সাহায্য:পাতার অবস্থা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Reverted 1 edit by 103.220.205.197 (talk) to last revision by Hrishikes. (TW)
ট্যাগ: পূর্বাবস্থায় ফেরত
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
১ নং লাইন:
শাক্যবংশের পরিনতি
{{process header
বাপ্পা গোস্বামী
| title = পাতার অবস্থা
 
| section =
 
| previous = [[সাহায্য:সূচী|সাহায্য সূচী]]
বুদ্ধদেব যে শাক্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন তা ইক্ষ্বাকু বংশের একটি ধারা। ইক্ষ্বাকুর বিতাড়িত চার পুত্র ও কন্যা নেপাল সংলগ্ন কপিলাবস্তু তে রাজ্য স্থাপন করেন এবং শাক্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে শাক্য বংশের আয়তন বৃদ্ধি হলে তা বিভক্ত হয় এবং একটি অংশ রোহিনী নদীর অপর পাড়ে নতুন বসতি স্থাপন করে যার নাম ছিল দেবদহ। দেবদহের শাক্যরা কোলীয় শাক্য নামে পরিচিত হয়।শাক্য বংশে দুটি নিয়ম অত্যন্ত কঠোরভাবে পালিত হতো, এক পত্নী গ্রহণ এবং অন্তর্বিবাহ|
| next =
বুদ্ধদেবের পরিশীলিত মানসিক স্তর তাঁকে এই অন্তর্বিবাহের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে সচেতন করেছিল বলেই মনে হয়। তা না হলে কেনই বা তিনি অতি বলিষ্ঠ এবং রণনিপুণ শাক্যদের প্রায় সমস্ত যুবাগনকে তাঁর অহিংস ধর্মে ব্রতী করিয়ে সংঘমুখী করে তুলবেন? আনন্দ, মৌদগল্লায়ন, নন্দ এমনকি দেবদত্ত পর্যন্ত "সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি" কে তাঁদের মূলমন্ত্র করে ক্ষাত্রধর্ম বিসর্জন দিয়ে সংঘ গমন করেন।পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ন শাক্য জাতি শাক্যসিংহের অহিংস মন্ত্রকে তাদের অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তা তাঁদের ধ্বংসের কারণ হয়।যেন পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ ঘটনা প্রবাহ চিত্রনাট্যে বর্ণিত নাটকের মত মঞ্চস্থ হয়|
| shortcut =
এই ধ্বংসলীলা কিভাবে মঞ্চস্থ হয় তার দিকেই নজর ফেরানো যাক।কোশল রাজ প্রসেনজিৎ জীবনের এক পর্যায়ে এসে বুদ্ধদেবের চরণাশ্রিত হান। এক সময় তার বাসনা হয় যে বংশে এরূপ মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে সেই বংশের একটি কন্যাকে কোশলের মহারানী করে আনার। এতে শাক্যরা প্রমাদ গোণেন কারন শাক্য বংশে কঠোরভাবে অন্তর্বিবাহ বলবত ছিল|এই বিপদ থেকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে বুদ্ধদেবের পিতৃব্য শুক্লোদনের পুত্র মহানাম এগিয়ে আসেন। মহানাম সেই সময়ে কপিলাবস্তুর সেনাপতি ছিলেন। মহানাম এর গৃহে তাঁর দাসীর গর্ভে তাঁর এক কন্যা ছিল। সেই কন্যার সাথে প্রসেনজিতের বিবাহ হয়। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মায়। পুত্রের নাম বিরূঢ়ক ও কন্যার নাম বজ্জিরা। বজ্জিরার সঙ্গে অজাতশত্রুর বিবাহ হয়। বিরূঢ়ক যখন মাতুলালয়ে ছিলেন তখন এক মহতী অনুষ্ঠান মঞ্চে খেলার ছলে তিনি উঠে পড়লে এক শাক্যবৃদ্ধ দ্বারা তিনি দাসীপুত্র বলে তিরস্কৃত হন। এর ফলে তিনি অত্যন্ত অপমানিত হন এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি শাক্য বংশ ধ্বংস করবেন। সেই জন্য কোশলের রাজ সিংহাসন দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। তিনি কোশল রাজপুরোহিত পুত্র অম্বরীষ এবং সেনাপতি দীর্ঘকারায়নের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। প্রসেনজিৎ বুদ্ধচরনবন্দনা করে শ্রাবস্তী ফেরার পথে বিরূঢ়কের সিংহাসন অধিকারের খবর পান এবং সাহায্য প্রার্থনাহেতু মগধ উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন| কিন্তু পৌঁছতে রাত্রি হওয়ায় তিনি রাজগৃহে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন এবং বিফল মনোরথে নগরদ্বারের বাইরে প্রাণ ত্যাগ করেন|
| notes = উইকিসংকলনে ব্যবহৃত বিভিন্ন পাতা স্থিতিগুলির একটি ব্যাখ্যা [[File:How to Proofread at Bengali wikisource.ogg|center|450px|thumb|thumbtime=0:23| কি ভাবে মূদ্রণ সংশোধন বা প্রুফরিড করবেন? ([https://www.youtube.com/watch?v=vPN4qjsRBPs&feature=youtu.be ইউটিউবেও দেখুন)]]]
