বাঙ্গলা ব্যাকরণ/সমাস

সমাস।

 দুই বা ততোধিক পদের একপদীকরণকে সমাস কহে। সমাস করিলে মধ্য পদে বিভক্তি থাকে না। শেষ পদে বিভক্তি দিলেই হয়।

 যে যে শব্দের পরস্পর অন্বয় থাকে, তাহাদিগেরই সমাস হয়। যথা; রামের চরণে প্রণাম, এখানে রামের এই পদের সহিত চরণে এই পদের সমাস হইবে, প্রণাম পদের সহিত সমাস হইবে না; কেননা রাম পদের সহিত চরণ পদের যেরূপ সম্বন্ধরূপে অন্বয় আছে, প্রণাম পদের সেরূপ নাই; কিন্তু দ্বন্দ সমাসে ওরূপ অন্বয়ের আবশ্যকতা নাই।

 সমাস পাঁচ প্রকার[]; দ্বন্দ, বহুবীহি, কর্ম্মধারয়, তৎপুরুষ ও অব্যয়ীভাব।

দ্বন্দ্ব।

 বিশেষ্য পদগুলি স্ব স্ব প্রাধান্য রাখিয়া পরস্পর মিলিত হইলে দ্বন্দ্ব সমাস হয়। দ্বন্দ্ব সমাসে সমাস করিবার সময়ে, ও, এবং, ইত্যাদি সমুচ্চয়ার্থক শব্দ থাকে। যথা; ফল ও পুষ্প, ফলপুষ্প; পাপ ও পুণ্য, পাপপুণ্য; ধর্ম্ম ও অধর্ম্ম, ধর্ম্মাধর্ম্ম; শাল, তাল ও তমাল, শালতালতমাল।

 দ্বন্দ্ব সমাসে অল্প-স্বর যুক্ত পদ প্রায়ই পূর্ব্বে থাকে। যথা; শুক্রশোণিত; দৈত্যদানব; স্রক‍্চন্দন; দিনযামিনী।

 স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ দুই পদে দ্বন্দ্ব সমাস করিতে হইলে স্ত্রীলিঙ্গ পদকে প্রায় পূর্ব্বে রাখিতে হয়। যথা। স্ত্রীপুরুষ; দুর্গাশিব; কন্যাপুত্র ইত্যাদি।

 দ্বন্দ্ব সমাসে অপেক্ষাকৃত পূজ্য পদটি প্রায় প্রথমে থাকে। যথা, দেবাসুর; মাতাপিতা; ভীমার্জ্জুন ইত্যাদি।

 পুত্র শব্দ ও ঋকারান্ত শব্দ পরে থাকিলে দ্বন্দ্ব সমাসের পূর্ব্ববর্ত্তী ঋকারান্ত শব্দ প্রায়ই আকারান্ত হয়। যথা; পিতাপুত্র; মাতাপিতা; স্বসাভ্রাতা ইত্যাদি।

 দ্বন্দ্ব সমাসে পরস্থিত রাত্রি ও নিশা শব্দের স্থানে রাত্র ও নিশ আদেশ হয়। যথা; আহোরাত্র; অহর্নিশ।

বহুব্রীহি।

 যে দুই পদে সমাস করা যায়, তাহাকে না বুঝাইয়া সমস্ত পদটি যদি অন্য কোন পদকে বুঝায় ও তাহারই বিশেষণ হয়, তাহা হইলে ঐরূপ সমাসকে বহুব্রীহি কহে। বহুব্রীহি সমাসের পূর্ব্বপদ প্রায় বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য থাকে[]। অন্য কোন পদকে বুঝাইবার নিমিত্ত সমাস করিবার সময় কর্ত্তৃকারক ভিন্ন যদ্ শব্দের একটি[] পদ থাকে। যথা; দীর্ঘ শৃঙ্গ যার, সে দীর্ঘশৃঙ্গ। এখানে দীর্ঘশৃঙ্গ পদে দীর্ঘ-শৃঙ্গ মাত্রকে না বুঝাইয়া দীর্ঘ শৃঙ্গযুক্ত পশুকে বুঝাইল। শৃঙ্গ মাত্রকে বুঝাইলে কর্ম্মধারয় হইবেক। এইরূপ; পীত অম্বর যার, সে পীতাম্বর।

