মনোমোহিনী অষ্টাবিংশ পুত্তলিকা

কহিল, হে ভোজরাজ, তুমি বলিতে পার, রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য বলবান, সাহসী ও জ্ঞানী মনুষ্য এই পৃথিবীতে আর কেহ জন্মিয়াছিলেন কি না। বোধ হয়, কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই। হে ভোজরাজ আমার বাক্য অপ্রকৃত জ্ঞান করিওনা। এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি শ্রবণ কর।

 এক দিবস আমি রাজা বিক্রমাদিত্যকে পরিহাসস্থলে কহিলাম, হে স্বামিন, পাতালেশ্বর বলিরাজা অতি বড় রাজা, তুমি তাহার সঙ্গীর তুল্যও নহ। অতএব যদি তোমার রাজ্য নির্বিঘে চলে, তাহা হইলে একবার তাহাকে দর্শন করিয়া আইস। এই কথা শুনিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য বেতাকে আজ্ঞা করিলেন আমাকে পাতালপুরে লইয়া চল। বেতাল আজ্ঞমিত্র রাজাকে পাতালপুরে লইয়া উপস্থিত করিল। রাজা পাতাল পুরে উপস্থিত হইয়া পাতালপুরীর শোভা দর্শনে বিস্ময়পন্ন হইলেন, মনে মনে কহিতে লাগিলেন অদ্যাবধি আমি এমত চমৎকার নগর কুত্রাপি দর্শন করি নাই, এ স্থান কৈলাসপুরীর তুল্য, এই রাজ্যের অধিপতি বলিরাজাকে ধন্য।

 রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রকার নগর দর্শনে চমংকৃত হইয়া চিন্তা করিতে করিতে বলিরাজার প্রাসাদের সম্মুখে গিয়া দ্বারপালকে কহিলেন, তোমার প্রভুকে সংবাদ দাও, মর্ত্যলোক হইতে রাজা বিক্রমাদিত্য তাহার দর্শনার্থ আসিয়াছেন। দ্বারী বলিরাজাকে সংবাদ কহিলে, বলিরাজা উত্তর করিলেন আমি নর লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিনা। দ্বাররক্ষক আসিয়া রাজা বিক্রমাদিত্যকে এই কথা বলিলে, তিনি বলিলেন আমি যেপর্যন্ত তাহার দর্শন না পাইব সেপর্য্যন্ত এস্থান হইতে প্রস্থান করিব না। দৌবারিক বলিরাজাকে এই কথা জানাইল। তিনি কহিলেন বিক্রমাদিত্য কে, দেবরাজ আসিলেও আমি তাহাকে দর্শন দিই না।

 এই প্রকার উত্তর করিয়া বলিরাজা দর্শন দিলেন না। রাজা বিক্রমাদিত্য কয়েক দিবস অপেক্ষা করিয়া, রাজদর্শনে নিরাশ হইয়া, আপনাকে ধিক্কার পূর্ব্বক আপন শিরচ্ছেদন করিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া বলিরাজার সভাস্থ সমস্ত লোক বলিলেন বিক্রমাদিত্য অতি অযুক্ত ও অনুচিত কর্ম্ম করিলেন। তখন বলিরাজা ভূতগণকে আজ্ঞা করিলেন অমৃত দ্বারা তাহার জীবন দান কর এবং তাহাকে বল এখন যাইয়া আপন রাজকার্য্য দেখুন, শিবরাত্রির দিবসে আসিলে দর্শন পাইবেন। এই আজ্ঞায়, বলিরাজার এক কিঙ্কর অমৃত লইয়া রাজা বিক্রমাদিত্যের অঙ্গে প্রোক্ষণ করিতে লাগিল। তাহাতে তিনি পুনর্জীবিত হইলে, তাহাকে রাজাজ্ঞা বিজ্ঞাপন করিল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন আমাকে একথা বলিয়া কেন প্রতারণা করিতেছ, আমি একথায় প্রত্যয় করিনা, আমি এখনি রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিব। ভূতগণ বলিরাজাকে, এই সমস্ত বিক্রমাদিত্যের বাক্য জানাইলে, বলিরাজা কোন উত্তর করিলেন না। রাজা বিক্রমাদিত্য বিলম্ব দেখিয়া পুনর্ব্বার আপনার শিরচ্ছেদন করিলেন। বলিরাজা পুনর্ব্বার ভূত দ্বারা অমৃত প্রেরণ করিলেন, এবং বলিলেন তাহকে বুঝাইয়া বল এখন প্রস্থান করুন। রাজদূত আসিয়া অমৃত দ্বারা তাহার জীবন দানপূর্ব্বক, রাজা জ্ঞাপন করিল। বিক্রমাদিত্য তাহা মানিলেন না।

