বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পরিশিষ্ট (ক)

পরিশিষ্ট—(ক)

সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উক্তি

দেশনায়ক

সুভাষচন্দ্র,

 বাঙ্গালী কবি আমি, বাঙ্গালাদেশের হয়ে তােমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি। গীতায় বলেন, সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতের বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারংবার আবির্ভূত হন। দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয়, তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের অধিনায়ক। রাজশাসনের দ্বারা নিষ্পিষ্ট, আত্মবিরােধের দ্বারা বিক্ষিপ্তশক্তি বাংলাদেশের অদৃষ্টাকাশে দুর্যোগ আজ ঘনীভূত। নিজেদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দুর্ব্বলতা বাইরে একত্র হয়েছে বিরুদ্ধ শক্তি। আমাদের অর্থনীতিতে কর্ম্মনীতিতে শ্রেয়ােনীতিতে প্রকাশ পেয়েছে নানা ছিদ্র। আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে হালে দাড়ে তালের মিল নেই। দুর্ভাগ্য যাদের বুদ্ধিকে অধিকার করে, জীর্ণ দেহে রােগের মত, তাদের পেয়ে বসে ভেদবুদ্ধি—কাছের লােককে তারা দূরে ফেলে আপনাকে করে পর, শ্রদ্ধেয়কে করে অসম্মান, স্বপক্ষকে পিছন থেকে করতে থাকে বলহীন; যােগ্যতার জন্য সম্মানের বেদী স্থাপন করে যখন স্বজাতিকে বিশ্বের দৃষ্টির সম্মুখে ঊর্দ্ধে তুলে ধরে মান বাঁচাতে হবে, তখন সেই বেদীর ভিত্তিতে ঈর্ষান্বিতের আত্মঘাতক মূঢ়তা নিন্দার ছিদ্র যখন করতে থাকে, নিজের প্রতি বিদ্বেষ করে শত্রুপক্ষের স্পর্দ্ধাকে প্রবল করে তোেল।

 বাহিরের আঘাতে যখন দেহে ক্ষত বিস্তার করতে থাকে তখন নারীর ভিতরকার সমস্ত প্রসুপ্ত বিষ জেগে উঠে সাংঘাতিকতাকে এগিয়ে আনে। অন্তর বাহিরের চক্রান্তে অবসাদগ্রস্ত মন নিজেকে নিরাময় করবার পূর্ণ শক্তি, প্রয়ােগ করতে পারে না। এই রকম দুঃসময়ে একান্তই চাই এমন আত্মপ্রতিষ্ঠ-শক্তিমান পুরুষের দক্ষিণ হস্ত যিনি জয় যাত্রার পথে ভাগ্যকে তেজের সঙ্গে উপেক্ষা করতে পারেন।

 সুভাষচন্দ্র তোমার রাষ্ট্রিক সাধনার আরম্ভ ক্ষণে তোমাকে দূর থেকে দেখেছি। সেই আলো আঁধারের অস্পষ্ট লগ্নে তোমার সম্বন্ধে কঠিন সন্দেহ জেগেছে মনে, তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে দ্বিধা অনুভব করেছি, কখনো কখনো দেখেছি তোমার ভ্রম তোমার দুর্বলতা তা নিয়ে মন পীড়িত হয়েছে। আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত, তাতে সংশয়ের আবিলতা আর নেই, মধ্য দিনে তোমার পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করেছে তোমার জীবন। কর্ত্তব্য-ক্ষেত্রে দেখলুম তোমার যে পরিণতি তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ। এই শক্তির কঠিন পরীক্ষা হয়েছে কারা-দুঃখে, নির্ব্বাসনে, দুঃসাধ্য রোগের আক্রমণে। কিছুতে তোমাকে অভিভূত করেনি। তোমার চিত্তকে করেছে প্রসারিত, তোমার দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে দেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে। দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিঘ্নকে করেছ সোপান। সে সম্ভব হয়েছে, যেহেতু কোন পরাভবকে তুমি একান্ত সত্য বলে মাননি। তোমার এই চরিত্র শক্তিকেই বাংলাদেশের অন্তরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সকলের চেয়ে গুরুতর।

