মানসী/গুরু গোবিন্দ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Mahir256 (আলোচনা | অবদান)
"{{শীর্ষক |শিরোনাম= ../ |টীকা = |লেখক =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |বছর..." দিয়ে পাতা তৈরি
(কোনও পার্থক্য নেই)

১৪:১৮, ২২ মে ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

গুরু গােবিন্দ

বন্ধু, তোমরা ফিরে যাও ঘরে,
এখনো সময় নয়।

নিশি-অবসান, যমুনার তীর,
ছোটো গিরিমালা, বন সুগভীর;
গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া
অনুচর গুটিছয়—

যাও রামদাস, যাও গো লেহারী,
সাহু, ফিরে যাও তুমি।
দেখায়ো না লোভ, ডাকিয়ো না মোরে
ঝাঁপায়ে পড়িতে কর্মসাগরে;
এখনো পড়িয়া থাক্‌ বহু দূরে
জীবনরঙ্গভূমি।

ফিরায়েছি মুখ, রুধিয়াছি কান,
লুকায়েছি বনমাঝে
সুদূরে মানব-সাগর অগাধ,
চিরক্রন্দিত ঊর্মিনিনাদ—
হেথায় বিজনে রয়েছি মগন
আপন গোপন কাজে।

মানবের প্রাণ ডাকে যেন মোরে
সেই লোকালয় হতে।
সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই
চমকিয়া উঠে বলি ‘যাই যাই’,
প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই
প্রবল মানবস্রোতে।

তোমাদের হেরি চিত চঞ্চল,
উদ্দাম ধায় মন—
রক্ত-অনল শত শিখা মেলি
সর্পসমান করি উঠে কেলি,
গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন
কোষমাঝে ঝন্‌ঝন্।

হায়, সেকি সুখ, এ গহন ত্যজি
হাতে লয়ে জয়তুরী
জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে,
রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে
অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া
হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি!

তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি,
বন্ধন করি তায়

রশ্মি পাকড়ি আপনার করে
বিঘ্নবিপদ লঘন ক’রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
প্রতিকূল ঘটনায়।

সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ,
পড়ে যায় কেহ ভূমে।
দ্বিধা হয়ে বাধা হতেছে ভিন্ন,
পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন,
আকাশের আঁখি করিছে খিন্ন
প্রলয়বহ্নিধুমে।

শতবার ক’রে মৃত্যু ডিঙায়ে
পড়ি জীবনের পারে।
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক,
লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
গরজিছে দুই ধারে।

কভু অমানিশা নীরব নিবিড়,
কভু বা প্রখর দিন।
কভু বা আকাশে চারি দিক -ময়
বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়ো হয়—

কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে
ভেঙে পড়ে দয়াহীন।

‘আয় আয় আয়’ ডাকিতেছি সবে,
আসিতেছে সবে ছুটে।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার—
সুখসম্পদ-মায়ামমতার
বন্ধন যায় টুটে।

সিন্ধু-মাঝারে মিশিছে যেমন
পঞ্চনদীর জল—
আহ্বান শুনে কে কারে থামায়,
ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায়,
পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া
উন্মাদ কোলাহল।

কোথা যাবি ভীরু, গহনে গোপনে
পশিছে কণ্ঠ মোর।
প্রভাতে শুনিয়া ‘আয় আয় আয়’
কাজের লোকেরা কাজ ভুলে যায়,
নিশীথে শুনিয়া ‘আয় তোরা আয়’
ভেঙে যায় ঘুমঘোের।

যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক,
ভরে যায় ঘাট বাট।
ভুলে যায় সবে জাতি-অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান অপমান
ব্রাহ্মণ আর জাঠ।

থাক্ ভাই, থাক্, কেন এ স্বপন—
এখনো সময় নয়।
এখনো একাকী দীর্ঘ রজনী
জাগিতে হইবে পল গণি গণি
অনিমেষ চোখে পূর্ব গগনে
দেখিতে অরুণোদয়।

এখনো বিহার’ কল্পজগতে,
অরণ্য রাজধানী।
এখনো কেবল নীরব ভাবনা,
কর্মবিহীন বিজন সাধনা,
দিবানিশি শুধু ব’সে ব’সে শোনা
আপন মর্মবাণী।

একা ফিরি তাই যমুনার তীরে,
দুর্গম গিরি-মাঝে।

মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে,
মিশাতেছি গান নদীকলরোলে,
গড়িতেছি মন আপনার মনে—
যোগ্য হতেছি কাজে।

এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
আরো কতদিন হবে—
চারি দিক হতে অমর জীবন
বিন্দু বিন্দু করি আহরণ
আপনার মাঝে আপনারে আমি
পূর্ণ দেখিব কবে!

কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব
‘পেয়েছি আমার শেষ!
তোমরা সকলে এসো মোর পিছে,
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে,
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ।

‘নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
নাহি আর আগুপিছু।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ—

নাই তার কাছে জীবন মরণ,
নাই নাই আর কিছু।’

হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মতো—
‘উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,
ওই চেয়ে দেখো কত দূর হতে
তোমার কাছেতে ধরা দিবে বলে
আসে লোক কত শত।

‘ওই শোনো শোনো কল্লোলধ্বনি,
ছুটে হৃদয়ের ধারা।
স্থির থাকো তুমি, থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতো আলস তেয়াগি,
এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা।’

ওই চেয়ে দেখো দিগন্ত-পানে
ঘনঘোর ঘটা অতি।
আসিতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে,
তাই ব’সে ব’সে হৃদয়-আলয়ে
জ্বালাতেছি আলো, নিবিবে না ঝড়ে—
দিবে অনন্ত জ্যোতি।

যাও তবে সাহু, যাও রামদাস,
ফিরে যাও সখাগণ।
এসো দেখি সবে যাবার সময়
বলো দেখি সবে ‘গুরুজির জয়’—
দুই হাত তুলি বলো ‘জয় জয়
অলখ নিরঞ্জন’।

বলিতে বলিতে প্রভাততপন
উঠিল আকাশ-’পরে।
গিরির শিখরে গুরুর মুরতি
কিরণছটায় প্রোজ্জ্বল অতি,
বিদায় মাগিল অনুচরগণ—
নমিল ভক্তিভরে।


২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