অনুরোধবতী একবিংশ পুত্তলিকা

কহিল হে ভোজরাজ তুমি আপনাকে এই সিংহাসনে বসিবার যোগ্য বিবেচনা করিয়া কেবল বৃথা অহস্কার প্রকাশ করিতেছ। আমি তোমাকে এক বিবরণ বলিতেছি শ্রবণ কর, তাহার পর সিংহাসনে বসিও।

 মাধব নামে এক ব্রাহ্মণকুমার ছিলেন। তিনি সাক্ষাৎ কপের ন্যায় রূপবান। যে নারী তাহার সেই অপরূপ রূপ দর্শন করিত সে একবারে মোহিত হইত। ঐ ব্রাহ্মণকুমার সকল প্রকার বিদ্যাভ্যাস করিয়া ছিলেন। সঙ্গীত বিদ্যা উত্তমরূপ জানিতেন। তিনি স্বভাবতঃ সপষ্টবাদী ছিলেন। ফলতঃ ততুল্য মনুষ্য প্রায় দেখাযায় না। তিনি সর্বদা ভ্রমণকারী ছিলেন এবং সকল রাজসভায় যাইতেন, সকল রাজাই তাহাকে সমাদর করিতেন। কিন্তু কোন স্থানে বহুকাল বাস করিতেন না। ব্রাহ্মণকুমার এই প্রকার নানা দেশ ভ্রমণ করিতে করিতে এক সময়, কাম নগরীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কামসেন নামে ঐ নগরের ভূপতি ছিলেন। সঙ্গীত বিদাতে সুনিপুণ কামকন্দলা নামী এক গন্ধর্ব্বকন্যা তাঁহার সভার নর্ত্তকী ছিল। মাধব রাজদ্বারে উপস্থিত হইয়া দ্বারপালকে কহিলেন রাজাকে সংবাদ দেও, আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব। দ্বারী তাঁহার বাক্য শুনিয়াও অঞতবৎ তুচ্ছ করিল। মাধব পথশ্রান্তি শান্তি জন্য দ্বারদেশে বসিলেন। ঐ সময়ে রাজপুরীর মধ্যে সঙ্গীত হইতেছিল। মাধব তাহা শুনিয়া বারম্বার কহিতে লাগিলেন, রাজা যেমন অপণ্ডিত, সভাসদও সেই প্রকার গুণাগুণ-বিবেচনা শূন্য। দৌবারিক তাহা শুনিয়া কুপিত হইল, কিন্তু কোন উত্তর না করিয়া, রাজার সম্মুখে কৃতাঞ্জলি পুটে দণ্ডায়মান হইল। ভূপতি তাহার প্রতি দৃষ্টি করিলে, দ্বারী কহিল মহারাজ এক বিদেশী ব্রাহ্মণ আসিয়া দ্বারে বসিয়াছে, এবং অনবরত কহিতেছে রাজসভাস্থ সমস্ত লোক মূখ, কেহ গুণের বিচার করেন না। ভূপাল দ্বারপালকে বলিলেন তুমি গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা কর তিনি কিজন্য ইহাদিগকে সূখ বলিতেছেন।

 দ্বারী রাজাজ্ঞানুসারে দ্বারে আসিয়া ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল তুমি মহারাজকে অজ্ঞান বলিতেছ ইহার কারণ কি। মাধব কহিলেন দ্বাদশ জন সঙ্গীতকারক তিন সারি হইয়া, চারি চারি জন এক এক শ্রেণীতে দণ্ডায়মান আছে। ইহার মধ্যে যে তিন জন মৃদঙ্গ বাজাইতেছে তন্মধ্যে পূর্বমুখী এক মৃদঙ্গীর এক অঙ্গুলি নাই, তাহাতে মানের ঘরে ভাল চাটি পড়িতেছেনা। এই জন্য আমি সকলকে মূঢ় বিবেচনা করিয়াছি। যদি এই কথায় প্রত্যয় না হয়, যাইয়া প্রত্যক্ষ দেখ।