 বহুব্রীহি ও কর্ম্মধারয় সমাসে পূর্ব্বপদস্থিত মহৎ শব্দের স্থানে মহা হয়। যথা; মহৎ ধন যার, সে মহাধন; মহৎ বল যার, সে মহাবল।

 নিষেধার্থ ন শব্দের সহিত কোন শব্দের সমাস করিলে, পূর্ব্ববর্ত্তী ন স্থানে, স্বর বর্ণ পরে থাকিলে অন্ হয়, আর ব্যঞ্জন বর্ণ পরে থাকিলে অ হয়। যথা; ন অর্থাৎ নাই অন্ত যার, সে অনন্ত; নাই ব্যয় যার, সে অব্যয় ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি ও কর্ম্মধারয় সমাসে, পূর্ব্বপদ স্ত্রীলিঙ্গের বিশেষণ হইলে তাহা পুংলিঙ্গের ন্যায় হইয়া থাকে[]। যথা; তীক্ষ্ণা বুদ্ধি যার, সে তীক্ষ্ণবুদ্ধি; স্থিরা মতি যার, সে স্থিরমতি; স্বল্পা আকৃতি যার, সে স্বল্পাকৃতি; হতা শ্রী যার, সে হতশ্রী ইত্যাদি।

 অন্তেস্থিত স্ত্রীলিঙ্গ আকারান্ত শব্দ, বহুব্রীহি সমাসের পর যদি কোন পুংলিঙ্গ পদের বিশেষণ হয়, তবে অকারান্ত হইয়া থাকে[]। যথা; ভগ্না শাখা যার, সে ভগ্নশাখ; নির্ অর্থাৎ নাই দয়া যার, সে নির্দ্দয়। এইরূপ, নির্লজ্জ, নির্ঘৃণ ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি সমাসের পরপদ ঋকারান্ত বা স্ত্রীলিঙ্গ ঈকারান্ত শব্দ হইলে তাহার উত্তর ক প্রত্যয় হয়। যথা; মৃত পিতা যার, সে মৃতপিতৃক; দ্বি মাতা যার, সে দ্বিমাতৃক; দ্বি পত্নী যার, সে দ্বিপত্নীক ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি সমাসে পরস্থিত অস‍্ভাগান্ত শব্দ ও উপানৎ, হবিস্, দধি, মধু, শালি, নৌ, অর্থ ও পূর্ব্ব প্রভৃতি শব্দের উত্তর প্রায় ক প্রত্যয় হইয়া থাকে। যথা; বিশাল উরঃ যার সে বিশালোরস্ক; অন্য মনঃ যার, সে অন্যমনস্ক; পীত পয়ঃ যাহা কর্ত্তৃক, সে পীতপয়স্ক ইত্যাদি।

 সহ শব্দের সহিত বহুব্রীহি সমাস করিলে, সহ শব্দের স্থানে প্রায়ই স হয়। যথা; পত্নীর সহিত যে, সে সপত্নীক; জলের সহ যে, সে সজল; শঙ্কা সহ যে, সে সশঙ্ক ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি সমাসে পরস্থিত অক্ষি, সক‍্থি ও নাভি শব্দের ই স্থানে অ হয়। আর স্ত্রীলিঙ্গের বিশেষণ হইলে অক্ষি ও সক‍্থি শব্দ ঈকারান্ত হইয়া থাকে। যথা; বিশাল অক্ষি যার, সে বিশালাক্ষ; স্ত্রীলিঙ্গে বিশালাক্ষী। কমলের ন্যায় অক্ষি যার, সে কমলাক্ষ; স্ত্রীলিঙ্গে কমলাক্ষী। এইরূপ; দীর্ঘসক‍্থ, দীর্ঘসক‍্থী। পদ্ম নাভিতে যার, সে পদ্মনাভ। ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি সমাসের পরস্থিত ধর্ম্ম শব্দের উত্তর অন্ প্রত্যয় হয়। যথা; বিধর্ম্মা, সুধর্ম্মা ইত্যাদি।

 বহুব্রীহি সমাসে জায়া ও ধনুষ্ শব্দ স্থানে যথাক্রমে জানি ও ধন্বন্ আদেশ হয়। যথা; যুবতী জায়া যার, সে যুবজানি; পুষ্প ধনু যার, সে পুস্পধন্বা ইত্যাদি।