 নানা কারণে আত্মীয় ও পরের হাতে বাংলাদেশ যতকিছু সুযোগ থেকে বঞ্চিত, ভাগ্যের সেই বিড়ম্বনাকেই সে আপন পৌরুষের আকর্ষণে ভাগ্যের আশীর্ব্বাদে পরিণত করে তুলবে, এই চাই। আপাত পরাভবকে অস্বীকার করায় যে বল জাগ্রত হয় সেই স্পর্দ্ধিত বলই তাকে নিয়ে যাবে জয়ের পথে, আজ চারিদিকেই দেখতে পাই বাংলাদেশের অকরুণ অদৃষ্ট তাকে প্রশ্রয় দিতে বিমুখ। এই বিমুখতাকে অবজ্ঞা করেই সে যদি দৃঢ় চিত্তে বলতে পারে আত্মরক্ষার দুর্গ বানাবার উপকরণ আছে আপন চরিত্রের মধ্যেই; বাধ্য হয়ে যদি সেই উপকরণকে রুদ্ধ ভাণ্ডারের তালা ভেঙ্গে সে উদ্ধার করতে পারে তবেই সে বাঁচবে, হিংস্র দুঃসময়ের পিঠের উপরে চড়েই বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হতে হবে, এই দুঃসাহসিক অভিযানে উৎসাহ দিতে পারবে তুমি, এই আশা করে তোমাকে আমাদের যাত্রনেতার পদে আহ্বান করি।

 দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে দুর্গম লক্ষ্যে গিয়া পৌঁছবই যদি আমরা মিলতে পারি। আমাদের সকলের চেয়ে দুরুহ সমস্যা এইখানেই। কিন্তু কেন বলব ‘যদি’, কেন প্রকাশ করব সংশয়? মিলতেই হবে কেন না দেশকে বাঁচতেই হবে। বাঙ্গালী অদৃষ্ট কর্ত্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না এই আশাকে সমস্ত দেশে তুমি জাগিয়ে তোল, সাংঘাতিক মার খেয়েও বাঙ্গালী মারের উপর মাথা তুলবে। তোমার মধ্যে অক্লান্ত তারুণ্য, আসন্ন সঙ্কটের প্রতি মুখে আশাকে অবিচলিত রাখার দুর্নিবার শক্তি আছে তোমার প্রকৃতিতে। সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বমুক্ত মৃত্যুঞ্জয় আশার পতাকা বাঙ্গালার জীবনক্ষেত্রে তুমি বহন করে আনবে সেই কামনায় আজ তোমাকে অভ্যর্থনা করি দেশনায়কের পদে। অসন্দিগ্ধ দৃঢ়কণ্ঠে বাঙ্গালী আজ একবাক্যে বলুক, তোমার প্রতিষ্ঠার জন্য তার আসন প্রস্তুত। বাঙ্গালীর পরস্পর বিরোধের সমাধান হোক তোমার মধ্যে, আত্মসংশয়ের নিরসন হোক তোমার মধ্যে, হীনতা লজ্জিত ও দীনতা ধিক্কৃত হোক তোমার আদর্শে; জয়ে পরাজয়ে আপন আত্মসম্ভ্রম অক্ষুন্ন রাখার দ্বারা তোমার মর্য্যাদা সে রক্ষা করুক।

 বাঙ্গালী নৈয়ায়িক, বাঙ্গালী অতি সূক্ষ্ম যুক্তিতে বিতর্ক করে, কর্ম্ম উদ্যোগের আরম্ভ থেকে শেষ পর্য্যন্ত বিপরীত পক্ষ নিয়ে বন্ধ্যা বুদ্ধির গর্বে প্রতিবাদ করতে তার অদ্ভুত আনন্দ, সমগ্র সৃষ্টির চেয়ে রন্ধ্র সন্ধানের ভাঙন্ লাগানো দৃষ্টিতে তার ঔৎসুক্য, ভুলে যায় এই তার্কিকতা নিষ্কর্মা বুদ্ধির নিষ্ফল শৌখিনতামাত্র। আজ প্রয়োজন হয়েছে তর্কের নয়, স্বতঃ উদ্যত ইচ্ছার। বাঙ্গালীর সম্মিলিত ইচ্ছা বরণ করুক তােমাকে নেতৃত্ব পদে, সেই ইচ্ছা তােমাকে সৃষ্টি করে তুলুক তােমার মহৎ দায়িত্বে, সেই ইচ্ছাতে তােমার ব্যক্তিস্বরূপকে আশ্রয় করে আবির্ভূত হােক সমগ্রদেশের আত্মস্বরূপ।

