বৈকুণ্ঠের খাতা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
"{{শীর্ষক | শিরোনাম = বৈকুণ্ঠের খাতা | লেখক = রবীন্দ্রনাথ ঠ..." দিয়ে পাতা তৈরি
(কোনও পার্থক্য নেই)

১৯:২২, ৩ জুলাই ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বৈকুণ্ঠের খাতা ।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর




কলিকাতা


আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে

শ্রীকালিদাস চক্রবর্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত ।
৫৫নং অপার চিৎপুর রোড।


চৈত্র ১৩০৩ সাল ।

 মূল্য ছয় আনা ।



নাটকের পাত্রগণ ।

 বৈকুণ্ঠ।

 অবিনাশ | বৈকুণ্ঠের কনিষ্ঠ ভ্রাতা।

 ঈশান বৈকুণ্ঠের ভূত্য।

 কেদার। অবিনাশের সহপাঠী।

 তিনকডি। কেদারের সহচর।

 


বৈকুণ্ঠের খাতা।

প্রথম দৃশ্য।

কেদার ও তিনকড়ি।

 কেদার। দেখ্ তিনকড়ে-অবিনাশ ত আমার গন্ধ পেলেই তেড়ে আসে —

 তিন। মানুষ চেনে দেখ্চি, আমার মত অবোধ নয়!

 কেদার। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার শ্যলীর সঙ্গে তার বিবাহ দিয়ে এই জায়গাটাতেই বসবাস করব, মার ঘুরে বেড়াতে পারিনে

 তিন। টিঁক্তে পারবে না দাদা। তোমার মধ্যে একটা ঘুর্ণি আছেন, তিনিই বরাবর ঘুরিয়েছেন এবং শেষ পর্য্যন্ত ঘোরাবেন।

 কেদার। এখন অবিনাশের দাদা বৈকুণ্ঠকে বশ কবতে এসে আমার কি দুর্গতি হয়েছে দেখ্। কে জানত বুড়ো বই লেখে! এত বড় একখানা খাতা আমাকে পড়তে দিয়ে লে গেছে—

 তিন। ওরে বাবা! ইঁদুরের মত চুরি করে খেতে এসে খাতার জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে গেছ দেখ্‌চি!

 কেদার। কিন্তু তিনকড়ে, তুইই আমার সব প্ল্যান্ মাটি করবি।

 তিন। কিছু দরকার হবে না দাদা, তুমি একলাই মাটি করতে পারবে!

 কেদার। দেখ্ তিনু, এসব ব্যস্ত হবার কাজ নয়। গণেশকে সিদ্ধিদাতা বলে কেন—তিনি মোট লোকটি, খুব চেপে বসে থাকতে জানেন, দেখে মনে হয় না ষে তাঁর কিছুতে কোনো গরজ আছে —

 তিনকড়ি। কিন্তু তাঁর ইঁদুরটি—

 কেদার। ফের বক্‌চিস? লক্ষ্মীছাড়া, তুই একটু আড়ালে যা!

 তিন। চল্লুম দাদা। কিন্তু ফাঁকি দিয়ো না। সমস্ত্র কালে অভাগা তিনকড়েকে মনে রেখো!

(তিনকড়ির প্রস্থান)

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। দেখ‍্চেন কেদার বাবু?

 কেদার। আজ্ঞে হাঁ, দেখ্চি বই কি! কিন্তু আমার মতে— ওর নাম কি—বইয়ের নামটা যেন কিছু বড় হয়ে পড়েচে।

 বৈকুণ্ঠ। বড় হোক্, কিন্তু বিষয়টা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রাচীন ও প্রচলিত সঙ্গীত শাস্ত্রের আদিম উৎপত্তি ও ইতিহাস এবং নুতন সার্ব্বভৌমিক স্বরলিপির সংক্ষিপ্ত ও সরল আদর্শ প্রকরণ।” এতে আর কোন কথাটি বাদ গেল না।

 কেদার। তা বাদ যায় নি। কিন্তু, ওর নাম কি, মাপ করবেন বৈকুণ্ঠ বাবু—কিছু বাদসাদ্ দিয়েই নাম রাথ তে হয়। কিন্তু লেখা যা হয়েছে সে পড়তে পড়তে, ও র নাম কি —শরীর রোমাঞ্চ হয়ে ওঠে!