 দুই সজাতীয় বিশেষ্য পদেও কতকগুলি স্থানে বহুব্রীহি সমাস হয়। যখন একটি বস্তু লইয়া উভয়ে কোন কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তখন ঐ সজাতীয় দুই পদে বহুব্রীহি হইয়া থাকে। ঐ রূপ বহুব্রীহিতে পূর্ব্ব পদটি আকারান্ত ও পর পদটি ইকারান্ত হয়। যথা; লাঠি ও লাঠি লইয়া যে যুদ্ধ, তাহার নাম লাঠালাঠি; কেশ ও কেশ ধরিয়া যে যুদ্ধ, তাহার নাম কেশাকেশি। এইরূপ; চুলাচুলি, নখনখি, মারামারি, লেখালেখি। এইরূপ সমাসে বিশেষ্য পদটি প্রায়ই উহ্য থাকে। যথা; লাঠালাঠি করিতেছে অর্থাৎ লাঠালাঠি যুদ্ধ করিতেছে।

 কখন কখন দুই বিশেষ্য পদেও বহুব্রীহি সমাস হয়। ঐ দুই বিশেষ্য পদের মধ্যে একটি অধিকরণ থাকে[]। যথা; চূড়ায় চন্দ্র যার, সে চন্দ্রচূড়; ধর্ম্মে বৃত্তি যায়, সে ধর্ম্মবৃত্তি; শূল পাণিতে যার, সে শূলপাণি; কুশ হস্তে যার, সে কুশহস্ত ইত্যাদি।

 উপমানার্থ বিশেষ্য পদের সহিত অপর বিশেষ্য পদের বহুব্রীহি সমাস হয়। ঐরূপ সমাসে উপমান বোধক তুল্য সদৃশাদি শব্দ লুপ্ত থাকে। যথা; চন্দ্র তুল্য মুখ যার, সে চন্দ্রমুখ; পদ্ম সদৃশ বদন যার, সে পদ্মবদন। এইরূপ; উষ্ট্রমুখ ইত্যাদি।

কর্মধারয়।

 বিশেষ্য ও বিশেষণ পদের সমাসকে কর্ম্মধারয় কহে। কর্ম্মধারয় সমাসে বিশেষণ পদ পূর্ব্বে ও বিশেষ্য পদ পরে থাকে[]। বহুব্রীহি সমাস করিলে সমস্ত পদটি যেমন অন্যের বিশেষণ হয়, কর্ম্মধারয় সেরূপ হয় না। শুদ্ধ পরবর্ত্তী বিশেষ্য মাত্রকে বুঝায়। যথা; নীল উৎপল, নীলোৎপল; এখানে নীলবর্ণ উৎপল এই মাত্র বুঝাইল। যদি নীলোৎপল পদে নীলবর্ণ উৎপল আছে যাহার, তাহাকে বুঝাইত, তবেই বহুব্রীহি হইত।

 এক্ষণে বহুব্রীহি প্রকরণে কর্ম্মধারয়ের যে যে সূত্র আছে, তদনুসারে উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে। যথা; মহৎ ব্যাপার, মহাব্যাপার; মহতী কীর্ত্তি, মহাকীর্ত্তি; মহতী অষ্টমী, মহাষ্টমী; দীর্ঘা লতা, দীর্ঘলতা; স্থিরা বুদ্ধি, স্থিরবুদ্ধি ইত্যাদি।

 কখন কখন দুই বিশেষ্য পদেও কর্ম্মধারয় হয়। যেখানে প্রকৃতি বিকৃতি ঘটে, বা রূপক বর্ণনা হয়, অথবা উপমা বুঝায়, তথায় দুই বিশেষ্য পদেও কর্ম্মধারয় সমাস হইয়া থাকে[]। উহার পূর্ব্বপদটি তুল্য, রূপ বা সদৃশাদি শব্দ অর্ন্তভূত রাখিয়া বিশেষণবৎ হয়। ঐরূপ তুল্যাদি শব্দ নিয়তই লুপ্ত থাকে। যথা; শঙ্খ তুল্য ধবল, শঙ্খধবল; হৃদয় রূপ কপাট, হৃদয়কপাট; চন্দ্র সদৃশ মুখ, চন্দ্রমুখ ইত্যাদি।

 যদি দুই বিশেষণ পদে কর্ম্মধারয় করিতে হয়, তবে পরপদের বিশেষ্য ভাবকল্পনা করিতে হইবে এবং পূর্ব্বপদটি পরবর্ত্তী বিশেষণেরই বিশেষণ হইয়া থাকিবে। যথা; পরম জ্ঞানী, পরমজ্ঞানী; মহান্ মান্য, মহামান্য; মহান্ ধনী, মহাধনী ইত্যাদি।

