দুই

 সুভাষচন্দ্রের পৈত্রিক নিবাস চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। তাঁহার পিতা স্বর্গগত রায় জানকীনাথ বসু বাহাদুর শৈশবে ও যৌবনে নানা প্রতিকূল অবস্থার সহিত সংগ্রাম করিয়া নিজের জীবনে উন্নতি সাধন করেন। জানকীনাথ কটকের সরকারী উকিল ছিলেন। তাঁহার ন্যায় বিচক্ষণ ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবি তৎকালে অল্পই ছিল। তিনি কটক ‘বারের’ নেতা ছিলেন। নিজের উদারতাগুণে কটকে তিনি অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করেন ও সুদীর্ঘকাল কটক মিউনিসিপালিটি ও জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্ব্বপ্রকার গণপ্রতিষ্ঠান ও সাধারণের কাজের সহিত তিনি বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁহার কর্ম্মদক্ষতার পরিচয়ে সরকার তাঁহাকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করিয়া সম্মানিত করেন। কিন্তু বিগত আইন অমান্য আন্দোলনে সরকার যে দমন-নীতি অবলম্বন করেন তাহার প্রতিবাদে তিনি অসঙ্কোচে রাজদত্তখেতাব পরিত্যাগ করিয়া দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জ্জন করেন। যে দেশাত্মবোধ ও স্বাদেশিকতা সুভাষচন্দ্রকে বিশ্ববরেণ্য করিয়া তুলিয়াছে তাহা তিনি পিতা জানকীনাথের নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্র যখন প্রথমবার কারাবরণ করেন তখন জানকীনাথ লিখিয়াছিলেন, সুভাষের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি (We are proud of Subhas!) জানকীনাথই সুভাষচন্দ্রকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করিয়া ছিলেন। দেশবাসী তাঁহাকে চিরদিন কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করিবে। সুভাষচন্দ্রের মাতা প্রভাবতী দেবীও একজন আদর্শ রমণী ছিলেন। তাঁহার ন্যায় দানশীলা ও ধর্ম্মপ্রাণা রমণী এ যুগে বিরল। তাঁহার ধর্ম্মভাব সুতাষচন্দ্রের জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। সহৃদয়, সরল ও অমায়িক স্বভাবের জন্য পারিবারিক জীবনে তিনি সকলের ভক্তি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিলেন। পিতার স্বাদেশিকতা ও তেজস্বিতা, মাতার ধর্ম্মপরায়ণতা ও পরদুঃখ কাতরতা সুভাষচন্দ্রের জীবন দেশপ্রেম ও ত্যাগ মাহাত্ম্যে অপূর্ব্ব মহিমামণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছে।

 ইংরেজী ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারী বাঙ্‌লা ১৩০৩ সালের ১১ই মাঘ শনিবার দিবা অনুমান ১২টা ১৫ মিনিটের সময় কটকে সুভাষচন্দ্রের জন্ম হয়। সুভাষচন্দ্র স্বর্গগত জানকী নাথ বসু মহাশয়ের ষষ্ঠ পুত্র। তাঁহার আট পুত্র ও ছয় কন্যার মধ্যে বর্ত্তমানে সাতজন পুত্র ও দুইটি মাত্র কন্যা জীবিত আছেন। জানকীনাথ সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রথম হইতেই বিশেষ যত্নবান ছিলেন। তাঁহারা প্রত্যেকেই যথোপযুক্ত শিক্ষা পাইয়াছিলেন। ছেলেরা প্রথমে কটকে ইউরোপীয় স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে প্রায় সকলেই ইউরোপে গিয়া উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত হন। ইহাদের মধ্যে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসু ব্যারিষ্টার এবং নেতা হিসাবে সকলেরই নিকট সুপরিচিত। দীর্ঘ কারাবাসের পর তিনি পুনরায় বাঙ্‌লার নেতৃত্বভার গ্রহণ করিয়াছেন। বর্ত্তমানে তিনিই বাঙলার একমাত্র অবিসংবাদী নেতা। ভাইদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় শরৎচন্দ্র বসুই সুভাষচন্দ্রকে সমধিক ভালবাসিতেন। পরবর্ত্তী জীবনে কংগ্রেসদলপতিদের সহিত অনিবার্য্য কারণে সুভাষচন্দ্রের যখন বিবোধ উপস্থিত হয় তখন শরৎ বাবুই সুভাষচন্দ্রের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র বসু ও ডাঃ সুনীল চন্দ্র বসুর নামও অনেকেই জানেন। সুভাষচন্দ্রের অনুজ শৈলেশচন্দ্র গত অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিয়া কারাবরণ করেন। সুভাষচন্দ্রের সহিত তাঁহার আকৃতির আশ্চর্য্য সাদৃশ্য বিদ্যমান। এই সাদৃশ্য হেতু তাঁহাকে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হইতে হইয়াছে।