 দ্বারী এই কথা রাজাকে গিয়া বলিল। রাজা পূর্ব্বমুখী চারি জন মৃদঙ্গীকে ডাকিয়া একে একে সকলের হস্ত পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন এক ব্যক্তির এক অঙ্গুলি মোম নির্মিত। এতদবলোকনে ভূপতি ব্রাহ্মণকুমারের প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে ডাকাইলেন। মাধব সম্মুখে আসিলে, রাজা তাহাকে সম্মান পূর্বক স্বীয় আসনে উপবেশন করাইলেন। এবং আপনি যে প্রকার বস্ত্রাদি পরিধান করিয়াছিলেন, সেই প্রকার বহুমূল্য বস্ত্রাদি আনাইয়া তাহাকে পরিধান করাইলেন। তদনন্তর কামকলাকে ডাকিয়া আজ্ঞা করিলেন ইহার সম্মুখে তুমি আপন গুণ প্রকাশ কর। ইনি সঙ্গীত শাস্ত্রে অতিপণ্ডিত, অতএব যাহা করিবে অতি সাবধানে করিতে হইবে।

 কামকন্দলা রাজাজ্ঞা পাইয়া নানা প্রকার রাগালোচনা ও অতি মনোেহর অঙ্গভঙ্গী পূর্ব্বক নৃত্য করিতে লাগিল। ঐ সঙ্গে নানাপ্রকার সুশ্রাব্য বাদ্য হইতে লাগিল। ইতিমধ্যে একটা ভ্রমর ভ্রমণ করিতে করিতে তাহার বক্ষঃস্থলে বসিয়া তাহার কুচদেশে দংশন করিল। ভ্রমরের দংশনে কামকলা কাতর হইল। কিন্তু তখন কাতরতা জানাইলে তাল ভঙ্গ হইবে ইহা ভাবিয়া, চতুরতা পূর্ব্বক কুচের বসন কিঞ্চিৎ উত্তোলন করিল। তাহাতে মধুকর উড়িয়া গেল। মাধব, কামকলার রূপমাধুরী ও সঙ্গীতচাতুরী দর্শনে পূর্বেই বিমোহিতচিত্ত হইয়া ছিলেন, এক্ষণে ভ্রমর-বারণ-চাতুরী দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়া, তুমি ধন্য তোমার কর্ম্ম ধন্য, ইহা বলিয়া তৎক্ষণাৎ রাজদত্ত বস্ত্রাভরণ খুলিয়া তাহাকে পারিতোযিক দিলেন।

 মাধবের এই কর্ম্ম দেখিয়া রাজা মন্ত্রীকে কহিলেন দেখ এই ব্যক্তি কেমন নির্বোধ, অনায়াসে বারাঙ্গনাকে সকল বস্ত্র ও বহুমূল্য রত্নাদি পুরস্কার করিল। কিন্তু ভিক্ষুক হইয়া আমার সম্মুখে এমত দাতৃত্ব প্রকাশ করা অতি অনুচিত কর্ম্ম। অনন্তর তিনি মাধবকে জিজ্ঞাসিলেন তুমি ইহার কি গুণে মোহিত হইয়াছ, তাহা আমাকে কহ। মাধব কহিলেন মহারাজ তুমি যেমন মূর্খ, তোমার সভাস্থেরাও সেই রূপ। তোমার নকী এমত গুণ প্রকাশ করিল, তাহা কেহ বিচার করিলনা। ইহার কুচতটে মধুকর উপবিষ্ট হইয়া দংশন করিতেছিল, তাহাতে এই নারী, পাছে নৃত্য গীতের ব্যাঘাত হয় এই ভয়ে, আপন শ্বাসরোেধ পূর্ব্বক বক্ষের বস্তু উত্তোলন করিয়া ভ্রমরকে উড়াইয়া দিল, একি সামান্য গুণপনা। এই গুণে আমি ইহাকে বস্ত্রালঙ্কার পুরস্কার দিলাম।

 মাধবের এই কথায় রাজা লজ্জিত হইয়া কোন উত্তর করিলেন না, কিন্তু তাহাকে কহিলেন তুমি এই দণ্ডে আমার নগর হইতে স্থানান্তর প্রস্থান কর, নতুবা তোমার হস্ত পদ বন্ধন পূর্ব্বক সমুদ্রে নিক্ষেপ করিব। মাধব কহিলেন মহারাজ আমাকে কি অপরাধে আপনি দেশান্তরিত করিতে চাহেন, এবং কি অপরাধেই বা সমুদ্রে নিক্ষেপ করিবেন। রাজা বলিলেন আমি তোমাকে যাহা দিয়াছিলাম তাহা তুমি আমার সমক্ষেই বেশ্যাকে দান কর, তোমার এত বড় আপদ্ধা, আমি কি উহাকে কিছু দিতে পারিতাম না।