 বাঙ্গলাদেশের ইচ্ছায় মুক্তি একদিন প্রত্যক্ষ করেছি বঙ্গভঙ্গরােধের আন্দোলনে। বঙ্গ কলেবর দ্বিখণ্ডিত করবার জন্যে সমুদ্যত খড়্গকে প্রতিহত করেছিল এই ইচ্ছা। যে বহুবলশালী শক্তির প্রতিপক্ষে বাঙ্গালী সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই রাজশক্তির অভিপ্রায়কে বিপর্য্যস্ত করা সম্ভব কিনা এ নিয়ে সেদিন সে বিজ্ঞের মতো তর্ক করেনি, বিচার করেনি, কেবল সে সমস্ত মন দিয়ে ইচ্ছা করেছিল। তার পরবর্ত্তীকালের প্রজন্মে (generation) ইচ্ছার অগ্নিগর্ভরূপ দেখেছি বাংলায় তরুণদের চিত্তে। দেশে তারা দীপ জ্বালাবার জন্যে আলাে নিয়েই জন্মেছিলে, ভুল করে আগুন লাগাল, দগ্ধ করল নিজেদের, পথকে করে দিল বিপথ। কিন্তু সেই দারুণ ভুলের সাংঘাতিক ব্যর্থতার মধ্যে বীর হৃদয়ের যে মহিমা ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন ভারতবর্ষের আর কোথাওতো তা দেখিনি। তাদের সেই ত্যাগের পর ত্যাগ, সেই দুঃখের পর দুঃখ, সেই তাদের প্রাণনিবেদন, আশু নিষ্ফলতায় ভস্মসাৎ হয়েছে কিন্তু তারা ত নির্ভীক মনে চিরদিনের মত প্রমাণ করে গেছে বাঙ্গালার দুর্জ্জয় ইচ্ছাশক্তিকে। ইতিহাসের এই অধ্যায়ে অসহিষ্ণু তারুণ্যের যে হৃদয়বিদারক প্রমাদ দেখিয়েছিল তার উপরে আইনের লাঞ্ছনা যত মসী লেপন করুক তবু কি কালাে করতে পেরেছে তার অন্তর্নিহিত তেজোস্ক্রিয়তাকে?

 আমরা দেশের দৌর্বল্যের লক্ষণ অনেক দেখেছি, কিন্তু যেখানে পেয়েছি তার প্রবলতার পরিচয় সেইখানেই আমাদের আশা প্রচ্ছন্ন ভূগর্তে ভবিষ্যতের প্রতীক্ষা করেছে। সেই প্রত্যাশাকে সম্পূর্ণ প্রাণবান ও ফলবান করবার ভার নিতে হবে তােমাকে; বাঙ্গালীর স্বভাবে যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সরসতা, তার কল্পনাবৃত্তি, তার নূতনকে চিনে নেবার উজ্জ্বল দৃষ্টি, রূপসৃষ্টির নৈপুণ্য, অপরিচিত সংস্কৃতির দানকে গ্রহণ করবার সহজ শক্তি, এই সকল ক্ষমতাকে ভাবের পথ থেকে কাজের পথে প্রবৃত্ত করতে হবে। দেশের পুরাতন জীর্ণতাকে দূর করে তামসিকতার আবরণ থেকে মুক্ত করে নববসন্তে তার নতুন প্রাণকে কিশলয়িত করবার সৃষ্টিকর্ত্তৃত্ব গ্রহণ করো তুমি।

