনেরা নগর লুণ্ঠন করিতে আসিতেছে। সেদিন আর আমার মন্দিরে জনতা দেখা যায় নাই, আমার উপাসকগণ বিরসবদনে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া উপবেশন করিয়াছিল। দূরে যখন যবনসেনার অশ্বপদধ্বনি শ্রুত হইল তখন যে যেদিকে পথ পাইল দ্রুতবেগে পলায়ন করিল। দেখিতে দেখিতে শত শত যবন অশ্বারোহী মন্দির মধ্যে প্রবেশ করিল, উল্কার আলোকে অন্ধকার গর্ভগৃহ আলোকিত হইয়া উঠিল। যবনগণ মন্দিরে প্রবেশ করিয়াই লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হইল, ক্ষণেকের মধ্যে গর্ভগৃহ ত্যাগ করিয়া তাহারা বিশাল মন্দির প্রাঙ্গনের চতুষ্পার্শ্বে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। শত শত বর্ষের যত্নসঞ্চিত ধনরাশি বিনা বাধায় তাহাদিগের হস্তগত হইল। গর্ভগৃহের মধ্য দেশে একজন যবন অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া ছিল, তাহার সম্মুখে উল্কাহস্তে অপর দুইজন যবন দণ্ডায়মান ছিল; যবনসেনা লুণ্ঠনে প্রাপ্ত ধনরত্নরাজি আনয়ন করিয়া অশ্বারোহীর সম্মুখে নিক্ষেপ করিতেছিল। দেখিতে দেখিতে গর্ভগৃহের মধ্যস্থলে মনি মুক্তা ও সুবর্ণের স্তূপ নির্ম্মিত হইল। ক্রমে ক্রমে একে একে যবনগণ গর্ভগৃহে আসিয়া সম্মিলিত হইল, তাহাদিগের আকার ভাষা, পরিচ্ছদ, আচার ব্যবহার কোন বিষয়েই প্রাচীন যবনদিগের সহিত সাদৃশ্য ছিল না। আকারে তাহারা শক এবং হূণদিগের অনুরূপ, পরিচ্ছদে বনবাসী বর্ব্বরগণের এবং আচার ব্যবহারে চণ্ডালসদৃশ। যখন লুণ্ঠন করিবার কিছু আর অবশিষ্ট রহিল না, তখন দলপতির আদেশে যবনসেনা আমার আবরণ মোচন করিল। আবরণের অভ্যন্তরে নীরস পাষাণ ব্যতীত আর কিছুই নাই দেখিয়া যবনগণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে গদা ও পরশুর আঘাতে আমার ঊর্দ্ধদেশ খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল, বর্ত্তমান সময়ে বিংশতি শতাব্দীর চিত্রশালায় আমার যে আকার দেখিতেছ, এ আকার যবনগণ কর্ত্তৃক প্রদত্ত। হতাশ্বাস হইয়া যবনসেনা আমাকে পরিত্যাগ করিল। দলপতির আদেশে লুণ্ঠনলব্ধ দ্রব্যসম্ভার ক্রমে ক্রমে মন্দিরের বহির্দ্দেশে প্রেরিত হইল। তাহার পর যবনগণ শুষ্ক কাষ্ঠে গর্ভগৃহ পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিল, দেখিতে দেখিতে ইন্ধনের চূড়া মন্দিরাভ্যন্তরের শিখরদেশ স্পর্শ করিল; তখন কাষ্ঠরাশিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া যবনগণ নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে মন্দির প্রাঙ্গণের শত শত স্থান হইতে লেলিহান অগ্নিশিখা মন্দিরের পাযাণখণ্ড সমূহ দগ্ধ করিতে লাগিল। গর্ভগৃহে সঞ্চিত কাষ্ঠরাশি ক্রমশঃ ধীরে ধীরে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল, অন্তরে ও বাহিরে উভয় দিক হইতে প্রবল অগ্ন্যুত্তাপ আসিয়া এক এক খানি করিয়া পাষাণ স্থানচ্যুত করিতে লাগিল। গর্ভগৃহের মধ্যে উত্তাপ অসহ্য হইয়া উঠিল, তখন মন্দির প্রাঙ্গণে অগ্নিক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। ক্রমে ভিত্তির বন্ধন শিথিল হইয়া আসিলে মহাশব্দের সহিত বৃহৎ মন্দিরশিখর ভূপতিত হইল, গুরুভার পাষাণখণ্ড সমূহ গর্ভগৃহের অগ্নি নির্ব্বাপিত করিল বটে, কিন্তু গর্ভগৃহের আর কোন চিহ্নই রহিল না। পাষাণরাশির নিম্নে পড়িয়া আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে অপসৃত হইলাম। তাহার পর বহুকাল যাবৎ আলোক, জগত বা মানব দেখি নাই।

