বাঁশী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
সেইদিন সন্ধ্যার পয়ই আমি চাকরের বেশে চক্রবেড়ে উপস্থিত হইলাম। জমীদার মহাশয়ের বাড়ী খুঁজিয়া লইতে আমার কিছু মাত্র বিলম্ব হইল না। দেখিলাম, বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও ত্রিতল সম্প্রতি মেরামত করা হইয়াছে। দরজার পার্শ্বে দুই দুইটী নহবৎ বসিয়াছে। বাড়ীর চাকরেরা লাল রঙ্গের কাপড় পরিয়া চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। কতকগুলি লোক আলো জ্বালিতে ব্যস্ত, কেহ বা আপনাপন আত্মীয় স্বজনের আহারের যোগাড় দেখিতেছে। কেহ আবার এই সুবিধা পাইয়া কোন যুবতী দাসীর সহিত রসালাপ করিতেছে।
দরজার সম্মুখে অনেক লোক জমায়েৎ হইয়াছিল। আমিও সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া চারিদিকে লক্ষ্য করিতেছি, এমন সময় আমার পরিচিত একজন চাকরকে দেখিতে পাইলাম। তাহাকে দেখিয়া আমার মনে আশা হইল। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিয়া অতি গোপনে সকল কথা প্রকাশ করিলাম।
লোকটার নাম ভোলা, বড় বিশ্বাসী। এক সময়ে সে আমারই বাসায় চাকরি করিত। কিন্তু জমীদার মহাশয়ের নিকট অধিক বেতন পাইবে আশা করিয়া, আমায় জানাইয়া, সে চাকরি ত্যাগ করে। কিন্তু তখন কোথায় চাকরি করিবে, সে কথা তখন তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করি নাই।
ভোলা নিকটে আসিলে আমি তাহাকে লইয়া এক নির্জন স্থানে যাইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভোলা, আমায় চিনতে পারিস?”
ভোলা হাসিয়া বলিল, “খুব পারি। আপনি যেমনই ছদ্মবেশ করুন না কেন, আমি আপনাকে নিশ্চয়ই চিনিতে পারি। আপনার নিকট এতকাল চাকরি করিয়াছি, আর আপনাকে ভুলিয়া যাইব! আমার নাম ভোলা বটে, কিন্তু আমি প্রায় কোন কথা ভুলি না। আমি ভোলার কথায় হাসিয়া ফেলিলাম। বলিলাম, “এখন আমার একটা উপকার করতে হইবে। পারবি?”
ভোলা আমার কথায় আশ্চর্য্য হইল। বলিল, “আপনি জমীদারের বাড়ীতে কি করিতে আসিয়াছেন?”
আ। সে কথা পরে জানতে পারবি। এখন আমার কথার উত্তর দে।
ভো। আপনার উপকার? নিশ্চয়ই পারিব। আপনার উপকার করিতে গিয়া যদি প্রাণবিনাশ হয়, সেও ভাল।
আ। তবে এক কাজ ক। আমাকে তোর মনিববাড়ীতে একটা চাকরি করে দে।
ভো। চাকুরি? আপনি কি চাকরি করিবেন? তা ছাড়া আমাদের মনিব যে গোঁয়ার, কোন দিন আপনাকে মারিয়া বসিবে।
আ। সে সকল কথা আমি জানি। এখন তোকে এই জমিদার-বাড়ীতে আমায় কোন চাকরি যোগাড় করে দিতে হবে?
ভো। আপনি কি চাকরি করিবেন?
অ। কেন? তোরা যা করি।
ভোলা হাসিয়া উঠিল। বলিল, “মহাশয় আমি এক সময়ে আপনার চাকর ছিলাম। আমার সহিত উপহাস করা ভাল দেখায় না।
আ। না ভোলা। আমি উপহাস করছি না। আমি কি কাজ করি, তুই কি জানিস্ না? আমার কাছ থেকে দু-দিন এসেই কি সব ভুলে গিয়াছিস? আমার কথা শুনিয়া ভোলা কি ভাবিল, পরে বলিল, “সেই জন্যই বুঝি আপনার এই বেশ? আচ্ছা, আমি এখনই সরকার মশাইকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। তাহার মুখে শুনিয়াছিলাম, জনকতক লোকের দরকার।”
আমি বলিলাম, “তবে যা একবার। যদি দরকার হয়, আমায় খবর দিস। আমি এইখানেই রহিলাম।”
ভোলা চলিয়া গেল। আমি সেইখানেই বেড়াইতে লাগিলাম। প্রায় আধঘণ্টার পর ভোলা হাসিতে হাসিতে আমার নিকট ফিরিয়া আসিল এবং আমাকে লইয়া জমীদার বাড়ী প্রবেশ করিল।
সরকার মহাশয় প্রবীণ লোক। তিনি আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। পরে ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভোলা! এ লোক তোর চেনা ত?”
ভোলা হাসিয়া উত্তর করিল, “আজ্ঞে হাঁ, আমরা একগায়ের লোক।”
সরকার মহাশয় বলিলেন, “লোকটীকে ভদ্রঘরের ছেলে বলিয়া বোধ হইতেছে। বাবুর যে রকম মেজাজ, তাতে এ যে এখানে থাকিতে পারিবে, এমন ত বোধ হয় না।”
ভোলাও খুব চালাক ছিল। সে বলিল, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন। এদের অবস্থা আগে খুব ভাল ছিল। সম্প্রতি দৈন্যদশায় পড়িয়া চাকরি করিতে আসিয়াছে।”
সরকার মহাশয় তখন আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি বাপু?”
আমি বললাম, “আমার নাম সদানন্দ।” স। জাতিতে?
আ। কায়স্থ।
স। লেখাপড়া জান? আ। যৎসামান্য।
স। তবে ভালই হইয়াছে। আপাততঃ বিবাহের কয়দিন এই কাজই কর। বিয়ের পর তোমায় ভাল কাজ দেওয়া যাইবে। এখন বাবুর মন রাখিতে পারিলে হয়।