বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পরিশিষ্ট (খ)

পরিশিষ্ট—(খ)

আজাদ হিন্দ ফৌজ ও গভর্ণমেণ্টের ইতিহাস

 ১৯৪২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুরের পতন হয়। বৃটিশ সৈন্যগণ পূর্বাহ্নেই পলায়ন করে এবং তাহাদের পলায়নের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা পূর্বেই করা হইয়াছিল, কিন্তু ভারতীয় সৈন্যগণকে তাহাদের অনিশ্চিত ভাগ্যের উপর ফেলিয়া রাখা হয়। ইহার ফলে সিঙ্গাপুরের সমস্ত ভারতীয় সৈন্য বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পন করে। এই সকল সৈন্য ও প্রবাসী ভারতীয়গণের বৃটিশ বিরােধী মনােভাব জাপানীদের কাজে লাগাইবার উদ্দেশ্যে (১৭ই ফেব্রুয়ারী) জাপানী হেড কোয়ার্টার্সের মেজর ফুজিয়ারা কতিপয় ভারতীয়কে আমন্ত্রণ করিয়া পাঠান। তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন যে, বৃটিশ শক্তি নিতান্ত দুর্বল এবং দিন দিন আরও দুর্বল হইয়া পড়িতেছে এবং পড়িবে। সুতরাং বৃটিশ শক্তিকে আঘাত হানিবার ইহাই সুবর্ণ সুযােগ। তিনি পরামর্শ দেন, ভারতীয়গণ যেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য একটি সমিতি গঠন করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, জাপানের তরফ হইতে সম্ভাব্য সকলপ্রকার সাহায্য দেওয়া হইবে। মেজর ফুজিয়ারার উদ্দেশ্য ছিল জাপানের তাঁবেদার হিসাবে একটি ভারতীয় সমিতি খাড়া করা। কিন্তু যে ভারতীয়গণ সুদীর্ঘ বৎসর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনযন্ত্রের তলায় নিষ্পেষিত হইয়া আসিতেছিলেন, তাঁহারা পরাধীনতার জ্বালা মর্মে মর্মে বুঝিয়াছিলেন। তাঁহারা ফুজিয়ারার এই আবেদনে সাড়া দিতে পারেন নাই। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন—ভারতের স্বাধীনতা ভারতের ভিতরে এবং বাহিরে ভারতীয়গণ কর্ত্তৃকই অর্জন করিতে হইবে। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন, ভারতীয় স্বাধীন বাহিনীরই মুক্তিদাতা বাহিনী হিসাবে ভারত প্রবেশের অধিকার আছে; কোন বৈদেশিক শক্তির বা বাহিনীর সে অধিকার নাই। এই দূরদৃষ্টি অনুযায়ী তাঁহারা ফুজিয়ারাকে কোনরূপে এড়াইবার জন্য বলেন যে, এ বিষয়ে তাঁহারা আরো গভীরভাবে চিন্তা করিবেন এবং প্রয়োজন হইলে পুনর্বার তাঁহার (ফুজিয়ারার) সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।

 ইহার পর ৯ই এবং ১০ই মার্চ ১৯৪২ সালে মালয়ের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সিঙ্গাপুরে একটি সভা করেন। (ইতিমধ্যে রাসবিহারী বসু মালয়ে শ্যামের একটি প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বান করেন) সিঙ্গাপুরের সভায় স্থির হয় যে টোকিওতে একটি শুভেচ্ছা দল পাঠান হউক। এই প্রস্তাব জাপানীদের ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধেই করা হইয়াছিল, কারণ তাহারা চাহিয়াছিল একটি ‘অফিসিয়্যাল ডেলিগেশন’ পাঠাইতে। তাহা হইলে সেই ডেলিগেশন জাপানীদের মুখপাত্র হিসাবেই গণ্য হইত। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কোনরূপেই জাপানী তাঁবেদার হিসাবে গণ্য হইতে অস্বীকার করেন।

