বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/সরকারী কর্ম্ম হইতে অবসরগ্রহণ

সরকারী কর্ম্ম হইতে অবসরগ্রহণ

 শিক্ষা বিভাগের কর্ম্মচারিরূপে বিদ্যাসাগর অসাধারণ উৎসাহ এবং বিচক্ষণতার সহিত তাঁহার কাজ সুসম্পন্ন করিয়াছিলেন। বঙ্গদেশে সংস্কৃত-শিক্ষার সংস্কার, বাংলা-শিক্ষার ভিত্তিস্থাপন এবং স্ত্রীশিক্ষার বহুল বিস্তার তাঁহার কাজ। তাঁহার কার্য্যদক্ষতা বিষয়ে উপরিওয়ালারা সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ ছিলেন। সুতরাং সকলেই আশা করিয়াছিল, প্র্যাট সাহেব ছুটি লইয়া বিলাতাযাত্রা করায় দক্ষিণ-বাংলার ইন্‌স্পেষ্টার অফ স্কুলের শূন্যপদে বিদ্যাসাগরই নিযুক্ত হইবেন। বস্তুতঃ ছোটলাট হ্যালিডের সহিত পণ্ডিতের এ সম্বন্ধে কিছু কথাবার্ত্তাও হইয়াছিল। নিম্নলিখিত পত্রাংশ হইতে তাহা জানা যাইবে:—

“গত শনিবার যখন আপনার সহিত দেখা করিয়া দক্ষিণ-বাংলার ইন্‌স্পেক্টার নিয়োগ সম্বন্ধে দু-একটা কথা বলিবার অনুমতি প্রার্থনা করি, আপনি তখন অনুগ্রহ করিয়া এ বিষয়ে একখানি লিখিত পত্র দাখিল করিবার আদেশ দিয়াছিলেন। তদনুসারে আমি বিনীতভাবে প্রস্তাব করিতেছি,—যদি আপনি আমাকে ঐ পদে বাহাল করিতে ইচ্ছুক হন, তাহা হইলে সংস্কৃত কলেজে আমার পদে যাঁহাকে আনা হইবে, তাঁহার নিয়োগ সম্বন্ধে আমার সহিত যেন পরামর্শ করা হয়, কেন-না যেসকল ব্যক্তির মধ্য হইতে নির্ব্বাচন হইবে, তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষরূপ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে বলিয়াই, আমার মনে হয়, কে ঐ পদের উপযুক্ত সে সম্বন্ধে আমিই ঠিক কথা বলিতে পারিব। আর সরকারী ইংরেজী কলেজ ও স্কুল থাকার দরুণ বিভাগটি আমার হাতে দেওয়া যদি যুক্তিসিদ্ধ বলিয়া বিবেচিত না হয়, তাহা হইলে আমার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ, অস্তুতঃ যে-জেলায় মডেল স্কুল আছে— যেমন মেদিনীপুর বর্দ্ধমান নদীয়া, সেই জেলাগুলি যেন আমার হাতে দেওয়া হয়; কলেজ ও স্কুলগুলি বিভাগীয় ইন্‌স্পেক্টারের অধীন থাকিলে আর কোনো অসুবিধা হইবে না।” (মে, ১৮৫৭)

 এই চিঠি হস্তগত হইবার পুর্ব্বেই হ্যালিডে এপ্রিল মাসে লজ সাহেবকে ঐ শূন্যপদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর ইহাতে একান্ত নিরাশ হইলেন। তাঁহার প্রতি সুবিচার করা হয় নাই, তাঁহার পদোন্নতির ন্যায্য দাবি বার বার উপেক্ষিত হইয়াছে, ইহাই তাঁহার মনে হইতে লাগিল। শিক্ষা বিভাগের নুতন ডিরেক্টর—গর্ডন ইয়ং নামক এক অনভিজ্ঞ যুবক সিভিলিয়ান তাহাঁর কাজে উৎসাহের পরিবর্ত্তে নানা বাধা দিয়া আসিতেছেন, এজন্য তিনি পূর্ব্ব হইতেই বিরক্ত হইয়াছিলেন। অবশ্য ছোটলাট হ্যালিডের মধ্যস্থতায় বিবাদের কতকগুলি কারণ দূরীকৃত হইয়াছিল। সরকারী শিক্ষা বিভাগের কাজে তাঁহার যে পদোন্নতি হইয়াছে, একজন কালা কর্ম্মচারীর পক্ষে তাহার অধিক আশা করা বিড়ম্বনা,—বিদ্যাসাগরের এই দৃঢ় ধারণা জন্মিল। তিনি সরকারী কর্ম্ম হইতে অবিলম্বে অবসর লইবেন স্থির করিলেন, এবং ডিরেক্টরকে জানাইলেন,—