বিরূঢ়ক ও শাক্যবংশীয়দের চরিত্র বর্ণনা এই প্রবন্ধে জরুরী। বিরূঢ়ক রাজপুত্র হিসেবে তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম শক্তিশালী নগর কোশলে জন্মগ্রহণ করেন। রাজকুমারোচিত স্বভাব তার পক্ষে অতি স্বাভাবিক ছিল। ক্ষত্রিয়জনোচিত শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু তে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন আইন অনুযায়ী কোনোভাবেই কোনো রাজপুরুষের সঙ্গে কোনো দাসী বা দাসীগর্ভজাত মহিলার বিবাহ সম্ভব ছিলনা। কিন্তু শাক্যগন এই নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন তাঁর পিতার ক্ষেত্রে এবং তাও বিরূঢ়কের পিতার অজ্ঞাতসারে। বিরূঢ়ক আবশ্যিকভাবেই এই ঘটনাকে তার জন্য অপমানজনক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া ললিতবিস্তারে কোশল রাজবংশ কে মাতঙ্গচ্যুতি অর্থাৎ মাতঙ্গ নামক কোন হীন জাতি থেকে উৎপন্ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।এই সমস্ত কিছুই বিরূঢ়কের সম্মানহানিকর এবং তাঁকে ক্রোধোন্মত্ত করে তোলার পেছনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করেছিল।
}}
অন্যদিকে শাক্য বংশের নেতৃস্থানীয়দের কিছু ক্রিয়া-কলাপ ও সমালোচিত হওয়ার যোগ্য। যে বংশের পরমপুরুষ আচার সর্বস্ব ও ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞ নিষিদ্ধ করার মহাযজ্ঞে নেমেছিলেন এবং বর্ণভেদ প্রথা ও লিঙ্গবৈষম্যকে নির্মূল করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং সেই কারণে যিনি দস্যু, দেহোপজীবিনী সকলকে নিজ শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে তৎকালের অচলায়তনের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন সেই বংশের নেতৃস্থানীয় এক বয়োঃবৃদ্ধের পক্ষে একটি বালক কে দাসীপুত্র হিসেবে ভর্ৎসনা করা কিছুটা আশ্চর্য জনক ই বটে। শাক্যরা সেই সময়ে কিন্তু স্বাধীন রাজবংশ হিসেবে রাজত্ব করতেন না| বুদ্ধদেব যখন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং রাজগৃহে আসেন তখন বিম্বিসারের কাছে নিজ পরিচয় দিয়েছিলেন এইভাবে,
উজুং জনপদোরাজা হিমবন্তসস পসসত|
ধনবিবিষেন সম্পন্নো কোসোলেস নিকেতন||
আদিচ্চা নাম গোত্তেন সাকিয়া নাম জাতিয়া|
তমহা কুলা পব্বাজতোমহি রাজন কামে অভিপল্মযং|| সুত্তনিপাত|
"হে রাজা এখানে সম্মুখস্থ হিমালয়ের পাদদেশে কোশল রাজ্যে একটি ছোট জনপদ আছে তাহার অধিবাসীদের গোত্র আদিত্য এবং জাতি শাক্য।হে রাজা আমি এই বংশে জন্মেছি এবং এখন কাম ভোগের ইচ্ছা ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইয়াছি।"- তথ্যসূত্র; ভগবান বুদ্ধ, ডি. কোশাম্বী|
অর্থাৎ এই সময় শাক্যরা কোশলরাজবংশের অধীনে থেকে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতেন এবং নিজেদের শাসন ব্যবস্থা নিজেরা পরিচালনা করতেন। এই শাক্যদের কোশল রাজবংশের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কিত ছলনা বিধিবহির্ভূত কাজ হয়েছিল বলে বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল। এবং এর কর্মফল ভোগ শাক্যগোত্রীয়দের করতেই হবে এরূপ ভবিষ্যৎবাণী বুদ্ধদেবের মুখে শোনা যায়। কর্মফল ভোগের ঘটনাটি জাতকের কাহিনী রূপেও শাক্য সিংহের মুখে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি নিম্নরূপ-
বুদ্ধদেব একসময় শিরঃপীড়ায় প্রায় তিন দিনের জন্য কাতর হলে শিষ্যরা এর কারণ জানতে চান। উত্তরে বুদ্ধদেব জানান কপিলাবস্তুর পাশে পুরাকালে এক বৃহৎ জলাশয় ছিল| একসময় প্রচন্ড খরা হয় এবং সেই জলাশয়ের মাছ গুলি কপিলাবস্তু অধিবাসীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। শেষ মাছটি একটি বৃহৎ মাছ ছিল যেটিকে খাওয়ার আগে একটি শিশু মাছটির মাথায় তিনবার আঘাত করে। এই মাছটি পূর্ব জন্মে ছিলেন বিরূঢ়ক এবং ছোট মাছগুলো তাঁর সৈন্য ছিল এবং তাদের যারা মেরে খেয়ে ছিলেন তারা শাক্য বংশীয় মানুষ ছিলেন এবং শিশুটি ছিলেন বুদ্ধদেব স্বয়ং।এই কর্মের ফলে তিনি তিনদিন শিরঃপীড়ায় কাতর হয়েছেন।অর্থাৎ কর্মফল সবাইকেই ভোগ করতে হয় তাই বিরূঢ়কের হাতে শাক্য বংশের ধ্বংস হওয়া সময়ের অপেক্ষা এবং তা কর্মফল ই, এই ঘোষণা শাক্য সিংহ কে করতে হয়েছিল।
বিরূঢ়কের মানসিক গঠন এবং মানসপটে শাক্যবৈরিতার যে বিষবৃক্ষের বীজ ঊপ্ত হয়েছিল তার পেছনে কোশলনরেশ প্রসেনজিতের দায় অনেকখানি।প্রসেনজিতের কানপাতলা স্বভাব এবং অগভীর মানসিকতা এক অনভিপ্রেত ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয়।