 কর্ম্মধারয় সমাস হইলে কোন কোন স্থলে মধ্যপদের লোপ হয়। যথা; ঘৃত মিশ্র অন্ন, ঘৃতান্ন; ফল মিশ্র অন্ন, ফলান্ন; হস্ত্যারূঢ় সৈন্য, হস্তিসৈন্য; চতুর্ অধিক দাশ, চতুর্দ্দশ ইত্যাদি।

 কর্মধারয় সমাসে সংখ্যাবাচক পদের পরস্থিত অধিক শব্দের লোপ হয়। আর দশ, বিংশতি বা ত্রিংশৎ শব্দ পরে থাকিলে দ্বি, ত্রি ও অষ্ট শব্দ স্থানে যথাক্রমে দ্বা, ত্রয়ঃ ও অষ্টা আদেশ হয়। যথা; দ্বি অধিক দশ, দ্বাদশ; ত্রি অধিক দশ, ত্রয়োদশ; অষ্ট অধিক দশ, অষ্টাদশ। এইরূপ; দ্বাবিংশতি, ত্রয়োবিংশতি, অষ্টাবিংশতি ইত্যাদি।

 চত্বারিংশৎ, পঞ্চাশৎ, যষ্টি, সপ্ততি ও নবতি শব্দ পরে থাকিলে কর্ম্মধারয় সমাসে দ্বি, ত্রি ও অষ্ট শব্দ স্থানে যথাক্রমে বিকল্পে দ্বা, ত্রয়ঃ ও অষ্টা আদেশ হয়। যথা; দ্বি অধিক চত্বারিংশৎ দ্বাচত্বারিংশৎ, দ্বিচত্বারিংশৎ; ত্রি অধিক চত্বারিংশৎ এয়শ্চত্বারিংশৎ, ত্রিচত্বারিংশৎ; অষ্ট অধিক চত্বারিংশৎ অষ্টাচত্বারিংশৎ, অষ্টচত্বারিংশৎ ইত্যাদি। অন্যত্র যথা; দ্ব্যশীতি, ত্র্যশীতি, অষ্টাশীতি।

 একাধিক দশ, একাদশ, যট্ অধিক দশ, ষোড়শ এই দুই পদ নিয়মের বহির্ভূত।

 কর্ম্মধারয় ও তৎপুরুষ সমাসে পরস্থিত অহন্ ও রাজন্ শব্দের নকারের লোপ হয়। যথা; দীর্ঘ অহন্, দীর্ঘাহ; মহান্ রাজা, মহারাজ; পর্ব্বের অহন্, পর্ব্বাহঃ; দেবের রাজা, দেবরাজ।

 সর্ব্ব শব্দ, সংখ্যাবাচক শব্দ, এক এক ভাগবাচক শব্দ ও অব্যয় শব্দের পর অহন্ শব্দ থাকিলে কর্ম্মধারয় সমাসে তাহার স্থানে অহ্ন[] আদেশ হয়। যথা সর্ব্ব অহন্, সর্ব্বাহ্ণ; পূর্ব্ব অহন্, পূর্ব্বাহ্ণ; মধ্য অহন্, মধ্যাহ্ন; সায় অহন্, সায়াহ্ন প্র অহন, প্রাহ্ণ ইত্যাদি।

 সর্ব্ব শব্দ, এক এক ভাগ বোধক ও সংখ্যাবাচক শব্দের উত্তর আর পুণ্য ও বর্ষা শব্দের উত্তর রাত্রি শব্দ থাকিলে কর্ম্মধারয় ও তৎপুরুষ সমাসে রাত্রির ই স্থানে অ হয়। যথা; সর্ব্বা রাত্রি, সর্ব্বরাত্র; পূর্ব্বা রাত্রি, পূর্ব্ব রাত্র; অপরা রাত্রি, অপররাত্র; পুণ্যা রাত্রি, পুণ্যরাত্র; ত্রি রাত্রি, ত্রিরাত্র; পঞ্চ রাত্রি, পঞ্চরাত্র ইত্যাদি।