 ইহার পর ১৯৪২ সালের ২৮শে,২৯শে এবং ৩০শে মার্চ শ্রীরাসবিহারীর সভাপতিত্বে টোকিওতে একটি সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে উপরিউক্ত শুভেচ্ছা দলের প্রতিনিধিবৃন্দ ছাড়াও হংকং, সাংহাই ও জাপান প্রবাসী ভারতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, পূর্বএশিয়া-প্রবাসী ভারতীয়গণের পক্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ করিবার ইহাই প্রকৃষ্ট সময়; এই স্বাধীনতা হইবে পূর্ণস্বাধীনতা এবং সকল প্রকার বৈদেশিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত; ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং ক্রিয়াকলাপের অধিকারী হইতে পারিবে কেবলমাত্র ভারতীয়গণের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় স্বার্থে চালিত স্বাধীন-ভারত বাহিনী বা আজাদ হিন্দ ফৌজ। সকল ক্ষমতা আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ পরিচালিত করিবে; আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের একটি কর্মপরিষদ থাকিবে; এই কর্মপরিষদ সামরিক প্রয়োজনে জাপানের নিকট হইতে নৌবল, বিমানবল প্রভৃতি চাহিতে পারেন, ইত্যাদি। এই সম্মেলন আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব করেন যে, ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনা করিবার অধিকার ভারতভূমিতে স্বয়ং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপরই বর্তিবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই সেই অধিকারের মালিক। এই সম্মেলনে স্থির হয় যে, আরও ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যাংককে একটি প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বান করিতে হইবে এবং তথা হইতেই সরাসরিভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা করা হইবে।

 এই প্রস্তাব অনুসারেই ১৯৪২ সালের ১৫ই হইতে ২৩শে জুন পর্য্যন্ত ব্যাংককে একটি প্রতিনিধি সম্মেলন বসে। জাপান, মাঞ্চুকুও, হংকং, বার্মা, বোর্ণিও, জাভা, মালয় ও শ্যাম হইতে ১০০ জন প্রতিনিধি সমবেত হন। ভারতীয় বাহিনী হইতেও প্রতিনিধি আসেন (ইঁহারা যুদ্ধবন্দী)। এই সম্মেলনে আজাদ হিন্দ আন্দোলনের মূল নীতি নির্ধারিত হয়; যথা—

 ১। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়গণকে লইয়া একটি আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ গঠন করিতে হইবে।

 ২। আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘের আদর্শ, কার্যক্রম ও সকলপ্রকার পরিকল্পনা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ, কার্যক্রম ও উহার পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুসৃত হইবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব মানিয়া চলিতে হইবে। কংগ্রেসের আন্দোলনের সহিত যোগসূত্র সাধন করিতে হইবে।

 ৩। পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় বাহিনী হইতে এবং ভারতীয় বেসামরিক জনসাধারণের মধ্য হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া একটি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করিতে হইবে।

 ৪। ভারতবর্ষের প্রতি এবং এই নবগঠিত আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের প্রতি জাপানীদের নীতি কি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করার জন্য জাপানী কর্ত্তৃপক্ষের কাছে দাবী জানাইতে হইবে।

  এইরূপে ব্যাংকক সম্মেলন হইতে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ গঠিত হইল। ইহার সভাপতি হইলেন শ্রীরাসবিহারী বসু। সিঙ্গাপুর উক্ত সঙ্ঘের প্রধান কর্ম্মস্থল হইল। একটি কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠিত হইল এবং পূর্ব এশিয়ার প্রত্যেক দেশে ইহার শাখা সঙ্ঘ স্থাপিত হইল। এই সময় গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট ‘ভারত ত্যাগ কর’ প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষ দুইটি মন্ত্রে দীক্ষিত হইল—করেঙ্গে ঔর মরেঙ্গে। ভারতব্যাপী দাবানল জ্বলিয়া উঠিল। ভারতবর্ষের সমস্ত কংগ্রেস নেতাকে তড়িৎ আক্রমণ হানিয়া বৃটিশ শক্তি কারারুদ্ধ করিল; সহস্র সহস্র কংগ্রেসকর্মী, জনগণ বৃটিশের গুলীতে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগিলেন, বৃটিশ বিমান হইতে বোম বর্ষণের ফলে গ্রাম, নগর ধ্বংস হইতে লাগিল। এই সকল সংবাদে পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য এবং অদম্য কর্মোৎসাহ চূড়ান্ত সীমায় ঠেলিয়া উঠিল। এই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে এইবার সর্বপ্রথম ক্যাপ্টেন মোহন সিংয়ের অধিনায়কত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠনকার্য আরম্ভ হইল। মালয়ে যে সকল ভারতীয় সৈন্য আত্মসমর্পন করিয়াছিল, তাহাদের লইয়াই বাহিনী গঠনের প্রাথমিক কর্মসূচী অনুসৃত হইতে লাগিল। মালয় প্রবাসী ভারতীয়গণের নিকট আবেদন জানাইলে আশাতিরিক্ত সাড়া পাওয়া যাইতে লাগিল।