 বৈকুণ্ঠ। হা হা হাহা! রোমাঞ্চ! আপনি ঠাট্টা করচেন!

 কেদার। সে কি কথা!

 বৈকুণ্ঠ। ঠাট্টার বিষয় বটে! ও আমার একটা পাগলামী! হাহাহাহা! সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ইতিহাস—মাথা তার মুণ্ড! দিন খাতাটা! বুড়ো মানুষকে পরিহাস করবেন না কেদার বাবু!

 কেদার। পরিহাস! ওর নাম কি, পরিহাস কি মশায় ছ ঘণ্ট ধরে কেউ করে! ভেবে দেখুন দেখি, কখন থেকে আপনার খাতা নিয়ে পড়েছি! তা হলে ত রামের বনবাসকেও —ওর নাম কি—কৈকেয়ীর পরিহাস বল্তে পারেন!

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহা! আপনি বেশ কথাগুলি বলেন!

 কেদার। কিন্তু হাসির কথা নয় বৈকুণ্ঠ বাবু, ওর নাম কি—অণপনার লেখার স্থানে স্থানে যথার্থই রোমাঞ্চ হয়— তা, কি বলে, আপনার মুখের সামনেই বল্লুম।

 বৈকুণ্ঠ। বুঝেছি আপনি কোন্ জায়গার কথা বল্চেন, সেখানটা লেখবার সময় আমারই চোখে জল এসেছিল যদি আপনার বিরক্তি বোধ না হয় ত সেই জায়গাটা এক বার পড়ে শোনাই।

 কেদার। বিরক্তি! বিলক্ষণ! ওর নাম কি, আমি আপনাকে ঐ জায়গাটা পড়বার জন্যে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলুম। (স্বগত) শ্যালীটিকে পার করা পর্য্যন্ত, হে ভগবান্, আমাকে ধৈর্য্য দা ও—তার পরে আমার ও একদিন আসবে!

 বৈকুণ্ঠ। কি বল্চেন কেদার বাবু?

 কেদার। বলছিলুম যে,— ওর নাম কি—সাহিত্যের কামড় কচ্ছপের কামড়, যাকে এক বা র ধরে — ওর নাম কি —তাকে তার সহজে ছাড়তে চায় না। আহা, অমন জিনিষ কি আর আছে?

