ভানুমতী দ্বাত্রিংশ পুত্তলিকা

কহিল, হে ভোজরাজ, আমি তোমাকে এক শেষ কথা বলিতেছি, মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ কর। রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হইলে তিনি ইন্দ্রলোকে গমন করিলেন, তাল বেতালও তাহার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্হিত হইল। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ত্রিলোকীমধ্যে এই জনরব হইল যে, পৃথিবীর আদিত্য রাজা বিক্রমাদিত্য ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন, সমুদয় পৃথিবী শোকান্ধকারে আচ্ছন্ন হইল, পৃথিবী হইতে ধর্মের ধ্বজা একবারে নিশূল হইল। রাজার মৃত্যু সংবাদে রাজ্যের আবাল বৃদ্ধ বনিতা তাবৎ প্রজা হাহাকার শব্দে রোদন করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, ভাট ভিখারীগণ উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে কহিতে লাগিল, হায়, যিনি আমাদিগকে আদর পূর্ব্বক প্রতিপালন করিতেন, যিনি আমাদিগের পিতা স্বরূপ সকল বিপদেই রক্ষা করিতেন, তিনি পৃথিবীহইতে একবারে অন্তহিত হইলেন। রাণীগণ রাজার সহগামিনী হইলেন। দাস দাসীগণ, এবং আর আর কর্মকর ও সৈন্য সামন্ত সকলে অনাথ হইয়া বোদন করিতে লাগিল। এই প্রকারে রাজ্যের মধ্যে মহাশোকধ্বনি উপস্থিত হইল।

 অনন্তর রাজমন্ত্রী, রাজপুত্র জৈতপালকে রাজা করিয়া তাহার হস্তে সমস্ত রাজ্যের ভারার্পণ করিলেন। জৈতপাল রাজা হইয়া এক দিবস এই সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছিলেন। উপবেশনমাত্র মূচ্ছাপন্ন ও জ্ঞানশূন্য হইলেন, এবং সেই মূচ্ছাবস্থাতেই স্বপ্ন দেখিলেন, রাজা বিক্রমাদিত্য তাহাকে বলিতেছেন, বৎস তুমি এক্ষণে এই সিংহাসনে উপবেশন করিও না, যদি কখন আমার সদৃশ সাহসী ও দাতা হইতে পার তবে এই সিংহাসনে বসিও। এইরূপ স্বপ্নে জৈতপালের জ্ঞানোদয় হইল। তখন তিনি সিংহাসন হইতে অবরোহণ করিয়া মন্ত্রীকে আদ্যোপান্ত স্বপ্নের সমস্ত বৃত্তান্ত কহিলেন। মন্ত্রী কহিলেন মহারাজ এক্ষণে এই সিংহাসনে উপবেশন না করিয়া, আমার এক নিবেদন শ্রবণ করুন, অদ্য রজনীতে আপনি শুদ্ধাচার হইয়া ভূমিশয্যায় শয়নপূর্বক মনের মধ্যে রাজাকে ধ্যান করিয়া নিদ্রাগত হউন।

 মন্ত্রীর পরামর্শানুসারে রাজা জৈতপাল ভূমিতে শয্যা করিয়া শয়ন করিলেন। নিদ্রাকর্ষণ হইলে স্বপ্ন দেখিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য তাহার সম্মুখে আসিয়া বলিতেছেন, হে বৎস তুমি উজ্জয়িনী ও ধারা নগর পরিত্যাগ করিয়া অবন্তীনগরে গিয়া রাজধানী স্থাপন কর, এবং এই সিংহাসন পৃথিবীগন্ত্রে সমর্পণ কর। রজনী প্রভাতা হইবামাত্র রাজা জৈতপাল গাত্রোধান করিয়া, লোেক দ্বারা মৃত্তিকা খনন পূর্ব্বক এই অপর্ব্ব সিংহাসন প্রােথিত করাইলেন। পরে আপনি অবন্তী নগরে রাজধানী স্থাপনপূর্বক তথায় রাজ্য করিতে লাগিলেন। তাহাতে ধারানগর ও উজ্জয়িনী নগর একবারে লােকশূন্য হইল, কিন্তু অবন্তীনগর, নানাদেশীয় ও নানাজাতীয় লােকে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

 পুত্তলিকা কহিল যিনি যে কর্মের যােগ্য নহেন তিনি সে কর্মে প্রবৃত্ত হইলে, কেবল যে কৃতকার্য্যই হইতে পারেন না এমত নহে, তাহাতে পৃথিবীতে অতিশয় অপযশও বিস্তীর্ণ হয়। পূর্ব্বকালের রাজাদিগের এই নিয়ম ছিল, যিনি যে কর্ম্মের যােগ্য তিনি তাহাই করিতেন। বর্তমান কালের বাজাদিগের সে বােধ নাই, ইহাদের যৎসামান্য প্রাধান্য ও যৎকিঞ্চিৎ সম্পত্তি লাভ হইলেই, প্রজাদিগকে প্রতিপালন করা দূরে থাকুক, অকিঞ্চিৎকর অর্থের জন্য তাহাদিগকে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ দেন। সাধু দিগকে রক্ষাকরা দূরে থাকুক, কোন প্রকার স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশে তাহাদিগকে অশেষবিধ ক্লেশ দিতেও পরাঙ্খ হয়েন না। এবং সত্যের প্রতি বিরত হইয়া কেবল মিথ্যা প্রতারণাতে অবিরত রত হয়েন। হে ভােজরাজ তােমার এতাদৃশ দোষ নাই, যথার্থ বটে, কিন্তু আপনার কতদূর পর্যন্ত ক্ষমতা, তাহা বিবেচনা না করিয়াই, আদিত্যতুল্য রাজা বিক্রমাদিত্যের ভুক্তপূর্ব্ব এই অপূর্ব্ব সিংহাসনে বসিবার বসনা কর,ইহা অতি অনুচিত কর্ম্ম, বলিতে হইবেক।

 পুত্তলিকার এই কথা শুনিয়া ভােজরাজসিংহাসনে উপবেশনের বাসনা একবারে পরিত্যাগ করিলেন, এবং অমানবদনে মন্ত্রীকে কহিলেন যেস্থান হইতে সিংহাসন উত্তোলন করা গিয়াছে, সেই স্থানেই ইহা অবিলম্বে পুনঃপ্রােথিত করাও। অনন্তর ভােজরাজ রাজ্যভােগে ঔদাস্থ্য ও অবহেলা করিয়া উদাসীন বেশে, তপস্যা করার্থ তীর্থ যাত্রায় নির্গত হইলেন। তাহার মন্ত্রীরাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন।

সমাপ্ত।