পাহাড়ে মেয়ে/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
ক্ষণিক চিন্তা।
“যে দিবস অতি প্রত্যুষে আমরা রেলওয়ে ষ্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেইদিবস দিবা দশটার সময় আমরা রেলযোগে হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইলাম। সেই স্থান হইতে একখানি ঘোড়ার গাড়ী করিয়া আমরা কলিকাতার ভিতর আগমন করিলাম। যে স্থানে আসিয়া আমাদিগের গাড়ী থামিল, সেই স্থানের নাম সেই সময় আমি জানিতাম না; কিন্তু পরে জানিয়াছিলাম, উহাকে সোণাগাছি বা সোণাগাজি কহে। আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া ইষ্টক-নির্ম্মিত একটী দ্বিতল বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। উহার ভিতর গমন করিয়া যাহা দেখিলাম, তাহা পূর্ব্বে আমি আর কখনও দেখি নাই, বা কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই।
“দেখিলাম, সেই বাড়ীর ভিতর উপরে ও নিম্নে ছোট বড় সতের আঠারখানি ঘর আছে। একখানি ঘর ব্যতীত সমস্ত ঘরগুলিই মনুষ্যের দ্বারা অধিকৃত। আমাদিগের দেশে যেরূপ নিয়মের বশীভূত হইয়া সকলে বসবাস করিয়া থাকেন, এ বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, এখানে সে নিয়ম পালিত হয় না। বাটীর সেই সমস্ত ঘর যে পুরুষমানুষের দ্বারা অধিকৃত, বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া তাহা কোনমতেই বোধ হইল না। বোধ হইল, প্রত্যেক ঘরই একটী একটী স্ত্রীলোকের আয়ত্বাধীন, এবং সেই সকল স্ত্রীলোক প্রত্যেকেই যেন স্বাধীনা, কেহ কাহারও কথার বশবর্ত্তিনী নহে। তাহাদিগের মধ্যে ছোট বড় বুঝিবার উপায় নাই। কারণ, কেহ কাহাকেও সম্মান করে না, এবং কেহই একান্নবর্ত্তিনী নহে। অধিবাসী পুরুষের মধ্যে কেবল তথাকার অধিকাংশ স্ত্রীলোকেরই একটী একটী পশ্চিমদেশীয় বেহারা বা চাকর দেখিতে পাইলাম।
“এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া আমি তত অসন্তুষ্ট হইলাম না, বরং কিয়ৎপরিমাণে আহ্লাদিতই হইলাম কারণ, তারাদিদির মৃত্যুর পর হইতেই আমি সর্ব্বদা একাকিনী থাকিতেই ভালবাসিতাম। নির্জ্জনে কেবল ‘তাহার’ সহিত আমোদ-প্রমোদ করা ব্যতীত পৃথিবীতে আমার অপর যে আর কোন সুখ আছে, তাহা আমার মনেই স্থান পাইত না।
“যে একখানি খালি ঘরের কথা আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি, সেই ঘরের মধ্যেই আমার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল। তিনি আমাকে সেই ঘরের ভিতর বাখিয়া আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিবার নিমিত্ত বাজারে গমন করিলেন। যাইবার সময় একটী বয়স্থা স্ত্রীলোককে আমার নিকট দিয়া গেলেন। তিনি আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিলেন, এবং আমার সহিত নানা প্রকার গল্প করিতে আরম্ভ করিলেন। ইহার বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরের অধিক হইবে, কিন্তু হঠাৎ দেখিলে চল্লিশ বৎসরের কম বলিয়াই অনুমান হয়। ইহার বর্ণ গৌর, কলেবর স্থূল, হস্তে সোণার কয়েকগাছি চুড়ি, পরিধানে একখানি মিহি কাশির পাছাপেড়ে পরিষ্কার সাদা শাটী, নাকের উপর তিলক, হস্তে হরিনামের ঝুলি। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ইনিই সেই বাড়ীর বাড়ীওয়ালী।