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহা! কচ্ছপের কামড়! আপনার কথাগুলি বড় চমৎকার।—এই যে সেই জায়গাটা! তবে শুনুন্। — হে ভারতভূমি, এক সময়ে তুমি প্রবান বীর্য্যবান্ পুরুষদিগের তপোতুমি ছিলে; তখন রাজার রাজত্ব ও তপস্যা ছিল কবির কবিত্বও তপস্যারই নাম স্তর ছিল। তখন তাপস জনক রাজ্যশাসন করিতেন, তখন তাপস বাল্মীকি রামায়ণ গানে তপঃপ্রভাব উৎসারিত করিয়া দিতেন; তখন সকল জ্ঞান, সকল বিদ্যা, সংসারের সকল কর্ত্তব্য, জীবনের সকল আনন্দ সাধনার সামগ্রী ছিল। তখন গৃহাশ্রমও আশ্রম ছিল, অরণ্যাশ্রমও আশ্রম ছিল। আজ যে কুলত্যাগিনী সঙ্গীত বিদ্যা নাট্যশালায় বিদেশী বংশীর কাংস্যকণ্ঠে আর্ত্তনাদ করিতেছে, প্রমোদালধে সুরা সরোবরে স্খলিতচরণে আত্মহত্যা করিয়া মরিতেছে, সেই সঙ্গীত একদিন ভরতমুনির তপোবলে মুত্তিমান্ হইয়া স্বৰ্গকে স্বর্গীয় করিয়া তুলিয়াছিল, সেই সঙ্গীত সাধকশ্রেষ্ঠ নারদের ধীণাতন্ত্রী হইতে শুভ্ররশ্মিরাশির ন্যায় বিচ্ছুরিত হইয়া বৈকুণ্ঠাধিপতির বিগলিত পাদপদ্মনিসান্দিত পুণ্য নিঝরিণীকে ম্লান মর্ত্তালোকে প্রবাহিত করিয়াছিল। হে দুর্ভাগিণা ভারতভূমি, আজ তুমি কৃশকায় দীনপ্রাণ রোগজীর্ণ শিশুদিগের ক্রীড়াভূমি; আজ তোমার যজ্ঞবেদীর পুণ্য মৃক্তিকা লইয়া অবোধগণ পুণ্ডলিকা নির্ম্মাণ করিতেছে; আজ সাধনাও নাই সিদ্ধিও নাই; আজ বিদ্যার স্থলে বাচালতা; বীর্য্যের স্থলে অহঙ্কার, এবং তপস্যার স্থলে চাতুরী বিরাজ করিতেছে। যে বজ্রবক্ষ বিপুল তরণী একদিন উত্তাল তরঙ্গভেদ করিয়া মহাসমুদ্র পার হইত, আজ সে তরণীর কর্ণধার নাই; আমরা কয়েকজন বালকে তাহারই কয়েকধণ্ড জীর্ণ কাষ্ঠ লইয়া ভেলা বাঁধিয়া আমাদের পল্লিপ্রান্তেৱ পঙ্কপল্বলে ক্রীড়া করিতেছি এবং শিশুসুলভ মোহে অজ্ঞানসুলভ অহঙ্কারে কল্পনা করিতেছি এই ভগ্ন ভেলাই সেই অর্ণবতরী, আমরাই সেই আর্য্য, এবং আমাদের গ্রামের এই জীর্ণপত্রকলুষিত জলকুণ্ডই সেই অতলস্পশ সাধনসমুদ্র।

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। বাবু, খাবার এসেছে।

 বৈকুণ্ঠ। তাঁকে একটু বস‍্তে বল!

 ঈশান। বস‍্তে বল্‌ব কাকে? খাবার এসেছে।

 কেদার। তাহলে আমি উঠি। ওর নাম কি, স্বার্থপর হয়ে আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি—

 বৈকুণ্ঠ। কেন, আপনি উঠ‍্চেন কেন?

 ঈশান। নাঃ, ওঁর আর উঠে কাজ নেই! তামাম রাত ধরে তোমার ঐ লেখা শুনুন! (কেদারের প্রতি) যাও বাবু, তুমি ঘরে যাও। আমাদের বাবুকে আর ক্ষেপিয়ে তুলোনা!

(প্রস্থান)

 কেদার। ইনি আপনার কে হন?

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, আমার চাকর।

 কেদার। ওঃ, ওর নাম কি, এ'র কথাগুলি বেশ পষ্ট পষ্ট।

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহা! ঠিক বলেচেন। তা কিছু মনে করবেন না—অনেকদিন থেকে আছে—আমাকে মানে টানে না!

 কেদার। ওর নাম কি, অল্পক্ষণের আলাপ যদিচ তবু আমাকেও বড় মানে না দেখলুম। কিন্তু ওর কথাটা অপিনি কানে তোলেন নি। থাবার এসেছে!

 বৈকুণ্ঠ। তা হোক্‌, রাত হয় নি -এই অধ্যায়টা শেষ করে ফেলি।

 কেদার। বৈকুণ্ঠ বাবু, খাবার আপনার ঘরে আসে এবং সে বসেও থাকে - ওর নাম কি - আমাদের ঘরে তাঁর ব্যবহার অন্য রকমের। দেখুন যখন ছেলেবেলায় কালেজে পড়তুম তখন – ওর নাম কি - খুব উচ্চ মাচার উপরেই বিশালতা চড়িয়েছিলুম – তাতে বড় বড় লাউয়ের মত দেড় হাত দু হাত ফলও ঝুলে পড়ে ছিল — কিন্তু – কি বলে – গোড়ায় জল পেলে না - ভিতরে রস প্রবেশ করলে না - এর নাম কি - সব ফাঁপা হয়ে রইল। এখন্‌ কোথায় পয়সা কোথায় অন্ন, এই করেই মরচি! ভিতরে সার যা ছিল সব চুপ্‌সে — ওর নাম কি — শুকিয়ে গেল!