 বলতে পার এত বড় কাজ কোন একজনের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না, সে কথা সত্য। বহু লোকের দ্বারা বিচ্ছিন্নভাবেও সাধ্য হবে না। একজনের কেন্দ্রাকর্ষণে দেশের সকল লোকে এক হতে পারলে তবেই হবে অসাধ্য সাধন। যারা দেশের যথার্থ স্বাভাবিক প্রতিনিধি তারা কখনই একলা নন। তারা সর্বজনীন, সর্বকালে তাদের অধিকার। তারা বর্তমানের গিরি-চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের প্রথম সূর্য্যোদয়ের অরুণাভাসকে প্রথম প্রণতির অর্ঘ্য দান করেন। সেই কথা মনে রেখে আমি আজ তোমাকে বাঙ্গালাদেশের রাষ্ট্রনেতার পদে বরণ করি। সঙ্গে সঙ্গে আহ্বান করি তোমার পার্শ্বে সমস্ত দেশকে।

 এমন ভুল কেউ যেন না করেন যে বাঙ্গলাদেশকে আমি প্রাদেশিকতার অভিমানে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই অথবা সেই মহাত্মার প্রতিযোগী আসন স্থাপন করতে চাই রাষ্ট্রধর্ম্মে যিনি পৃথিবীতে নূতন যুগের উদ্বোধন করেছেন, ভারতবর্ষকে যিনি প্রসিদ্ধ করেছেন সমস্ত পৃথিবীর কাছে। সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে বাংলার সম্মিলন যাতে সম্পূর্ণ হয়, মূল্যবান হয়, পরিপূর্ণ ফলপ্রসূ হয়, যাতে সে রিক্তশক্তি হয়ে পশ্চাতের আসন গ্রহণ না করে তারই জন্য আমার এই আবেদন। ভারতবর্ষে রাষ্ট্রমিলন যজ্ঞের যে মহদনুষ্ঠান আজ প্রতিষ্ঠিত, প্রত্যেক প্রদেশকে তার জন্য উপযুক্ত আহুতির উপকরণ সাজিয়ে আনতে হবে। তোমার সাধনায় বাংলাদেশের সেই আত্মাহুতি ষোড়শোপচারে সত্য হোক, ওজস্বী হোক—তার আপন বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।

 বহুকাল পূর্ব্বে একদিন আর এক সভায় আমি বাঙ্গালী সমাজের অনাগত অধিনায়কের উদ্দেশ্যে বাণীদূত পাঠিয়েছিলুম। তার বহু বৎসর পরে আজ আর এক অবকাশে বাংলাদেশের অধিনেতাকে প্রত্যক্ষ বরণ করছি। দেহে মনে তাঁর সঙ্গে কর্ম্মক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারব আমার সে সময় আজ গেছে, শক্তিও অবসন্ন। আজ আমার শেষ কর্ত্তব্যরূপে বাংলাদেশের ইচ্ছাকে কেবল আহ্বান করতে পারি। সেই ইচ্ছা তোমার ইচ্ছাকে পূর্ণশক্তিতে প্রবুদ্ধ করুক, কেবল এই কামনা জানাতে পারি। তারপরে আশীর্ব্বাদ করে বিদায় নেব এই জেনে যে, দেশের দুঃখকে তুমি তোমার আপন দুঃখ করেছ, দেশের সার্থক মুক্তি অগ্রসর হয়ে আসছে তোমার চরম পুরস্কার বহন করে।

 (১৯৩৯ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে কবিগুরুর এই ভাষণ লিখিত ও মুদ্রিত হয়; কিন্তু উহা তখন প্রচারিত হয় নাই। সম্প্রতি এই রচনাটি দৈনিক আনন্দবাজার ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে)।

[ ২ ]

 [কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালের ২০ শে মে মংপু হইতে শ্রীযুক্ত অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লিখিত এক পত্রে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলন সম্পর্কে তাঁহার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন। এই পত্রখানি ঐ বৎসর জুলাই মাসে “কংগ্রেস” নাম দিয়া ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়। নিম্নে উহার কিয়দংশ উদ্ধৃত হইল। কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের তৎকালীন মনোভাব সম্বন্ধে কবির অভিমত বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক]।

