বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পরিশিষ্ট (ঙ)

পরিশিষ্ট-(ঙ)

মহাত্মা গান্ধীজীর উদ্দেশ্যে

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বেতার বক্তৃতা

মহাত্মাজি!
(৯ই জুলাই, ১৯৪৪)

 ব্রিটীশ কারাগারে শ্রীমতী কস্তুরবার শােচনীয় মৃত্যুর পর আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে দেশবাসীর উদ্বেগ হওয়া স্বাভাবিক।······প্রবাসী ভারতবাসীর পক্ষে মতের পার্থক্য সামান্য ঘরােয়া বিবাদ ছাড়া কিছুই নয়। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহাের কংগ্রেসে আপনি স্বাধীনতার প্রস্তাব আনিবার পর হইতে সমস্ত কংগ্রেসসেবীর সম্মুখে কেবল একটী মাত্র লক্ষ্য —পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রবাসী ভারতবাসীরা আপনাকেই ভারতে মহাজাগরণের স্রষ্টা বলিয়া জানে। প্রবাসী ভারতবাসী এবং ভারতের স্বাধীনতার বিদেশী সমর্থকদের দৃষ্টিতে সেইদিন আপনার মর্য্যাদা শতগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে, যেইদিন ১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে আপনি অসমসাহসের সহিত “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাব আনয়ন করেন।

 ব্রিটীশ গভর্ণমেণ্ট ও ব্রিটীশ জনগণের মধ্যে কোনরূপ প্রভেদ করা আমাদের পক্ষে মারাত্মক ভুল হইবে। অবশ্য একথা সত্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় বৃটেনেও আদর্শবাদী একদল লােক আছে যাহারা ভারতকে স্বাধীন দেখিতে চায়। ইহারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটীশ গভর্ণমেণ্ট ও ব্রিটীশ জনসাধারণের মনােভাব আসলে এক এবং অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিচালনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও বলিতে পারি, ওয়াশিংটনের বর্ত্তমান শাসকগােষ্ঠী এখন সমগ্র পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব স্থাপনের স্বপ্ন দেখিতেছেন। এই শাসকগােষ্ঠী এবং তাঁহাদের প্রচারকগণ এক্ষণে ‘আমেরিকান শতাব্দী’ (American Cantury)র কথা খােলাখুলি ভাবেই বলিয়া থাকেন। ইহাদের মধ্যে এমন চরমপন্থীও আছে যাহারা বৃটেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম রাষ্ট্র বলিয়া অভিহিত করিতেছে।

 মহাত্মাজি, আপনাকে আমি নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, এই বাধাবিঘ্ন-পরিকীর্ণ পথে যাত্রা করিবার পূর্বে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ইহার দোষগুণ, ফলাফল সমস্ত বিচার করিয়া দেখিয়াছি। এতদিন যথাশক্তি দেশবাসীর সেবা করিয়া অবশেষে দেশদ্রোহী সাজিবার বা কেহ আমাকে দেশদ্রোহী বলিতে পারে এইরূপ সুযোগ দিবার বাসনা আমার আদৌ ছিল না। দেশবাসীর ভালবাসা ও উদারতা আমাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়াছে—এই সম্মান ও মর্য্যাদা যে কোন দেশকর্মীর পক্ষেই অতীব শ্লাঘার বস্তু। উপরন্তু, দেশে আমি এমন একটি দল গঠন করিয়াছি যাহাতে আমি বহু আদর্শনিষ্ঠ ও কর্মকুশল দেশসেবীর অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করিয়াছি—যাহারা আমাকে একান্তরূপে বিশ্বাস করিতেন। এই দুর্গম লক্ষ্যপথে যাত্রা করিয়া আমি কেবল নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎই বিপন্ন করি নাই আমার পার্টির ভবিষ্যৎও অন্ধকার করিয়াছি। যদি আমার বিন্দুমাত্র আশা থাকিত যে বাহিরের সাহায্য ব্যতিরেকেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জন করা সম্ভব তাহা হইলে এই সঙ্কটময় মুহূর্ত্তে আমি কখনই দেশত্যাগী হইতাম না। যদি এমন আশা থাকিত যে আমাদের জীবৎকালেই বর্ত্তমান যুদ্ধের ন্যায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জনের পক্ষে আর একটি সুযোগ মিলিবে তাহা হইলেও আমি এ সময়ে ভারত ত্যাগ করিতাম না।