 কর্ম্মধারয় সমাসে সংখ্যাবাচক শব্দের উত্তর অঙ্গুলি শব্দের ই স্থানে অ হয়, আর অঞ্জলি শব্দের ই স্থানে বিকল্পে অ হয়। যথা; পঞ্চ অঙ্গুলি, পঞ্চাঙ্গুল; দ্বি অঙ্গুলি, দ্ব্যঙ্গুল। দ্বি অঞ্জলি দ্ব্যঞ্জল, দ্ব্যঞ্জলি।

 সংখ্যাবাচক পদ পূর্ব্বে রাখিয়া যে কর্ম্মধারয় সমাস করা যায়, তাহাতে কখন কখন ঐক্য বুঝায় এবং কোন কোন সমস্ত পদটি ঈকারান্ত হয়। যথা, ত্রি লোকের ঐক্য, ত্রিলোকী। এই রূপ; চৌপদী।

তৎপুরুষ।

সাধারণ নিয়ম।

 নির্, অতি প্রভৃতি কতকগুলি উপসর্গের সহিত সমাস করিলে ঐ সকল উপসর্গ পদ পূর্ব্বে যায়। যথা; বেলা উৎক্রান্ত, উদ্বেল; রাজাকে অতিক্রান্ত অতিরাজ; নিদ্রা হইতে উত্থিত, উন্নিদ্র ইত্যাদি।

 তৎপুরুষ পাঁচ প্রকার। দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, পঞ্চমী, ষষ্ঠী ও সপ্তমী, এই কয় প্রকার তৎপুরুষ আছে।

 যেখানে দ্বিতীয়ান্ত পদ পূর্ব্বে থাকে, সেই খানে প্রায় দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। তৎ পুরুষ সমাসের পর পদ, হয় বিশেষ্য না হয় বিশেষণ থাকে। যথা; হর্ষকে প্রাপ্ত, হর্ষপ্রাপ্ত; দুর্গা আশ্রিত, দুর্গাশ্রিত; দেবকে দত্ত, দেবদত্ত[১০]; আত্মাকে সমর্পিত, আত্মসমর্পিত ইত্যাদি।

 পূর্ব্বপদে তৃতীয়া থাকিলে, তৃতীয়। তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা; ধন দ্বারা ক্রীত, ধনক্রীত; বাক্য দ্বারা দত্ত, বাক্যদও; তৎকর্ত্তৃক কৃত, তৎকৃত; গজ কর্ত্তৃক ভুক্ত, গজভুক্ত।

 ঊনার্থ শব্দ পরে থাকিলে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা; একোন, গর্ব্বশূন্য, বিদ্যাহীন, পিতৃতুল্য, মাতৃসদৃশ ইত্যাদি।

 যদি পূর্ব্বপদ পঞ্চমী থাকে, তাহা হইলে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা; মুখ হইতে ভ্রষ্ট, মুখভ্রষ্ট; সিংহাসন হইতে চ্যুত, সিংহাসনচ্যুত; হস্ত হইতে পতিত, হস্তপতিত; শীত হইতে ভীত, শীতভীত ইত্যাদি।

 যেখানে পূর্ব্বপদে ষষ্ঠী থাকে, তথায় ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হইবেক। যথা; রাজার পুত্র, রাজপুত্র; কর্মের ফল, কর্ম্মফল; বৃক্ষের তল, বৃক্ষতল; বর্ষার রাত্রি, বর্যারাত্র; গুরুর উপদেশ, গুরূপদেশ।

 অণ্ড প্রভৃতি শব্দ পরে থাকিলে তৎপুরুষ সমাসে কতকগুলি স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পুংলিঙ্গ হয়। যথা; হংসীর অণ্ড, হংসাণ্ড; কুক্কুটীর শাবক, কুক্কুটশাবক; ছাগীর দুগ্ধ, ছাগদুগ্ধ।

 তৎপুরুষ সমাসে দাস শব্দ পরে থাকিলে দেবী ও কালী শব্দ ইকারান্ত হয়। যথা; দেবিদাস, কালিদাস।

 সহার্থ ও তুল্যার্থ শব্দের সহিত পূর্ব্বপদের ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়[১১] যথা; পত্নীর সহ, পত্নীসহ, ভ্রাতার তুল্য, ভ্রাতৃতুল্য; আমার সদৃশ, মৎসদৃশ।

 পূর্ব্বপদে সপ্তমী থাকিলে[১২] সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা; বনে চর, বনচর; ভোগে আসক্ত, ভোগাসক্ত; দুষ্ক্রিয়ায় রত, দুষ্ক্রিয়ারত; নরকে পতিত, নরকপতিত; অশ্বে আরূঢ়, অশ্বারূঢ়; মাসে গম্য, মাসগম্য; করে স্থিত, করস্থিত ইত্যাদি।