 এই কথায় মাধব মলিনবদনে সভাসদন হইতে গাত্রোখান করিয়া বাহির হইলেন, এবং এক বৃক্ষমূলে ব্যাকুলিত ভাবে দাঁড়াইয়া খেদ করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, হায়, এই নির্বোধ রাজা আমাকে নির্বাসল করিবার অনুমতি করিলেন। কিন্তু আমি এদেশ পরিত্যাগ করিয়া, কামকলার বদনেন্দু সন্দর্শনে বঞ্চিত হইলে, আপন প্রাণে বঞ্চিত হইব, এবং এখানে। থাকিলেও এই রাজা প্রাণহন্তা হইবেন। অতএব কি কবি, কোথায় যাই। এবম্বিধ বিবিধ চিন্তা করিতে করিতে কামকলার নামোচ্চারণ পূর্ব্বক রোদন করিতে লাগিলেন।

 কামকন্দলা মাধবের রূপ লাবণ্য ও গুণাগুণবিবেকনৈপুণ্য দর্শনে একবারে বিমোহিত হইয়াছিল। অতএব, মাধব সভা হইতে বাহিরে গমন করিলে পর, রাজার স্থানে বিদায় হইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ এক দুত প্রেরণ করিল। তাহাকে বলিয়াদিল মাধবকে লইয়া আমার গৃহে রাখ, আমি এখনি যাইতেছি। দূত মাধবকে আনিয়া কামকলার আলয়ে বসাইল। কামকলা গৃহে আসিয়া মাধবের সহিত একত্র বসিয়া, রসালাপ করিতে লাগিল। মাধব কহিলেন রাজা অমাকে দেশান্তর গমনের আজ্ঞা দিয়াছেন। কিন্তু তুমি আমাকে আপন গৃহে আনিয়াছ, রাজা ইহা শুনিলে আমার প্রাণ দণ্ড করিবেন। আমার প্রাণ নাশ হইলে আমার দুঃখের শেষ হইবে বটে, কিন্তু তুমিও তাহার কোপানলে ভস্ম হইবে। অতএব যাহাতে প্রাণ বিয়োগ ও অপযশঃ সম্ভব এমত কর্ম্ম অকর্তব্য। কামকলা কহিল আমি এখন তোমাকে ছাড়িতে পারি না। পরমেশ্বর যাহা করেন তাহাই হইবে। ইহ, বলিয়া বাদ্যযন্ত্রাদি আনাইয়া আপনার যে যে গুণ ছিল তাহা প্রকাশ করিতে লাগিল। মাধবও গান বাদ্য করিলেন। এই প্রকার আমোদে আহলাদে অনেক রাত্রি হইল। নিশাবসানের কিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকিতে কামকুন্দল। মাধবকে কহিল, তুমি অনেক শ্রম করিয়াছি, এই ক্ষণে বিশ্রাম কর। ইহা বলিয়া শয়ন মন্দিরে লইয়া গিয়া তাহার সহিত একত্র শয়ন করিয়া থাকিল।

 প্রভাতে প্রভাতিক বাদ্যারম্ভ হইলে, মাধৱ রাজাজ্ঞা স্মরণ করিয়া হতবুদ্ধি হইয়া কামকলাকে কহিলেন হে সুন্দরি রজনী অতি সুখে যাপন করিলাম, কিন্তু এক্ষণে এখানে থাকিলে উভয়েরই প্রাণ বিনাশ হইবে। অতএব, ইহা নাহয় এবং উভয়ে স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারি, আমি মনে মনে ইহার এক সদুপায় স্থির করিয়াছি। আমি সম্প্রতি চলিলাম, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমি সত্য করিয়া যাইতেছি, অতঃপর আসিয়া তোমাকে এখান হইতে লইয়া যাইব। এই কথা শ্রবণ মাত্র কামকন্দলা মূচ্ছাগত হইয়া ভূমিতে পড়িল। মাধব, আপনি ও আপন প্রেয়সী উভয়েরি প্রাণ রক্ষার্থ, তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং হা কামকলা হা কামকলা বলিয়া অহর্নিশি ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