“বাড়ীওয়ালী আমার নিকট কিয়ৎক্ষপ উপবেশন করিবার পরই, অন্যান্য ঘর হইতে এক এক করিয়া প্রায় সমস্ত স্ত্রীলোকই আমার নিকট আগমন করিল। উহাদিগের মধ্যে কেহবা গৌরাঙ্গী, কেহ শ্যামাঙ্গী; কিন্তু সকলেই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, দুই একখানি সোণার অলঙ্কার এবং ধপ্ধপে পরিষ্কার বস্ত্র সকলেই পরিধান করিয়াছিল। আমি উহাদিগের চালচলন, বেশভুষা, অঙ্গভঙ্গি প্রভৃতি দেখিয়া বিবেচনা করিলাম যে, ইহারাই সর্ব্বপ্রকার দুঃখ ও কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাইয়া পরমসুখে এই স্থানে বাস করিতেছে।
“আমি কিরূপ দুঃখ ও কষ্টে পিতামাতার গৃহে বিধবা অবস্থায় বাস করিতেছিলাম, তাহার কিছু কিছু বিবরণ উহারা আমার নিকট শ্রবণ করিয়া কতই দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল, এবং এখন আমি যাহাতে তাহাদিগের মত স্বাধীন হইয়া তাহাদিগের ন্যায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনের অবশিষ্টকাল অতিবাহিত করিতে পারি, তদ্বিষয়ক কতপ্রকার যুক্তিপূর্ণ উপদেশ প্রদান করিতে লাগিল।
“দেখিতে দেখিতে দিবা চারিটা বাজিয়া গেল, সেই সময় ‘তিনি’ বাজার হইতে ফিরিয়া আসিলেন। বাজার হইতে তিনি যে সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আপনার সঙ্গে করিয়া আনিলেন, তাহা দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। এক কথায়, আমার নূতন ঘর, তিনি অন্যান্য সকলের ঘরের ন্যায় দ্রব্যাদিতে সজ্জিত করিয়া দিলেন। পালঙ্ক, বিছানা, বালিস, আলমারি, বাক্স, ছবি, কাঁচের বাসন, পিত্তলের বাসন, প্রভৃতি আসবাবে গৃহ পূর্ণ হইয়া গেল। আমার আর কোন দ্রব্যেরই অভাব রহিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিচর্য্যার নিমিত্ত একজন ‘কাহার’ চাকরও নিযুক্ত হইল।
“আমি আমার পিতামাতার বাড়ীতে যেরূপ দরিদ্রেরমত থাকিতাম, যেরূপ কষ্টে দিন অতিবাহিত করিতাম, তাহার তুলনায় আজ আমি রাজরাণীর অবস্থায় প্রবেশ লাভ করিলাম। মনে আর সুখ ধরে না, হৃদয় যেন আহ্লাদে আটখানা হইতে লাগিল। কিন্তু সময় সময় আমার পিতামাতার দুঃখের অবস্থার সহিত আমার অবস্থার তুলনা করিয়া মনে কষ্ট পাইতাম; সেরূপ কষ্ট অতি অল্প সময়ের নিমিত্ত হইত।
“সন্ধ্যা হইতে হইতেই সেই বাড়ীর অবস্থার পরিবর্ত্তন হইতে আরম্ভ হইল। বাড়ীর সকলেই মনোহারিণী বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া যেন নূতন রূপ ধারণ করিতে লাগিল। যিনি কৃষ্ণাঙ্গী, তিনি আর এখন কৃষ্ণাঙ্গী রহিলেন না, আপাদমস্তক পাউডার মাখিয়া তিনিও এখন গৌরাঙ্গী হইয়া দাঁড়াইলেন। অলঙ্কারে সকলেই ভূষিত হইলেন; যাহাদের সুবর্ণময় অলঙ্কার নাই, তাহারাও পিত্তলের অলঙ্কারাদি দিয়া সেই স্থান পূর্ণ করিয়া দিলেন। সেই সকল অলঙ্কার এরূপ যত্নের সহিত ব্যবহৃত হইয়া থাকে যে, যাহারা না জানেন, তাহারা উহা দেখিয়া হঠাৎ বলিতে সাহসী হয়েন না যে, উহা সুবর্ণ-নির্ম্মিত অলঙ্কার নহে। এইরূপে সুসজ্জিত হইয়া কেহবা উপরের বারান্দায়, কেহবা আপনার ঘরে ও কেহবা নীচের ঘরের জানালা খুলিয়া তাহার নিকট উপবেশন করিল। দিবাভাগে যে স্থান কেবলমাত্র স্ত্রীলোকের পুরী বলিয়া অনুমান হইতেছিল,
