পূরবী/পূরবী/শিলংয়ের চিঠি

শিলংয়ের চিঠি

শ্রীমতী শোভনা দেবী ও শ্রীমতী নলিনী দেবী-
কল্যাণীয়াসু।

ছন্দে লেখা একটি চিঠি চেয়েছিলে মোর কাছে,
ভাব্‌ছি ব’সে, এই কলমের আর কি তেমন জোর আছে।
তরুণ বেলায় ছিলো আমার পদ্য লেখার বদ্‌-অভ্যাস,
মনে ছিলো হই বুঝি বা বাল্মীকি কি বেদব্যাস,
কিছু না হোক ‘লঙ্‌ফেলো’দের হবো আমি সমান তো,
এখন মাথা ঠাণ্ডা হ’য়ে হ’য়েছে সেই ভ্রমান্ত।
এখন শুধু গদ্য লিখি, তাও আবার কদাচিৎ,
আসল ভালো লাগে খাটে থাক্‌তে প’ড়ে সদা চিৎ।
যা-হোক একটা খ্যাতি আছে অনেক দিনের তৈরি সে,
শক্তি এখন কম প’ড়েছে তাই হ’য়েছে বৈরি সে;
সেই সেকালের নেশা তবু মনের মধ্যে ফির্‌ছে তো,
নতুন যুগের লোকের কাছে বড়াই রাখার ইচ্ছে তো।
তাই বসেছি ডেস্কে আমার, ডাক দিয়েছি চাকরকে,
“কলম লে আও, কাগজ লে আও, কালী লে আও ধাঁ কর্‌কে।”

ভাব্‌ছি যদি তোমরা দু’জন বছর তিরিশ পূর্ব্বেতে
গরজ ক’রে আস্‌তে কাছে, কিছু তবু সুর পেতে।
সেদিন যখন আজ্‌কে দিনের বাপ-খুড়ো সব নাবালক,
বর্ত্তমানের সুবুদ্ধিরা প্রায় ছিলো সব হাবা লোক,
তখন যদি ব’ল্‌তে আমায় লিখ্‌তে পয়ার মিল ক’রে,
লাইনগুলো পোকার মতো বেরতো পিল্-পিল্ ক’রে।
পঞ্জিকাটা মানো না কি, দিন দেখাটায় লক্ষ্য নেই?
লগ্নটি সব বইয়ে দিয়ে আজ এসেছো অক্ষণেই।
যা হোক তবু যা পারি তাই জুড়্‌বো কথা ছন্দেতে,
কবিত্ব-ভূত আবার এসে চাপুক আমার স্কন্ধেতে।
শিলংগিরির বর্ণনা চাও? আচ্ছা না হয় তাই হবে,
উচ্চদরের কাব্যকলা না যদি হয় নাই হবে;—
মিল বাঁচাবো, মেনে যাবো মাত্রা দেবার বিধান তো;
তা’র বেশী আর ক’র্‌লে আশা ঠক্‌বে এবার নিতান্ত।
 * * *
গর্ম্মি যখন ছুট্‌লো না আর পাখার হাওয়ায় সর্‌বতে,
ঠাণ্ডা হ’তে দৌড়ে এলুম শিলঙ্‌ নামক পর্ব্বতে।
মেঘ-বিছানো শৈলমালা গহন-ছায়া অরণ্যে
ক্লান্ত জনে ডাক দিয়ে কয়, “কোলে আমার শরণ নে।”
ঝর্‌ণা ঝরে কল্‌কলিয়ে আঁকাবাঁকা ভঙ্গীতে,
বুকের মাঝে কয় কথা যে সোহাগ-ঝরা সঙ্গীতে।

বাতাস কেবল ঘুরে বেড়ায় পাইন্ বনের পল্লবে,
নিঃশ্বাসে তা’র বিষ নাশে আর অবল মানুষ বল লভে।
পাথর-কাটা পথ চলেছে বাঁকে বাঁকে পাক দিয়ে,
নতুন নতুন শোভার চমক দেয় দেখা তা’র ফাঁক দিয়ে।
দার্জ্জিলিঙের তুলনাতে ঠাণ্ডা হেথায় কম হবে,
একটা খদর চাদর হ’লেই শীত-ভাঙানো সম্ভবে।
চেরাপুঞ্জি কাছেই বটে, নামজাদা তা’র বৃষ্টিপাত;
মোদের পরে বাদল মেঘের নেই ততদূর দৃষ্টিপাত।