 মাধবের গমনান্তে কামকলার সখীগণ তাহার মূচ্ছ। বিশ্রান্তি বাসনায় তাহার মুখে সুগন্ধি বারি প্রক্ষেপ করিতে লাগিল। তাহাতে জ্ঞানোদয় হইলে, সে অনবরত দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্বক মাধব মাধব বলিয়া রোদন করিতে লাগিল। সখীগণ নানা প্রকার বুঝাইতে লাগিল, কিন্তু কোন প্রকারে তাহার ধৈর্য্য সম্পাদন করিতে পারিল না। গোলাব কপূর চন্দনাদি সুগন্ধীয় সুশীতল দ্রব্য যত তাহার অঙ্গে দিল ততই অধিক অঙ্গদাহ হইতে লাগিল, কেবল মাধবের মধুর নাম শ্রবণে কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইতে লাগিল।

 মাধব হতাশ্বাস হইয়া বন ভ্রমণ করিতে করিতে মনে মনে ভাবিলেন সংসারে এমন কে আছে যে তাহার নিকটে যাইয়া দুঃখ নিবারণ করি। অনন্তর তাহার স্মরণ হইল, রাজা বিক্রমাদিত্য পরম দয়ালু এবং পর দুঃখহারী, অতএব তাহার শরণাপন্ন হইলে তিনি অবশ্য আমার দুঃখ বিমোচন করিতে পারেন। মনে মনে ইহা স্থির করিয়া উজ্জয়িনী নগরে যাত্রা করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া তন্নগরস্থ এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন রাজার সহিত সাক্ষাতের উপায় কি। সে কহিল। গোদাবরী তীরে এক শিবালয় আছে, রাজা প্রতিদিন শিব দর্শন জন্য তথায় গমন করেন। সেইখানে সাক্ষাৎ হইতে পারে। ইহা শুনিয়া মাধব গোদাবরী তটে মঠে গমন করিলেন, এবং মন্দিরের দ্বারের চৌকাষ্ঠের উপর এই কয়েকটা কথা লিখিয়া রাখিলেন, যথা, “আমি বিদেশস্থ ব্রাহ্মণ অতি দুঃখী এবং বিরহে ব্যাকুলিত, আমি শুনিয়াছি রাজা পরদুঃখ নিবারণ ও গো ব্রাহ্মণকে সদা রক্ষা করেন। অতএব আমি এই নগরে আসিয়াছি, যদি রাজা আমার দুঃখ দূর করেন তবে আমি প্রাণ ধারণ করিব, নতুবা গোদাবরীতে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করিব, এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছি,,।

 রাজা বিক্রমাদিত্যের এই নিয়ম ছিল অন্ন বস্ত্র হীন বা ভূমি ও অন্য দ্রব্যাকাঙ্ক্ষী বা বিবেকী কিম্বা বিরহে পীড়িত কোন ব্যক্তি নগরে আসিলে, তিনি যে পর্যন্ত তাহার দুঃখ নিবারণ না করিতেন সে পর্যন্ত জল গ্রহণ দূরে থাকুক দন্তধাবন করিতেন না। এব পর দিবস প্রাতঃকালে মন্দিরে গিয়া মহাদেবকে প্রদক্ষিণ করিতে করিতে উর্দ্ধে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন কোন ব্যক্তি আপনার দুঃখের বিবরণ চৌকাষ্ঠে লিখিয়া গিয়াছে। রাজা, তাহা পাঠানন্তর, মহাদেবকে প্রণাম করিয়া বাজবাটীতে আসিয়া আজ্ঞা দিলেন মাধব নামে এক ব্রাহ্মণ আমার নগরে আসিয়াছে, যে ব্যক্তি তাহাকে অন্বেষণ করিয়া আনিবে তাহাকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার দিব। এই আজ্ঞায় বহুতর লোক মাধবের অন্বেষণে বহির্গত হইল, এবং মাঠ ঘাট হাট উদ্যান উপবন সকল অন্বেষণ করিতে লাগিল, কিন্তু কোন স্থানে কেহ তাহাকে পাইলনা। অনন্তর রাজা এক দূতীকে আহ্বান করিয়া, মাধবের অবস্থা জানাইয়া, আজ্ঞা দিলেন যদি তুমি মাধবকে অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারি তবে তুমি যে অর্থ প্রার্থনা করিবে তোমাকে দিব। দূতী কহিল এ কর্ম্ম অতি সামান্য, আমি এখনি তাহাকে অন্বেষণ করিয়া আনিতেছি।