 এই সকল ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়া জাপান ভড়কাইয়া গেল। ভারতীয়গণের এই স্বাধীন প্রচেষ্টা জাপান কিছুতেই প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে নাই। বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মনেও ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হইয়াছিল। সুতরাং জাপানী কতৃপক্ষের সহিত আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মপরিষদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ বাঁধিয়া উঠিল। প্রধানতঃ দুইটি কারণে তিক্ততা চরম হইয়া পড়িল, যেমন—

 ১। কর্মপরিষদ দাবী জানাইয়াছিলেন, ভারতবর্ষ, পূর্ব এশিয়া এবং আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের প্রতি জাপানের নীতি কি ইহা জাপান অনতিবিলম্বে ঘােষণা করুক। জাপান উত্তরে জানাইয়াছিল, কতকগুলি মামুলী জবাব। যেমন ভারতকে সাহায্য করিতে জাপান প্রস্তুত, ভারতে রাজ্য বা অধিকার বিস্তারের কোন দুরভিসন্ধি জাপানের নাই, ইত্যাদি। কিন্তু কর্মপরিষদ জাপানী গবর্ণমেণ্টের ঐ মামুলী জবাব সন্তোষজনক বলিয়া গণ্য করিতে পারেন নাই।

 ২। সম্পূর্ণভাবে জাপানিগণ কর্তৃক পরিচালিত ইয়াকুবরা কিকান নামক ‘লায়াসন’ ডিপার্টমেণ্টের অফিসারগণ আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করিতে আসিতেন। সুতরাং ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসেই চরম সঙ্কট ঘনাইয়া উঠিল। মালয়ে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজকে জাপানী সমরকর্তাদের আদেশ অনুসারে বার্মায় স্থানান্তরিত করিতে কর্মপরিষদ অস্বীকার করিল। জাপানীদের অন্যান্য অনেক দাবীও সরাসরি অগ্রাহ্য় করা হইল। কর্মপরিষদকে না জানাইয়া জাপানীরা ৮ই ডিসেম্বর আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্ণেল এন এস গিলকে গ্রেপ্তার করিলে অবস্থা চরমে গিয়া পৌঁছে। ইহার প্রতিবাদে পরিষদের সভ্যগণ পদত্যাগ করেন, ইহাতে শ্রীরাসবিহারী অবস্থার গুরুত্ব বুঝিতে পারেন এবং জানান তিনি অনতিবিলম্বে জাপান যাইবেন এবং প্রধান প্রধান বিষয়ে জাপানীদের স্পষ্ট নীতি কি তাহা টোকিও গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে বাহির করিবেন। ইতিমধ্যে সঙ্ঘের কার্য চলিতে থাকিবে। এই সময় মালয়-শাখা প্রস্তাব করেন যে, রাসবিহারী বসুকে এতদ্বারা অনুরোধ করা যাইতেছে যে, তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে টোকিও গবর্ণমেণ্টের মতামত ও নীতি কি তাহা জানিতে সম্ভাব্য চেষ্টা করুন এবং টোকিও গবর্ণমেণ্টও ঘোেষণা, বিবৃতি বা অন্য যে কোন প্রকার উপায়ে তাহা যত শীঘ্র সম্ভব জ্ঞাত করুক। ইতিমধ্যে সঙ্ঘের কাজ পূর্বের মতই চলিতে থাকিবে, কিন্তু টোকিও গবর্ণমেণ্টের ঘোষণা বা বিবৃতির পরই কেবলমাত্র নূতনভাবে অগ্রসর হওয়া যাইবে।

