উনিশ

 ১৩৪৫ সালের ৭ই মাঘ রাষ্ট্রপতি শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু শান্তিনিকেতন আশ্রম পরিদর্শনে গেলে শান্তিনিকেতনের ছায়াশীতল আম্রকুঞ্জে কবিগুরু নিজে নবীন রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা করেন। অভ্যর্থনা করিয়া কবিগুরু বলেন, “কল্যানীয় সুভাষচন্দ্র! আমাদের যা’ বলবার কথা, হাজার বছর পূর্বে আমাদের ঋষিরা তা’ বলে গেছেন। সমস্ত দেশের অভ্যর্থনার ভিতর দিয়ে তুমি এসেছ। আমাদের দেশ তােমাকে যে আসন দিয়েছে সে আসনের বার্ত্তা রযেছে ঋষিদের সেই পবিত্র বাণীর ভিতরে— তাঁদের বাণীতে তুমি পেয়েছ তােমার আসন। আমরা খুসী হয়েছি আজ তােমাকে এখানে পেয়ে। আমার খুসী হবার একটা কারণ হচ্ছে, এই সুযােগে তুমি আমার পরিচয় পাবে। বাণীর সাধনায় আমার সিদ্ধি সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছ। যাঁরা আমাকে ভালবাসেন তাঁরা বলেন, আমি একটা কিছু প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি বাক্‌দেবতার কল্যাণে। কিন্তু তােমার দৃষ্টিতে পড়্‌বে এই কর্মক্ষেত্রে আমার পরিচয়। মানুষের মানবত্বের পরিচয় যদি এখানে জাগ্রত হয়ে থাকে, ত্যাগ ও সাধনার ক্ষেত্র যদি এখানে খুলে থাকে, তাহলে তুমি আনন্দিত হবে জানি। আর সে পরিচয় আমি গর্বের সংগে তােমাকে দিতে চাই; এই কারণে দিতে চাই, তুমি এখানে দেশের কর্ণধাররূপে এসেছ—দেশ তােমাকে স্বীকার করেছে। এখানে দেশের যে সাধনা সে তােমাকে জানতে হবে, স্বীকার কর্তে হবে, গ্রহণ কর্তে হবে। যদি তুমি স্বীকার কর তাহলে এ চিরকালের জন্য সার্থক হবে। আমার সৌভাগ্য আজ তােমাকে আহ্বান করে এনেছে আমার এই কর্মক্ষেত্রে—তুমি আমাকে জানবে।

 তােমাকে আমি রাষ্ট্রনেতারূপে স্বীকার করেছি মনে মনে। আমার সঙ্কল্প আছে জনতার মধ্যে আমার সেই বাণী আমি প্রকাশ করব। তুমি বাঙ্‌লাদেশের রাষ্ট্রীয় অধিপতির আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। অন্য দেশকে আমি জানি না, সেখানে আমার জোর খাট্‌বে না। আমি বাঙালী—বাঙালাকে জানি—বাঙালার প্রয়োজন অসীম। সেই জন্য তোমাকে যদি আহ্বান করি, স্বীকার কর্তে হবে। এখানে তুমি আমাদের অতিথি ও বন্ধু। আমাদের দেখে আমাদের কার্যভার যদি লাঘব কর্তে পার, কর। অবসর হ’লে আসতে যেতে হবে।

 দেশে যারা অপমানিত তাদের সন্মান দেবার আয়োজন করেছি এখানে। এখানকার হাওয়াতে এখানকার ছেলে মেয়েদের যে আনন্দ, তাতে তাদের দাবী আছে, এই জন্য তারা জন্মেছে। তা নইলে কেন ফুল ফোটে, দিনান্তে কেন পাখী ডাকে, যদি তারা ক্লাস ঘরে ঢুকে দাগ কাটা Passage মুখস্থ করে জীবনের সুন্দর সময় নষ্ট করে। কি দুর্ভাগ্যে মানুষ সৌন্দর্য্যবোধ থেকে বঞ্চিত থাকবে। শিক্ষাটা জীবনের সংগে জড়িত। শিক্ষাকে যারা বিচ্ছিন্ন করে রাখে, তারা তাকে পীড়িত করে, মানুষের মনকে তারা কেটে কেটে বাঁচাবার চেষ্টা করে। এখানে শিক্ষাকে সমগ্র জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে আহ্বান করেছি—মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ দিতে চেষ্টা করেছি। কাজ যা করবার সম্পূর্ণ হয় নি। রাষ্ট্রীয় দিক থেকে তুমি আমার কর্মের পরিচয় নিয়ে যদি তাকে স্বীকার কর্তে পার, সুখী হব।”