 ইহা বলিয়া দূতী দেবালয়ের দ্বারে গিয়া বসিয়া থাকিল। দিবাবসানে মাধব ভ্রমণ করিতে করিতে তথায় আসিতেছেন। দূতী অন্তরে থাকিয়া দেখিল তাহার মুখ হরিদ্রাবর্ণ, চক্ষু বারিপূরিত, এবং চিত্ত উদাস হইয়াছে। তদবলোকনে মনে মনে সংশয় করিল, এই সেই বিরহাক্রান্ত ব্যক্তি কি না। সময়ে মাধব ঐ স্থানে আসিয়া বসিলেন, এবং ক্ষণেক পরে কামকলা কামকলা বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন। ইহাতে দূতী তৎক্ষণাৎ তাহার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক কহিল আমি রাজাজ্ঞায় তোমার অন্বেষণে আসিয়াছি, তুমি শীঘ্র আমার সঙ্গে আইস, তোমার অতিলাষ পূর্ণ হইবে, তোমার দুঃখে রাজা নিতান্ত দুঃখিত আছেন।

 মাধব তাহার সঙ্গে চলিলেন। দূতী তাহাকে রাজার সম্মুখে উপস্থিত করিয়া কহিল, মহারাজ আপনি যাহার নিমিত্ত এত চিন্তিত ছিলেন সেই বিরহী এমত এই। রাজা মাধবকে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কাহার বিচ্ছেদে এই বিষমশর দশা প্রাপ্ত হইয়াছ। মাধব দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, মহারাজ, কামকদলার বিচ্ছেদে আমার এই দুর্গতি হইয়াছে। কামকন্দলা রাজা কামসেনের সভার নর্তকী। তুমি ধর্ম্মাত্মা, আমি তোমার শরণ লইয়াছি। তুমি যদি সেই প্রাণানন্দদায়িনীকে দিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর তবে প্রাণ দান পাই। রাজা হাস্য করিয়া কহিলেন হে বিপ্র সে বারাঙ্গনা, তাহার প্রেমে তুমি আপন ধর্ম্ম কর্ম্ম সকল বিসর্জন দাও, ইহা অনুচিত। মাধব কহিলেন, মহারাজ, প্রেমের তন্ত্র স্বতন্ত্র, যে ব্যক্তি প্রেম মন্ত্র পাঠ করে সে আপন শরীর আত্ম। ও ধর্ম কর্ম সকল তাহাতে সমর্পণ করে, তাহার বৃত্তান্ত কি নিবেদন করিব।

 রাজা এই কথা শুনিয়া তাহাকে স্ববাসে রাখিলেন, এবং স্বীয় সভার নকীগণকে বলিলেন তোমরা অতি মনোহর বেশ ভূষ করিয়া আইস। নর্তকীগণ নানা অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া নিরুপম মোহিনীসজ্জা করিয়া রাজার সভায় আসিলে, রাজা মাধবকে বলিলেন ইহার মধ্যে তোমার যাহাকে অভিলাষ হয় গ্রহণ কর। ব্রাহ্মণনন্দন কহিলেন মহারাজ এই সকল নারী পরম সুন্দরী বটে, কিন্তু কামকলা ভিন্ন অন্য কামিনী আমার কামনীয় নহে। বারিদ-বিনিগর্ত-বারিবিন্দুপ্রত্যাশী চাতকের পিপাসা ঐ বারি ব্যতীত আর কিছু তেই নিবারণ হইতে পারে না।  রাজা কামকলার প্রেমে মাধবকে এইরূপ মুগ্ধ দেখিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন ইহাকে সঙ্গে লইয়া কামকলাকে দিতে হইল, তাহা না হইলে ইহার মনের চাঞ্চল্য দূর হইবেক না, ব্রহ্মহত্যা হইবেক। ইহা ভাবিয়া তিনি মাধবকে বলিলেন, তুমি স্নান পূজা করিয়া কিঞ্চিৎ জলযোগ কর, আমি গমনের আয়োজন করি। পরে তোমাকে সঙ্গে লইয়া গিয়া কামকলাকে দেওয়াইব। মাধব এই কথায় অপার আনন্দ-সাগরে মগ্ন হইয়া আহারাদি করিলেন। রাজা ইতিমধ্যে সৈন্যগণকে সংগ্রাম সজ্জা করিবার আজ্ঞা দিলেন, অনন্তর আপনি সুসজ্জিত হইয়া বিপ্রকুমারকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাত্রা করিলেন, এবং চতুরঙ্গ সেনা তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