আপনি তিন মাসের জন্য শহর ত্যাগ করিয়া যাইতেছেন জানিয়া আমি মনে করিলাম, সরকারী কর্ম্ম হইতে শীঘ্র অবসর গ্রহণ করিবার যে সঙ্কল্প করিয়াছি তাহা আপনাকে জ্ঞাত করাইবার ইহাই প্রকৃত সুযোগ। এই সঙ্কল্পের মূলে যে-সকল কারণ আছে তাহা ব্যক্তিগত—সাধারণের সহিত তাহার কোনো সম্বন্ধ নাই, সুতরাং সেগুলি বিবৃত করিতে বিরত হইলাম।” (২৯ আগষ্ট, ১৮৫৭)

হ্যালিডেও যাহাতে এই সংবাদ জানিতে পারেন, তজ্জন্য বিদ্যাসাগর তাঁহাকেও এই পত্রের এক প্রতিলিপি পাঠাইলেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্কল্পের কথা পাঠ করিয়া হ্যালিডে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে লিখিলেন,—

প্রিয় পণ্ডিত, তোমার অভিপ্রায় অবগত হইয়া আমি সত্যসত্যই অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি। বৃহস্পতিবার আমার সহিত দেখা করিতে আসিবে এবং জানাইবে কেন তুমি এ সঙ্কল্প করিয়াছ।” (৩১ আগষ্ট)

 দক্ষ কর্ম্মচারীরা কাজ ছাড়িয়া দেয়, ইহা হ্যালিডের কাছে কখনই রুচিকর ছিল না। তিনি পণ্ডিতকে হঠাৎ কিছু না-করিতে অনুরোধ করিলেন। বিদ্যাসাগরও সম্মত হইলেন। যদিও তাঁহার ইচ্ছা ছিল না, তবুও তিনি আর এক বৎসর ঐ পদে কাজ করিতে লাগিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ভাঙিতে শুরু হওয়ায় তিনি ১৮৫৮, ৫ই আগষ্ট তারিখে ডিরেক্টরের কাছে কর্ম্মত্যাগপত্র পাঠাইলেন,—