 এই যখন অবস্থা তখন ইয়াকুরো কিকান আজাদ হিন্দ সঙ্ঘকে হীনবল করিবার জন্য একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল গঠন করিল। উহার অফিসারগণ আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের বিরুদ্ধে একটি গুপ্ত যুব আন্দোলন সংগঠন করিতে লাগিলেন এবং নিজেরাও তাঁবেদার অনুচর লইয়া আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচারকার্য এবং মিথ্যা রটনা সুরু করিলেন। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মালয় শাখা কমিটি তিনদিন মিটিং ও আলোচনার পর শ্রীরাসরিহারীর নিকট একটি স্মারকলিপি পাঠাইতে মনস্থ করেন। এই স্মারকলিপি যথাস্থানে পৌঁছিবার পূর্বেই জাপানীরা গোপনে তাহা হস্তগত করিয়াছিল। তাহারা মালয় শাখার সভাপতি শ্রী এন্ রাঘবনকে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করার জন্য শ্রীযুক্ত রাসবিহারী বসুর উপর চাপ দিতে লাগিল। ফলে শ্রীরাঘবন পদত্যাগ করেন। উক্ত শাখার অন্যান্য সভ্যগণ বুঝিলেন যে, পদত্যাগই জাপানীদের কাম্য, কেননা, তাহা হইলে জাপানের তাঁবেদারগণকে লইয়া সঙ্ঘ পুনর্গঠিত করা যাইবে ও আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ সম্পূর্ণভাবে জাপানীদের ‘পুত্তলিকা’ হইবে। এই সকল বিবেচনা কবিয়া, শ্রীরাঘবনের পরে আর কোন সভ্যই পদত্যাগ করিলেন না।

 ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরে আর একটি প্রতিনিধ সম্মেলন হয়। ইহাতে পূর্ব এশিয়ার সমস্ত দেশের ভারতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় রাসবিহারী বসু জানান যে, শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু আসিতেছেন এবং আন্দোলনের গুরুদায়িত্বভার তাঁহার ন্যায় একজন যােগ্যতম জন-নেতার উপর অর্পিত হইলে তিনি পদত্যাগ করিবেন।

 ১৯৪৩ সালের ২রা জুলাই শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে পৌঁছেন এবং ৪ঠা জুলাই আহূত এক প্রতিনিধি সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সকল আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাসবিহারী পদত্যাগ করেন। বাঙ্গলা তথা ভারতের জনপ্রিয় একজন কংগ্রেসনেতাকে লাভ করিয়া তাজাদ হিন্দ সঙ্ঘ এবং তদীয় বাহিনী নবপ্রাণসঞ্চারে চঞ্চল হইয়া উঠিল। ৫ই জুলাই সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যবিবরণী গৃহীত হয় এবং ঐ তারিখে উক্ত বাহিনীর গঠন সংবাদ প্রকাশ্যভাবে জগতে ঘােষণা করা হয়। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব গ্রহণের পর হইতে ঘটনাবলী দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকে। নারিগণও দলে দলে আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের সভ্যা হইতে থাকেন। তাহাদের মধ্য হইতে স্বেচ্ছাসেবিকা বাছাই করিয়া শ্রীমতী লক্ষ্মীর নেতৃত্বে “রাণী অফ্ ঝান্সী রেজিমেণ্ট” গঠিত হইল। অনেক মহিলা রেড ক্রসের সভ্য হইলেন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে এবং পরে রেঙ্গুনেও নারীদিগকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করিবার জন্য দুইটি সামরিক শিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপিত হইল।

