পূরবী/পূরবী/বকুল-বনের পাখী

বকুল-বনের পাখী

শোনো শোনো ওগো, বকুল-বনের পাখী,
দেখো তো, আমায় চিনিতে পারিবে না কি?
নই আমি কবি, নই জ্ঞান-অভিমানী,
মান অপমান কি পেয়েছি নাহি জানি,
দেখেছো কি মোর দূরে-যাওয়া মনখানি,
উড়ে-যাওয়া মোর আঁখি?
আমাতে কি কিছু দেখেছো তোমারি সম,
অসীম - নীলিমা - তিয়াষী বন্ধু মম?

শোনো শোনো ওগো, বকুল-বনের পাখী,
কবে দেখেছিলে মনে পড়ে সে কথা কি?
বালক ছিলাম, কিছু নহে তা’র বাড়া,
রবির আলোর কোলেতে ছিলেম ছাড়া,
চাঁপার গন্ধ বাতাসের প্রাণ-কাড়া
যেতে মোরে ডাকি’ ডাকি’।
সহজ রসের ঝর্‌না-ধারার পরে
গান ভাসাতেম সহজ সুখের ভরে।

শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
কাছে এসেছিনু ভুলিতে পারিবে তা কি?
নগ্ন পরাণ ল’য়ে আমি কোন সুখে
সারা আকাশের ছিনু যেন বুকে বুকে,
বেলা চ’লে যেতো অবিরত কৌতুকে
সব কাজে দিয়ে ফাঁকি।
শ্যামলা ধরার নাড়ীতে যে তাল বাজে
নাচিত আমার অধীর মনের মাঝে।


শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
দূরে চ’লে এনু, বাজে তা’র বেদনা কি?
আষাঢ়ের মেঘ রহে না কি মোরে চাহি’?
সেই নদী যায় সেই কলতান গাহি’,—
তাহার মাঝে কি আমার অভাব নাহি?
কিছু কি থাকে না বাকি?
বালক গিয়েছে হারায়ে, সে কথা ল’য়ে
কোনো আঁখিজল যায়নি কোথাও বয়ে?


শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
আর বার তা’রে ফিরিয়া ডাকিবে না কি?

যায়নি সে-দিন যে-দিন আমারে টানে,
ধরার খুসিতে আছে সে সকল খানে;
আজ বেঁধে দাও আমার শেষের গানে
তোমার গানের রাখী।
আবার বারেক ফিরে চিনে লও মোরে,
বিদায়ের আগে লও গো আপন ক’রে।


শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
সে-দিন চিনেছে, আজিও চিনিবে না কি?
পার-ঘাটে যদি যেতে হয় এইবার,
খেয়াল-খেয়ায় পাড়ি দিয়ে হবে পার,
শেষের পেয়ালা ভ’রে দাও, হে আমার
সুরের সুরার সাকী।
আর কিছু নই, তোমারি গানের সাথী,
এই কথা জেনে আসুক ঘুমের রাতি।


শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
মুক্তির টীকা ললাটে দাও তো আঁকি’।
যাবার বেলায় যাবো না ছদ্মবেশে,
খ্যাতির মুকুট খ’সে যাক নিঃশেষে,

কর্ম্মের এই বৰ্ম যাক না ফেঁসে,
কীর্ত্তি যাক না ঢাকি’।
ডেকে লও মোরে নাম-হারাদের দলে
চিহ্ন-বিহীন উধাও পথের তলে।


শোনো শোনো, ওগো বকুল-বনের পাখী,
যাই যবে যেন কিছুই না যাই রাখি’।
ফুলের মতন সাঁঝে পড়ি যেন ঝ’রে,
তারার মতন যাই যেন রাত ভোরে,
হাওয়ার মতন বনের গন্ধ হ’রে
চ’লে যাই গান হাঁকি’।
বেণুপল্লব - মর্ম্মর - রব সনে
মিলাই যেন গো সোনার গোধূলি-খনে॥


(ফাল্গুন, ১৩৩০)