 বৈকুণ্ঠ। আহা হাহা! এত বড় দুঃখের বিষয় আর কিছু হতে পারে না! অথচ সর্ব্বদাই প্রফুল্ল আছেন – আপনি মহানুভব ব্যক্তি! (কেদারের হাত চাপিয়া ধরিয়া) দেখুন আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে যদি আপনার কোন সাহায্য করতে পারি খুলে বলবেন – কিছুমাত্র সঙ্কোচ–  কেদার। মাপ করবেন বৈকুণ্ঠ বাবু - ওর নাম কি – আমাকে টাকার প্রত্যাশী মনে করবেন না — আজ যে আনন্দ দিয়েছেন এর তুলনায় - ওর নাম কি - টাকার তোড়া -

তিনকড়ির প্রবেশ।

 তিন। (জনান্তিকে) খুসি হয়ে দিতে চাচ্চে, নে না -

 কেদার। সব মাটি করলে লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর কোথাকার -

 বৈকুণ্ঠ। এ ছেলেটি কে?

 কেদার। দেনার সঙ্গে যেমন সুদ - ওর নাম কি - উনি আমার তেমনি! নিজের দায়ই সামলাতে পারিনে - তার উপর আবার ভগবান - কি বলে - ঢাকের উপর ঢেঁকি চড়িয়েছেন।

 তিন। উনি যদি হণ গোরু আমি হই ওঁড় ল্যাজ। যখন চরে খান্‌ আমি পিঠের মাছি তাড়াই, আবার যখন চাষার হাতে লাঞ্ছনা খেতে হয় তখন মলাটা আমার উপর দিয়েই যায়।

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহাঃ! এ ছোকরাটা বেড়ে পেয়েছেন! এর যে খুব চোখেমুখে কথা! — দেখুন বিলম্ব হয়ে গেছে, আজ আমার এখানেই আহারাদি হোক্‌ না!

 কেদার। না, না, সে আপনার অসুবিধা করে কাজ নেই!

 তিনকড়ি। বিলক্ষণ! শুভকার্য্যে বাধা দিতে নেই-! খাওয়াতে ওঁর সামান্য অসুবিধে, না খেতে পেলে আমাদের অসুবিধে ঢের বেশি! ক্ষিধে পেয়েছে মশায়!

 বৈকুণ্ঠ। বেশ বাবা, তুমি পেট ভরে খেয়ে যাও! তৃপ্তির সঙ্গে খেতে দেখ্‌লে আমার বড় আনন্দ হয়!

 কেদার। এই ছোঁড়াটাকে ভগবান্—ওর নাম কি— অন্তরিন্দ্রিয়ের মধ্যে কেবল একটি জঠর দিয়েছেন মাত্র! আপনার এই আশ্রমটিতে এলে পেট বলে যে একটা গভীর গহ্বর আছে—কি বলে—সে কথা একেবারে ভুলে যেতে হয়। মনে হয় যেন কেবল একযোড়া হৃৎপিণ্ডের উপরে, ওর নাম কি, একখানি মুণ্ডু নিয়ে বসে আছি!

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহাঃ। আপনি বড় সুন্দর রস দিয়ে কথা বল্‌তে পারেন— বা, বা, আপনার চমৎকার ক্ষমতা!

 তিনকড়ি। কথায় মত্ত হয়ে প্রতিজ্ঞে ভুল্‌বেন না বৈকুণ্ঠবাবু! ক্ষিধে ক্রমেই বাড়চে!

 বৈকুণ্ঠ। বটে, বটে! ঈশেন, ঈশেন, একবার এই দিকে শুনে যাওত ঈশেন!