 কংগ্রেস যতদিন আপন পরিণতির আরম্ভ যুগে ছিল, ততদিন ভিতরের দিক থেকে তার আশঙ্কার বিষয় অল্পই ছিল। এখন সে প্রভূত শক্তি ও খ্যাতি সঞ্চয় করেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্বীকার করে নিয়েছে সমস্ত পৃথিবী। সে কালের কংগ্রেস যে রাজদরবারের রুদ্ধ দ্বারে বৃথা মাথা খোঁড়াখুড়ি করে মরত, আজ সেই দরবারে তার সম্মান অবারিত। এমনকি সেই দরবার কংগ্রেসের সঙ্গে আপোষ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু মনু বলেছেন সম্মানকে বিষের মত জানবে। পৃথিবীতে যে দেশেই যে কোন বিভাগেই ক্ষমতা অতি প্রভূত হয়ে সঞ্চিত হয়ে উঠে সৈখানেই সে ভিতরে ভিতরে নিজের মারণ বিষ উদ্ভাবিত করে। ইম্পিরিয়ালিজম্ বল, ফ্যাসিজম বল, অন্তরে নিজের বিনাশ নিজেই সৃষ্টি করে চলেছে। কংগ্রেসের অন্তর-সঞ্চিত ক্ষমতার তাপ হয়তো তার অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে সন্দেহ করি। যাঁরা এর কেন্দ্রস্থলে এই শক্তিকে বিশিষ্টভাবে অধিকার করে আছেন, সঙ্কটের সময় তাঁদের ধৈর্য্যচ্যুতি হয়েছে; বিচারবুদ্ধি সোজা পথে চলে নি। পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য, যে বৈধতা রক্ষা করলে যথার্থভাবে কংগ্রেসের বল ও সম্মান রক্ষা হত তার ব্যভিচার ঘটতে দেখা গেছে; এই ব্যবহার-বিকৃতির মূলে আছে শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব। খৃষ্টান শাস্ত্রে বলে স্ফীতকায় সম্পদের পক্ষে স্বর্গরাজ্যের প্রবেশ পথ সঙ্কীর্ণ, কেননা ধনাভিমানী ক্ষমতা আনে তামসিকতা। কংগ্রেস আজ বিপুল সম্মানের ধনে ধনী, এতে তার স্বর্গরাজ্যের পথ করেছে বন্ধুর। মুক্তির সাধনা তপস্যার সাধনা, সেই তপস্যা সাত্ত্বিক—এই জানি মহাত্মার উপদেশ। কিন্তু এই তপঃক্ষেত্রে যাঁরা রক্ষকরূপে একত্র হয়েছেন তাঁদের মন কি উদারভাবে নিরাসক্ত? তাঁরা পরস্পরকে আঘাত করে যে বিচ্ছেদ ঘটান সে কি বিক্ষুব্ধ সত্যেরই জন্য। তাঁর মধ্যে কি সে উত্তাপ একেবারে নেই যে উত্তাপ শক্তিগর্ব্ব ও শক্তিলোপ থেকে উদ্ভূত? ভিতরে ভিতরে কংগ্রেসের মন্দিরে এই যে শক্তি-পূজার বেদী গড়ে উঠেছে তার কি স্পর্ধিত প্রমাণ এবারে পাইনি যখন মহাত্মাজীকে তার ভক্তেরা মুসোলিনী ও হিট্‌লারের মর্ম্মকথা বলে বিশ্বসমক্ষে অসম্মানিত করতে পারলেন?

 সত্যের যজ্ঞে যে তপস্বী কংগ্রেসকে গড়ে তুলেছেন, তার বিশুদ্ধতা কি তারা রক্ষা করতে পারবেন শক্তিপূজার নরবলি সংগ্রহের কাপালিক যাঁদের আদর্শ। আমি সর্ব্বান্তঃকরণে শ্রদ্ধা করি জহরলালকে, যেখানে ধন বা অন্ধ ধর্ম্ম বা রাষ্ট্রপ্রভাব ব্যক্তিগত সঙ্কীর্ণ সীমায় শক্তির ঔদ্ধত্য পুঞ্জীভূত করে তােলে সেখানে তার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি কংগ্রেসের দুর্গদ্বারের দ্বারীদের মনে কোথাও কি এই ব্যক্তিগত শক্তিমদের সাংঘাতিক লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করেনি? এতদিন পরে অন্তত আমার মনে সন্দেহ প্রবেশ করেছে।