বিদায় ভোজ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 সে রাত্রে আর কোন কাজ না করিয়া আহারাদি সমাপন করতঃ বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। পরদিন দৈনিক কার্য্য শেষ করিতে অনেক সময় অতিবাহিত হইল। সেদিন একটা খুনি মোকদ্দমা ছিল। যখন আদালত হইতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা চারিটা বাজিয়াছিল।

 থানায় আসিয়া আমি ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং প্রথমেই বড়বাজারের একখানি সামান্য পোদ্দারের দোকানের নিকট কোন নিভৃত স্থানে দাঁড়াইয়া রহিলাম কত শত লোক আপন আপন কার্য্যে ব্যস্ত হইয়া সেই সঙ্কীর্ণ পথে যাতায়াত করিতেছিল। কেহ বা স্বর্ণ ক্রয় করিতেছে, কেহ বা কোন পুরাতন অলঙ্কার বিক্রয় করিবার জন্য এক দোকান হইতে অপর দোকানে গমনাগমন করিতেছে, কেহ বা আবার কোন গহনা বন্দক রাখিয়া টাকা কর্জ্জ করিতে আসিয়াছে। আমি অতি মনোযোগের সহিত ঐ সকল ব্যাপার অবলোকন করিতেছিলাম।

 প্রায় একঘণ্টা কাল এইরূপ অতীত হইলে আমি যে দোকানের নিকট দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেই দোকানের নিকট একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। যদিও গ্রীষ্মের প্রকোপে গাত্রে বস্ত্র রাখা কষ্টকর বোধ হইতেছিল, তত্রাপি তাহার সর্ব্বাঙ্গে একখানি গরম কাপড় আবৃত। তাহার পরিচ্ছদ দেখিয়া সহজেই বোধ হইল যে, তাহার পিতৃ বা মাতৃদায় উপস্থিত। তাহার পরিধানে একখানি নূতন সাদাধুতি, গাত্রে একখানি ময়লা পুরাতন শাল, গলায় কাচা, পায়ে জুতা ছিল না। হাতে একখানা পশমী আসন। লোকটীর বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাহাকে দেখিতে হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। তাহার বর্ণ গৌর, মুখশ্রী নিতান্ত মন্দ নয়। লোকটী আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত।

 দুই একবার সেই দোকানের সম্মুখে পায়চারি করিয়া লোকটী দোকানের ভিতরে প্রবেশ করিল। আমার কেমন কৌতূহল জন্মিল; আমি দূরে থাকিয়া তাহার কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু কি দোকানদার, কি সেই লোকটী কেহই আমার উপর কোন প্রকার সন্দেহ করিল না।

 আমি দূর হইতে দেখিলাম, আগন্তুক কোন দ্রব্য বিক্রয় করিতে তথায় উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সেই জিনিষটী আমি দেখিতে পাইলাম না। কিছুক্ষণ পরে দোকানদার গাত্রোত্থান করিলেন এবং দোকান হইতে বাহির হইয়া পরবর্ত্তি আর একখানি দোকানে প্রবেশ করিলেন। আমি যেখানে দাঁড়াইয়াছিলাম, সেখান হইতে অপর দোকানখানি ভালরূপ দেখা যায় না দেখিয়া, একটু সরিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, পূর্ব্বোক্ত দোকানদার অপর দোকানদারকে কি দেখাইতেছেন। দ্বিতীয় দোকানের অধিকারীকে ব্যগ্রদৃষ্টিতে তাহা অবলোকন করিতে দেখিয়া এবং তাঁহাকে বিস্মিত দেখিয়া আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইল। আমি তখনই একটা অছিলা করিয়া সেই দোকানে প্রবেশ করিলাম।

 যে দোকানে প্রবেশ করিলাম, তাহার অধিকারী তখনই আমায় সম্ভাষণ করিয়া তথায় যাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি প্রস্তুত ছিলাম, তখনই পকেট হইতে ঘড়ি ও চেন বাহির করিয়া বলিলাম, “আপনারা এই দুইটী দ্রব্য ক্রয় করিবেন?”