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। এক্‌টি ছিল, দুটি জুটেছে!

 তিনকড়ি। রেগো না দাদা, তোমাকেও ভাগ দেব!

 ঈশান। এখনো লেখা শোনানো চল্‌চে বুঝি!

 বৈকুণ্ঠ। (লজ্জিতভাবে খাতা আড়াল করিয়া) না, না, লেখা কোথায়! দেখ ঈশেন, ইয়ে হয়েছে— এই দুই বাবু— বুঝেছ, এঁদের জন্যে কিছু খাবার এনে দিতে হচ্চে!

 ঈশান। খাবার এখন কোথায় যোগাড় করব!

 তিন। ও বাবা!

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, বুঝেছ, তুমি একবার বাড়ির মধ্যে গিয়ে আমার মাকে বলে এস গে যে—

 ঈশান। সে হবে না বাবু, দিদি ঠাকরুণকে আমি আবার এই দিবসান্তে বেড়ি ধরাতে পারব না তিনি তোমার ভাত কোলে নিয়ে সেই অবধি বসে আছেন—

 বৈকুণ্ঠ। তা এঁদের না খাইয়েত আমি যেতে পারি না, তুমি একবার মাকে বল্লেই—

 ঈশান। তা জানি, তাঁকে বল্লেই তিনি ছুটে যাবেন কিন্তু আজ সমস্ত দিন একাদশী করে আছেন। বাবু আজকের মত তোমরা ঘরে গিয়ে খাওগে!

 তিনকড়ি। দাদা, পরামর্শ দেওয়া সহজ, কিন্তু খাবার না থাক লে কি করে খাওয়া যায় সে সমিস্যে ত কেউ মেটাতে পারলে না!

 কেদার। তিনকড়ে, থাম্! বৈকুণ্ঠ বাবু, ব্যস্ত হবেন না—ওর নাম কি —আজ থাক্ না—

 বৈকুণ্ঠ। দেখ্‌ ঈশেন, তোর জ্বালায় কি আমি বাড়ি ঘর দোর ছেড়ে বনে গিয়ে পালাব! বাড়িতে দুজন ভদ্রলোক এলে তাদের দুমুঠো খেতে দিবিনে! হারামজাদা লক্ষ্মীছাড়া বেটা! বেরো তুই আমার ঘর থেকে—

(ঈশানের প্রস্থান।) 

 তিনকড়ি। আহা রাগ করবেন না! আমি ঠাউরেছিলুম খাওয়াতে আপনার কোন অসুবিধে নেই— ঠিক বুঝ্‌তে পারিনি—একটু অসুবিধে আছে বৈ কি! এ লোকটিকে ইতিপূর্ব্বে দেখি নি—তা ছাড়া আপনার বুড়ো মা—

 বৈকুণ্ঠ। না না সেটি আমার একমাত্র বিধবা মেয়ে, আমার নীরু, আমার মা নেই।

 তিনকড়ি। মা নেই! ঠিক আমারি মত!

 কেদার। বৈকুণ্ঠ বাবু—ওর নাম কি—আজ তবে উঠি— ঈশান-কোণে ঝড়ের লক্ষণ দেখা যাচ্চে!

 তিনকড়ি। দাঁড়াও না যাবে কোথায়?— দেখুন বৈকুণ্ঠ বাবু লজ্জা পাবেন না—এই তিনকড়ের পোড়াকপালের আঁচ পেলে অন্নপূর্ণার হাঁড়ির তলা দুফাঁক হয়ে যায়। যা হোক্ আমার উপর সম্পূর্ণ ভার দিন্ আমি বড়বাজার থেকে আহারের যোগাড় করে আন্‌চি! আপনাকে আর কিছু দেখ্‌তে হবে না।

 কেদার। (কৃত্রিম রোষে) দেখ্‌ তিনকড়ি! এত দিন—ওর নাম কি—আমার সহবাসে এবং দৃষ্টান্তে তোর এই—কী বলে—হেয় জঘন্য লুব্ধ প্রবৃত্তি ঘুচ্‌ল না! আজ থেকে—ওর নাম কি—তোর মুখ দর্শন করব না!  (প্রস্থান।)