 কয়েক দিবস পরে রাজা কামনগরের দশ ক্রোশ ব্যবধানে উপস্থিত হইয়া তথায় শিবির সন্নিবেশন পূর্ব্বক তনগরস্থ ভূপতিকে পত্র লিখিলেন কামকলা নামে যে গন্ধর্ব্বকন্যা তোমার সভাতে আছে তাহাকে আমার স্থানে প্রেরণ কর, নতুবা যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হও। দূত পত্র লইয়া কামনগরের রাজার নিকট সমর্পণ করিলে, কামসেন তাহাকে বলিলেন যদি রাজা সংগ্রাম ইচ্ছা করেন আমি সম্মত আছি। বার্তাবহ এই বার্তা আনয়ন করিলে রাজা বিক্রমাদিত্য স্বীয় সেনাগণকে সুসজ্জিত হইতে অজ্ঞা দিলেন। কিন্তু মনে মনে ভাবিলেন, আমি যে কামকলাকে লইবার জন্য আসিএকবিংশ পুত্তলিকা।য়াছি অগ্রে তাহার প্রেমের পরীক্ষা করিতে হইবে। যদি মাধবের সহিত তাহার যথার্থ প্রণয় হইয়া থাকে তবেই সমর সার্থক হইবে, নতুবা অনর্থক বিবাদে কি প্রয়োজন।

 ইহা ভাবিয়া রাজা বৈদ্যবেশে কামনগরে গমন করিলেন, এবং কামকলার গৃহান্বেষণ পূর্বক তাহার দ্বারে উপস্থিত হইয়া দ্বারাঘাত করিতে লাগিলেন। তাহাতে অন্তঃপুর হইতে এক পরিচারিণী আসিয়া তাহার পরিচয় শুনিয়া বলিল তুমি যদি চিকিৎসা বিদ্যাতে সুপণ্ডিত হও এবং আমার নায়িকার রোগ শান্তি করিতে পার তবে অনেক অর্থ পাইবে। ইহা বলিয়া দাসী তাহাকে কামকলার নিকটে লইয়া গেল। রাজা দেখিলেন কামকলা সপন্দহীন শয্যায় পড়িয়া আছে। পরে তাহার ব্যাধি নির্ণয় করিয়া বলিলেন ইহার আর কোন পীড়া নাই, কেবল প্রিয়তমের প্রতি প্রেমাত্তা হইয়াছে। রাজার এই কথায় কামকলা নেত্রোন্মীলন করিয়া বলিল হে বৈদ্যরাজ যদি ইহার কোন ঔষধ জান, বল। রাজা বলিলেন ইহার ঔষধ আমার নিকটে ছিল, কিন্তু এইক্ষণে আমি তাহার কথা কিছু বলিতে পারিনা। কামকলা বলিল তোমার স্থানে কি ঔষধ ছিল। রাজা বলিলেন মাধব নামক এক ব্রাহ্মণ আমার নিকটে আসিয়াছিল, সে বিরহে সস্তাপিত হইয়া উজ্জয়িনী নগরে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। এই কথা শ্রবণমাত্র কামকলা হা শব্দ করিয়া অচৈতন্য হইয়া ভূমিতে পড়িল, এবং তৎক্ষণাৎ প্রাণ পরিত্যাগ করিল। তদ্দর্শনে তাহার গৃহজন সকলে রোদন করিতে লাগিল। রাজা তাহাদিগকে বলিলেন তোমরা ক্রন্দন করিও না, ইহার মূচ্ছবেশ হইয়াছে, প্রাণ বিয়োগ হয় নাই, কিঞ্চিৎ বিলম্বে সচেতন হইবে, তোমরা ইহার শান্তি চেষ্টা কর। আমি ঔষধ আনয়ন করিতেছি।