সরকারী কর্তব্যপালনে অবিরত মানসিক পরিশ্রম করিতে হইয়াছে। তাহাতে আমার এমন গুরুতর স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছে যে বাংলার ছোটলাট বাহাদুরের নিকট আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করিতে বাধ্য হইলাম।
“আমি মনে করি, আমার কর্তব্যপালনে যে অবিশ্রান্ত মনোযোগের প্রয়োজন, তাহা আমি আর দিতে পারি না। আমার বিশ্রামের দরকার। সাধারণের স্বার্থের খাতিরে এবং নিজের সুখস্বাচ্ছ্যন্দ্যের প্রয়োজনে সরকারী কাজ হইতে অবসরগ্রহণ করিলে সেই বিশ্রাম পাইতে পারি।
“যে মুহূর্তে স্বাস্থ্য পুনরায় ফিরিয়া পাইব, আমার ইচ্ছা তন্মুহূর্ত হইতে আমার সময় এবং চেষ্টা প্রয়োজনীয় বাংলা পুস্তক প্রণয়নে এবং সঙ্কলনে নিয়োগ করিব। স্বদেশবাসীর শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তার সম্পর্কে সরকারী কর্ম্মের সহিত আমার সাক্ষাৎ যোগ ছিন্ন হইয়া যাইতেছে সত্য, তবুও আমার অবশিষ্ট জীবন এই মহৎ এবং পবিত্র কর্ম্মের অনুষ্ঠানেই ব্যয়িত হইবে। এবিষয়ে আমার গভীর ও আন্তরিক অনুরাগ কেবল আমার জীবনের সহিত অবসানলাভ করিতে পারে।
“এরূপ গুরুতর পন্থা অবলম্বন করিবার গৌণ হেতুগুলির মধ্যে দুইটি এই, ভবিষ্যৎ উন্নতির আর কোনো আশা নাই; এবং কর্তব্যপরায়ণ বিভাগীয় কর্ম্মচারিগণের পক্ষে যে-সহানুভূতি বাঞ্ছনীয়, বর্ত্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থার সহিত আমার সেই ব্যক্তিগত সহানুভুতির অভাব।
“প্রথম কারণটি সম্পর্কে কথা এই,—বর্ত্তমান পদের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ অল্প শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমে সময়ের সদ্ব্যবহার করিতে পারিব। অস্বীকার করিতে পারি না, যে-ব্যক্তি এতদিন পর্য্যন্ত আপন পরিবারবর্গের ভবিষ্যৎ গ্রাসাচ্ছাদনের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থাই করিয়া উঠতে পারে নাই, তাহার পক্ষে এরূপ ভাবা অন্যায় নহে। এই পরিশ্রমিসাধ্য গুরুকর্ত্তব্যের সশ্রব হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে বিলম্ব করিলে ভগ্নস্বাস্থ্যবশে সেরূপ সংস্থান করাও আর চলিবে না।
“দ্বিতীয় কারণ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য,—আমি মনে করি সরকারের স্কন্ধে আমার মতামত চাপাইবার অধিকার নাই। তবুও, কর্ম্মের সহিত আমার হৃদয়ের যোগ নাই—যাঁহাদের চাকরি করি তাঁহাদের নিকট হইতে এ সত্য গোপন করিতে চাই না। এ কারণে আমার কর্ম্মকুশলতার অবশ্য হানি হইবে। বিবেকবুদ্ধিপরায়ণ সহকারী কর্ম্মচারীর পক্ষে সদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত হইয়া কাজ করা এক প্রধান গুণ। এইরূপ সদুদ্দেশ্যেরে বশবর্ত্তী হইয়া ইহা অপেক্ষা অল্পও বলিতে পারি না—অধিক বলিতে ইচ্ছুক নই।”
“আমার ক্ষুদ্রশক্তি অনুযায়ী যতদূর সম্ভব উৎসাহসহকারে কর্ত্তব্যপালন করিয়াছি, এই তৃপ্তি হৃদয়ে লইয়া আমি অবসর গ্রহণ করিতেছি। আশা করি, সরকার চিরদিন আমার প্রতি যে অবিচলিত অনুগ্রহ, বিবেচনা এবং স্নেহ প্রকাশ করিয়া আসিয়াছেন তজ্জন্য আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা নিবেদন ধৃষ্টতা বলিয়া বিবেচিত হইবে না।”

 শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর বিদ্যাসাগরের পদত্যাগপত্র অনুমোদন করিয়া, মঞ্জুরীর জন্য সরকারের কাছে পাঠাইলেন।

 অনেকেই বলিয়া থাকেন, বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত ব্যাপারে ডিরেক্টরের সহিত বিরোধের ফলেই বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেন। কিন্তু হ্যালিডেকে লিখিত বিদ্যাসাগরের একখানি আধা-সরকারী পত্রে প্রকৃত কারণগুলি প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। বিদ্যাসাগর লিখিতেছেন,—