 বৈকুণ্ঠ। আহা, আহা, রাগ করে যাবেন না কেদার বাবু—কেদার বাবু শুনে যান্—

 তিনকড়ি। কিছু ভাবেন না! কেদারদাকে আমি বেশ জানি। ওকে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে জুড়িয়ে ঠাণ্ডা করে আপনার এখানে হাজির করে দেব। বুঝচেন না পেটে আগুন জললেই বাক্যিগুলো কিছু গরম গরম আকারে মুখ থেকে বেরতে থাকে।

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহাঃ! বাবা, তোমার কথা গুলি বেশ তা দেখ, এই তোমাকে কিঞ্চিৎ জলপানি দিচ্চি (নো দিয়া) কিছু মনে কোরো না!

 তিনকড়ি। কিচ্ছু না কিচ্ছু না! এর চেয়ে বেশি দিলেও কিছু মনে করতুম না— আমার সে রকম স্বভাব, নয়!

(প্রস্থান।)

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। বাবু! (বৈকুণ্ঠ নিরুত্তর) বাবু! (নিরুত্তর) বাবু থাবার এসেছে! (নিরুত্তর) খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে!

 বৈকুণ্ঠ। (রাগিয়া) যা—আমি খাব না!

 ঈশান। আমায় মাপ কর— থাবার জুড়িয়ে গেল।

 বৈকুণ্ঠ। না আমি খাব না।

 ঈশান। পায়ে ধরি বাবু—থেতে চল -রা। কোরো

 বৈকুণ্ঠ। যাঃ বেরো তুই —বিরক্ত করিস্ নে!

 ঈশান। দাও আমার কান মলে দাও—বাবু—

অবিনাশের প্রবেশ।

 অবিনাশ। কি দাদা! এখনে বসে বসে লিখচ বুঝি?

 বৈকুণ্ঠ। না না কিচ্ছু না—এখন লিখ্‌তে যাব কেন?—শনের সঙ্গে বসে বসে গল্প করচি।—ঈশেন তুই যা, আমি যাচ্চি। (ঈশানের প্রস্থান)

 অবা। দাদা মাইনের টাকাগুলো এনেছি—এই কুড়ি আর পাঁচ কেতা নোট—আর এই পাঁচশো টাকার এক—!

 বৈকুণ্ঠ। ঐ পাঁচশো টাকার খানা তুমিই রাখনা অবু!

 অবি। কেন দাদা!

 বৈকুণ্ঠ। যদি কোন আবশ্যক হয়—খরচ পত্র—

 অবিনাশ। আবশ্যক হলে চেয়ে নেব—

 বৈকুণ্ঠ। তবে এইখানে রাখ। তোমার হাতে টাকা ও ত থাকে না। যে আসে তাকেই বিশ্বাস করে বস! রাখ‍্তে হলে লোক চিন্‌তে হয় ভাই।

 অবিনাশ। (হাসিয়া) সেই জন্যেই ত তোমার হাতে নিশ্চিত্ত হই দাদা!

 বৈকুণ্ঠ। অবি, হাস্‌চিস্ যে! কেন, আমাকে কেউ ঠকিয়েছে বল্‌তে পারিস্? সে দিন সেই স্বরসূত্রসার কিন্‌লেম তোরা নিশ্চয় মনে করেছিস্ ঠকেছি—কিন্তু সঙ্গীত সম্বন্ধে অমন প্রাচীন বই আর আছে? হীরে দিয়ে ওজন করলেও ওর দাম হয় না। তিনশো টাকায় ত অমনি পেয়েছি।

 অবি। ও বই সম্বন্ধে আমি কি কিছু বলেছি?

 বৈকুণ্ঠ। তাতেইত বুঝতে পারলুম তোরা মনে মনে করচিস্ বুড়ো ঠকেছে। নইলে একবার জিজ্ঞাসা কর্‌তে হয়, একবার নেড়েচেড়ে দেখ্‌তে হয়—

 অবিনাশ। ওর আর আছে কি দাদা, নাড়তে চাড়তে গেলে যে গুঁড়িয়ে ধূলো হয়ে যাবে!

