পদধ্বনি

আঁধারে প্রচ্ছন্ন ঘন বনে
আশঙ্কার পরশনে
হরিণের থরথর হৃৎপিণ্ড যেমন—
সেই-মতো রাত্রি দ্বিপ্রহরে
শয্যা মোর ক্ষণতরে
সহসা কাঁপিল অকারণ।
পদধ্বনি, কার পদধ্বনি
শুনিনু তখনি?
মোর জন্ম-নক্ষত্রের অদৃশ্য জগতে
মোর ভাগ্য মোর তরে বার্ত্তা ল’য়ে ফিরিছে কি পথে?

পদধ্বনি, কার পদধ্বনি?
অজানার যাত্রী কে গো? ভয়ে কেঁপে উঠিল ধরণী।

এই কি নির্ম্মম সেই যে আপন চরণের তলে
পদে পদে চির দিন
উদাসীন
পিছনের পথ মুছে চলে?
এ কি সেই নিত্য শিশু, কিছু নাহি চাহে,—
নিজের খেলেনা-চূর্ণ
ভাসাইছে অসম্পূর্ণ
খেলার প্রবাহে?
ভাঙিয়া স্বপ্নের ঘোর,
ছিঁড়ি’ মোর
শয্যার বন্ধন মোহ, এ রাত্রি বেলায়
মোরে কি করিবে সঙ্গী প্রলয়ের ভাসান্-খেলায়?
হোক তাই
ভয় নাই, ভয় নাই,
এ খেলা খেলেছি বারম্বার
জীবনে আমার।
জানি, জানি, ভাঙিয়া নূতন করে তোলা;
ভুলায়ে পূর্ব্বের পথ অপূর্ব্বের পথে দ্বার খোলা;
বাঁধন গিয়েছে যবে চুকে
তা’রি ছিন্ন রসিগুলি কুড়ায়ে কৌতুকে

বার বার গাঁথা হ’লো দোলা।
নিয়ে যত মুহূর্ত্তের ভোলা
চির-স্মরণের ধন
গোপনে হ’য়েছে আয়োজন।
পদধ্বনি, কার পদধ্বনি
চিরদিন শুনেছি এমনি
বারেবারে?
একি বাজে মৃত্যু-সিন্ধু-পারে?
একি মোর আপন বক্ষেতে?
ডাকে মোরে ক্ষণে ক্ষণে কিসের সঙ্কেতে?
তবে কি হবেই যেতে?
সব বন্ধ করিব ছেদন?
ওগো কোন্ বন্ধু তুমি, কোন্ সঙ্গী দিতেছে বেদন
বিচ্ছেদের তীর হ’তে?
তরী কি ভাসাবো স্রোতে?
হে বিরহী,
আমার অন্তরে দাও কহি’
ডাকো মোরে কি খেলা খেলাতে
আতঙ্কিত নিশীথ বেলাতে?

বারে বারে দিয়েছে নিঃসঙ্গ করি’;
এ শূন্য প্রাণের পাত্র কোন্ সঙ্গসুধা দিয়ে ভরি’
তুলে নেবে মিলন-উৎসবে?
সূর্য্যস্তের পথ দিয়ে যবে
সন্ধ্যাতারা উঠে আসে নক্ষত্র-সভায়,
প্রহর না যেতে যেতে
কি সঙ্কেতে
সব সঙ্গ ফেলে রেখে অস্তপথে ফিরে চ’লে যায়?
সেও কি এমনি
শোনে পদধ্বনি?
তা’রে কি বিরহী
বলে কিছু দিগন্তের অন্তরালে রহি?
পদধ্বনি, কার পদধ্বনি?
দিনশেষে
কম্পিত বক্ষের মাঝে এসে
কি শব্দে ডাকিছে কোন্ অজানা রজনী?


আণ্ডেস্ জাহাজ, ২৪ অক্টোবর, ১৯২৪।