 দোকানদার দুই একবার দেখিয়া বলিলেন, “আমরা এরূপ ঘড়ী ক্রয় করি না। তবে চেন ছড়া বিক্রয় করেন ত লইতে পারি।” ঘড়ী বা চেন বিক্রয় করা আমার অভিপ্রেত ছিল না। যখন দেখিলাম, সেখান হইতে প্রস্থান করিবার বেশ সুবিধা হইয়াছে, তখন আমিও আর কালবিলম্ব করিলাম না। বলিলাম, “না বাপু; কেবল চেন বিক্রয় করিবার জন্য আমি এখানে আসি নাই। যদি ঘড়ী ও চেন দুইটীই ক্রয় করেন তাহা হইলে আমি সম্মত আছি, নচেৎ চলিলাম।”

 এই বলিয়া উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে পূর্ব্বোক্ত দোকানদারের হস্তে যাহা ছিল, তাহাও দেখিয়া লইলাম। তাঁহার হাতে একটী আংটী ছিল।

 আংটী দেখিয়া আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। সেখান হইতে নড়িতে ইচ্ছা হইল না দোকানদারও আমার কথার উত্তর দিতে বিলম্ব করিতে লাগিল দেখিয়া আমি যেন বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বলেন, ঘড়ীটী কিনিবেন কি?

 দোকানদার বলিলেন, “ও সকল সামান্য জিনিষ আমরা কিনি না। ঘড়ীটা যদি দামী হইত, তাহা হইলেও কথা ছিল। অল্পদামের পুরাতন ঘড়ী কিনিলে প্রায়ই ঠকিতে হয়।”

 বাধা দিয়া আমি বলিলাম, “না দেখিয়া ঘড়ীর নিন্দা করেন কেন? ঘড়ীটা রূপার বটে, কিন্তু কম দামের নহে। ইহা বিলাতী রদারহামের, ইহার দাম ষাইট্‌ টাকার কম নহে। যদি লওয়া হয় বলুন, নচেৎ অন্য চেষ্টা দেখি।”

 দোকানদার হাসিয়া উত্তর করিলেন, “রাগ করেন কেন মহাশয়! ষাট সত্তর টাকার ঘড়ী কি আর ঘড়ী, পাঁচশতটাকার ঘড়ী হয়, তাহা হইলে আমরা ক্রয় করিতে পারি। রদারহামই বলুন, আর যাহাই বলুন, দু-এক শতটাকার ঘড়ী আমরা কিনি না।”

 আমার কেমন ক্রোধ হইল। আমি সহ্য করিতে পারিলাম না। কর্কশ স্বরে বলিলাম, “যাহারা একটা সামান্য আংটী ক্রয় করিবার জন্য সাত দোকান ঘু্রিয়া বেড়ায়, তাহাদের মুখে অমন কথা শোভা পায় না।”

 দোকানদার আমার কথায় হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আপনি কি মনে করিয়াছেন, এই আংটীটা সামান্য! দেখুন দেখি, এমন আংটী আপনি জীবনে আর কখন দেখিয়াছেন কি না?”

 এই বলিয়া তিনি আমার হাতে সেই আংটীটী প্রদান করিলেন। আমি দৃষ্টিগোচর করিবামাত্র চমকিত হইলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে যুগপৎ আনন্দিত—বিস্মিত হইলাম! আংটীটার উপরে একটা অতি ক্ষুদ্র ঘড়ী! ঘড়ীর কাঁটাগুলি এত ক্ষুদ্র যে, চর্মচক্ষের অগোচর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

 আমি বলিলাম, “না বাপু! এমন ঘড়ীবসান আংটী আমি ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দৃষ্টিগোচর করি নাই। আংটীটার দাম কত?”

 দো। আমার বোধ হয় হাজার টাকা।

 আ। এ রকম জিনিষ বোধ আর কখনও আপনাদের হাতে আইসে নাই?

 দোকানদার হাসিয়া বলিলেন, “কেন আসিবে না? আপনি দেখেন নাই, বলিয়া যে আর কোন লোক দেখে নাই, এরূপ মনে করিবেন না। আরও পাঁচ-ছয়বার এইরূপ আংটী আমাদের হাতে আসিয়াছিল। সেগুলির দাম আরও বেশী, কেন না, সেই ঘড়ীগুলিতে অনেকগুলি করিয়া দামী প্রস্তর ছিল।”

 পোদ্দারের কথা শুনিয়া আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম। কহিলাম, আপনি যাহার নিকট হইতে এই আংটী পাইয়াছেন সে ভিতরে, এখন চলুন, আমি তাহাকে গ্রেপ্তার করিব।

 এই আংটী দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে, ইহা চোরাদ্রব্য, আমি ইহারই অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি। এই বলিয়া আমি সেই দোকানদারের সহিত তাহার দোকানের ভিতর গমন করিলাম এবং তখনই তাহাকে ধৃত করিয়া নিকটবর্ত্তী একজন প্রহরীকে ডাকাইয়া তাহার জিম্মা করিয়া দিলাম। অনন্তর সে কোথায় থাকে তাহা জানিবার নিমিত্ত তাহাকে লইয়া তাহার বাসা অভিমুখে গমন করিলাম। লোকটী ক্রমে জোড়াবাগানের একটী ক্ষুদ্র মাঠ গুদামে প্রবেশ করিল।