“বিশেষ চিন্তা করিয়া দেখিলাম আমার পদত্যাগপত্রের যে-অংশগুলি আপনার কাছে আপত্তিকর ঠেকিয়াছে, সঙ্গতি বা ঔচিত্যের দিক দিয়া সে-অংশগুলি আমি উঠাইয়া লইতে পারি না। শারীরিক অসুস্থতা আমার পদত্যাগের একটি প্রধান কারণ বটে, কিন্তু বিবেকধর্ম্মানুসারে বলিতে গেলে ইহাকে একমাত্র কারণ বলিতে পারি না। তাহাই যদি হইত, তাহা হইলে দীর্ঘ অবসর গ্রহণ করিয়া আমি স্বাস্থ্যের উন্নতি করিতে পারিতাম। বর্ত্তমান অবস্থায় সরকারী চাকরি করা যে আমার পক্ষে অনেক সময় অপ্রীতিকর এবং অসুবিধাজনক বোধ হইয়াছে, এবং যে-ব্যবস্থার উপর নির্ভর করিয়া বাংলার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চলিতেছে, তাহা যে অর্থের অপব্যয় হইতেছে মাত্র—এ-সব কথা আপনাকে বহুবার বলিয়াছি। আপনি জানেন, আমি অনেক সময় কাজে বাধা পাইয়াছি। এ ছাড়া, দেখিয়াছি পদোন্নতির আর কোনো আশা নাই, কারণ আমার ন্যায্য দাবি একাধিকবার উপেক্ষিত হইয়াছে। অতএব আমি আশা করি, আপনি স্বীকার করিবেন, আমার অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।” (১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৮)

 ডিরেক্টরের অনুমোদন গ্রাহ্য করিয়া বাংলা-সরকার মন্তব্য প্রকাশ করিলেন,—

“পণ্ডিত মহাশয় যে কিঞ্চিৎ অসুষ্ঠুভাবে অবসর গ্রহণ করা সঙ্গত বিবেচনা করিলেন ইহা দুঃখের বিষয়, বিশেষতঃ তাঁহার যখন অসন্তোষের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। যাহা হউক, আপনি অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাকে জানাইবেন যে দেশবাসীর শিক্ষাবিস্তারকল্পে তিনি দীর্ঘকাল উৎসাহের সঙ্গে যে কাজ করিয়াছেন তজ্জন্য সরকার তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ।” (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৮)

 স্বাস্থ্যের অবনতি কর্ম্মত্যাগের একটি কারণ বটে, কিন্তু পদোন্নতি সম্পর্কে আশাভঙ্গ এবং উপরিতন কর্ম্মচারীর সহিত মতবিরোধই যে বিদ্যাসাগরকে সরকারী কর্ম্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিল তাহা উপরের চিঠিগুলি হইতে বেশ বুঝিতে পারা যায়। ছোটলাট হ্যালিডে তাঁহার গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁহার সহিত সদয় ও ভদ্রব্যবহার করিতেন সত্য, কিন্তু যাঁহার অধীনতায় পণ্ডিতকে প্রতিদিন কাজ করিতে হইত, সেই সাক্ষাৎ উপরিতন কর্ম্মচারী—শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের প্রতিবন্ধকাচরণ এবং অনাত্মীয় ব্যবহারে বিদ্যাসাগরের পক্ষে আর কাজ করা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ‘পণ্ডিত কিঞ্চিত অসুষ্ঠুভাবে অবসর গ্রহণ করিলেন’ বাংলা-সরকারের এই মন্তব্য অযথার্থ। বিদ্যাসাগরের চাকরির কাল দশ বৎসরের অধিক নহে; এত অল্পদিনের সরকারী কাজে আংশিক পেন্‌সনেরও অধিকারী হওয়া যায় না সত্য, কিন্তু তাঁহার সম্পাদিত কর্ম্মের গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া পুরস্কার-স্বরূপ তাঁহাকে এককালীন কিছু টাকা দান করিলেই সরকারের পক্ষে শোভন হইত।

 ১৮৫৮, ৪ঠা নভেম্বর ই, বি, কাওয়েল সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের ভার গ্রহণ করিলেন।

 ইহার কিছুদিন পরেই বিদ্যাসাগর বোর্ড অফ একজামিনার্স-এর সদস্যপদ ত্যাগ করিলেন (মে, ১৮৬০)। ইহার কারণ তিনি ছোটলাটের সহিত সাক্ষাৎ আলাপে বিবৃত করিয়াছিলেন।