পাহাড়ে মেয়ে/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


পাপের প্রথম সোপান।

 “একদিবস দুইদিবস করিয়া দেখিতে দেখিতে ক্রমে দুই মাস অতীত হইয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার সময় আমি তার বাড়ীতে বসিয়া তাহার সহিত নানা প্রকার হাসি-ঠাট্টা করিতেছি, এমন সময় সেই মায়াবিনী তাহার ভয়ানক মায়া প্রকাশ করিয়া আমাকে অভিভূত করিল। সে কথায় কথায় আমার মনকে এরূপ বিমোহিত করিয়া তুলিল যে, সেই সময় আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম, ভালমন্দ বুঝিতে একবারে অসমর্থ হইয়া পড়িলাম। সেও আমার মনের বিকৃতি ভাব বুঝিতে পারিয়া, সময় বুঝিয়া একটী লজ্জাকর প্রস্তাবের অবতারণা করিল। বুঝিলাম, তাহার প্রস্তাবিত বিষয় আমার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত; তথাপি, আমার আন্তরিক পূর্ণ-অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহার খাতিরে সেই ঘৃণিত প্রস্তাবে কতক সম্মত হইলাম, সম্পূর্ণরূপে তাহা অনুমোদন করিতে পারলাম না। মনে ভয়, একবারে অসম্মত হইলে পাছে তারাদিদি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়, এবং আমাদিগের সংসারের খরচপত্র একবারে বন্ধ করিয়া দেয়। দ্বিতীয় দিবস তারাদিদি পুনরায় সেই প্রস্তাবের অবতারণা করিল। সেই দিবস আমার মনের ভাব আরও নরম হইয়া আসিল; কিন্তু একবারে সম্মত হইতে পারিলাম না।

 “ক্রমে যত দিন গত হইতে লাগিল, তারাদিদিও আমার মনের গতি ক্রমে তত পরিবর্ত্তিত করিয়া আসিতে লাগিল। এইরূপে সপ্তাহকাল অতীত হইতে না হইতেই তারাদিদি আমার মনকে সম্পূর্ণরূপে তাহার আয়ত্বে আনিতে সমর্থ হইল। সপ্তম দিবসে তাহারই উত্তেজনায় আমি আমার মনকে কলুষিত করিলাম, পবিত্র হৃদয়কে অপবিত্র করিলাম, ক্ষণিক সুখে প্রবৃত্ত হইয়া চিরজীবনের নিমিত্ত নিত্যসুখে জলাঞ্জলি দিলাম! হায়! সেই আমার মহাপাতকের প্রথম সোপানে উত্থিত হইবার প্রথম দিন। এখন সেই দিন মনে করিলে, আমার হৃদয়ে ভয়ানক আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হয়, বিষম অনুতাপ আসিয়া মনকে ভয়ানক যন্ত্রণা দেয়! সেই সময় তাবাদিদির প্রলোভনময় বাক্যস্রোতে ভাসিয়া না গিয়া, যদি আমি আমার হৃদয়ের গতি রুদ্ধ করিতে পারিতাম, সর্ব্বনাশী কুহকিনীর প্রলোভনে না ভুলিতাম, তাহা হইলে কি আজ আমার এই দশা হইত! হতভাগিনী আমি, তাই আমি তখন বুঝিয়াও বুঝি নাই, সর্বনাশী আমাদিগের নিমিত্ত কেন এত অর্থ জলের ন্যায় ব্যয় করিতেছে, আর কোথা হইতেই বা সেই অর্থরাশি প্রাপ্ত হইতেছে!

 “এই সময় আমি আমার জীবনের এক অধ্যায় শেষ করিয়া অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ করিলাম। হৃদয়ের সমস্ত দুঃখ ও ভাবনা দূর করিয়া ‘মহামুখে’ নিবিষ্ট হইলাম। যাহাকে এখন আমি মহাদুঃখ বলিয়া জানিতে পারিতেছি, তখন তাহাকেই মহাসুখ জ্ঞান করিয়াছিলাম। যাহাকে ভয়ানক বিষ বলিয়া এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি, তখন তাহাকেই অমৃত বলিয়া মহাসুখে পান করিয়াছিলাম। যে সর্ব্বনাশী রাক্ষসীর কথায় আমার ইহকাল গিয়াছে, পরকাল নষ্ট হইয়াছে, যে মহাপাপের কথা কর্ণে প্রবেশ করিলে কঠোর প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয়, সে কথা, সেই রাক্ষসীর মায়ায় সে সময় জানিতে পারি নাই। সেই হতভাগিনীর কথাকেই আমি প্রথমে বেদবাক্য সদৃশ জ্ঞান করিয়াছিলাম বলিয়াই, এখন আমার এই ভয়ানক দশা উপস্থিত হইয়াছে! ইহার পরে আরও যে কি হইবে, তাহা ভাবিতও পারিতেছি না!