 চক্রশক্তির সম্বন্ধে আমাকে একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হইবে। ইহা কি সম্ভব যে আমি জাপানীদের দ্বারা প্রতারিত হইয়াছি? আমার বিশ্বাস সকলেই স্বীকার করিবেন যে পৃথিবীতে ব্রিটীশ রাজনীতিকগণই (politicians) সর্বাপেক্ষা ধূর্ত্ত ও চতুর। যে ব্যক্তি আজীবন ব্রিটিশ রাজনীতিকদের সংস্পর্শে আসিয়াছে ও তাহাদের সহিত নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাইয়াছে, অন্য কোন দেশের রাজনীতিকদের দ্বারাই সে প্রতারিত হইতে পারে না। ব্রিটীশ রাজনীতিকেরাই যখন আমাকে প্রলুব্ধ করিতে বা বাধ্য করিতে পারে নাই তখন অপর কােন রাজনীতিকই তাহা পারিবে না। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট দীর্ঘ কারাদণ্ড, নির্য্যাতন ও নিপীড়নের দ্বারাও যখন আমাকে ভগ্নোদ্যম ও দুর্ব্বল করিতে সক্ষম হয় নাই তখন আর কোন শক্তিই তাহা করিতে সমর্থ হইবে না।·····স্বদেশের স্বার্থ, মর্য্যাদা ও সম্মান কথঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইতে পারে এমন কোন কাজ আমি কোনদিন করি নাই।

  এক সময় ছিল যখন জাপান আমাদের শত্রু ব্রিটীশের সহিত মিত্রতাবদ্ধ ছিল। যতদিন ইঙ্গ-জাপানী চুক্তি বলবৎ ছিল ততদিন আমি জাপানে আসি নাই। এই দুই দেশের মধ্যে যতদিন কুটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল ততদিন আমি জাপানে আসি নাই। যখন জাপান বৃটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা-রূপ তাহার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল কেবল তখনই আমি স্বেচ্ছায় জাপান পরিদর্শনে আসা স্থির করি; আমার দেশের অনেকের মতই ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে আমার সহানুভূতিও ছিল চুংকিংএর প্রতি। আপনার হয়ত স্মরণ থাকিতে পারে যে, কংগ্রেস সভাপতিরূপে ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমিই চুংকিংএ একটি মেডিক্যাল মিশন প্রেরণ করিয়াছিলাম।

 মহাত্মাজি! আপনি ভালভাবেই জানেন যে ভারতবাসী মুখের কথায় কতদূর অবিশ্বাসী। জাপানের প্রতিশ্রুতি যদি কেবল অন্তঃসারশূন্য মুখের কথামাত্রই হইত তাহা হইলে আমি কখনই তাহার দ্বারা প্রভাবিত হইতাম না।

 মহাত্মাজি, আমরা যে অস্থায়ী সরকার গঠন করিয়াছি তাহার সম্বন্ধে আপনাকে কিছু নিবেদন করিতে ইচ্ছা করি। অস্থায়ী সরকারের একটিমাত্র লক্ষ্য—তাহা হইতেছে সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা ভারতবর্ষকে ব্রিটীশের শৃঙ্খলমুক্ত করা। আমাদের শত্রুগণ বিতাড়িত হইলে ও দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিলেই অস্থায়ী সরকারের প্রয়ােজন নিঃশেষিত হইবে। আমাদের প্রচেষ্টা, দুঃখ-বরণ ও স্বার্থ-ত্যাগের পরিবর্ত্তে আমরা একটিমাত্র পুরস্কার চাই—মাতৃভূমির মুক্তি। আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁহারা ভারত স্বাধীন হইলেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সহিত সকল সংশ্রব ত্যাগ করিবেন।

 যদি দেশবাসী নিজেদের চেষ্টায় স্বাধীন হইতে পারিত বা কোন কারণে ব্রিটীশ গভর্ণমেণ্ট আপনার “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাব মানিয়া লইয়া সত্যসত্যই ভারত পরিত্যাগ করিয়া যাইত তাহা হইলে কেহই আমাদের চেয়ে বেশী আনন্দিত হইত না। কিন্তু আমরা এই স্থির বিশ্বাসেই অগ্রসর হইয়া চলিয়াছি যে উহার কোনটিই সম্ভব হইবে না এবং সশস্ত্র সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী।

 ভারতের স্বাধীনতার শেষযুদ্ধ শুরু হইয়াছে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদল ভারতভূমির উপর অসামান্য বীরত্বের সহিত সংগ্রাম করিতেছে এবং বহু বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ধীরে অথচ অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হইতেছে। এই সশস্ত্র সংগ্রাম চলিতে থাকিবে যতদিন না শেষ ব্রিটীশটি ভারত হইতে বিতাড়িত হয় এবং ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা নয়া দিল্লীর বড়লাট প্রাসাদের শীর্ষে গর্বভরে উড়িতে থাকে।

 হে জাতির জনক! ভারতবর্ষের স্বাধীনতার এই পবিত্র যুদ্ধে আমরা আপনার আশীর্ব্বাদ ও শুভেচ্ছা কামনা করি।

সমাপ্ত