বুদ্ধদেবের শ্রাবস্তী অবস্থানকালে 500 ভিক্ষু প্রত্যেকদিন অনাথপিণ্ডক ও বিশাখার গৃহে ভিক্ষান্ন গ্রহণ করতেন। প্রসেনজিৎ বুদ্ধদেবের কাছে প্রার্থনা করেন যেন 500 ভিক্ষু প্রত্যেকদিন রাজপ্রাসাদেও অন্নগ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব তাতে রাজিও হন। কিন্তু অনাথপিণ্ডক বা বিশাখা গৃহে যে শ্রদ্ধাসহ ভিক্ষান্ন প্রদত্ত হতো রাজপ্রাসাদে তা হতো না।কোশলনরেশের পক্ষে তার তদারকি করা সম্ভব হতো না, অন্যদিকে মহারানীরা এই কাজে আগ্রহী ছিলেন না। কোন একদিন কোশলনরেশ কিছু রসযুক্ত সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য ভিক্ষুদের জন্য খাদ্যগ্রহণের নির্দিষ্ট স্থানে পাঠালে পরিচারক ফিরে এসে জানায় ভিক্ষুরা অন্নগ্রহণ নিমিত্ত সেখানে আসেননি।মহারাজ বুদ্ধদেবের কাছে এর সম্বন্ধে অনুযোগ করতঃ ভিক্ষুরা কেন আসছেন না তা জানতে চাইলে বুদ্ধদেব জানান ভিক্ষুরা শ্রদ্ধাসহ প্রদত্ত ভিক্ষান্ন যেখানে পান সেখানে তা গ্রহণ করেন। কারা সেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন তা জানতে চাইলে বুদ্ধদেব জানান সজ্ঞাতি বা শাক্যরা এই কাজ অত্যন্ত সুচারুভাবে করে। এমত পরিস্থিতিতে প্রসেনজিৎ একজন শাক্য রাজকুমারীকে বিবাহেচ্ছা ব্যক্ত করেন। এর পেছনে অবশ্য আরেকটি কারণ ও থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। শাক্যরা কোশলনরেশের অধঃস্তন হলেও তারা বংশগৌরবে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন।এবং তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী প্রসেনজিৎ এই কুলের একজনকে প্রধানা মহিষী করে তার পুত্রকে পরবর্তী রাজা করার বাসনা পোষণ করতেন যাতে তাঁর বংশ ও উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
 
এরপরে প্রসেনজিতের দূত শাক্যরাজদরবারে প্রসেনজিতের প্রস্তাব পেশ করেন। শুদ্ধোদন তখনও শাক্য কুলপতি এবং মহানাম সেনাপতি। আগেই বলা হয়েছে শাক্যরা অন্তর্বিবাহ কঠোরভাবে মেনে চলতেন আবার একই সাথে কোশলনরেশের বাসনার বিরোধিতা করাও তাঁদের পক্ষে প্রকাশ্যে সম্ভব ছিল না কারণ এর বিষময় ফল তাঁরা কয়েকবার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ফলে মহানামের কুবুদ্ধির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাঁদের উপায় ছিল না। মহানামের গৃহে তার ঔরসে নাগমুন্ডা নামক এক দাসীর গর্ভে তাঁর এক কন্যা ছিল। তার নাম বাসবক্ষত্রিয়া।তাকে রাজকুমারী পরিচয়ে কোশলনরেশ এর সঙ্গে পরিণয় এর ইচ্ছা প্রকাশ করে প্রসেনজিতের দূতকে জ্ঞাত করা হয়।তিনি প্রকৃত রাজকন্যা কিনা তা জানার উদ্দেশ্যে দূতের তরফে একটি প্রার্থনা শাক্যকুলপতির উদ্দেশ্যে পেশ করা হয় যে বাসবক্ষত্রিয়া শাক্যদের সঙ্গে একই পাত্র থেকে অন্নগ্রহণ করছেন এরকম একটি ভোজসভায় যেন তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়। আবার মহানাম মঞ্চে অবতীর্ণ হন। তিনি জানান যে তাঁকে আর বাসবক্ষত্রিয়াকে যেন একই পাত্রে খাদ্য দেয়া হয় । তিনি প্রথম খাদ্যগ্রাস গ্রহনের পরে যেন বাসবক্ষত্রিয়াকে সেখানে আনা হয়। তারপরে অন্ন যেন বাসবক্ষত্রিয়া গ্রহণ করেন এবং সেই সময় মহানামকে যেন কোন জনৈক রাজার কাল্পনিক অতি জরুরী পত্র পাঠ করার অনুরোধ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নাটক মঞ্চস্থ হয়।মহানাম সেই কাল্পনিক জরুরী পত্রে এতটাই মনোনিবেশ করেন যে বাসবক্ষত্রিয়ার খাদ্যগ্রহণ শেষ হয় এবং কোশলদূতের মনে রাজকন্যার পরিচয় সম্পর্কিত সন্দেহ সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়। এরপর কোশলনরেশ বাসবক্ষত্রিয়াকে বিবাহ করে তাকে অগ্রমহিষীর স্থান দেন। যথাকালে এক পুত্র এবং এক কন্যা প্রসেনজিতের ঔরসে তাঁর গর্ভে জন্ম নেয়। কোশলনরেশ পুত্রের নামকরনের জন্য তার পিতামহীর কাছে এক বধির আমাত্যকে পাঠালে রাজপিতামহী বলেন পুত্রের জন্মের পরে তো বাসবক্ষত্রিয়া আরো বল্লভা অর্থাৎ মহারাজের প্রিয়া হবেন। বধির আমাত্য এই বল্লভা কে বিরূঢ়ক শোনেন এবং রাজপুত্রের নামকরণ হয় বিরূঢ়ক। এরপরের অল্প কিছু অংশ পূর্ববর্তী অংশে জানানো হয়েছে। বিরূঢ়ক কয়েকবার মাতুলালয়ে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করার পরে তাঁর 16 বছর বয়সে তাঁকে মাতুলালয়ে পাঠানো হয়। সেখানেই তার মঞ্চে উঠে পড়ার ঘটনা, সেখানের একটি উচ্চাসনে বসার ঘটনা এবং দাসীপুত্র রূপে তিরস্কৃত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাঁর বয়স্য অম্বরীষ দাসীপুত্র বক্তব্যের মর্মার্থ উদ্ধারে সমর্থ হয় এবং এই সত্য শ্রাবস্তী রাজপ্রাসাদে উন্মোচন করে। বিরূঢ়কের রাজকুমারোচিত মন এতে অভিমানাহত হয় এবং যে উচ্চাসন তার বসার কারণে দুগ্ধধৌত করার প্রয়োজন হয়েছিল তাকে শাক্যরক্তে ধৌত করার পণ নিয়ে তিনি ফিরে আসেন।সম্পূর্ণ ঘটনা রাজার কর্ণগোচর হলে রাজা বাসবক্ষত্রিয়া এবং বিরূঢ়কের প্রাপ্ত সমস্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে তাদের শুধুমাত্র দাসদের প্রদত্ত সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দেন। এর কিছু পরে বুদ্ধদেব- শ্রাবস্তী এলে প্রসেনজিৎ তার সঙ্গে ঘটা ছলনার কথা এবং তৎপরবর্তী কালে বাসবক্ষত্রিয়া ও বিরূঢ়ক কে প্রদত্ত অগ্রমহিষী ও যুবরাজপদ প্রত্যাহারের ঘটনা নিবেদন করেন।