বিদায় ভোজ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


 রাত্রি প্রায় আটটা বাজিয়াছিল। আকাশ মেঘশূন্য, অসংখ্য তারকা সেই সুনীল অম্বরে থাকিয়া আপন আপন ক্ষীণ জ্যোতি বিকীরণ করিতেছিল। মলয় পবন রাজপথের ধূলি-কণাগুলিকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া জনগণের মনে অশান্তির উদ্রেক করিতেছিল।

 যে বাড়ীর ভিতর আমরা প্রবেশ করিলাম, তাহা ভদ্রলোকের আবাস বলিয়া বোধ হইল না। সেই মাঠ কোটার বারান্দায় তিন চারিজন যুবতী সাজ সজ্জা করিয়া এক একটী টুলের উপর উপবিষ্ট রহিয়াছে।

 আমি তাহার গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরখানি অতি ক্ষুদ্র। ভিতরে বিশেষ কোন আসবাব নাই। একখানি ভাঙ্গা তক্তপোষ, তাহার উপর একটা ছিন্ন মাদুর, তদুপরি একটা বালিস। তক্তপোষের অপর পার্শ্বে একটা টিনের ট্রাঙ্ক। বাহ্যিক অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, লোকটী বিদেশী; দুই একদিনের জন্য তথায় আসিয়া বাস করিতেছে।

 গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া আমি সেই তক্তপোষের উপর উপবেশন করিলাম। পরে অতি নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কতদিন এখানে আসিয়াছ?”

 লোকটী কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে আমি বিদেশী লোক?”

 আমি হাসিয়া বলিলাম, “ঘরের অবস্থা দেখিয়া আমি পূর্ব্বেই ঐ প্রকার অনুমান করিয়াছি। তোমার আদি নিবাস কোথায়? আর নামই বা কি?”

 লোকটী বলিল, “আমার নাম ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষাল, নিবাস বরিশাল জেলায়। সম্প্রতি বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছি।”

 আ। এই আংটী কাহার এবং তুমি উহা কোথায় পাইলে?

 ব্র। উহা আমারই কোন আত্মীয়ের। তিনি উহা বিক্রয় করিবার জন্য আমাকে দিয়াছিলেন।

 আ। তিনি থাকেন কোথায়?

 ব্র। নিকটেই—আহিরীটোলায়।

 আ। আংটীটা দামী, যাঁহারা ওরূপ আংটী ব্যবহার করেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই ধনবান লোক। তাঁহাদের যে চাকর, সরকার ইত্যাদি লোক নাই, তাহা ত বিশ্বাস হয় না। সে সকল লোক সত্ত্বেও তোমাকে দিয়া উহা বিক্রয় করিবার আবশ্যকতা কি?

 ব্র। তাহা আমি বলিতে পারি না, আমার সহিত বিশেষ আলাপ পরিচয় আছে, সেই বিশ্বাসেই তিনি আমাকে বিক্রয় করিতে দিয়াছিলেন।

 আমি। ঐ আংটীটা কাহার, জানিতে আমার বড় ইচ্ছা; তাই তোমার আত্মীয়ের নিবাস জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। আমাকে সেখানে লইয়া চল।

 ব্রজেন্দ্র প্রথমে অনেক আপত্য করিল, কিন্তু আমি কিছুতেই ছাড়িলাম না। অবশেষে আমাকে লইয়া বাড়ীর বাহির হইল এবং নিকটস্থ একখানি দ্বিতল অট্টালিকাতে প্রবেশ করিল।

 বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াই বুঝিলাম, সেখানি হোটেল, দশ পনের জন লোক তথায় বাস করিতেছে। ব্রজেন্দ্র আমাকে দ্বিতলে লইয়া গেল। পরে একটী গৃহের ভিতরে প্রবেশ করিল এবং একজনকে দেখাইয়া দিল।

 ব্রজেন্দ্র যাহাকে দেখাইয়া দিল, তাহাকে দেখিয়া আমি চমকিত হইলাম। লোকটা আমার পরিচিত—একজন দাগী চোর। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমি তখন ছদ্মবেশে ছিলাম বলিয়া সে আমাকে চিনিতে পারিল না। আমিও অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একেবারে তাহাকে গ্রেপ্তার করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই আংটী তুমি ব্রজেন্দ্রকে বিক্রয় করিতে দিয়াছিলে?

 লোকটার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর, দেখিতে বেশ সুপুরুষ। বাহ্যিক অবয়ব দেখিলে সকলে তাহাকে ধনবান বলিয়া মনে করিয়া থাকে। আমার কথায় সে উত্তর দিবার পূর্ব্বেই ব্রজেন্দ্র উপযাচক হইয়া বলিল, ইহারই আংটী—উপযুক্ত মূল্য দিলেই আংটীটা কিনিতে পারিবেন।

 আমি। তোমার নাম কি?