 অনন্তর বলিরাজার মন্ত্রীগণ একবাক্যে বলি রাজাকে বলিলেন মহারাজ, বিক্রমাদিত্যকে নিরাশ করিওনা, কেননা তিনি অতিশয় সাহস প্রকাশ করিয়াছেন। মন্ত্রীগণের মন্ত্রণায় বলিরাজা সিংহাসন হইতে গাত্রোত্থানপূর্বক দ্বার দেশে আসিলেন। বিক্রমাদিত্য তাহার দর্শন পাইয়া কৃতাঞ্জলি পূর্বক কহিলেন মহারাজ, আমাকে ধন্য, আমার অদৃষ্টকে ধন্য, আপনাকে দর্শন করিয়া আমার জন্ম সার্থক হইল। কিন্তু মহারাজ, আমার কি অপরাধ হইয়াছিল যে আমাকে অগ্রে দর্শন দেন নাই, আমি কি সাহসী কিম্বা দাতা নহি। আমি এমত কি পাপ করিয়াছিলাম যে আমার প্রতি আপনি বিরূপ হইয়াছিলেন। বলিরাজা বলিলেন অহে বিক্রমাদিত্য তোমার তুল্য সদণশালী মনুষ্য পৃথিবীতে আর নাই, যথার্থ। কিন্তু তোমাকে যেজন্য দর্শন দিই নাই তাহার কারণ শুন, রাজা হরিশ্চন্দ্র অত্যন্ত দাতা ও সাহসী ছিলেন, এবং গজরাজাও দাতা ও প্রতাপশালী ছিলেন, তাহারা অনেক দান ও সাহস কর্ম্ম করিয়াছিলেন, ইহাতে তাহারা আমার দর্শন পায়েন নাই। তুমি হঠাৎ আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে এমত কি কর্ম্ম করিয়াছ, কিন্তু এক্ষণে তোমার অতি কঠোর তপস্যা দর্শন করিয়া তোমাকে দর্শন দিতে হইল।

 রাজা বিক্রমাদিত্য বিনয়পূর্ব্বক কহিলেন মহারাজ আপনি যাহা অজ্ঞা করিতেছেন, যথার্থ। আমি এক্ষণে বিলক্ষণ জানিতেপারিয়াছি আপনি আমাকে দর্শন দিয়া অনেক দয়া প্রকাশ করিলেন, এবং আপনার কৃপাতে আমি অবশ্যই ভবসাগরে পার পাইতে পারিব। বলিরাজা কহিলেন বিক্রমাদিত্য তুমি এইক্ষণে বিদায় হও, এবং আপন রাজ্যে গিয়া রাজকার্য কর। বিদায়ের কথায় রাজা বিক্রমাদিত্য বিমর্শ হইলেন। তাহাতে বলিরাজা এক রত্ন আনাইয়া তাহার হস্তে অর্পণ করিয়া বলিলেন তুমি এই রত্ন লও, ইহার স্থানে যখন যাহা যাচ ঞা করিবে তৎক্ষণাৎ তাহা পাইবে। বিক্রমাদিত্য ঐ রত্ন গ্রহণ পূর্ব্বক বলিরাজাকে প্রণাম করিয়া, বেতালের স্কন্ধারোহণে স্বীয় রাজধানীতে আসিলেন।

 রাজা রাজধানীর অনতিদুরে আসিয়া দেখিলেন এক ব্যক্তি পরলোক গমন করিয়াছে, তাহার ভার্য্যা শবদাহনপূর্ব্বক নদীতটে দণ্ডায়মানা বরাদনপরায়ণ। হইয়া এই কথা বলিতেছে, এইক্ষণে পৃথিবীতে আমার আর সহায় সম্পত্তি কিছুই নাই, আমি কি প্রকারে স্বামির শ্রাদ্ধাদি করিয়া শুদ্ধি প্রাপ্ত হইব। এবং কিপ্রকারেই বা উদরান্ন করিয়া জীবনকাল যাপন করিব। রাজা,নারীর এইরূপ অত্যন্ত খেদোক্তি শ্রবণে দয়াদ্রচিত্ত হইয়া, তাহাকে বলিরাজদত্ত রত্ন প্রদানপূর্বক বলিলেন তোমার যে বস্তু অভিলাষ হয়, এই রত্নের স্থানে চাহিলে তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত হইবে। এই কথায় নারী রত্ন লইয়া কৃতকৃতার্থ হইয়া নগরে গমন করিল। রাজাও আপন গৃহে আসিলেন।

 পুত্তলিকা কহিল হে ভোজরাজ, রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রকার সাহসী ও পরোপকারী ছিলেন। তুমি সবার স্বর্গ ভ্রমণ করিয়া আসিলেও, ততুল্য হইতে পারিবে না। অতএব তুমি এই দুরাশা পরিত্যাগ কর। রাজা বিক্রমাদিত্য যে যে অলৌকিক কর্ম্ম করিয়াছিলেন তাহ সমস্ত অবগত হও।

 এই সকল কথাতে সে দিবসের শুভক্ষণ অতীত হইল, রাজা সিংহাসনে বসিতে পারিলেননা। পরদিবস পুনর্ব্বার মন্ত্রীসমভিব্যাহারে সিংহাসন সমীপে আসিয়া উপস্থিত হইলে,