বাঁশী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


 অমরেন্দ্র বাবুর মুখে সুধার ভগ্নীর মৃত্যুর কথা যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে বড়ই আশ্চর্য্য হইলাম। যখন পুলিস হঠাৎ মৃত্যুর কথা শুনিয়াছিল, তখন মৃতদেহ নিশ্চয়ই পরীক্ষা করা হইয়াছিল; এই স্থির করিয়া, অমরেন্দ্র বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ভাবী বধুমাতার ভগ্নীর মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া, ডাক্তার সাহেব কি বলিয়াছিলেন?”


 অমরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে সে কথা আমি বলিতে পারিলাম না। সুধা আমায় সে কথা বলে নাই; সম্ভবতঃ সে কিছু জানে না।”

 আমি দেখিলাম, সুধার সহিত এ বিষয়ে একবার কথা না কহিলে কোনরূপ সুবিধা করিতে পারিব না। অমরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার বেয়াদবী মাপ করিবেন। আমি একবার আপনার ভাবী পুত্রবধূর সহিত দেখা করিতে ইচ্ছা করি। কোনরূপ সুবিধা হইতে পারে?”

 অমরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “বিবাহের আগে সুধাকে আর এ বাড়ীতে আনা যায় না। তবে যদি —— আজ্ঞা হাঁ, সুধার সহিত দেখা হইবার সুবিধা করিতে পারি। সুধার মামী আমাদের দুরসম্পর্কের একজন আত্মীয়। তিনি এখন জোড়াসাঁকোয় আছেন। তিনি সুধাকে আইবড় ভাত খাওয়াইবার ছলে জোড়াসাঁকোয় আনিতে পারেন। আপনি সেখানে যাইলে আমি কৌশলে তাহাকে আপনার সাক্ষাতে আনিতে পারিব।”

 আমি হাসিয়া বলিলাম, “উত্তম পরামর্শ করিয়াছেন। কিন্তু অধিক বিলম্ব করিবেন না। আপনার পুত্রের বিবাহ কবে?”

 অ। আজ বুধবার আর বুধবারে।

 আ। তবে এখনও ছয়দিন দেরী।

 অ। আজ্ঞে হাঁ। বলেন ত আজই সুধাকে জোড়াসাঁকোয় আনাইবার চেষ্টা করি।

 অ। বেশ—তাহাই করুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিব। আপনি বেলা একটার সময় সংবাদ দিবেন।

 অমরেন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন। আমিও স্নানাহার সমাপন করিয়া হাতের কাজ সারিলাম। বেলা একটার কিছু পরেই অমরেন্দ্র পুনবার আমার বাসায় আসিলেন। বলিলেন, “সুধা আজই বেলা তিনটার সময় জোড়াসাঁকোয় আসিবে। সম্ভবত সে আজ সেই স্থানেই থাকিবে। আপনি যখন যাইতে ইচ্ছা করেন?”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সুধার খুড়া মহাশয় কিছু বলিলেন না?”

 অ। আজ্ঞে না, তবে তিনি বলিয়া দিয়াছেন যে, সুধাকে আজই ফিরিতে হইবে।

 আ। যিনি আনিতে গিয়াছিলেন, তিনি কি উত্তর করিলেন?

 অ। তিনি বলিয়াছেন, যদি অধিক বিলম্ব হয়, তাহা হইলে সে আজ ফিরিতে পারিবে না। সুধার খুড়া তাহার কথায় মনে মনে রাগান্বিত হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার কথার উপর বেশী কথা বলিতে সাহস করেন নাই॥

 আ। আমার বিশ্বাস, সুধাকে অজই যাইতে হইবে। যদি আপনারা স্ব-ইচ্ছায় না পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে তিনি স্বয়ং লোক পাঠাইয়া সুধাকে লইয়া যাইবেন।

 অ। আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে; কেন না, প্রাণকৃষ্ণ বাবু বড় কড়া লোক, তিনি যাহা বলেন তাহা করেন।

 আ। প্রাণকৃষ্ণ বাবুর বয়স কত?

 অ। বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর।

 আ। তাহাকে দেখিতে কিরূপ?

 অ। অত্যন্ত বলিষ্ঠ। এমন কি, প্রতিবেশীগণ তাহাকে অসুর বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকে।

 আ। তাহার চরিত্র?

 অ। নিতান্ত মন্দ নয়। কিন্তু বড় একগুয়ে। পল্লীর সকলেই তাহাকে ভয় করে। এক সময়ে তিনি এক প্রতিবেশীকে এমন আঘাত করেন যে, তাহার হাত ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সেই অবধি আর কোন লোক তাহার মতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলিতে সাহস করে না। এখন আপনি কখন যাইতে চান বলুন?

 আ। তবে চলুন, এখনই যাইতেছি। আপনার বৈবাহিক মহাশয় যেমন লোক শুনিতেছি, তাহাতে তিনি কখন আসিয়া পাকে লইয়া যাইবেন বলা যায় না।