 প্র, পরা প্রভৃতি উপসর্গের সহিত ধাতুর যে সমাস হয়, উহাকে নিত্য সমাস কহে। নিত্য-সমাস যথা; উপ-কৃ, উপকৃ; অনু-ভূ, অনুভূ ইত্যাদি।

 কৃৎ প্রত্যয় করিবার সময় ধাতুর পূর্ব্বে যে সমুদায় পদ থাকে তাহাকে উপপদ বলে। উপপদের সহিত কৃদন্ত পদের যে সমাস[১৩] হয়, তাহার নাম উপপদ সমাস। যথা: কুম্ভকার, আশুগ ইত্যাদি।

অব্যয়ীভাব।

 যদি অব্যয় পদ পূর্ব্বে থাকে, অথচ সেই অব্যয় দ্বারা কোন কারক, বীপ্সা, সামীপ্য, পর্যন্ত, যোগ্যতা, অনতিক্রম, পশ্চাৎ বা অভাব ইত্যাদির অন্যতম কোন অর্থ বুঝায়, তাহা হইলে অব্যয়ীভাব সমাস হয়। ক্রমশঃ উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে।

 কারকার্থ যথা;—আত্মকে অধি অর্থাৎ অধিকার করিয়া, এই অর্থে অধ্যাত্ম,[১৪] এখানে অধি উপসর্গ দ্বারা আত্মার কর্ম্ম কারকের অর্থ বুঝাইল।

 বীপ্সার্থ যথা—দিনে দিনে, প্রতিদিন; এখানে প্রতিশব্দ দ্বারা দিনের বীপ্সা অর্থাৎ পৌনঃপুন্য বুঝাইল। এইরূপ; জনে জনে, প্রতিজন; গৃহে গৃহে, প্রতিগৃহ; ক্ষণে ক্ষণে অনুক্ষণ।

 সামীপ্য যথা;—কুলের সমীপে, উপকূল; বনের সমীপে, উপবন।

 পর্যন্ত যথা;—সমুদ্র পর্যন্ত, আসমুদ্র; ব্রহ্ম পর্যন্ত, আব্রহ্ম।

 যোগ্যতা যথা;—রূপের যোগ্য, অনুরূপ। গুণের যোগ্য, অনুগুণ। এইরূপ; প্রতিমূর্ত্তি, প্রতিরূপ ইত্যাদি।

 অনতিক্রম যথা;—শক্তি অতিক্রম না করিয়া, যথাশক্তি। এইরূপ; যথাযোগ্য; যথাসাধ্য।

 পশ্চাদর্থ যথা;—রথের পশ্চাৎ, অনুরথ; পদের পশ্চাৎ, অনুপদ।

 অভাব যথা;—পাপের অভাব, অপাপ; বিঘ্নের অভাব, অবিঘ্ন; ধর্মের অভাব, অধর্ম্ম; মক্ষিকার অভাব, নির্ম্মক্ষিক ইত্যাদি।

 প্রতি, পর ও সম্ শব্দের পর অক্ষি শব্দ অকারান্ত হইয়া থাকে এবং পর শব্দের স্থানে পরো আদেশ হয়। যথা; অক্ষির প্রতি, প্রত্যক্ষ; অক্ষির পর, পরোক্ষ; অক্ষির সমীপে সমক্ষ।

সাধারণ লক্ষণ।

 সমাসের পূর্ব্বপদ ন‍্কারান্ত হইলে তাহার ন্ লুপ্ত হয়। আত্মন‍্-কৃত; আত্মকৃত; রাজ‍্নপুত্র, রাজপুত্র; গুণিন্-জন, গুণিজন ইত্যাদি।

 সমাসে দ্বি ও অন্তর্ শব্দের পরস্থিত অপ্ শব্দ স্থানে ঈপ হয়। যথা; দ্বি-অপ, দ্বীপ; অন্তর্-অপ্, অন্তরীপ।

 ক, খ, ত, থ, প, ফ ও স পরে থাকিলে সমাসের পূর্ব্বপদ দান্ত হইলে দ্ স্থানে ৎ হয়। যথা; তদ্-কাল, তৎকাল; বিপদ্-পাত, বিপৎ-পাত ইত্যাদি।