 কবিগুরুর সম্বর্দ্ধনার উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেন—“আপনার যে অখণ্ড সাধনা, সেটা সাধারণ মানুষ বা সাধারণ ভারতবাসী যে সহজে উপলব্ধি করবে এটা আশা করা অন্যায়। আমিও সেই সাধারণের একজন। সুতরাং আমি যে আপনার অখণ্ড সাধনা, মহত্ত্ব ও গৌরব উপলদ্ধি কর্তে পারব, সে দুরাকাঙ্ক্ষা আমি করি না, সে উপলব্ধি একদিনে আসে না। সে উপলব্ধি হচ্ছে ক্রমিক এবং সারা জীবনব্যাপী। তবে আমার মনে হয় যদি আমরা চলার পথে চল্‌তে থাকি তা’হলে সে উপলব্ধি ক্রমশঃ প্রসারলাভ কর্‌বে।

 মধ্যে মধ্যে একথা উঠে এবং আমাদের মধ্যে আলোচিত হয়, আপনি উপস্থিত না থাকলে আপনার সাধনার কি হবে। আমি বল্‌তে চাই—কোন বস্তু বা সাধনা মরতে পারে না, যতদিন তার সার্থকতা আছে। যে সত্য ও সাধনা নিয়ে আপনার সমস্ত জীবন দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেদিন ভারতবর্ষের প্রত্যেক নর-নারীর হৃদয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন শান্তিনিকেতন বাঁচুক বা মরুক তাতে কিছু আসবে যাবে না। যতদিন পর্য্যন্ত সে সত্য ও সাধনা জাতির প্রাণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন পর্য্যন্ত আপনার শান্তিনিকেতনের ও শ্রীনিকেতনের সার্থকতা ও প্রয়োজনীয়তা থাকবেই থাকবে। শুধু তাই নয়, এ রকম সাধনা ভারতের দিকে দিকে স্থানে স্থানে গড়ে উঠবে।

 আমরা, যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে বেশী সময় ও শক্তি ব্যয় করি, আমরা মর্মে মর্মে আমাদের অন্তরের দৈন্য অনুভব করি। প্রাণের দিক দিয়ে যে সম্পদ না পেলে মানুষ বা জাতি বড় হতে পারে না, সেই সম্পদ্—সেই প্রেরণা আমরা চাই, কারণ, আমরা জানি—সেই প্রেরণা, সত্যের সেই আভাস যদি প্রাণের মধ্যে পাই তাহলে আমাদের কর্মজীবনের ও বহির্জীবনের সাধনা সাফল্যমণ্ডিত ও সার্থক হবে। আপনার কাছ থেকে সে প্রেরণা আমরা চাই।

 আমরা হয়ত আজ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা কর্‌ছি; কিন্তু আমাদের আদর্শ বড়। আমরা চাই মানুষের ও জাতির পরিপূর্ণ জীবন, আমরা চাই সব দিক দিয়ে আমাদের অখণ্ড জাতি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হউক। এই যাত্রার পথে, এই সাধনার পথে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা একটি সোপান মাত্র। বাণীর বা সাহিত্যের সাধনায় আপনার চেষ্টা পর্য্যবসিত হয় নাই—শুধু ভগবানের উপাসনায় আপনার সাধনা পর্য্যবসিত হয় নাই। অন্তরের আদর্শকে আপনি বহির্জীবনে মূর্ত্ত কর্তে চেষ্টা করেছেন। এইটুকু আপনার চরণে নিবেদন কর্তে চাই—এই আদর্শ আমাদেরও জীবনের আদর্শ, কারণ, এটা আমাদের জাতীয় আদর্শ। আমাদের জীবনে তা’ সফল কর্তে পারি না পারি সেই আদর্শকে আমরা অন্তরে রেখেছি, বাহিরে রেখেছি এবং সেই আদর্শ অনুসরণ কর্তে চেষ্টা কর্‌ছি, ভবিষ্যতেও করব।”

 শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের এক সভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেন, “আমরা যে নূতন ভারত তৈরী করব তার প্রতিষ্ঠা হবে মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম আদর্শের উপর। তাকে ভিত্তি করে স্বরাজের সৌধ নির্ম্মিত হ’বে। তার মধ্যে জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন ফুটিয়ে তুলতে পারব, ভারতবর্ষকে আবার ধনধান্যে পূর্ণ কর্তে পারব এবং ভারতের নর-নারীকে সকল রকমে যােগ্য করে তুলতে পারব। যেদিন ভারতের প্রত্যেক নর-নারীকে মনুষ্যত্বের উচ্চতর সােপানে উন্নীত কর্তে পারব, সেদিন আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হ’বে। শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে শিক্ষার যে আয়ােজন হ’য়েছে তার যদি সদ্ব্যবহার হয়, তা’হলে জাতিসংঘঠনকার্য সাফল্যমণ্ডিত হবে।”