 সময় অতিবাহিত হইতেছিল, কত? তাহা কে নিরূপণ করিবে? এই সুদীর্ঘকালমধ্যে কখনও আলোক দেখিতে পাই নাই, কখনও মানবের মুখ দর্শন করি নাই। মন্দিরের ভগ্নাবশেষ যে পাষাণ স্তূপে পরিণত হইয়াছিল, তাহার উপরিভাগের পাষাণখণ্ডগুলি আমাদিগকে বলিয়া দিত যে যবনগণ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া বর্ব্বরজাতি সমতলভূমি পরিত্যাগ করিয়া পর্ব্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। বাস্তবিক কোশলের সমগ্র সমতলভূমি পুনরায় অরণ্যে পরিণত হইয়াছে, পর্ব্বতবাসী বর্ব্বর জাতি ধীরে ধীরে সভ্যতার সংস্পর্শের অভাবে অসভ্য হইয়া যাইতেছে, পূর্ব্ব সংস্কারের প্রভাব তখনও তাহাদিগের মন হইতে দূরীভূত হয় নাই বলিয়া তখনও তাহারা সময়ে সময়ে সপুত্রকলত্র নিবিড় বন ভেদ করিয়া মন্দিরের ভগ্নাবশেষ অর্চ্চনা করিতে আসিত। কাহার মন্দির, কে উপাস্য দেবতা? তাহা তাহারা বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিল। এই মাত্র তাহাদিগের স্মরণ ছিল যে, অতি প্রাচীনকাল হইতে এই ভগ্ন পাষাণের স্তূপ তাহাদিগের পূর্বপুরুষদিগের উপাসনার স্থান, সেই জন্যই তাহারা শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের অশেষ বিপদজনক পথ অতিক্রম করিয়া জনশূন্য, দেবশূন্য মন্দিরের ভগ্নাবশেষ উপাসনা করিতে আসিত। সময়ে সময়ে তাহাদিগের গ্রামবৃদ্ধগণ সন্ধ্যায় গৃহদ্বারে বসিয়া বালক ও যুবকগণকে মন্দিরের পূর্ব্ব সমৃদ্ধি ও তাহাদিগের অতীত গৌরবের কথা উপাখ্যানের ন্যায় বিবৃত করিতেন; মঠবাসী সন্ন্যাসিগণের আশ্চর্য্য বিদ্যাবত্তা, অপরিসীম করুণা ও অত্যাশ্চর্য্য রাজনীতি-কুশলতার কথা বলিয়া গ্রাম্য যুবকদিগকে আশ্চর্য্যাম্বিত করিয়া দিতেন। আখ্যায়িকা শ্রবণ করিয়া তাহারা যখন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দর্শন করিতে আসিত, তখন বিশাল পাষাণ স্তূপের বিশালতা দেখিয়া তাহার পূর্ব্বগৌরব স্মরণ করিয়া আত্মহারা হইয়া কত কথাই বলিত। এইরূপে যুগের পর যুগ কাটিয়া গেল।