এখন হইতে সেইস্থানে পুরুষের আগমন আরম্ভ হইতে লাগিল। কেহ পরিচিতের ন্যায়, কেহ অপরিচিতের ন্যায়, কেহ প্রকাশ্যে, কেহ অপ্রকাশ্যে, কেহ একাকী, কেহ বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ ও বাটী হইতে বহির্গত হইতে লাগিল। কোন ঘরে গীতবাদ্য, কোন ঘরে নৃত্যগীত, কোন ঘরে হাসিঠাট্টা ও কোন ঘরে মদ্যপানাদি চলিতে লাগিল। সকলেই যেন আমোদে বিভোর, আহ্লাদে গদ গদ; দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, সকলেই যেন অপার সুখে সুখী। এইরূপে সমস্তরাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল।“প্রথম রাত্রিতে আমার এই সকল কিছুই ভাল লাগিল না; সমস্ত রাত্রির মধ্যে আমি আমার ঘরের বাহির হইলাম না। রাত্রিদিবসের পরিশ্রম হেতু আমরা উভয়েই অতিশয় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। সুতরাং স্থিরভাবে শয়ন করিয়া রহিলাম; কিন্তু ভালরূপে নিদ্রা হইল না, নানা প্রকার চিন্তা আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া আমার নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। কখন আমার বৃদ্ধ পিতামাতার নিমিত্ত মন কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল, তাঁহাদিগের যত্ন ও ভালবাসার কথা মনে উদিত হওয়ায়, চক্ষু দিয়া জলধারা বহিতে লাগিল। আবার পরক্ষণেই সে জলধারা মিলাইয়া গেল, আমার উপর তাঁহাদিগের কঠোর ব্যবহারের কথা মনে আসিল, আমাকে তাঁহারা হত্যা করিতে চাহিয়াছিলেন বলিয়া, তাঁহাদিগের উপর আমার রাগ হইতে লাগিল।
“কখনও ভাবিতে লাগিলাম, ‘ইনি, ত এখন আমাকে ঘরের বাহির করিলেন, আমাকে যথেষ্ট দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করিয়া দিলেন; কিন্তু আমার উপর ইহার এখন যেরূপ ভালবাসা আছে, তাহা কি চিরস্থায়ী হইবে? যদি ইনি আমাকে কখনও পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে এই অপরিচিত স্থানে আমার কি দশা হইবে? তখন আমি কোথায় যাইব, এবং কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিব? ঈশ্বর না করুন, যদি আমি কখনও কোন রোগগ্রস্ত হই, তাহা হইলেই বা আমার দশা কি হইবে? পিতামাতা ত আর আমাকে গ্রহণ করিতে পারিবেন না; হিন্দু-সমাজ ইহাতে কখনই সম্মতি প্রদান করিবেন না। আর যদি তাহারা লোকাপবাদ সহ্য করিয়া, সমাজের দিকে দৃষ্টি না রাখিয়া, বা আমার জীবনের উপর হস্তক্ষেপ না করিয়াও আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত হন, তাহা হইলেই বা আমি সেই স্থানে ফিরিয়া যাইব কোন মুখে? প্রতিবেশীর গঞ্জনা, পাড়ার মেয়েদের কানাঘুষা, শত্রুপক্ষের বিদ্রুপবর্ষী আমোদ-আহ্লাদ আমি ত কখনই সহ্য করিতে পারিব না। স্নানের ঘাটে, বসিবার বৈঠকখানায়, পূজার মন্দিরে, চলিবার পথে, বিবাহের বাসরে, সভায়, মজলিসে, সকল স্থানেই আমার চরিত্রের কথা কাণে কাণে, মুখে মুখে ফিরিবে। কেহ কেহবা আমাকে শুনাইয়া শুনাইয়া বলিবে, দেখাইয়া দেখাইয়া হাসিবে; কিন্তু ইহা ত আমি কোন প্রকারেই সহ্য করতে পারিব না। আমার অদৃষ্টে যাহাই হউক না কেন, যখন ঘরের বাহির হইয়াছি, তখন আমি এই স্থানেই থাকিব। এ বাড়ীর সকলেই ত সুখে কালযাপন করিতেছে দেখিতেছি, তবে আমিই বা না পারিব কেন? এইরূপে নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল।”