বুদ্ধদেব এই ছলনার নিন্দা করলেও কাষ্ঠহারী জাতকের কাহিনী বলে কাষ্ঠবাহন রাজার কাঠকুড়ুনির ছেলে হয়েও রাজার ঔরসে জন্মগ্রহন করায় অর্থাৎ পিতৃপরিচয়ে বারানসীরাজ হয়েছিলেন সেই ঘটনা ব্যক্ত করেন এবং বাসবক্ষত্রিয়া ও বিরূঢ়ক দুজনই পিতৃপরিচয়ে ক্ষত্রিয়বংশজাত এবং তাদের প্রাপ্ত সমস্ত সুবিধাই যে তারা ভোগ করার অধিকারী এই বিধান দিলে বাসবক্ষত্রিয়া ও বিরূঢ়কের হৃতমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই মর্যাদাহরন নিশ্চিতভাবে বিরূঢ়কের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যা পরিণতি পায় শাক্য বংশের বিলোপসাধনে।|
প্রসেনজিৎ কৃত আরেকটি ঘটনা তাঁর সিংহাসনচ্যুতি এবং পরিনতি স্বরূপ বিরূঢ়কের সিংহাসনপ্রাপ্তি এবং তাঁর প্রতিজ্ঞাস্বরূপ শাক্যদের চরমপরিণতির কারণ। কোশল রাজকুমার প্রসেনজিৎ, মল্লবীর বন্ধুলমল্ল এবং লিচ্ছবীবীর মহালি(মহালিচ্ছবী) একই সঙ্গে তক্ষশীলায় শিক্ষাগ্রহণান্তে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনপূর্বক তাঁদের অধীত বিদ্যা প্রদর্শনেআগ্রহী হন নিজের রাজ্যে।প্রসেনজিৎ এবং মহালি কোন বিরূপতা ছাড়াই অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করেন কিন্তু মল্লদের ক্ষেত্রে একটি ঘটনা ঘটে।বন্ধুলমল্ল তাঁর তরবারির শৌর্য্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ষাটটি মাস বাঁশের দন্ড একসঙ্গে বেঁধে এক তরবারির আঘাতে সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত করে দেখাবার প্রয়াস পান।কোন শত্রুভাবাপন্ন মল্লকুমার একটি বাঁশের দন্ডের ভেতরে লোহার দন্ড প্রবেশ করিয়ে রাখে।এরপর বন্ধুলমল্ল যদিও সেই একত্রীভূত বংশদন্ড স্তূপকে দ্বিখন্ডিত করেন কিন্তু সেই ধাতবশব্দ শুনে তিনি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পান এবং মল্লভূমি ত্যাগ করে মিত্র প্রসেনজিতের আশ্রয়গ্রহন করেন| তিনি শ্রাবস্তীতে বসবাস করতে থাকেন এবং প্রসেনজিতের প্রধান সহায় হন।কোনভাবেই এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বন্ধুলমল্লর মহাপ্রতাপ কোশল রাজ্যকে মহাশক্তিশালী করার প্রধানতম অবলম্বন ছিল। বন্ধুলমল্লর স্ত্রী অপুত্রক থাকায় তিনি তাকে পিতৃগৃহে প্রেরণ করেন।তাঁর স্ত্রী মল্লিকা সম্পূর্ণ ঘটনা বুদ্ধের নিকট নিবেদন করলে বুদ্ধদেব তাঁকে পতিগৃহে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরে মল্লিকা সন্তানসম্ভবা হন।এই অবস্থায় তার লিচ্ছবী গণরাজ্যের অভিষেক পুষ্করিণীর জলপান ও সেখানে অবগাহনের ইচ্ছে হলে বন্ধুল সেই ইচ্ছা পূরণে উদ্যোগী হন। লিচ্ছবীরা বাধা দিলে সেই বাধা বাহুবলে দূর করেন।বন্ধুলের প্রত্যাগমন কালে ৫০০ লিচ্ছবী রাজপুরুষ তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহালির আদেশ প্রার্থনা করলে মহালি তাঁদের এই কাজ করতে নিষেধ করেন।কিন্তু সেই নিষেধ মানতে রাজি না হওয়ায় মহালি লিচ্ছবীদের নির্দেশ দেন যদি কোন রথচক্র অর্ধপ্রোথিত অবস্থায় তাঁরা দেখেন সেখান থেকে তাঁরা যেন প্রত্যাগমন করেন| এরপরেও অগ্রসর হলে যেখানে বজ্রনাদ শুনবেন সেখান থেকে যেন প্রত্যাগমন করেন এবং তার পরেও যদি অগ্রসর হন তবে যেখানে তাঁদের রথের শীর্ষদেশ তিরবিদ্ধ হবে সেখান থেকে যেন অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করেন নচেৎ মৃত্যু অনিবার্য। পশ্চাদ্ধাবনকালে বন্ধুল পাঁচশ লিচ্ছবী রাজপুরুষকে বাধাদানের উদ্দেশ্যে তাঁর ধনুতে জ্যা রোপন করলে তার রথচক্র অর্ধেক ভূপ্রবিষ্ট হয়।পরবর্তীতে তিনি ধনুতে টংকার করলে তা বজ্রনাদের ধ্বনি সৃষ্টি করে এর পরেও লিচ্ছবীরা অগ্রসর হলে তিনি তাঁদের রথশীর্ষ কর্তন করেন।তবুও লিচ্ছবীরা তাঁকে অনুসরণ করলে তিনি একই তীরে ৫০০ লিচ্ছবীর কটিবন্ধের স্থান বিদ্ধ করে প্রত্যেককে দ্বিখণ্ডিত করেন। এ হয়তো অতিকথন কিন্তু তাঁর শারীরিক বলের পরাক্রম ব্যক্ত করতেই এত রূপকের আমদানি। বন্ধুলমল্ল প্রসেনজিতের পরমসহায় ছিলেন।লিচ্ছবী রাজপুরুষদের দমনের পরে তার ৩২ টি পুত্র হয় তাঁরাও বন্ধুলের সমমানের যোদ্ধা ছিলেন। বন্ধুলমল্ল অত্যন্ত ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন। ন্যায়ালয়ের অনৈতিক কাজকর্ম প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বন্ধ করায় প্রসেনজিৎ তাঁকে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতি পদেও অভিষিক্ত করেন। তিনি প্রসেনজিতের বয়স্য ছিলেন সুতরাং তাঁদের সম্পর্ক রাজা ও সেনাপতির সম্পর্কের বাইরেও বন্ধুত্বের ও ছিল। তার জেরে বন্ধুলমল্ল কোশলনরেশকে পরিহাসে বিদ্ধ করতেও সংকুচিত হতেন না। যারা বন্ধুলের উন্নতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল তারা কোশলনরেশের মনকে বন্ধুলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তুলতে বিশেষ প্রযত্ন নেয়।