ব্যবহারকারী:Jayantanth/book/Oldbook: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
+
১৯ নং লাইন:
চর্যাপদের পরে প্রবাদ, বচন, ছড়া, ডাক ও খনার বচন ইত্যাদি কিছু কিছু কাব্যনিদর্শন থাকলেও চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো রচনা পাওয়া যায় না। তাই এ সময়টাকে (১২০১-১৩৫০) কেউ কেউ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পরিবর্তনের যুগ; ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এবং মুসলিম শাসকদের ভিন্নতর রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তখন এক নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছিল। সে সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল সৃজ্যমান অবস্থায় এবং চর্যার বঙ্গীয়-বৈশিষ্ট্যময় অপভ্রংশ ভাষা আরও বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৩শ-১৪শ শতকের রামাই পন্ডিতের গাথাজাতীয় রচনা শূন্যপুরাণ। এতে বৌদ্ধদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনাসম্বলিত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ শীর্ষক একটি কবিতা আছে। এছাড়া আছে অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃতপৈঙ্গল নামক একটি গীতিকবিতার সংকলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা। হলায়ুধ মিশ্র রচিত সেখশুভোদয়া (আনু. ১২০৩) নামক সংস্কৃত গ্রন্থেও একটি বাংলা গান পাওয়া গেছে। এরূপ পীরমাহাত্ম্যসূচক ছড়া বা আর্যা, প্রেমসঙ্গীত এবং খনার বচন শ্রেণির দু-একটি বাংলা শ্লোকই এ সময়কার প্রধান রচনা।
 
==মধ্যযুগ আদি-মধ্যযুগ ==
মধ্যযুগ আদি-মধ্যযুগ সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে: বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। বড়ু চন্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, যিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাটগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন।
 
মধ্যযুগ আদি-মধ্যযুগ সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে: বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। বড়ু চন্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, যিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাটগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন।
 
চৈতন্যদেবের আগে-পরে রচিত সহস্রাধিক বৈষ্ণব পদের ভণিতায় একাধিক চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় আদি চন্ডীদাস, কবি চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস ও দীন চন্ডীদাস। এঁরা এক না পরস্পর ভিন্ন তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিতর্ক আছে, যা ‘চন্ডীদাস সমস্যা’ নামে পরিচিত। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে যে পুথিটি প্রকাশিত হয়, তার ভণিতায় বড়ু চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত ইনিই আদি চন্ডীদাস, যাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা যায়। মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয় পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল বা গোবিন্দবিজয়। এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন।
২৫ ⟶ ২৭ নং লাইন:
এ যুগেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ব্রজবুলি ভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময় কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়।
 
==মধ্য-মধ্যযুগ ==
মধ্য-মধ্যযুগ এ সময় চৈতন্যদেব বঙ্গদেশে এক নবভক্তি-ধারার প্রবর্তন করেন, যা ভাবচৈতন্যের ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সূচনা করে। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলায় একটি শক্তিশালী সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং এক বিরাট সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়। এ যুগেই বাংলায় জীবনচরিত লেখার প্রচলন হয় এবং প্রধানত চৈতন্যদেবের জীবনকে কেন্দ্র করে জীবনীগ্রন্থগুলি রচিত হয়। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৭৩), জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৬শ শতকের শেষভাগ), লোচনদাসের (১৫২৩-১৫৮৯) চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)। এগুলি ছাড়া আরও কিছু উল্লেখ করার মতো চৈতন্য-সংশ্লিষ্ট জীবনীকাব্য হচ্ছে নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর (চৈতন্যদেবের পার্ষদ-ভক্তদের জীবনী), নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস (শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দের জীবনী এবং তাঁদের ধর্মমত প্রচারের কথা) ও ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৮-৬৯)। এগুলির মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃতকে চৈতন্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ মনে করা হয়। পান্ডিত্যপূর্ণ এ গ্রন্থে একাধারে জীবনচরিত, দার্শনিক তত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল বেশকিছু ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ।
 