এখানে খুব লাগ্‌লো ভালো গাছের ফাঁকে চন্দ্রোদয়,
আর ভালো এই হাওয়ায় যখন পাইন্‌-পাতার গন্ধ বয়;
বেশ আছি এই বনে বনে, যখন-তখন ফুল তুলি,
নাম-না-জানা পাখী নাচে, শিষ দিয়ে যায় বুলবুলি।
ভালো লাগে দুপুর বেলায় মন্দমধুর ঠাণ্ডাটি,
ভোলায় রে মন দেবদারু-বন, গিরিদেবের পাণ্ডাটি।
ভালো লাগে আলো-ছায়ার নানারকম আঁক কাটা,
দিব্যি দেখায় শৈলবুকে শস্য-ক্ষেতের থাক কাটা।
ভালো লাগে রৌদ্র যখন পড়ে মেঘের ফন্দীতে,
রবির সাথে ইন্দ্র মেলেন নীল সোনালীর সন্ধিতে।
নয় ভালো এই গুর্খাদলের কুচ্-কাওয়াজের কাণ্ডটা,
তা ছাড়া ঐ ব্যাঘ্রপাইপ নামক বাদ্য-ভাণ্ডটা।
ঘন ঘন বাজায় শিঙা—আকাশ করে সর্‌গরম,
গুলিগোলার ধড়্‌ধড়ানি, বুকের মধ্যে থর্‌থরম্।

আর ভালো নয় মোটর-গাড়ির ঘোর বেসুরো হাঁক দেওয়া,
নিরপরাধ পদাতিকের সর্ব্বদেহে পাঁক দেওয়া।
তা’ছাড়া সব পিসু মাছি কাশি হাঁচি ইত্যাদি,
কখনো বা খাওয়ার দোষে রুখে দাড়ায় পিত্তাদি;
এমনতরো ছোটখাটো একটা কিম্বা অর্দ্ধটা
যৎসামান্য উপদ্রবের নাই বা দিলাম ফর্দ্দটা।
দোষ গাইতে চাই যদি তো তাল করা যায় বিন্দুকে;
মোটের উপর শিলঙ্ ভালোই যাই না বলুক নিন্দুকে।
আমার মতে জগৎটাতে ভালোটারই প্রাধান্য,—
মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।
বর্ণনাটা ক্ষান্ত করি, অনেকগুলো কাজ বাকি,
আছে চায়ের নেমন্তন্ন, এখনো তা’র সাজ বাকি।
 * * * *
ছড়া কিম্বা কাব্য কভু লিখ্‌বে পরের ফর্‌মাসে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জেনো নয়কো তেমন শর্ম্মা সে।
তথাপি এই ছন্দ র’চে ক’রেছি কাল নষ্ট তো;
এইখানেতে কারণটি তা’র ব’লে রাখি স্পষ্টত,—
তোমরা দু’জন বয়সেতে ছোট-ই হবে বোধ করি,
আর আমি তো পরমায়ুর ষাট দিয়েছি শোধ করি’।

তবু আমার পক্ক কেশের লম্বা-দাড়ির সম্ভ্রমে
আমাকে যে ভয় করোনি দুর্ব্বাসা কি যম ভ্রমে,
মোর ঠিকানায় পত্র দিতে হয়নি কলম কম্পিত,
কবিতাতে লিখ্‌তে চিঠি হুকুম এলো লক্ষিত,
এইটে দেখে মনটা আমার পূর্ণ হ’লো উৎসাহে,
মনে হ’লো, বৃদ্ধ আমি মন্দ লোকের কুৎসা এ।
মনে হ’লো আজো আছে কম বয়সের রঙ্গিমা,
জরার কোপে দাড়ি-গোঁপে হয়নি জবড়-জঙ্গিমা।
তাই বুঝি সব ছোটো যারা তা’রা যে কোন্ বিশ্বাসে
এক-বয়সী ব’লে আমায় চিনেছে এক নিশ্বাসে।
এই ভাবনায় সেই হ’তে মন এম্‌নিতরো খুশ্ আছে,
ডাক্‌ছে ভোলা “খাবার এলো” আমার কি আর হুঁশ আছে?
জান্‌লা দিয়ে বৃষ্টিতে গা ভেজে যদি ভিজুক তো,
ভুলেই গেলাম লিখ্‌তে নাটক আছি আমি নিযুক্ত।
মনকে ডাকি “হে আত্মারাম, ছুটুক তোমার কবিত্ব,
ছোট্ট দুটি মেয়ের কাছে ফুটুক রবির রবিত্ব।”


(শিলং, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩০)