তারা প্রসেনজিতের অগভীর মানসিকতা সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং তাঁকে এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে তুলতে সক্ষম হয় যে বন্ধুল তাঁর ৩২ পুত্রসহ রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং শীঘ্রই রাজসিংহাসন দখল করবেন।প্রসেনজিতের পক্ষে বন্ধুলের বিরুদ্ধে প্রমাণহীন অবস্থায় প্রকাশ্যে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল না কারণ বন্ধুল নাগরিক মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। প্রসেনজিৎ সপুত্রক বন্ধুলকে প্রত্যন্ত প্রদেশে দস্যুদমন উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। এঁদের পেছনে তিনি গুপ্তঘাতক প্রেরণ করেন। বন্ধুল শান্তিপ্রতিষ্ঠা করে শ্রাবস্তী প্রত্যাবর্তনের পথে সপুত্রক গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন।তাঁর এবং তার ৩২ পুত্রের মস্তক প্রসেনজিতের কাছে প্রেরিত হয়। পরে প্রসেনজিৎ এহেন ভুল সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন| তিনি বন্ধুলপত্নী এবং তাঁর পুত্রবধূদের নিজ নিজ পিত্রালয়ে প্রেরণ করেন এবং বন্ধুলের ভাগ্নে দীর্ঘকারায়নকে সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। দীর্ঘকারায়ন কিন্তু এই পদ লাভের উৎকোচের বিনিময়ে নিজ জ্ঞাতির রক্তপাত সহজভাবে গ্রহণ করেননি। তিনি বন্ধুলের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন এবং এই মাতুল হত্যার প্রতিশোধগ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেই সময়ে বুদ্ধ সন্দর্শনে কোনরকম রাজঅভিজ্ঞা গ্রহণ করে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। বন্ধুলহত্যার পরে প্রসেনজিৎ প্রকৃতই অনুতপ্ত ছিলেন এবং মানসিক শান্তি প্রাপ্তির অভিলাষে তিনি বাসবক্ষত্রিয়া ও দীর্ঘকারায়নসহ বুদ্ধ দর্শনাভিলাষে জেতবনে যান। তিনি পঞ্চঅভিজ্ঞা যথা তরবারি, মুকুট, ছত্র, ব্যজন ও পাদুকা দীর্ঘকারায়নের হস্তে সমর্পণ করে বুদ্ধ পদতলে বসেন। এই সময় দীর্ঘকারায়ন তাঁর জন্য একটিমাত্র দাসী রেখে বাকি দাসদাসী ও পঞ্চরাজঅভিজ্ঞা সহ রাজধানী ফিরে যান।তিনি ইতিমধ্যেই বিরূঢ়ককে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করাতে সক্ষম হয়েছিলেন এই বলে যে রাজসিংহাসনে বসলে তাঁর পক্ষে শাক্যবংশ লোপের প্রতিজ্ঞাপূরণ করা অতি সহজ হবে।ফলে রাজধানী প্রত্যাবর্তন করে দীর্ঘকারায়ন বিরূঢ়ককে রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করেন এবং শাক্যকুল ধ্বংসের প্রথম পদক্ষেপটি সম্পূর্ণ হয়।
শাক্যদের পরিণতি বর্ণনার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছানো গেছে। দীর্ঘকারায়ন বিরূঢ়ক কে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে তাঁর মাথায় শ্বেতছত্র ধরে তাকে শ্রাবস্তীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন এবং আমাত্যকুল তাঁকে কোশলনরেশ হিসেবে গ্রহণ করেন। সিংহাসনে বসে বিরূঢ়ক তার প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে কপিলাবস্তু উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য শাক্যরক্তে তাঁর সিংহাসন ধৌত করে তাঁর অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ। এই তথ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘে পৌঁছালে সেখানে দুঃখ মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বুদ্ধ তখন জেতবনে অবস্থান করছিলেন।যেহেতু শাক্য রাজপুরুষেরা প্রায় সবাই তখন ভিক্ষুসংঘের সদস্য তাই তাদের স্বজাতিকে রক্ষা করার বাসনা প্রকাশিত হয় বুদ্ধসকাশে। মহামৌদগল্লায়ন বিশেষভাবে এই অভিযান বন্ধ করার জন্য বুদ্ধদেবকে অনুরোধ করেন। যেদিন বিরূঢ়ক তাঁর সেনা সমাভিব্যাহারে কপিলাবস্তু অভিযানে বের হন সেদিন সকালে বুদ্ধদেব তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে সৃষ্টি অবলোকন করছিলেন। তিনি সেই অভিযানোদ্যত সেনাকে অবলোকন করেন। এরপরে তিনি মাধুকরী সমাপন করে ভিক্ষান্ন গ্রহণ সমাপনান্তে মধ্যাহ্নে গন্ধকুঠিতে সিংহশয়ানে বিশ্রাম করেন। এরপর অপরাহ্নে দৈবক্ষমতাবলে কোশল ও কপিলাবস্তু সীমান্তবর্তী স্থানে যেখানে তখন ও বিরূঢ়কের সৈন্য এসে পৌঁছায়নি সেখানে উপস্থিত হন।