 ক্রমে শুনিলাম অরণ্যান্তর হইতে নূতন বর্ব্বরজাতি আমাদিগের চতুষ্পার্শস্থিত অরণ্যে আসিয়া বাস করিয়াছে। তাহাদিগকে দেখিয়া বোধ হয় না যে তাহারা কখনও সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়াছে। শুনিতাম তাহারা আসিবার পরে পর্ব্বতবাসিগণ আর সদা সর্ব্বদা অরণ্যপথ অতিবাহন করিয়া মন্দিরের ভগ্নাবশেষ অর্চ্চনা করিতে বসিতে সাহসী হইত না। কিন্তু সময়ে সময়ে তাহারা আসিত। তাহাদিগের গ্রামবৃদ্ধগণের মনে তখনও বদ্ধমূল সংস্কার ছিল যে, বিশেষ বিশেষ তিথিতে পাষাণ স্তূপের অর্চ্চনা করা অত্যন্ত আবশ্যক, পূর্ব্বপুরুষগণের আখ্যায়িকা শ্রবণে তাহারা জানিয়া রাখিয়াছিল যে, এই সকল তিথিতে মঠবাসিগণ সমারোহে মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার অর্চ্চনা করিতেন। এই সকল তিথিতে পর্ব্বতবাসী প্রাচীন বর্ব্বরজাতি সশস্ত্র হইয়া মন্দিরের ভগ্ন স্তূপ অর্চ্চনা করিতে আসিত। নূতন বর্ব্বরজাতি বনমধ্যে বৃক্ষকাণ্ডের অন্তরালে আত্মগোপন করিয়া তাহাদিগের পূজার্চ্চনার বিধি লক্ষ্য করিয়া দেখিত। কিছুকাল দেখিতে দেখিতে তাহাদিগের মনেও বদ্ধমূল সংস্কার হইয়া গেল যে, এই পাষাণ স্তূপে নিশ্চয়ই কিছু বিশেষত্ব আছে, ইহার কোন স্থানে কোনও নিভৃত কোণে নিশ্চয়ই শিষ্ট বা দুষ্ট দেবত লুক্কায়িত আছে। এই বন নিশ্চয়ই সেই দেবতার রাজ্য, নতুবা সূদুর বনপ্রান্তে অবস্থিত পর্ব্বতমালার অধিবাসিগণ কি কারণে এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যপথ অতিবাহিত করিয়া এই ভগ্ন পাষাণখণ্ডসমূহের অর্চ্চনা করিতে আসিয়া থাকে?

 শিশু যেমন অন্ধকার দেখিয়া ভীত হয়, বিজনে অজ্ঞাতপথ অবলম্বন করিতে মানব হৃদয় যেমন কম্পিত হয়, শিশুবৎ আটবিক জাতিও সেইরূপ ভয়ে অভিভূত হইল। তাহাদিগের গ্রামবৃদ্ধগণ এই অজ্ঞাতপূর্ব্ব বনদেবতার সন্তোষ সাধনে সচেষ্ট হইল। আমরা আশ্চর্য্য হইয়া শুনিতাম সহস্র সহস্র বর্ষ পূর্ব্বে প্রাচীন মানবজাতি উপাসনার জন্য যে স্থান নির্দ্দেশ করিয়াছিল, অমূলক ভয়ের বশবর্ত্তী হইয়া যুগের পর যুগ মানবজাতি শ্রদ্ধায় বা ভয়ে সেই স্থানে নতশির হইতেছে। ধীরে ধীরে ভগ্ন পাষাণের স্তূপ নবাগত জাতির উপাসনার কেন্দ্র হইয়া উঠিল। মন্দিরের ভগ্নাবশেষের এক পার্শ্বে পর্ব্বতবাসিগণ চন্দন লেপন করিয়া আমার উদ্দেশে পত্র, পুষ্প, ফল নিবেদন করিত, তাহার অপর পার্শ্বে নূতন আটবিক জাতি তাহাদিগের সুচিরাগত প্রথানুসারে শূকর, কুক্কুট বলি দিয়া মদ্য মাংসের উপহার সমেত আমাদিগের অর্চ্চনা করিত। এই দীর্ঘকালে মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উপরে অনেকগুলি দীর্ঘাকার বৃক্ষ জন্মিয়াছিল, তাহারাও উপাসনার অংশ লাভ করিত। নবাগত বর্ব্বরজাতি ক্রমশঃ সভ্য হইয়া উঠিতেছিল। প্রথমে তাহারা বন্য পশু হনন করিয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিত, তাহাদিগের মাংসে অন্ন সংস্থান ও চর্ম্মে আচ্ছাদন হইত। ক্রমে পর্ব্বতবাসী বর্ব্বরগণের রীতি নীতি অনুসরণ করিয়া তাহারা হলকর্ষণ করিতে শিক্ষা করিল, ক্রমে বন পরিষ্কৃত হইতে আরম্ভ হইল।