 সে বলিল, “আমার নাম বসন্তকুমার দত্ত।”

 আ। আংটীটা কোথায় পাইয়াছিলে?

 ব। বিবাহের যৌতুক স্বরূপ পাইয়াছিলাম।

 আমি তখন বসন্তের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আংটীটা কোথায় পাইয়াছ যদি সত্য করিয়া বল, তাহা হইলে তোমায় এ যাত্রা মুক্তি দিতে পারি। আমি তোমায় পূর্ব্বেই চিনিতে পারিয়াছি। তােমার প্রকৃত নাম রজনীকান্ত। সেদিন একটা ঘড়ী চুরি করিয়া ছয়মাস জেল খাটিয়াছ। আবার এত শীঘ্রই যে নিজ ব্যবসা আরম্ভ করিবে, তাহা স্বপ্নেও জানিতাম না।”

 আমার কথা শুনিয়া রজনীকান্ত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “আপনারা না পারেন এমন কার্য্যই নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোন অপরাধ নাই। আংটীটা যিনি বিক্রয় করিতে দিয়াছেন, তিনি আমার পরিচিত, আমি আপনাকে তাঁহার নিকটে লইয়া যাইতেছি।”

 আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কি এই বাসায় আছেন?”

 ব। আজ্ঞে না, তিনি এই পার্শ্বের বাড়ীতে আছেন। আমাকে ছাড়িয়া দিলে আমি এখনই তাঁহাকে এখানে হাজির করিতে পারি।

 আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম, “এখনও যদি আমার চক্ষে ধূলি দিবার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে তাহা ত্যাগ কর। লােকটার নাম বলিয়া দাও, আমি তােমার নাম করিয়া তাঁহাকে ডাকাইতে পাঠাইতেছি।”

 রজনীকান্ত অগত্যা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। সে সেই বাসার দাসীকে দিয়া লােকটাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন।

 কিছুক্ষণের পর দাসী একজন প্রৌঢ়কে লইয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হইল। প্রৌঢ়কে দেখিবামাত্র আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। পূর্ব্বে তাঁহাকে আরও দুই চারিবার দেখিয়াছিলাম সুতরাং আমার ভ্রম হইবার কোন কারণ ছিল না।

 প্রৌঢ়কে কোন প্রশ্ন না করিয়া তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য সেই কনষ্টেবলকে আদেশ করিলাম, অবিলম্বে তাঁহার হস্তে বলয় ভূষিত হইল।

 সুশীলের ভগ্নীর শ্বশুরই যে ঐ আংটী সরাইয়াছিলেন, তাহা আমার বেশ ধারণা হইয়াছিল। এখন আমার অনুমান সত্যে পরিণত হইল দেখিয়া আন্তরিক প্রীত হইলাম। পরে প্রৌঢ়ের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “এ বয়সেও আপনি লোভ সম্বরণ করিতে পারেন নাই। আপনি যে উহা আপনার পুত্রের শ্বশুরালয় হইতে চুরি করিয়া আনিয়াছেন, তাহা আমি পূর্ব্বেই ভাবিয়াছিলাম। কেন এ কাজ করিলেন?”

 প্রৌঢ় কোন উত্তর করিলেন না, কিন্তু আমার কথায় কোনও প্রতিবাদ করিলেন না। তাহার দুই চক্ষু দিয়া অনর্গল বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমাকে কি চিনিতে পারেন নাই?”

 প্রৌঢ় কাঁদিতে কাঁদিতে উত্তর করিলেন, “বেশ চিনিয়াছি। আপনি পুলিশ-কর্ম্মচারী তাহা জানি, আর সুশীল বাবুর সহিত আপনার যে অত্যন্ত সদ্ভাব আছে, তাহাও জানি। কিন্তু কি করিব, ‘স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী’, এক স্ত্রীলোকের পরামর্শে আমি ইহ ও পরকাল নষ্ট করিয়াছি এবং শেষ বয়সে জেলে পচিতে যাইতেছি। আপনার যাহা ইচ্ছা করুন, আমায় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না।”

 অগত্যা সেই প্রৌঢ়, ব্রজেন্দ্র ও বসন্ত এই তিনজনকে থানায় চালান দিলাম। সকলেই আপন আপন দোষ স্বীকার করিল, কেবল প্রৌঢ় তাঁহার স্ত্রীর নাম উল্লেখ করিলেন না। কাজেই তিনি বাঁচিয়া গেলেন। বিচারে প্রৌঢ়ের এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হইল। অপর দুইজন নিষ্কৃতি পাইল।

 যথাসময়ে আমি আংটীটা সুশীলের মাতাকে ফেরৎ দিলাম। তিনি আমায় যৎপরোনাস্তি আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন।

সমাপ্ত।

(চিত্র)


চৈত্র মাসের সংখ্যা

“জোড়া পাপী”

যন্ত্রস্থ।