সেখানে কোশল ভূ ভাগে একটি ছায়াপ্রদানকারী বটগাছ এবং কপিলাবস্তু ভূভাগে একটি শাখাসর্বস্ব এবং পত্র ও ছায়াবিহীন গাছ ছিল। অপরাহ্নের রোদ তখনো অপসৃত হয়নি। বুদ্ধদেব ছায়াবিহীন গাছটির নিচে পদ্মাসনে উপবিষ্ট হন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরূঢ়ক সৈন্যসহ এখানে উপস্থিত হন। এই ঘটনা মহাপরিনির্বাণ এর এক বছর আগের।তখন বুদ্ধদেব এতটাই সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং এতটাই ভারতীয় রাজন্যবর্গের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ছিলেন যে বিরূঢ়কের পক্ষে তাঁকে উপেক্ষা করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিলনা। বুদ্ধদেবের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন তখন অবশ্য কর্তব্যকর্মের মধ্যে গৃহীত হয়েছে।সুতরাং বিরূঢ়ক উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বুদ্ধ পদতলে বসে তিনি কেন ছায়াপূর্ণ গাছের আশ্রয় ছেড়ে পত্রবিহীন শাখাসর্বস্ব বৃক্ষমূলে বিশ্রামহেতু আশ্রয় নিয়েছেন যেখানে অস্তগামী রবির প্রখর কিরন বিশ্রামগ্রহনের অন্তরায় এই প্রশ্ন বুদ্ধের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন| বুদ্ধদেব তাঁকে জানান সজ্ঞাতির ভূমিস্থিত পত্রহীন বৃক্ষের ছায়া শত্রু ভূখণ্ডের বৃক্ষছায়া তুলনায় শীতল। বিরূঢ়কের এই রূপক বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি যে বুদ্ধদেব তাঁর সজ্ঞাতির ধ্বংসরোধের উদ্দেশ্যে তাঁর যাত্রাপথে উপস্থিত হয়েছেন। বিরূঢ়ক তাঁর সৈন্যবাহিনীকে শ্রাবস্তী ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
 
একমাস পরে বিরূঢ়ক সংকল্প পালনার্থে পুনর্বার অভিযানে বেরোলে দ্বিতীয়বারে একই ভাবে বুদ্ধের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাজধানীতে প্রত্যাগমনে বাধ্য হন।তৃতীয়বারে আবার একবার সেনা অভিযানের প্রচেষ্টা বুদ্ধদেব দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিরূঢ়ক আবার একমাস পরে চতুর্থবারের জন্য তাঁর প্রতিজ্ঞাপূরণের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীসহ কপিলাবস্তুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। চতুর্থবারে কিন্তু বুদ্ধদেব আর এই অভিযানে বাধা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেননি। তিনি ভিক্ষুসংঘকে জানান শাক্যদের কর্মফল ভোগ করার সময় সমাগত। মহামৌদগল্লায়ন আবার শাক্যদের রক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানালে বুদ্ধদেব তাঁর অনিচ্ছার কথা তাঁকে জানান। মহামৌদগল্লায়ন দৈবশক্তি কে কাজে লাগিয়ে শাক্যদের রক্ষা করার শেষ চেষ্টা করেন। তিনি দৈববলে কপিলাবস্তু পৌঁছে তার ভিক্ষাপাত্রে ৫০০ শাক্যকে লুকিয়ে নিয়ে জেতবনে ফিরে আসেন। জেতবনে ফেরার পরে সেই ভিক্ষাপাত্রের আবরণ উন্মোচন করার পরে তা শুধুমাত্র রক্তপূর্ণ ভিক্ষাপাত্র হিসেবেই দেখা যায়। এই রূপক ও আসন্ন শাক্যবংশের ধ্বংসের ভবিষ্যতবানী হিসেবে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে প্রচারিত হয়।
 
বিরূঢ়ক সৈন্যবাহিনী নিয়ে কপিলাবস্তু পৌঁছান এবং শাক্য বংশ ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নগর প্রাকারের বাইরে অবস্থান করতে শুরু করেন। শাক্যদের শরসন্ধানের প্রতিভা তৎকালে ভারতে সুবিদিত ছিল সে বিষয়ে বিরূঢ়ক অজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু শাক্যরা বুদ্ধদেবের শরণাপন্ন হয়ে অহিংসায় ব্রতী হয়েছেন এই খবর ও তাঁর কাছে ছিল।সুতরাং শাক্যদের দ্বারা তার সৈন্যহানি হবে না এই সম্বন্ধে তাঁর শ্রূততথ্য যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে নগরপ্রাকারের বাইরে সৈন্য সমাবেশ করে শাক্যদের প্রতিক্রিয়া জানার প্রচেষ্টায় অপেক্ষা করতে থাকেন। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি নগরের দিকে কিছু আক্রমণ পরিচালনা করলে শাক্যরা শরবর্ষণ শুরু করে। শাক্যরা কিন্তু তাঁদের অহিংসা ও প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকার পথ থেকে বিচ্যুত হননি।তাঁরা কোশলসেনাকে আক্রমণ করে তাদের ঢাল ভেদ করতে থাকেন এবং শত্রুসৈন্য কে ঢালবিহীন করার পর তাদের কর্ণকুন্ডল বিদ্ধ করে কান দ্বিখণ্ডিত করতে থাকেন।