 ১৯৪২ সালে আজাদ হিন্দ্ ফৌজে স্বেচ্ছাসৈন্য সংগ্রহ করিবার জন্য আহ্বান জানান হইয়াছিল। অগণিত লােক সৈন্যদলে নাম লিখাইয়াছিল; কিন্তু জাপানীদের অস্পষ্ট নীতির ফলে সৈন্যদের শিক্ষাদান কার্যে বেশী দূর অগ্রসর হওয়া যায় নাই। এইবার শ্রীসুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে অবস্থা পরিবর্তিত হইল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই মতামত ব্যক্ত করিলেন যে, আজাদ হিন্দ্ ফৌজই ভারতবর্ষের প্রতিনিধিমূলক জাতীয় বাহিনী। জাপানীদের সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব থাকিলে ইহা বিভীষণ বাহিনী বলিয়া কুখ্যাত হইবে। ইহার নীতি, কার্যকলাপ, নেতৃত্ব—ভারতীয় দেশপ্রেমিকগণ কতৃকই চালিত হইবে। জাপানীদের ভারত আক্রমণের অধিকার নাই। কোনরূপ বৈদেশিক কর্তৃত্ব অথবা একজনও বৈদেশিক সৈন্যকে ভারতভূমিতে স্বীকার করা চলিবে না। জাপানিগণ যদি বলেন যে, তাঁহারা ভারতকে বৃটিশ শক্তির কবল হইতে মুক্ত করিয়া স্বাধীনতা দান করিতে যাইতেছেন, তথাপি আজাদ হিন্দ্ ফৌজ তাহাদের অন্যায় আক্রমণকারী হিসাবেই গণ্য করিবে। ভারতবর্ষকে যদি বৃটিশের কবল হইতে মুক্ত করিতে হয়, তবে একমাত্র ভারতের নিজস্ব বাহিনীই তাহা করিতে পারে। জাপানীদের সামরিক কৌশল ও নীতির দ্বারা এই ভারতীয় বাহিনী কখনই চালিত হইতে পারিবে না; জাপানীদের নীতির সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব থাকিল ইহা পঞ্চম বাহিনী বলিয়া ইতিহাসে কলঙ্কভাগী হইবে। এই নীতিগত সুস্পষ্ট ঘােষণার ফলে আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘ এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ নবশক্তিতে উজ্জীবিত হইল। দেশপ্রেমিক ভারতীয়গণ এই প্রতিষ্ঠান এবং এই বাহিনীকে সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করিয়া ইহাকে আরও শক্তিশালী করিবার জন্য সকল শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োগ করিলেন। মালয়ে একটি সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র খােলা হইল। ইহাতে একই সময়ে ৭০০০ জনকে লইয়া পালাক্রমে সামরিক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা হইয়াছিল। ৭০০০ হাজার ব্যক্তি লইয়া একটি দল হইত। এইরূপে দলে দলে স্বেচ্ছাসৈন্য শিক্ষিত হইতে লাগিল। ভারতীয় বাহিনী ও নন্-কমিশণ্ড অফিসারগণের মধ্য হইতে ঊর্ধ্বতন অফিসার বাছাই করিয়া শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হইয়াছিল। কেবলমাত্র ভারতীয়গণের নিকট হইতেই অর্থসংগ্রহ করা হইত। স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হইয়া ভারতীয়গণ অকাতরে দান করিতে লাগিলেন। অর্থভাণ্ডার, সৈন্য বাহিনী নানাপ্রকার জনহিতকর কার্যকলাপ প্রভৃতি ব্যাপকতা লাভ করায় একটি গবর্নমেণ্ট স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হইল।

 সুতরাং শ্রীসুভাষচন্দ্র একটি অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট গঠন করিলেন। ইহার নাম হইল স্বাধীন-ভারত-অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট। তাঁহাকেই রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান অধিনায়ক করা হইল। ইহা ইংলণ্ডের বিরুদ্ধে যুধ্যমান সকল রাষ্ট্র কতৃক গবর্ণমেণ্ট হিসাবে স্বীকৃত হইল। ঐ বৎসর ২৩শে অক্টোবর স্বাধীন-ভারত-অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট যথাযথ নিয়ম ও রীতি অনুযায়ী ইংলণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘােষণা করিল। আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘ ও স্বাধীন-ভারত-অস্থায়ী গবর্নমেণ্টের প্রধান কর্মস্থল ভারতের নিকটবর্তী কোন স্থানে হওয়া আবশ্যক বিবেচনায় ১৯৪৪ সালের ৭ই জানুয়ারী উহার কর্মস্থল বার্মায় স্থানান্তরিত হয়। বার্মায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর হইতে অস্থায়ী গবর্ণমেণ্টের কার্যকলাপ, আরও ব্যাপক হইয়া উঠে। স্বাধীন ভারত অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট যথাযথভাবে মন্ত্রী নিয়ােগ করিয়াই বিভিন্ন রাষ্ট্রিক কার্য চালাইতেন, কাহারও খুসীমত বা নীতিশূন্যভাবে কিছুই ঘটিতে পারিত না। এই সকল মন্ত্রী ছিলেন আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। রেঙ্গুণই ছিল অস্থায়ী গবর্নমেণ্টের রাজধানী এবং প্রধান কর্মস্থল। এখানে ১৯টি বিভিন্ন ডিপার্টমেণ্ট ছিল। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেণ্টেরই রীতিমতভাবে রেকর্ড-বুকস্ নথিপত্র হিসাব প্রভৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিগণকেই এই সকল কর্মে নিয়ােগ করা হইত। ঊর্ধতন কর্মচারীর নিকট তাঁহাদের জবাবদিহি করিতে হইত। এক কথায় ইহা আইন অনুসারে নির্বাচিত গবর্ণমেণ্টের মতই ছিল। রেঙ্গুন হেডকোয়ার্টার হওয়ায় নানা দিক দিয়া অনেক সুবিধা হইয়াছিল।