 সমাসের পরপদস্থ পথিন্ শব্দ স্থানে পথ হয়। যথা; চতুষ‍্পথ, রাজপথ, বিপথ ইত্যাদি।

 সম্, অব ও অন্ধ শব্দের উত্তর তমস্ শব্দ থাকিলে সমাসে তাহার উত্তর অ প্রত্যয় হয়। যথা; সন্তমস, অবতমস, অন্ধতমস।

 সু, উৎ, সুরভি ও পূতি শব্দের পরস্থিত গন্ধ শব্দের উত্তর সমাসে ই প্রত্যয় হয়। কিন্তু উপমানবাচক পদের উত্তরস্থিত গন্ধশব্দের উত্তর বিকল্পে ই প্রত্যয় হয়। যথা; সুগন্ধি, উদ্গন্ধি, সুরভিগন্ধি, পূতিগন্ধি। উপমান যথা; পদ্মের ন্যায় গন্ধ যার, এই অর্থে পদ্মগন্ধি, পদ্মগন্ধ। এইরূপ; ঘৃতগন্ধি, ঘৃতগন্ধ ইত্যাদি।

 সমাসের পূর্ব্বপদস্থ কু[১৫] শব্দের পর স্বরবর্ণ থাকিলে কু শব্দ স্থানে কৎ হয়, কিন্তু পুরুষ ও পথ শব্দ পরে থাকিলে উহার স্থানে বিকল্পে কা হয়। যথা; কু-অন্ন, কদন্ন; কুআচার, কদাচার; কু-উষ্ণ; কদুষ্ণ; কু-অগ্নি, কদগ্নি। কু-পুরুষ, কাপুরুষ, কুপুরুষ; কু-পথ, কাপথ, কুপথ।

 জ্যোতিঃ, জনপদ, রাত্রি, নাভি, বন্ধু, গন্ধ, পিণ্ড, কুক্ষি, বেণী, ব্রহ্মচারী, তীর্থ, পত্নী ও পক্ষ শব্দ পরে থাকিলে সমাসে সমান শব্দ স্থানে স হয়। সমান জ্যোতিঃ যার, সে সজ্যোতিঃ। এইরূপ; সকুক্ষি, সনাভি, সবন্ধু, সগন্ধ, সপিণ্ড, সপক্ষ, সতীর্থ ইত্যাদি।

 রূপ, নাম, গোত্র, স্থান, বর্ণ, বয়ঃ, বচন, উদর, ধর্ম্ম ও জাতীয় শব্দ করে থাকিলে সমান শব্দ স্থানে বিকল্পে স হয়। যথা; সমান। রূপ যার, সে সমানরূপ, সরূপ। এইরূপ; সমানবর্ণ, সবর্ণ; সমানধর্ম্ম, সধর্ম্ম; সমানজাতীয়, সজাতীয় ইত্যাদি।

 সমাসের পূর্ব্ব পদ যুষ্মদ্ বা অস্মদ্ শব্দ থাকিলে তাহার স্থানে একবচন স্থলে যথাক্রমে ত্বং ও মৎ হয়। যথা; তোমার কৃত, ত্বৎকৃত; আমার পুত্র, মৎপুত্র; আমাকে দত্ত, মদ্দত্ত ইত্যাদি।

 বিরল প্রচলিত সমাসান্ত প্রত্যয়গুলি। পরিত্যক্ত হইল।

নিম্নলিখিত পদগুলিতে কি কি সমাস আছে, স্থির কর।

 প্রচণ্ডরবিকিরণ, নির্ব্বাতপ্রদেশ, তদাগমন, অনুদিন, পদ্মাক্ষ, বিকসিতকমলাবলীসুশোভিতসরোবর, বাষ‍্পাকুললোচন, শোভাকৃষ্ট, যশঃপ্রকাশিতদিঙ্মণ্ডল, নক্ষত্রচন্দ্রাতপশোভিত, আত্মপ্রতিরূপ, স্কন্ধারূঢ়, তরুণরুণচ্ছবি, শীতভীতনর, অঞ্জনশূন্য, লতাপ্রবাল, স্বর্ণময়সিংহাসনস্থ, দেবদত্ত, প্রভাবভীত, স্বধনদান, ত্রিযুগ, বিনিদ্র, দেবসেবাপরায়ণ, জ্ঞানালোকনিরাকৃতান্ধতমস, জিগীষাহতবুদ্ধিবৃত্তি।


