বিদায় ভোজ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 কথায় কথায় রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। আর বিলম্ব না করিয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম; এবং শকট আনীত হইলে দুই বন্ধুতে মিলিয়া তাহাতে আরোহণ করিলাম।

 অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই রামবাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সুশীলের বাড়ীখানি দ্বিতল ও নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। বাড়ীর দরজায় গাড়ীখানি স্থির হইলে আমরা উভয়েই অবতরণ করিলাম। পরে কোচমানকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিয়া সুশীলের সহিত ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

 ইতিপূর্ব্বে আমি অনেকবার সুশীলের বাড়ী গিয়াছিলাম। সুশীলের মাতাঠাকুরাণী আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন। সুতরাং অন্দরে প্রবেশ করিতে আমার কিছুমাত্র লজ্জা বোধ হইল না।

 সুশীল আমাকে লইয়া একেবারে তাহার মাতাঠাকুরাণীর গৃহে প্রবেশ করিল। সুশীলের মাতা তখন সেই ঘরেই ছিলেন, আমাকে দেখিবামাত্র এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আসিয়াছ বাবা! বড়ই বিপদে পড়িয়াছি—তুমি বিপদের কাণ্ডারী।”

 আমিও দুঃখিতভাবে বলিলাম, “আজ্ঞে আমি সুশীলের মুখে সকল কথাই শুনিয়াছি। কিন্তু যখন সকলেই আপনাদের আত্মীয়, তখন আংটীটা বোধ হয় কোথাও পড়িয়া গিয়া থাকিবে।”

 সুশীলের মাতাঠাকুরাণী বলিলেন, “আমরা সকলেই ত তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াছি, কিন্তু কই, আংটীত পাওয়া গেল না।”

 আ। কি রকম আংটী?

 সুশীল নিকটেই ছিল। সে বলিল, “দেখিতে তেমন দামী বলিয়া বোধ হয় না। তবে আংটীর উপরে একটী ক্ষুদ্র ঘড়ী আছে। ঘড়ীটা এত ছোট যে, দেখিয়া সহজে সময় স্থির করা যায় না। দূরবীণ দিয়া না দেখিলে ঘড়ীর দাগগুলি জানিতে পারা যায় না। ঘড়ীর দুই পার্শ্বে দুইখানি বড় বড় হীরক আছে। হীরক দুইখানির দাম অনেক বলিয়া বোধ হইল।”

 আমি তখন সুশীলের মাতাঠাকুরাণীর দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন স্থানে বসিয়া আপনারা আংটীটী দেখিয়াছিলেন?”

 সু-মা। ভিতরের দালানে।

 আ। তখন সেখানে কতগুলি লোক ছিলেন?

 সু-মা। প্রায় কুড়িজন।

 আ। সকলেই কি স্ত্রীলোক?

 সু-মা। না—চারিজন মাত্র পুরুষ ছিলেন।

 আ। সকলেই কি গৃহে ফিরিয়া গিয়াছেন?

 সু-মা। যাহার আংটী সে গিয়াছে আর আমার বেয়ান ও বেহাই কাশী যাত্রা করিয়াছেন। আর সকলেই আছেন।

 আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, তাঁহারা নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিয়াছিলেন, এখনও গৃহে প্রত্যাগমন করেন নাই কেন? কিন্তু মুখে কোন কথা বলিলাম না।

 আমাকে নীরব দেখিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী আমার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন। তিনি বলিলেন, “এই আংটীর গোলযোগ না মিটিলে তাঁরা এ বাড়ী ছাড়িতে চান না। আমি অনেক অনুরোধ করিয়াছি কিন্তু কেহই আমার কথা গ্রাহ্য করিতেছেন না।”

 আ। আপনার বেয়ান কি আর বাড়ী ফিরিয়া যান নাই? আপনাদের বাড়ী হইতেই কি তীর্থ যাত্রা করিয়াছেন?

 সু-মা। এই রূপই কথা ছিল। তাঁহারা উভয়েই প্রস্তুত হইয়া এখানে আসিয়াছিলেন।

 আ। তাঁহারা কি আর ফিরিবেন না?

 সু-মা। সে কথা ঠিক জানি না বাবা! তাঁহাদের কথা তােমার অগােচর নাই। তাঁহারা আমার সহিত এতদিন যেমন ব্যবহার করিয়া আসিতেছিলেন, তাহাও তােমার অবিদিত নাই। সরলার মুখে শুনিলাম, তাঁহারা সকল তীর্থ ভ্রমণ করিবেন। কবে ফিরিবেন তাহার স্থিরতা নাই। সেই জন্যই নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম।

 আর কোন প্রশ্ন না করিয়া আমি সুশীলের সহিত ভিতরের দালানে গমন করিলাম; এবং উভয়ে মিলিয়া দুই তিনজন ভৃত্যের সাহায্যে সমস্ত স্থান ভাল করিয়া অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু আংটীটীর কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না।

 সে রাত্রে আর বৃথা পরিশ্রম করিতে ইচ্ছা হইল না। সুশীলকেও তাহা বলিলাম এবং উভয়ে মিলিয়া পুনরায় তাঁহার মাতাঠাকুরাণীর গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। আমাদিগকে দেখিয়াই তিনি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বাবা, আংটীটা পাও নাই?”

 আমি কিছু সলজ্জভাবে উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে না—কিন্তু রাত্রিকালে অন্বেষণের সুবিধা হয় না। বিশেষতঃ আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে। কাল অতি প্রত্যুষে আমি পুনরায় এখানে আসিয়া ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিব।”  সুশীলের মাতা আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি বলিলেন, “এখন তােমারই ভরসা বাবা! তুমি আর সুশীল এক আত্মা বলিলেও হয়। সুশীলের বিপদ আপদে তুমি না দেখিলে আর কে দেখিবে বাবা। কিন্তু আংটীটা কি আর ফিরিয়া পাইব?”

 আমি বলিলাম, “সে কথা এখন বলিতে পারিলাম না। তবে যাহাতে উহাকে বাহির করিতে পারি, সেজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব।”

 এই বলিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম এবং সুশীলের হাত ধরিয়া বাড়ীর সদর দরজায় আগমন করিলাম। পরে সেই শকটে আরোহণ করিয়া সুশীলকে চুপি চুপি বলিলাম, “যাহাতে আর কোন লোক এখান হইতে না যাইতে পারে, তাহার উপায় করিও। সকলের মনের কথা জানা যায় না। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আংটীটা কোথাও না কোথাও পড়িয়া আছে। কিন্তু যদি বাস্তবিক তাহা হয়, তাহা হইলে একবার প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা না করিয়া কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা হইবে না।”

 আমার শেষ কথা শুনিয়া সুশীল জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি তুমি এ সংবাদ তোমার ডায়েরিতে লিখিয়া রাখিবে?”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “আজ রাত্রে আর লিখিব না। কাল প্রাতে অন্বেষণ করিয়াও যদি উহা বাহির করিতে না পারি, তাহা হইলে বুঝিব যে, কোন লোক নিশ্চয়ই আংটীটী চুরি করিয়াছে! চোরকে কোনরূপে প্রশ্রয় দিতে নাই।”

 কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া সুশীল বলিল, “তুমি ঠিক বলিয়াছ। চোর যাহাতে শাস্তি পায় তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু দেখিও, বিনাদোষে যেন কোন লোক উৎপীড়িত না হয়।”

 “সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাক” এই বলিয়া আমি কোচমানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। সুশীল বিদায় লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। কোচমানও শকট চালনা করিল।