 “জীবনের অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ করিবামাত্রই আমার মনের গতি পৃথক হইয়া গেল। তারাদিদিকে যেরূপ ভালবাসিতাম, তখন ‘আর একজনকে’ তারা অপেক্ষা আরও ভালবাসিতে লাগিলাম। তাবাদিদিকে কিয়ৎক্ষণ না দেখিতে পাইলে, মনের মধ্যে যেরূপ কষ্ট হইত, তখন আবার সেই ‘আর একজনকে’ না দেখিতে পাইলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু সর্ব্বদা মনে ভয়, অমাদিগের লুক্কায়িত কাণ্ড সকল পাছে কেহ দেখিতে পায়, বা পাছে কেহ জানিতে পারে, অথবা আমার চরিত্রের উপর পাছে কেহ সন্দেহ করে। কিন্তু তারাদিদির এমনই কৌশল, এমনই নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবনের ক্ষমতা যে, প্রায় এক বৎসরকাল আমি সেই ‘আর একজনের’ সহিত আমোদ আহ্লাদে বিভোর হইয়া দিনরাত্রি মহাসুখে অতিবাহিত করিতে লাগিলাম, তথাপি কেহই তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না। এমন কি, আমার পিতামাতা পর্য্যন্তও ঘূণাক্ষরে তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু আমার এমনই অদৃষ্ট যে, এইরূপে একবৎসর অতিবাহিত হইতে না হইতেই আমার সেই প্রাণের দিদির মৃত্যু হইল, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার অদৃষ্টও ভাঙ্গিয়া গেল। তারাদিদির যাহা কিছু ছিল, মৃত্যুকালে সে আমার পিতামাতাকেই তাহা দিয়া গেল।

 “তারাদিদির মৃত্যুর আট দশদিবস পর হইতেই আমার এত দিবসের সকল গুপ্তকথা ব্যক্ত হইতে আরম্ভ হইল। এক কান, দুই কান করিয়া আমার পাপের কথা সকলের কানে কানে ফিরিতে লাগিল; ক্রমে উহা আমার পিতামাতার কানে পর্য্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হইল। কেবল যে পরের মুখে তাঁহারা আমার চরিত্রের কথা শুনিলেন তাহা নহে। একদিবস সন্ধ্যার পর তারাদিদির খালি বাড়ীতে আমি আমার সেই ‘আর একজনের’ সহিত অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপে উন্মত্তা আছি, এমন সময়ে আমার মাতা কিরূপে তাহা জানিতে পারেন, এবং পরিশেষে আমার পিতাকে ডাকাইয়া তিনি আমার সেই অদ্ভুত ক্রিয়া-কলাপ তাঁহাকে দেখাইয়া দেন। তিনি পূর্ব্বে লোক-পরম্পরায় যাহা শুনিয়া সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পরিতেছিলেন না, আজ তিনি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়া একেবারে মর্ম্মাহত হইলেন, এবং আমাকে সেই ‘আর একজনের’ সহিত হত্যা করিয়া এই ভয়ানক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবেন, ইহাই মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন। কিন্তু স্ত্রীহত্যা মহাপাপ, এই কথা তাঁহার মনে উদিত হওয়ায়, সহসা সেই কার্য্য তিনি হস্তক্ষেপ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এদিকে ক্রমে অপত্য-স্নেহ আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিতে লাগিল।

 “এই ঘটনার দুই চারিদিবস পরেই আমি জানতে পারিলাম যে, আমার পিতামাতা আমার সমস্ত ব্যাপার স্বচক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন। আরও বুঝিতে পারিলাম, আমার পিতার উদ্দেশ্য ভাল নহে; সুযোগ পাইলে, তিনি আমাদিগের উভয়ের প্রাণ নষ্ট করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। তখন মনে বড় ভয় হইল, প্রাণে মায়া জন্মিল, অথচ সুখের চরমসীমা দেখিতে ইচ্ছা হইল। তখন মনে মনে আর কোন উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, সময়মত সকল কথা ‘তাহাকে’ কহিলাম। তখন ‘তিনিও’ তাঁহার দুষ্কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহার পিতা মাতা, ভ্রাতা ভগিনী ও আত্মীয়-স্বজনের জ্বালায় জ্বালাতন, প্রতিবেশীদিগের কঠোর অত্যাচারে প্রপীড়িত; সুতরাং ‘তিনিও’ অপর আর কোন উপায় স্থির করিয়া উঠিতে পারলেন না। অগত্যা উভয়ে পরামর্শ করিয়া যাহা কিছু সংগ্রহ করিতে পারিলাম, তাহা লইয়া, পিতা, মাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, একদিবস রজনীতে উভয়েই গ্রাম হইতে বহির্গত হইলাম, ও ক্রমাগত সমস্ত রাত্রি চলিয়া অতি প্রত্যুষে একটী রেলওয়ে ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইলাম।

 “হায়! আমি প্রথমে বুঝিতে পারিয়াছিলাম না বলিয়াই, আমি আমার অমূল্য সতীত্বরত্ন হারাইয়াছিলাম! এবং পরিশেষেও বুঝিতে না পারিয়া, সামান্য প্রাণের মায়ায় মুগ্ধ হইয়া অকিঞ্চিৎকর সুখে মন মজাইয়া আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশ পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। আমার দেশ পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই যদি আমার পাপের উপযুক্ত দণ্ড গ্রহণ করিতাম, পিতামাতা বা গ্রামের অপর কাহারও হস্তে যদি আমার প্রাণ বিসর্জ্জিত হইত, তাহা হইলে আজ আমি মহাসুখে আমার আত্মাকে সুখী করিতে পারিতাম। কখন না কখন আমার সেই প্রথম অবস্থার পাপ হইতে পরমেশ্বর আমার আত্মাকে মুক্তি প্রদান করিতেন; কিন্তু এখন আর আমার সে আশা নাই। আমার ভয়ানক ভয়ানক রাশি রাশি পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোন জগতেই হইবে না!”