  1. সংখ্যাবাচক বিশেষণ পদ পূর্ব্বে থাকিলেও কর্ম্মধারয় সমাস হইয়া থাকে। যথা; সপ্তর্ষি ইত্যাদি। ঐরূপ; ত্রিভুবন, ত্রিরাত্র ইত্যাদি স্থলেও কর্ম্মধারয় সমাস করাই ভাল। বাঙ্গলা ভাষায় ঐ স্থলে দ্বিগু সমাস স্বীকার করায় গৌরব ভিন্ন লাঘব নাই। দশহাতথান ইত্যাদি তদ্ধিতার্থ দ্বিগু সমাসকে বহুব্রীহির অন্তর্ভূত করিলেই হইবে।
  2. প্রিয় প্রভৃতি কতকগুলি বিশেষণ শব্দ কখন কখন পরে থাকে। যথা; গুড় প্রিয় যার, সে গুড়প্রিয়।
  3. ক্রিয়াব্যতীহারে ও সহ শব্দের সহিত ষে বহুব্রীহি হয়, কেবল তাহাতেই কর্ত্তৃকারক যৎ পদ থাকিবেক।
  4. জাতি, সংজ্ঞা ও অবয়ব বাচক স্ত্রীলিঙ্গ ঈকারান্ত শব্দ এবং মৎ, বৎ ও বিন্ প্রত্যয়ান্ত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পূর্ব্বপদ থাকিলে বঙ্গভাষায় সমাস করিয়া তাহাদিগকে পুংলিঙ্গের ন্যায় করা, রীতি নাই। যথা; সুমুখী-বনিতা, গুণবতী-কন্যা ইত্যাদি।
  5. প্রজা ও মেধা শব্দের উত্তর কখন কখন একটি স হয়। যথা; সুপ্রজাঃ, সুমেধাঃ।
  6. অধিকরণ পদটি প্রায় পূর্ব্বেই থাকে। কিন্তু অঙ্গবাচক পদের সহিত সমাস করিতে হইলে অধিকরণ পদকে প্রায়ই পরে রাখিতে হয়।
  7. কদাচিৎ যুব প্রভৃতি বিশেষণ পদ পরেও থাকে। যথা; ব্রাহ্মণযুবা, তাপসবৃদ্ধ ইত্যাদি।
  8. ইহাকেই উপমিতি ও রূপক সমাস কহে।
  9. ঐক্য বুঝাইলে সংখ্যাবাচক পদের পর অহ্ন আদেশ হয় না। যথা; দশাহ, দ্বাদশাহ।
  10. এই স্থলে পূর্ব্বপদ সম্প্রদান কারক বলিয়া সংস্কৃত ভাষায় উহাকে চতুর্থী তৎপুরুষ বলে। কিন্তু বঙ্গ ভাষায়: সম্প্রদান কর্ম্মর মধ্যে নিবিষ্ট বলিয়া উহাকে দ্বিতীয়া তুৎপুরুষ বলা গেল।
  11. সহার্থ ও তুলার্থ শব্দের যোগে সংস্কৃত ভাষায় তৃতীয় বিভক্তি বিহিত আছে, তদনুসারে ঐ স্থলে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। কিন্তু বঙ্গ ভাষায় যষ্ঠীর অর্থই প্রচলিত বলিয়া ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসই সঙ্গত।
  12. কখন কখন যষ্ঠী ও সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসে পূর্ব্বপদ সংস্কৃত বিভক্তি যুক্ত থাকিয়াই মিলিত হয়। যথা; ভ্রাতুষ্পুত্র, বাচস্পতি, খেচর, সরসিজ ইত্যাদি।
  13. উপপদ সমাসে দ্বিতীয়া তৃতীয়া প্রভৃতি তৎপুরুষের লক্ষণ দৃষ্ট হয়, সুতরাং উহাকে তৎপুরুষ সমাস বলাই উচিত।
  14. অব্যয়ীভাব সমাসে পরস্থিত অন‍্ভাগান্ত শব্দের ন‍্কারের লোপ হয়।
  15. অগ্নি ও উষ্ণ শব্দ পরে থাকিলে কু স্থানে কা ও কর আদেশও হইয়া থাকে। যথা; কোষ্ণ, কবোষ্ণ। আর অক্ষি শব্দ পরে থাকিলে উহার স্থানে কা আদেশ হয়। যুথু; কাক্ষ।