বিরূঢ়ক এই আক্রমণের স্বরূপ বুঝতে না পেরে প্রাথমিক পর্যায়ে আতঙ্কিত হন এবং শাক্যদের সম্বন্ধে প্রাপ্ত তথ্য সমূহ ভ্রান্ত ভেবে তাঁর গুপ্তচরবাহিনীকে দোষারোপ করে দণ্ডিত করতে উদ্যোগী হলে গুপ্তচরবাহিনীর প্রধান তাঁকে প্রকৃত তথ্য জানান যে শাক্যরা কোশলসেনার প্রাণহরণের বদলে শুধুমাত্র কর্ণছচ্ছেদন করেছেন। তাঁরা জীব হত্যা না করার যে মহান ব্রতে ব্রতী হয়েছেন সেই পথ থেকে বিচ্যুত হননি। এই খবর বিরূঢ়কের রণ উন্মাদনাকে দ্বিগুণ করে কারণ তিনি নিশ্চিন্ত হন শাক্যদের দ্বারা তাঁর একটি সৈন্যের ও প্রাণহানি হবে না। তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীকে দুর্গপ্রাকার ভেদ করার নির্দেশ দেন। কোশল সেনা যে কোন প্রকারে নগরীর প্রবেশপথ খুলে ফেলতে সমর্থ হয় এবং এক বিরাট নরসংহারযজ্ঞ সংঘটিত হয় কপিলাবস্তুর পথে-প্রান্তরে। দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ কেউ কোশল সেনার উদ্যত তরবারী থেকে রক্ষা পায়নি। কপিলাবস্তুর রাস্তা রক্তনদীর রূপ ধরে। বিরূঢ়ক প্রতিজ্ঞা পূরণ করেন। তিনি তাঁর রাজসিংহাসন কে শাক্যরক্তে ধৌত করতে চেয়েছিলেন| শুধু সিংহাসন নয়, সংস্থাগার, রাজপ্রাসাদ, রাজপথ সবকিছুকেই তিনি রক্তস্নান করানোর সবরকম ব্যবস্থা করেন। শাক্যদের লুকানোর কোন জায়গা তিনি বাকি রাখেননি। এরপরের ঘটনার দু'রকম বিবরণ পাওয়া যায়। কোন কোন মতে এই রক্তস্নাত নগরে তখনও যে কয়েকজন জীবিত ছিলেন তাঁদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মহানাম বিরূঢ়কের সমীপে উপস্থিত হন এবং যাই হোক না কেন বিরূঢ়ক তাঁর রক্তের সম্পর্কের দৌহিত্র সেই কথা স্মরণ করিয়ে একটি অনুরোধ করেন। তিনি বিরূঢ়ক কে জানান তিনি রোহিনী নদীতে যতক্ষণ ডুবে থাকতে পারবেন ততক্ষন যেন বিরূঢ়ক শাক্যদের হত্যা না করেন এবং নগর ছেড়ে নিরাপদে চলে যেতে দেন। বিরূঢ়ক এতে কৌতূক অনুভব করেন এবং কতক্ষণই বা বৃদ্ধ জলে নিমজ্জিত অবস্থায় থাকতে পারবেন এই ভেবে এই শর্তে রাজি হন। মহানাম তাঁর দীর্ঘ চুলের প্রান্তভাগ একটি জলে নিমজ্জিত গাছের শিকড়ে বেঁধে জলের ভেতরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বহুক্ষণ মহানাম জলে ডুবে থাকায় সমস্ত শাক্যরাই নগর ত্যাগে সমর্থ হন। বিরূঢ়ক অবশেষে জলে সৈন্য নামিয়ে মহানামের দেহ খুঁজে পান এবং পুনর্বার প্রতারিত হয়ে (এবারে মহানামের জীবনের বিনিময়ে) আবার দ্বিগুণ ক্রোধান্বিত হয়ে অবশিষ্ট ৫০০ শাক্যকে বন্দী করে কোশলে প্রত্যাবর্তনের পথ ধরেন।
দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে বিরূঢ়ক মহানাম ও তাঁর পরিবারের শাক্যদের ছাড়া বাকি সমস্ত শাক্যকে মারার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। বিরূঢ়কের সেনাবাহিনী কপিলাবস্তুর রাজপথ রক্তে রাঙিয়ে শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবেশ করলে কিছু শাক্য তৃণকে তাঁদের আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করেন এবং কিছু শাক্য শরগাছকে তাঁদের আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে আত্মগোপনের চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয় এবং সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পরেন| সেনাবাহিনী তাঁরা শাক্যবংশীয় কিনা জানতে চাইলে তাঁরা জানান যে তাদের হস্তধৃত বস্তুসমূহ যথাক্রমে তৃণ ও শরগাছ এবং তা শাক্য (শালগাছ) নয়। বলাবাহুল্য, এরা প্রত্যেকেই কোশল সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন এবং মহানামের পরিবারসহ বিরূঢ়কের সমীপে আনীত হন। এই বন্দীদের নিয়ে বিরূঢ়ক শ্রাবস্তীতে প্রত্যাগমন উদ্দেশ্যে রওনা হন। রাত্রি শেষে পরদিন প্রত্যূষে একটি হ্রদের তীরে প্রাতঃরাশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিরূঢ়ক সেনাবাহিনীকে থামার নির্দেশ দিয়ে মহানামকে তাঁর সঙ্গে প্রাতঃরাশ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন।যেভাবে তাঁর বাবাকে ছলনা করে জানানো হয়েছিল যে শাক্যরা বাসবক্ষত্রিয়ার সঙ্গে একই পাত্র থেকে অন্ন গ্রহণ করেছেন সেই ঘটনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে একই পদ্ধতিতে মহানামকে তাঁর সঙ্গে একই পাত্র থেকে প্রাতঃরাশ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। এই কাজ করতে পারলে মহানামের বংশ গৌরব ধূলিস্যাৎ হবে এই ছিল বিরূঢ়কের উদ্দেশ্য। মহানাম জানান তিনি স্নানসমাপনান্তে প্রাতঃরাশ গ্রহণ করবেন। এরপর তিনি হ্রদে নেমে চুলের অগ্রভাগে একটি গ্রন্থি বেঁধে পা দুটোকে চুলের ভেতরে ঢুকিয়ে হ্রদের জলে ডুব দেন। সেখানে মহানামের প্রবেশকালে নাগরাজ উপস্থিত হন এবং মহানাম কে নাগলোকে নিয়ে যান। মহানাম সেখানে আরও ১২ বছর সুখ ভোগ করেন।বিরূঢ়ক মহানামের ফিরে আসতে দেরি হওয়ায় তাঁর সন্ধানে চতুর্দিকে সেনাপ্রেরণ করলেও মহানামের কোন হদিস না পেয়ে বন্দীদের নিয়ে শ্রাবস্তী উদ্দেশ্যে রওনা হন।
 