 ইহা বলিয়া রাজা স্বীয় শিবিরে গমন করিলেন এবং মাধবকে তাহার মৃত্যু বার্তা কহিলেন। মাধব ঐ সম্বাদ শ্রবণমাত্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তখন রাজা মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, আমি যাহার জন্য এত যত্নে সৈন্যসামন্ত লইয়া আসিলাম, তাহাকে আপনি কালের করাল গ্রাসে নিক্ষেপ করিলাম, হায়, আমি দুই জনের প্রাণ বিয়োগের মূল হইলাম, অতএব আমার জীবন ধারণ করা আর উচিত নহে। ইহা ভাবিয়া রাজা যথানিয়মক্রমে চিত। প্রস্তুত করাইয়া আপনি প্রাণত্যাগ করিবেন প্রতিজ্ঞা করিলেন। মন্ত্রী নিষেধ করিলেন, কিন্তু তাহা না শুনিয়া চিত আরোহণ করিতে উদ্যত হইলেন। বেতাল এই দুর্দৈব দেখিয়া তাহার হস্ত ধারণ পূর্বক কহিল মহারাজ এ কি কর্ম্ম করিতেছেন। রাজা বলিলেন আমা কর্তৃক দুই মহাপ্রাণী নষ্ট হইয়াছে, জন্য আমারও জীবন ধারণ উচিত নহে, কলঙ্কভাগী হইয়া বাঁচিয়া থাকা অপেক্ষা মৃত্যুই ভাল। বেতাল কহিল মহারাজ প্রাণত্যাগ করিবেন না, আমি অমৃত আনয়ন করিতেছি, তদ্বারা উভয়ের প্রাণ দান হইবে। ইহা বলিয়া বেতাল পাতালপুর হইতে অমৃত আনয়ন করিয়া ব্রাহ্মণকুমারের প্রাণদান করিল। রাজা ঐ অমৃত লইয়া গিয়া কামকলার অঙ্গে প্রোক্ষণ করিলেন, তাহাতে সেও পুনর্জীবিত হইয়া উঠিল এবং মাধব মাধব বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। সম্মুখে রাজাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল তুমি কে, কোথা হইতে আসিয়াছ। রাজা বলিলেন আমি বীর বিক্রমাদিত্য, মাধবের বিরহ-যন্ত্রণা দূর করণার্থ উজ্জয়িনী নগর হইতে তাহাকে এখানে লইয়া আসিয়াছি, তুমি নিশ্চয় জান, তোমার সঙ্গে তাহার সংমিলন করিয়া দিব। ইহা শুনিয়া কামকলা প্রেমানন্দে পুলকিত হইয়া রাজার চরণ ধারণ করিল, আর বলিল হে পুরুষোত্তম তুমি ইহা করিলে আমাকে জীবন দান করিবে, এবং তোমার যে প্রকার যশঃ শ্রবণ করা যায় তাহা আরো বিস্তারিত হইবে।

কামকন্দলা এ কথা বলিলে রাজা স্বীয় শিবিরে প্রত্যাগমন করিলেন। পর দিবস সৈন্য সামন্ত লইয়া কামনগরী আক্রমণ করিলেন। তখন কামসেন রাজা পরাভব মানিয়া অঙ্গীকার করিলেন কামকলাকে প্রেরণ করিবেন। তিনি ইহাও বলিয়া পাঠাইলেন আমি আপনার চরণ দর্শন জন্য যুদ্ধ করিতে চাহিয়াছিলাম, আমার সে অভিলাষ পূর্ণ হইল, এবং আপনার চরণরেণু সম্পর্কে আমার রাজ্যও পবিত্র হইল। তদ- নন্তর রাজা কামসেন রাজা বিক্রমাদিত্যের সহিত সা- ক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেলেন, এবং বহুতর অর্থ ও অলঙ্কার সহিত কামকন্দলাকে তা- হার সম্মুখে আনাইলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য মাধবকে আনাইয়া তাহাকে কামকলা সমর্পণ করিলেন। পরে তথা হইতে আপন রাজধানীতে আসিয়া মাধবকে অনেক অর্থ দিয়া বিদায় করিলেন।

 এই বৃত্তান্ত সমাপন করিয়া অনুরােধবতী পুত্তলিকা বলিল হে ভােজরাজ যদি তােমার এই প্রকার সামর্থ্য ও সাহস থাকে তবে সিংহাসনারােহণ কর, নতুবা পতিত হইয়া নরকগামী হইবে। এইরূপে সে দিবসও গত হইল। পর দিবস রাজা পুনর্ব্বার সিংহাসনের সমীপে উপস্থিত হইলে