যাত্রা

আশ্বিনের রাত্রিশেষে ঝ’রে-পড়া শিউলি-ফুলের
আগ্রহে আকুল বনতল; তা’রা মরণকূলের
উৎসবে ছুটেছে দলে দলে; শুধু বলে, “চলো চলো!”
অশ্রুবাষ্প-কুহেলিতে দিগন্তের চক্ষু ছলছল,
ধরিত্রীর আর্দ্রবক্ষে তৃণে তৃণে কম্পন সঞ্চারে,
তবু ওই প্রভাতের যাত্রীদল বিদায়ের দ্বারে
হাস্যমুখে ঊৰ্দ্ধপানে চায়, দেখে অরুণ-আলোর
তরণী দিয়েছে খেয়া, হংস-শুভ্র মেঘের ঝালর
দোলে তা’র চন্দ্রাতপতলে।
ওরে, এতক্ষণে বুঝি
তারা-ঝরা নির্ঝরের স্রোতঃপথে পথ খুঁজি’ খুঁজি’
গেছে সাত ভাই চম্পা; কেতকীর রেণুতে রেণুতে
ছেয়েছে যাত্রার পথ; দিগ্বধূর বেণুতে বেণুতে
বেজেছে ছুটির গান; ভাঁটার নদীর ঢেউগুলি
মুক্তির কল্লোলে মাতে, নৃত্যবেগে ঊর্দ্ধে বাহু তুলি’
উচ্ছলিয়া বলে, “চলো, চলো।” বাউল উত্তরে-হাওয়া

ধেয়েছে দক্ষিণ মুখে, মরণের রুদ্রনেশা-পাওয়া;
বাজায় অশান্ত ছন্দে তাল-পল্লবের করতাল,
ফুকারে বৈরাগ্যমন্ত্র; স্পর্শে তা’র হ’য়েছে মাতাল
প্রান্তরের প্রান্তে প্রান্তে কাশের মঞ্জরী, কাঁপে তা’রা
ভয়কুণ্ঠ উৎকণ্ঠিত সুখে,—বলে, বৃন্ত-বন্ধহারা
যাবো উদ্দামের পথে, যাবো আনন্দিত সর্ব্বনাশে,
রিক্তবৃষ্টি মেঘ সাথে, সৃষ্টিছাড়া ঝড়ের বাতাসে,
যাবো, যেথা শঙ্করের টলমল চরণ-পাতনে
জাহ্নবীতরঙ্গমন্দ্র-মুখরিত তাণ্ডব-মাতনে
গেছে উড়ে জটাভ্রষ্ট ধুতুরার ছিন্নভিন্ন দল,
কক্ষচ্যুত ধূমকেতু লক্ষ্যহারা প্রলয়-উজ্জ্বল
আত্মঘাত-মদমত্ত আপনারে দীর্ণ কীর্ণ করে
নির্ম্মম উল্লাস-বেগে, খণ্ড খণ্ড উল্কাপিণ্ড ঝরে,
কণ্টকিয়া তোলে ছায়াপথ।”
ওরা ডেকে বলে, “কবি,
সে তীর্থে কি তুমি সঙ্গে যাবে, যেথা অস্তগামী রবি
সন্ধ্যা-মেঘে রচে বেদী নক্ষত্রের বন্দনা-সভায়,
যেথা তা’র সর্ব্বশেষ রশ্মিটির রক্তিম জবায়
সাজায় অন্তিম অর্ঘ্য; যেথায় নিঃশব্দ বেণু-পরে
সঙ্গীত স্তম্ভিত থাকে মরণের নিস্তব্ধ অধরে?”

কবি বলে, “যাত্রী আমি, চলিব রাত্রির নিমন্ত্রণে
যেখানে সে চিরন্তন দেয়ালির উৎসবপ্রাঙ্গণে
মৃত্যুদূত নিয়ে গেছে আমার আনন্দ দীপগুলি,
যেথা মোর জীবনের প্রত্যুষের সুগন্ধি শিউলি
মাল্য হ’য়ে গাঁথা আছে অনন্তের অঙ্গদে কুণ্ডলে,
ইন্দ্রাণীর স্বয়ম্বর-বরমাল্য সাথে; দলে দলে
যেথা মোর অকৃতার্থ আশাগুলি, অসিদ্ধ সাধনা,
মন্দির-অঙ্গনদ্বারে প্রতিহত কত আরাধনা
নন্দন-মন্দারগন্ধ-লুব্ধ যেন মধুকর-পাঁতি,
গেছে উড়ি’ মর্তের দুর্ভিক্ষ ছাড়ি’।
আমি তব সাথী,
হে শেফালি, শরৎ-নিশির স্বপ্ন, শিশির-সিঞ্চিত
প্রভাতের বিচ্ছেদ-বেদনা, মোর সুচিরসঞ্চিত
অসমাপ্ত সঙ্গীতের ডালিখানি নিয়ে বক্ষতলে,
সমর্পিব নির্ব্বাকের নির্ব্বাণ বাণীর হোমানলে।”


(৫ই আশ্বিন, ১৩৩০)