 একদিন আমাদিগের উপরিস্থিত পাষাণখণ্ডগুলি কহিল যে অরণ্যবাসী বর্ব্বরগণের উপাসনা দেখিতে একজন নূতন মানব আসিয়াছে, তাহার বর্ণ শ্বেত, পরিচ্ছদ বিদেশীয় ও অজ্ঞাতপূর্ব্ব। সে ব্যক্তি দূরে দাঁড়াইয়া বর্ব্বরজাতির উপাসনা দেখিয়া চলিয়া গেল। আমাদিগের নিকটে আসিল না বা আমাদিগকে স্পর্শ করিল না। শ্বেতকায় মানরের কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে বড় কৌতূহল হইল। যে সমস্ত পাষাণখণ্ড মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরিভাগে পতিত ছিল তাহারা নবীন স্তূপের পাষাণের ন্যায় প্রবীণ নহে। আমরা মানরজাতির অভ্যুদয়ের প্রারম্ভে বহু শ্বেতকায় মানব দেখিয়াছি, কিন্তু তাহারা যখন পর্ব্বতের সানুদেশ হইতে আনীত হইয়াছে, তখন শ্বেত কৃষ্ণের সংমিশ্রণে নূতন বর্ণের উৎপত্তি হইয়াছে।

 একদিন দ্বিপ্রহরে আমাদিগের উপরিস্থিত পাষাণগুলি হঠাৎ বলিয়া উঠিল যে পূর্ব্ব বর্ণিত শ্বেতাঙ্গের ন্যায় আরও কতকগুলি শ্বেতাঙ্গ মনুষ্য আমাদিগের দিকে আসিতেছে। তখন স্তূপ সান্নিধ্যে হেমন্তের উজ্জ্বল রবিকরস্নাতঃ মধ্যাহ্নে বর্ব্বর বালক-বালিকাগুলি মন্দিরের ভগ্নাবশেষের চারি পার্শ্বে ক্রীড়া করিতেছিল, তাহার শ্বেতাঙ্গ মনুষ্য দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিল। শুনিলাম শ্বেতাঙ্গগণ ভগ্নাবশিষ্টের উপরে উঠিয়া সযত্নে পাষানখণ্ডগুলি পরীক্ষা করিল। তখন ভগ্ন স্তূপের উপরে ভিন্ন ভিন্ন যুগে আনীত বিবিধ বর্ণের পাষাণ পতিত ছিল, তাহারা সযত্নে সেইগুলি পরীক্ষা করিতেছিল। তাহাদিগের করস্পর্শে বোধ হইতেছিল যে বহু প্রাচীন পাষাণ স্পর্শ করিয়া তাহাদিগের হস্তগুলির এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে তাহারা স্পর্শমাত্রে বিভিন্নতা অনুভব করিতে পারে। বহুক্ষণ ধরিয়া আমাদিগকে পরীক্ষা করিয়া শ্বেতাঙ্গগণ সূর্য্যাস্তের পূর্ব্বে স্তূপসন্নিধি পরিত্যাগ করিল।

 পরদিন সূর্য্যোদয় হইবার পূর্ব্বে খনিত্র ও রজ্জু হস্তে দলে দলে বর্ব্বর নর-নারী আসিয়া আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া ফেলিল। শ্বেতাঙ্গগণের মধ্যে একজন তাহাদিগের সহিত আসিয়াছিল; সে ব্যক্তি বৃদ্ধ, বিরলকেশ কিন্তু তাহার শ্মশ্রু ছিল। বর্ব্বরগণ শ্বেতাঙ্গের নির্দেশ অনুসারে খনন করিতে আরম্ভ করিল, যে প্রস্তরে সিন্দূর লেপন করিয়া তাহারা দেবত্ব আরোপণ করিয়াছিল তাহা ব্যতীত অপর প্রস্তরগুলি রজ্জু ও লৌহদণ্ডের সাহাষ্যে স্থানান্তরে লইয়া যাইতে আরম্ভ করিল। এই কার্য্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল।

