পূরবী/পূরবী/লীলা-সঙ্গিনী

লীলা-সঙ্গিনী

দুয়ার-বাহিরে যেমনি চাহি রে
মনে হ’লো যেন চিনি,—
কবে, নিরুপমা, ওগো প্রিয়তমা,
ছিলে লীলা-সঙ্গিনী?
কাজে ফেলে মোরে চ’লে গেলে কোন দূরে,
মনে প’ড়ে গেলো আজি বুঝি বন্ধুরে?
ডাকিলে আবার কবেকার চেনা সুরে—
বাজাইলে কিঙ্কিণী।
বিস্মরণের গোধূলি-ক্ষণের
আলোতে তোমারে চিনি।

এলোচুলে ব’হে এনেছে কি মোহে
সেদিনের পরিমল?
বকুল-গন্ধে আনে বসন্ত
কবেকার সম্বল?
চৈত্র-হাওয়ায় উতলা কুঞ্জ-মাঝে
চারু চরণের ছায়া-মঞ্জীর বাজে,
সে-দিনের তুমি এলে এ-দিনের সাজে
ওগো চিরচঞ্চল।
অঞ্চল হ’তে ঝরে বায়ুস্রোতে
সেদিনের পরিমল।


মনে আছে সে কি সব কাজ, সখি,
ভুলায়েছে বারে বারে।
বন্ধ দুয়ার খুলেছো আমার
কঙ্কণ - ঝঙ্কারে।
ইসারা তোমার বাতাসে বাতাসে ভেসে
ঘুরে ঘুরে যেতো মোর বাতায়নে এসে,
কখনো আমের নব মুকুলের বেশে,
কভু নব মেঘ-ভারে।
চকিতে চকিতে চল-চাহনিতে
ভুলায়েছো বারে বারে।

নদী কূলে কূলে কল্লোল তুলে
গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।
বনপথে আসি’ করিতে উদাসী
কেতকীর রেণু মেখে।
বর্ষা-শেষের গগন কোণায় কোণায়,
সন্ধ্যা-মেঘের পুঞ্জ সোনায় সোনায়
নির্জ্জন ক্ষণে কখন অন্য-মনায়
ছুঁয়ে গেছো থেকে থেকে।
কখনো হাসিতে কখনো বাঁশিতে
গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।


কি লক্ষ্য নিয়ে এসেছো এ বেলা
কাজের কক্ষ-কোণে?
সাথী খুঁজিতে কি ফিরিছো একেলা
তব খেলা-প্রাঙ্গণে?
নিয়ে যাবে মোরে নীলাম্বরের তলে
ঘর-ছাড়া যত দিশা-হারাদের দলে,
অযাত্রা পথে যাত্রী যাহারা চলে
নিষ্ফল আয়োজনে?
কাজ ভোলাবারে ফেরো বারে বারে
কাজের কক্ষ-কোণে!

আবার সাজাতে হবে আভরণে
মানস প্রতিমাগুলি?
কল্পনা-পটে নেশার বরণে
বুলাবো রসের তুলি?
বিবাগী মনের ভাবনা ফাগুন-প্রাতে
উড়ে চ’লে যাবে উৎসুক বেদনাতে,
কল-গুঞ্জিত মৌমাছিদের সাথে
পাখায় পুষ্পধূলি।
আবার নিভৃতে হবে কি রচিতে
মানস প্রতিমাগুলি?

দেখো না কি, হায়, বেলা চ’লে যায়—
সারা হ’য়ে এলো দিন।
বাজে পূরবীর ছন্দে রবির
শেষ রাগিণীর বীণ।
এত দিন হেথা ছিনু আমি পরবাসী,
হারিয়ে ফেলেছি সেদিনের সেই বাঁশি,
আজ সন্ধ্যায় প্রাণ ওঠে নিঃশ্বাসি’
গানহারা উদাসীন।
কেন অবেলায় ডেকেছে খেলায়,
সারা হ’য়ে এলো দিন।

এবার কি তবে শেষ খেলা হবে
নিশীথ-অন্ধকারে?
মনে মনে বুঝি হবে খোঁজাখুঁজি
অমাবস্যার পারে?
মালতী-লতায় যাহারে দেখেছি প্রাতে
তারায় তারায় তা’রি লুকাচুরি রাতে?
সুর বেজেছিলো যাহার পরশ-পাতে
নীরবে লভিব তা’রে?
দিনের দুরাশা স্বপনের ভাষা
রচিবে অন্ধকারে?

যদি রাত হয়—না করিব ভয়,—
চিনি যে তোমারে চিনি।
চোখে নাই দেখি, তবু ছলিবে কি,
হে গোপন-রঙ্গিণী?
নিমেষে আঁচল ছুঁয়ে যায় যদি চ’লে
তবু সব কথা যাবে সে আমায় ব’লে,
তিমিরে তোমার পরশ-লহরী দোলে
হে রস-তরঙ্গিণী!
হে আমার প্রিয়, আবার ভুলিয়ো,
চিনি যে তোমারে চিনি।


(ফাল্গুন, ১৩৩০)