 এই সঙ্ঘের রিয়ার হেডকোয়ার্টার্স ছিল সিঙ্গাপুরে। এখান হইতেই মালয়, সুমাত্রা, জাভা, বাের্ণিও প্রভৃতি অঞ্চলের তদারক করা হইত। আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘের কেবলমাত্র মালয়েই ৭০টি শাখা ছিল, মালয় শাখার সভ্যসংখ্যা দুই লক্ষের উপর, বার্মায় ছিল ১০০টি শাখা, শ্যামে ছিল ২৪টি। ইহা ছাড়া আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, সুমাত্রা, জাভা, বোর্ণিও সেলিবিস দ্বীপপুঞ্জ, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, চীন মাঞ্চুকুয়ো এবং জাপান প্রভৃতি স্থানেও ইহার অসংখ্য শাখা এবং অভাবনীয় প্রভাব বৃদ্ধি পাইয়াছিল। আজাদ হিন্দ্ ফৌজের জন্য সৈন্য এবং সিভিল সার্ভিসের জন্য অফিসার সংগ্রহ করা হইত। সামরিক শিক্ষাদানের জন্য ৯টি কেন্দ্র ছিল। সিঙ্গাপুর এবং রেঙ্গুনে অফিসার ট্রেণিংয়ের জন্য দুইটি কেন্দ্র ছিল। কোন কেন্দ্রেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন রকমের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় নাই, শিক্ষার্থিগণই পালাক্রমে সে ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। অফিসার এবং এবং এন-সি-ওগণ হিন্দুস্থানী ভাষায় শিক্ষাদান করিতেন। যুদ্ধে আদেশদানের রীতিও ছিল হিন্দুস্থানীতে। কেবলমাত্র মালয়েই প্রায় ২০ হাজার বেসামরিক ব্যক্তিগণকে শিক্ষাদান করিয়া আজাদ হিন্দ্ ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল, ইহা ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল হইতে হাজারে হাজারে শিক্ষার্থী শিক্ষালাভ করিতে আসিয়াছিল, ইহাদের অনেককেই আজাদ হিন্দ্ ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘের সমগ্র আন্দোলনে কেবলমাত্র ভারতীয়গণের অর্থই ব্যয় করা হইত। পূর্বএশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ভারতীয়গণের নিকট হইতেই অর্থ সংগ্রহ করা হইত। বার্মায় ভারতীয় বাসিন্দাগণের নিকট হইতে কিছু দিনের মধ্যেই ৮ কোটি টাকা সংগৃহীত হইয়াছিল। ১৯৪৫ সালে জানুয়ারী মাসে ‘নব বৎসরের’ উপহার হিসাবে মালয় ভারতকে ৪০ লক্ষ টাকা দান করিয়াছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ নিজ প্রয়োজনের জন্য বাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিজ অর্থ দিয়াই ক্রয় করিত। আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘ ছিল প্রধানতঃ একটি রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ইহাকে সমাজসেবার গুরুদায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। যুদ্ধপীড়িতদের সাহায্যকল্পে ইহার ভাণ্ডার হইতে অজস্র অর্থ ব্যয় করা হইত। মালয়ের শ্রমিকগণ চরম দুর্দশায় পড়িয়াছিল, সুতরাং উক্ত সদ্য মজুরদিগের জন্য চিকিৎসালয়, ডাক্তার, ঔষধ, পথ্য, খাদ্য প্রভৃতি ব্যাপারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিয়াছে। কুয়ালা-লামপুরে ছিল সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সাহায্যকেন্দ্র। এখানে প্রত্যহ এক হাজারের উপর নারী, শিশু ও দুর্গতজনকে নানাবিধ সাহায্য দেওয়া হইত। ইহার মাসিক খরচ ছিল ৭৫ হাজার ডলার। সঙ্ঘ বার্মাতে অনেকগুলি দাতব্য চিকিৎসালয় চালাইত। উক্ত সঙ্ঘ শ্যামে এমটি আধুনিক ধরণের উচ্চাঙ্গের হাসপাতাল খুলিয়াছিল। তাছাড়া দুর্গত ভারতীয়গণের বসতি স্থাপনের জন্য উক্ত সঙ্ঘ ভূমি সংগঠনের কার্যসূচী গ্রহণ করিয়াছিল। মালয়ের জঙ্গল অপসারিত করিয়া প্রায় ২০০০ একর জমি বাসােপযােগী করা হইয়াছে। ভারতীয়গণ এখানে ভূমিকর্ষণের বাণিজ্যোপযােগী বৃক্ষরােপণের ব্যবস্থা করিয়াছেন। বালক-বালিকাদিগকে শিক্ষাদানের জন্যও আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ সচেষ্ট হইয়াছিল। পূর্ব এশিয়াবাসী ভারতীয়গণের জন্য হিন্দুস্থানী শিক্ষা দিবার সুবন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। উক্ত সঙ্ঘ চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়িয়া জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। কেবলমাত্র বার্মাতে উক্ত সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৬৫টি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 সংবাদপত্র প্রাপ্ত এই সকল তথ্য অতি সামান্য। ইহা বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, খাঁটি অনুসন্ধান করিলে আরও বিশদ তথ্য লাভ করা যাইবে। স্বাধীন ভারতের এই অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট, আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের পিছনে শুধু যে পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়গণের সামগ্রিক সমর্থন ছিল তাহা নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের, এমন কি তথাকথিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যেও সমর্থনের অভাব ছিল না।

 আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত প্রবেশের অব্যবহিত পূর্বে বার্মার পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ ছিল না। শ্রীসুভাষচন্দ্রের সর্বাপেক্ষা কৃতিত্ব এই যে, তাঁহারই অনমনীয় নীতির ফলে জাপানীরা ভারত আক্রমণের নীতি পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হয়। ইহা ছাড়া অর্থনীতিক সাহায্যের দিক দিয়া বিচার করিলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারত অভিযানের ন্যায় এক বৃহৎ দূরূহ অভিযানের ক্ষমতা তাহাদের ছিল না। এদিকে বার্ম্মা পুনর্দখলের যুদ্ধ শুরু করিবার জন্য বৃটিশ শক্তি বদ্ধপরিকর হইয়াছে। হকোয়াং উপত্যকায় ব্রিটীশের আক্রমণ এবং তাহাদের চিন্দুইন নদী অতিক্রমের সম্ভাবনায় জাপানীরা অধীর হইয়া পড়িল। তাহারা তাড়াহুড়া করিয়া একটা পরিকল্পনা করিয়া ফেলিল। ইম্ফল দখল করিবার জন্য অবিলম্বে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানী বাহিনীর ভারত আক্রমণের অধিকার কিছুতেই স্বীকার করিবে না। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে জাপানীদের নীতি ঘোষণা করিতে হইল যে, উহারা কেবলমাত্র ইম্ফল দখল করিতে চায়; অতঃপর ভারত আক্রমণের সমস্ত সামরিক কার্যকলাপ আজাদ হিন্দ ফৌজের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিস্থিতি সম্যক বুঝিতে পারিলেন। তথাপি ইম্ফল দখলের যুদ্ধে তাঁহারাই প্রধান অংশ গ্রহণ করিতে মনস্থ করিলেন। ১৯৪৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী আজাদ হিন্দ ফৌজ আক্রমণাত্মক কার্য শুরু করে। ১৮ই মার্চ্চ শা’নওয়াজের অধীনস্থ বাহিণী পালেল খণ্ডের মধ্য দিয় ভারতব্রহ্ম সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতভূমিতে পদার্পণ করে ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এইরূপে ভারতবর্ষের একটি অংশ শত্রুকবলমুক্ত হয়। মেজর জেনারেল চ্যাটার্জ্জী এই অঞ্চলের প্রথম শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন।

 এই বাহিনীতে প্রধানতঃ তিনটি ব্রিগেড, ছিল,—(১) শা’নওয়াজের নেতৃত্বে ৩২০০ সৈন্য লইয়া গঠিত ‘সুভাষ ব্রিগেড’।

 (২) কিয়ানির নেতৃত্বে ‘গান্ধী ব্রিগেড’। ইহার সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৮০০।

 (৩) মােহন সিংহের নেতৃত্বে ‘আজাদ ব্রিগেড’। ইহাতে দুই নং ব্রিগেডের সমান সংখ্যক সৈন্য ছিল।