 ক্রমে যে সমস্ত পাষাণখণ্ড যোজনা করিয়া শৈব সন্ন্যাসীর মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা স্থানান্তরিত হইল। একদিন মধ্যাহ্নে শত শত বৎসর পরে তীব্র সূর্য্যালোক আসিয়া আমাকে অন্ধ করিয়া ফেলিল, আমি পুনরায় প্রকাশিত হইলাম। যতদিন দেবাদিদেব মহাদেবরূপে সন্ন্যাসিগণ কর্ত্তৃক পূজিত হইতাম ততদিন দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও উদকে স্নান করিয়া আমার অঙ্গ মসৃণ হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু মন্দিরের পতনকালে অগ্নির উত্তাপে এবং পতনশীল পাষাণখণ্ডসমূহের আঘাতে আমার অঙ্গ খণ্ড বিখণ্ড হইয়া গিয়াছিল। যখন জগতে পুনঃ প্রকাশিত হইলাম, তখন আর দেবাদিদেব বলিয়া কেহ আমাকে সম্বোধন করিল না, কিন্তু যে বিরলকেশ শ্বেতাঙ্গ বর্ব্বরগণের কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিল, সে ব্যক্তি দর্শন ও স্পর্শমাত্রে আমার প্রাচীনতা অনুভব করিতে পারিয়াছিল। আমাকে দেখিয়া তাহার অজ্ঞাতসারে তাহার মুখ হইতে হর্ষব্যঞ্জক অস্ফুট ধ্বনি নির্গত হইয়াছিল। মাতা যেমন অতি সাবধানে শিশু সন্তানকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইয়া থাকে, শ্বেতাঙ্গের তত্ত্বাবধানে তেমনই সাবধানে বর্ব্বরগণ আমার সহস্র সহস্র বর্ষের বাসস্থান হইতে আমাকে উত্তোলন করিয়া স্থানান্তরে লইয়া গেল। বিরলকেশ শ্বেতাঙ্গ বহুক্ষণ ধরিয়া আমাকে পরীক্ষা করিল, আমাকে দর্শন করিয়া হর্ষে তাহার মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল।

 তখন খনিত্র হস্তে বর্ব্বরগণ খনন করিতে আরম্ভ করিল, ধীরে ধীরে সযত্নে ভূগর্ভে সজ্জিত প্রস্তরগুলি দিবালোকে প্রকাশ করিতে লাগিল, আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া বিরলকেশ শ্বেতাঙ্গ তাহাদিগের কার্য্য নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, তাহার জীবনে এমন সৌভাগ্য বোধ হয় আর কখনও হয় নাই। ধীরে ধীরে পরিক্রমণের পথ, বেষ্টনীর ধ্বংসাবশেষ, যশোধর্ম্মের যুগ, কনিষ্কের যুগ, ধনভূতির যুগ ভূগর্ভ হইতে নির্গত হইয়া পুনরায় সূর্য্যালোক দর্শন করিল। শ্বেতাঙ্গের নির্দ্দেশানুসারে বর্ব্বরগণ প্রাচীন পাষাণখণ্ডগুলি উত্তোলন করিয়া আমার পার্শ্বে আনয়ন করিল। তাহার পরে আমাদিগের অঙ্গে সযত্নে কার্পাস ও বস্ত্রের আচ্ছাদন দিয়া আমাদিগকে কাষ্ঠাধারে আবদ্ধ করিল।

 মনে হইল যেন কোথায় চলিতেছি, তাহারা আমাদিগকে গোযানের সাহায্যে কোথায় লইয়া যাইতেছিল। একস্থানে আমাদিগকে গোযান হইতে উত্তোলন করিয়া যানান্তরে স্থাপন করিল। দ্বিতীয় যান অত্যন্ত দ্রুতগামী, সেরূপ দ্রুতগামী বাহন আমি কখনও দেখি নাই, বায়ুর বেগ অনুভব করিয়া বুঝিতেছিলাম যে অত্যন্ত দ্রুতবেগে পথ অতিবাহিত হইতেছে। কয়েক দিবস পরে যাহারা আমাদিগকে লইয়া যাইতেছিল, তাহারা পুনরায় আমাদিগকে যানান্তরে স্থাপন করিল, অনুভবে বুঝিলাম পুনরায় গোযানে আরোহণ করিয়াছি। সেই দিনই পুনরায় দিবালোক দর্শন করিলাম, শত শত লোক আমাদিগকে দর্শন করিতে আসিল, তদবধি এই স্থানেই অবস্থান করিতেছি।