বিরূঢ়কের অন্তিম পরিণতির প্রতি আলোকপাত না করলে এ প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। শাক্যরক্তে কপিলাবস্তুকে স্নান করিয়ে পেছনে স্বজনহীন ক্রন্দনরত নগরকে ফেলে রেখে ৫০০ শাক্য নারী-পুরুষকে বন্দী করে বিজয়োল্লাসমত্ত বিরূঢ়ক শ্রাবস্তীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এর পরের ঘটনা সম্বন্ধে দুটো প্রচলিত কাহিনী পাওয়া যায়। একটি কাহিনী অনুসারে তিনি এক অগ্নিকাণ্ডের শিকার হন| ঘটনাটি নিম্নরূপ-
৫০০ শাক্যবন্দী সহ বিরূঢ়ক শ্রাবস্তীতে ফিরে আসার পরে তাঁদের হাত-পা কেটে ফেলার আদেশ দেন। ছিন্ন হস্তপদ এই ৫০০ বন্দীকে এর পরে একটি গর্তে ফেলে তাঁদের গায়ে গলিত লোহা ঢেলে দেওয়া হয়। এই মারাত্মক অত্যাচার বুদ্ধদেবের মনকে দ্রবীভূত করে এবং তিনি জানান বিরূঢ়ক তাঁর অপকর্মের শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছে এবং সাত দিনের মধ্যে তাঁর বিনাশ সাধিত হবে। যে অগ্নিপ্রদাহময় মৃত্যু তিনি নিরপরাধ ৫০০ শাক্যবন্দীর জন্য বরাদ্দ করেছিলেন সেই যন্ত্রনায় তাঁকেও দগ্ধ হতে হবে।এরপরে তিনি সেই মুমূর্ষু ৫০০ নিরপরাধ শাক্যকে আপন স্নিগ্ধ করস্পর্শে শীতল করেন, তাঁদের যন্ত্রণা মুক্তি ঘটান এবং তাঁদের স্বর্গারোহণ এর ব্যবস্থা করেন। বিরূঢ়ক বুদ্ধদেব মুখনিঃসৃত তাঁর পরিণতি শ্রবণে অতি ভীত হন এবং তার সব দুষ্কর্মের সহচর এক আমাত্যর দ্বারস্থ হন। বুদ্ধদেব তাঁর অগ্নিদহনে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।সেই আমাত্য তাঁকে জলের ওপরে বাসস্থান নির্মাণ করে সাতদিন সেই বাসস্থান বসবাসের পরামর্শ দেন। সেই বাসস্থানে কোনরকম দাহ্যবস্তুর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। বিরূঢ়ক তাঁর মহারানীর সঙ্গে সাত দিন সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। ৬দিন নিরুপদ্রবে কাটার পরে সপ্তম দিনে একটি দর্পণে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে রানির ব্যবহৃত একটি রেশমবস্ত্রে অগ্নিসংযোগ হয়। এই আগুন সম্পূর্ণ জলটুঙ্গী কে আবাসিক সহ ভস্মীভূত করে এবং সবান্ধব সজ্ঞাতি বিরূঢ়ক রাজা এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান। তাঁর দেহাবশেষ জলজন্তুর খাদ্যরূপে গৃহীত হয় অর্থাৎ তাঁর ইহলৌকিক দেহের সৎকার করা সম্ভব হয়নি এবং তাঁর আত্মা নিম্নতম নরকে স্থান লাভ করে।
দ্বিতীয় প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, মহানামের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার এবং বাকি রক্ষা পাওয়া শাক্যদের বন্দী করে বিরূঢ়ক শ্রাবস্তী উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমধ্যে রাত্রি নামে এবং তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী এবং বন্দীসহ অচিরবতী নদীর কুলে রাত কাটানোর জন্য মনস্থির করেন। সৈন্যবাহিনীর কিছু অংশ নদীসংলগ্ন তটভূমিতে এবং বাকি অংশ একটু দূরে বাঁধের উপরে শয্যা পাতে। এরপর সেখানে শ্বেত পিপীলিকার এক স্রোত উপস্থিত হয়।তটভূমিতে সৈন্যদের সঙ্গে যে বন্দীরা শয্যা পেতেছিল, তারা পিঁপড়ের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে বাঁধের উপরে উঠে আসে| অন্যদিকে বাঁধের উপরে বন্দীদের পাহারা দেওয়ার দেয়ার জন্য যে সেনাদল নিয়োজিত ছিল তারা পিঁপড়ের লক্ষ্যবস্তু হয়। তারা পিঁপড়ের কামড়ের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বাঁধের উপর থেকে নেমে এসে অচিরবতীর তটরেখা বরাবর শয্যা পাতে। এরপরে রাত গভীর হলে এক ভয়ংকর প্রলয়ঙ্করী প্লাবন আসে অচিরবতী নদীতে।সেই প্লাবন নদীর তটরেখাকে ভাসিয়ে নিয়ে বাঁধের কাছে এসে শান্ত হয়। বিরূঢ়কের নিজস্ব ছাউনিও তটরেখা সন্নিহিত ছিল। সেই মহাপ্লাবন বিরূঢ়ককে তাঁর সৈন্যবাহিনী সমেত অতল কালো, নিঃসঙ্গ, নিঃসীম মৃত্যুর কালগর্ভে নিক্ষেপ করে। বিরূঢ়কের মর্মান্তিক পরিনতি জানার পরে বুদ্ধ মুখনিঃসৃত বাক্যবন্ধ ছিল-
পুপ্পানি এব পচিনান্তম
ব্যাসত্তমানসম নরাম
সুত্তম গামম মহগোভ
মাচ্চু অদয়া গচ্ছতি|
" সাগরের ভয়ঙ্কর প্লাবন আসিয়া
যেরূপ নিদ্রিত গ্রামে লয় ভাসাইয়া
মৃত্যুও সেইরূপ হবে যে জন বিলাসী
যে চুনে বিলাস ভোগে ভাবি ফুলরাশি||"
 
 
সমাপ্ত||
 
তথ্যসূত্র:1.ভগবান বুদ্ধ, ডি. কোশাম্বী|
2.সুত্তনিপাত
3..জাতক, ঈশানচন্দ্র ঘোষ|।
4.ধম্মপদ অট্ টকথা
5. ধম্মপদ, প্রকাশক আচার্য ভিক্ষু শাসন রক্ষিত
6.The great chronicles of Buddhas by Ven. Mingun Sayadaw.
7.S.N. Goenka; published in Vipassana Research Institute, source: Google
 
==বৈধকরণের পথ==