 ইহা ছাড়া তিনশত বাহাদুর দলের ফৌজ ছিল। সাতশত বেসামরিক সাহায্যকারীও ইহাদের সঙ্গে ছিলেন। কর্ণেল গুরু বক্স সিং ধীলনের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য লইয়া গঠিত নেহরু ব্রিগেড ইহাদের পিছনে ছিল। রাণী ঝান্সি ব্রিগেড ও বালসেনাদলও বিশেষ উল্লেখযােগ্য অংশ গ্রহণ করে। বালসেনাদল আত্মঘাতী বাহিণীর কাজ করিত। ইহারা পৃষ্ঠে মাইন বাঁধিয়া শত্রুর ট্যাঙ্কের নীচে পড়িয়া থাকিত ও সুযােগমত ট্যাঙ্ক উড়াইয়া দিত এবং নিজেরা মৃত্যুবরণ করিত। তাহারা মােরাই, কোহিমা ও অন্যান্য অনেক জনপদ দখল করিয়া ইম্ফলে উপনীত হয় এবং উহা অবরােধ করে। ২৭শে মার্চ্চ হইতে ৮ই মে পর্য্যন্ত ইম্ফল-কোহিমা-টিডি্ডম এলাকায় ও মণিপুর রােডের উপর সর্ব্বাপেক্ষা ভীষণতম যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে আজাদী সৈন্যেরা অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে। এই যুদ্ধে কোনরূপ বিমান সাহায্য দেওয়া সম্ভব হয় নাই এবং নিদারুণ বর্ষায় সরবরাহ পথ ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল, তখন এই বাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। অতঃপর আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। যখন বৃটিশ শক্তি বার্ম্মা আক্রমণ করিল, তখন এই বাহিনীর অনেক ‘ষ্টাফ অফিসার’ বৃটিশ পক্ষে যােগ দেন, কিন্তু অধিকাংশই আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখিয়া অবিচলিত ছিলেন। বৃটিশের হস্তে ‘মিক্তিলার’ পতন হইলে যখন পরিষ্কার বােঝা গেল জাপানীরা বৃটিশ অগ্রসরকে ঠেকাইতে পারিবে না, তখন রেঙ্গুন পরিত্যাগের পরিকল্পনা করা হইল।

 ১৯৪৫ সালের ২৩শে এপ্রিল জাপানী প্রধান সেনাপতি এবং বার্ম্মা গবর্ণমেণ্ট রেঙ্গুন ত্যাগ করিল। তাহাদের সহিত একত্রে রেঙ্গুন ত্যাগ করিতে শ্রীসুভাষচন্দ্রের অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট অস্বীকার করিয়াছিলেন। তাঁহারা ২৪শে এপ্রিল উক্ত সহর ত্যাগ করিয়া আসেন। কিন্তু ভারতীয়গণের ধন প্রাণ রক্ষা করিবার জন্য মেজর জেনারেল লোকনাথনের অধিনায়কত্বে ছয় হাজার আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্য রাখিয়া এবং সঙ্ঘের সহ-সভাপতি শ্রীযুক্ত জে, এন, ভাদুড়ীর উপর সঙ্ঘের সকল দায়িত্বভার অর্পণ করিয়া চলিয়া আসা হইয়াছিল। রেঙ্গুন ত্যাগের পূর্ব্বেই স্বাধীন ভারত অস্থায়ী গবর্ণমেণ্টের সকল দেনাপাওনা পরিশোেধ করা হইয়াছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ রেঙ্গুণের সকল কর্ত্তৃত্বভার গ্রহণ করেন। জাপানীদের পশ্চাদপসরণ ও বৃটিশ কর্ত্তৃক পুনরধিকারের সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে রেঙ্গুণে একটিও রাহাজানি বা অন্য কোনরূপ অরাজক বিশৃঙ্খল অবস্থা ঘটে নাই। ইহার সহিত তুলনায় ১৯৪২ সালের কথা ভাবিলে আশ্চর্য হইতে হয়। যখন বৃটিশেরা বার্ম্মা ত্যাগ করিয়া আসে, তখন সমগ্র দেশে অভাবনীয় অরাজকতা, লুঠতরাজ, খুনজখম, দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটিয়াই চলিয়াছিল। সেদিনের কথা মনে করিলে আজিও ভারতীয়গণ আতঙ্কে শিহরিয়া ওঠেন।

 ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে আজাদ হিন্দ্ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ১৯৪৫এর মে মাস পর্যন্ত এই ব্যাঙ্ক যাবতীয় কাজকর্ম্ম চালাইতেছিল। ১৯শে মে বৃটিশ সামরিক কর্ত্তৃপক্ষ হঠাৎ উহা অধিকার করিয়া বসে। ফিল্ড সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্ত্তৃপক্ষ ২৮শে মে হঠাৎ শ্রীযুক্ত ভাদুড়ীকে গ্রেপ্তার করে এবং তখন হইতে আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের কার্যকলাপ বন্ধ হইয়া যায়। তখন হইতেই আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের কর্মিগণ ও তাঁহাদের সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণকে দলে দলে প্রেপ্তার করা হইতে থাকে।