মধ্য-মধ্যযুগ এ সময় চৈতন্যদেব বঙ্গদেশে এক নবভক্তি-ধারার প্রবর্তন করেন, যা ভাবচৈতন্যের ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সূচনা করে। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলায় একটি শক্তিশালী সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং এক বিরাট সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়। এ যুগেই বাংলায় জীবনচরিত লেখার প্রচলন হয় এবং প্রধানত চৈতন্যদেবের জীবনকে কেন্দ্র করে জীবনীগ্রন্থগুলি রচিত হয়। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৭৩), জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৬শ শতকের শেষভাগ), লোচনদাসের (১৫২৩-১৫৮৯) চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)। এগুলি ছাড়া আরও কিছু উল্লেখ করার মতো চৈতন্য-সংশ্লিষ্ট জীবনীকাব্য হচ্ছে নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর (চৈতন্যদেবের পার্ষদ-ভক্তদের জীবনী), নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস (শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দের জীবনী এবং তাঁদের ধর্মমত প্রচারের কথা) ও ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৮-৬৯)। এগুলির মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃতকে চৈতন্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ মনে করা হয়। পান্ডিত্যপূর্ণ এ গ্রন্থে একাধারে জীবনচরিত, দার্শনিক তত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল বেশকিছু ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ।
 
পদাবলি এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যধারা হচ্ছে পদাবলি। এর শুরু চৈতন্যপূর্বযুগেই। রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক এ সাহিত্য ভাব, ভাষা ও ছন্দে অতুলনীয়। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মার আত্মীয়রূপে কল্পিত; তাঁর ও ভক্তের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। পরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এবং চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করে মধ্যযুগের পদাবলি বা গীতিকাব্যের ধারা। চৈতন্যদেবের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা পদাবলি সাহিত্য বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হয়। অনেকের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জাগরণ ঘটে এই পদাবলি রচনার মধ্য দিয়েই। কতিপয় মুসলমানসহ অগণিত কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন, যেমন: চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, লোচনদাস, গোবিন্দদাস, কবিবল্লভ রায়শেখর, বলরাম দাস, নরোত্তম দাস, নরহরি দাস, রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখ। মিথিলার বিদ্যাপতি ছিলেন চৈতন্যপূর্ব কবি। মৈথিল ভাষায় রচিত তাঁর পদগুলি পদাবলি সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি পদাবলি সাহিত্যের দুই সেরা কবি।
 
==অনুবাদ সাহিত্য==
অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা। বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। বর্ণনার হূদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ। কৃত্তিবাস ১৫শ শতকের গোড়ার দিকে জীবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে মধ্যযুগের বাঙালি-জীবন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃত্তিবাসের পরে আরও অনেকে রামায়ণ রচনা করেছেন। সতেরো শতকে ময়মনসিংহের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণগাথা সে অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গের অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ গায়ক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। নোয়াখালীর দ্বিজ ভবানী দাসের শ্রীরামপাঁচালি কাব্য অধ্যাত্ম্যরামায়ণ অবলম্বনে রচিত।
 
অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা। বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। বর্ণনার হূদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ। কৃত্তিবাস ১৫শ শতকের গোড়ার দিকে জীবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে মধ্যযুগের বাঙালি-জীবন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃত্তিবাসের পরে আরও অনেকে রামায়ণ রচনা করেছেন। সতেরো শতকে ময়মনসিংহের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণগাথা সে অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গের অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ গায়ক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। নোয়াখালীর দ্বিজ ভবানী দাসের শ্রীরামপাঁচালি কাব্য অধ্যাত্ম্যরামায়ণ অবলম্বনে রচিত।
 
মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত। ১৫১৫-১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কবীন্দ্র পরমেশ্বর এটি রচনা করেন। লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত। কবীন্দ্র মহাভারতে অশ্বমেধপর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে। বাংলা মহাভারতের প্রধান কবি কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২-১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন। শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি মুদ্রিত হয়। সকল বাংলা মহাভারতের মধ্যে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
৩৯ ⟶ ৪৫ নং লাইন:
কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে বৈদিক দেবতা রুদ্র শিবের রূপ ধারণ করে; শিব বাঙালি হিন্দুর জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই বাঙালির সুখ-দুঃখ ভরা সংসারের কথা স্থান পেয়েছে শিবমঙ্গলে। এ ধারার প্রথম কাব্য দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। শিবায়নের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তী (১৭১০-১১)। এগুলি ছাড়া শীতলামঙ্গল (কৃষ্ণরাম দাস) ও ষষ্ঠীমঙ্গল নামে দুটি মঙ্গলকাব্যের কথাও জানা যায়। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের কথা নিয়ে রচিত শেষোক্ত কাব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ কাব্যে সমাজধর্মের সমন্বয় প্রয়াসে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা আছে। ফলে দক্ষিণরায়ের সঙ্গে মুসলমান পীর বড় খাঁ গাজীর পূজাও এতে স্থান পেয়েছে।
 
===মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যচর্চা===
মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যচর্চা মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনীকাব্য বা রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ-হিন্দু রচিত বাংলা সাহিত্যে যেখানে দেবদেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান সেখানে মুসলমান রচিত সাহিত্যে মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। মুসলমান কবিরা কাহিনীকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন; এমনকি চৌতিশা, জ্যোতিষ ও সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে মধ্যযুগের মুসলমান রচিত কাব্যগুলিকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: কাহিনীকাব্য, ধর্মীয় কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্য।
 
মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যচর্চা মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনীকাব্য বা রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ-হিন্দু রচিত বাংলা সাহিত্যে যেখানে দেবদেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান সেখানে মুসলমান রচিত সাহিত্যে মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। মুসলমান কবিরা কাহিনীকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন; এমনকি চৌতিশা, জ্যোতিষ ও সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে মধ্যযুগের মুসলমান রচিত কাব্যগুলিকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: কাহিনীকাব্য, ধর্মীয় কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্য।
 
মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর। তাঁর কাব্য ইউসুফ-জুলেখা সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত বলে মনে করা হয়। এর সব পুথি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও পার্শবর্তী ভারতীয় ত্রিপুরা) থেকে পাওয়া গেছে। বাইবেল-কুরআনের ইউসুফ নবীর সংক্ষিপ্ত কাহিনী যা ফেরদৌস ও জামীর ইউসুফ-জুলেখায় পল্লবিত, তিনি তা বাংলায় যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে তা একটি মৌলিক কাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। জৈনুদ্দীন একটিমাত্র কাব্য রসুলবিজয় রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি ছিলেন। এর গল্পাংশ ফারসি থেকে নেওয়া। ‘বিজয়’ জাতীয় যে কাব্যধারা মধ্যযুগে প্রাধান্য লাভ করে তদনুসারেই এর নামের সঙ্গে ‘বিজয়’ শব্দটি যুক্ত হয়। কাহিনীতে কিছু ঐতিহাসিক নামের উল্লেখ থাকলেও ঘটনা ঐতিহাসিক নয়। মুজাম্মিল ১৫শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি প্রধানত তিনটি কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন: নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়াৎনামা ও খঞ্জনচরিত। আরবির অনুবাদ সায়াৎনামায় সুফিবাদ স্থান পেয়েছে এবং অনুবাদে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কাব্যটি আকর্ষণীয় হয়েছে। তাঁর নীতিশাস্ত্রবার্তায় বহু বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে। চাঁদ কাজী ছিলেন গৌড় সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) নবদ্বীপের কাজী। তিনি এ পদে থাকাকালেই নবদ্বীপে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের প্রচার ও প্রসার ঘটে এবং তিনি নানা কারণে বৈষ্ণব-ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি কোনো কাব্য রচনা করেননি, তবে বৈষ্ণব পদ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ কবীরও ছিলেন একজন খ্যাতিমান পদকর্তা। তিনি সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের সময়ে আবির্ভূত হন এবং সম্ভবত তাঁর রাজকর্মচারী ছিলেন। আফজাল আলী এযুগের কবিদের অন্যতম। নসিহৎনামা নামে একটি কাব্য এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে রচিত তাঁর কয়েকটি পদ পাওয়া গেছে (সম্ভবত ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত)। এ গ্রন্থে কবিত্ব তেমন নেই, তবে সরল ভাষায় ধর্মোপদেশ আছে। সাবিরিদ খান বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা বলে মনে করা হলেও কোনোটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয় এবং হানিফা ও কয়রাপরী নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খন্ডিত পুথি পাওয়া গেছে। দোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল। তিনি সম্ভবত ১৬শ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন। তাঁর ভাষা সাধারণ এবং প্রাকৃত-প্রভাব ও সারল্যের মিশ্রণে প্রাচীনত্বের দ্যোতক। শেখ ফয়জুল্লাহ মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। যে পাঁচটি গ্রন্থের জন্য তিনি খ্যাতিমান সেগুলি: গোরক্ষবিজয়, গাজীবিজয়, সত্যপীর (১৫৭৫), জয়নবের চৌতিশা এবং রাগনামা। রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর একটিমাত্র কাব্য পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো লায়লী-মজনু; এর রচনাকাল ১৫৬০-৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। এটি ফারসি কবি জামীর লাইলী-মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ; তবে স্বচ্ছন্দ রচনা, কাব্যরস ইত্যাদি গুণে এটি অনন্য। মুহম্মদ কবীর একটিমাত্র কাব্য মধুমালতী রচনা করেই বিখ্যাত হন। ১৫৮৩-৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচিত বলে মনে করা হয়। কাব্যের পরিবেশ ও পরিকল্পনা গুলে বকাওলী জাতীয়।