 বৈকুণ্ঠ। সেইত ওর দাম! ও ধুলো কি আজকের ধুলো! ও ধুলো লাখ্‌টাকা দিয়ে মাথায় রাখতে হয়!

 অবিনাশ। দাদা, এ মাসে আমাকে পঁচাত্তর টাকা দিতে হবে।

 বৈকুণ্ঠ। কেন কি করবি? (অবিনাশ নিরুত্তর) নিলেম থেকে বিলিতি গাছ কিন্‌বি বুঝি? ঐ তোর এক গাছ-পোঁতা বাতিক হয়েছে, দিনরাত যত রাজ্যের উড়েমালী নিয়ে কারবার! কত মিথ্যে গাছের নাম করে কত লোক যে তোমাকে ঠকিয়ে নিয়ে যাচ্চে তার আর সংখ্যে করা যায় না।— অবু তুই বিয়ে থাওয়া করবিনে।

 অবিনাশ। তার চেয়ে অন্য বাতিকগুলো যে ভাল! বয়স প্রায় চল্লিশ হল আর কেন?

 বৈকুণ্ঠ। সে কি, এরি মধ্যে চল্লিশ?

 অবিনাশ। এরি মধ্যে আর কই? ঠিক্ পূরো সময়ই লেগেছে—যেমন অন্য লোকের হয়ে থাকে!

 বৈকুণ্ঠ। আমারি অন্যায় হয়েছে। ছি, ছি! লোকে স্বার্থপর বল্‌বে! আর দেরি করা নয়!

 অবিনাশ। একটি লোক বসে আছে। আমি তবে চল্লুম।

(প্রস্থান।)

 বৈকুণ্ঠ। নিশ্চয় সেই মাণিকতলার মালী! একেই বলে বাতিক!

কেদারের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। এই যে কেদার বাবু ফিরে এসেছেন—বড় খুশি হলুম— তা হলে—

 কেদার। দেখুন্— ওরনাম কি—আপনার লাইব্রেরিতে সকল রকম সঙ্গীতের বই আছে, কিন্তু— কি বলে— চীনেদের সঙ্গীত পুস্তক বোধ করি নেই!

 বৈকুণ্ঠ। (ব্যস্ত হইয়া) আজ্ঞে না! আপনি কোথাও সন্ধান পেয়েছেন?

 কেদার। একখানি যোগাড় করে এনেছি—আপনাকে উপহার দিতে চাই। বইখানি, ওরনাম কি, বহুমূল্য। এই দেখুন্। —(স্বগত) বেটা চীনেম্যানের কাছ থেকে ত পুরাণোজুতোর হিসেব চেয়ে এনেছি!

 বৈকুণ্ঠ। তাইত! এ যে আদৎ চীনে ভাষা দেখ্‌চি। কিচ্ছু বোঝবার যো নেই! আশ্চর্য্য! একেবারে সোজা অক্ষর! বা, বা, চমৎকার! তা এর দাম—

 কেদার। মাপ করবেন্ ওর নাম কি—

 বৈকুণ্ঠ। না, সে হবে না! আপনি যে কষ্ট করে বইখানি খুঁজে এনেছেন এতেই আমি আপনার কেনা হয়ে রইলুম—আমার ঋণ আর বাড়াবেন না!

 কেদার। (নিশ্বাস ফেলিয়া) কিন্তু কি বল্‌ব— দামটা বোধ হয় ঠকেছি।

 বৈকুণ্ঠ। আজ্ঞে না—তা কখনো হতেই পারে না। আমি জানি কিনা— এ সব জিনিষের দাম বেশি!

 কেদার। আজ্ঞে, বেটাত পঁয়ত্রিশ টাকা চেয়ে বসেছে! বোধকরি— ওর নাম কি—ত্রিশেই রফা হবে!

 বৈকুণ্ঠ। পঁয়ত্রিশ! এ ত জলের দর! টাকাটা এখনই নিয়ে দিন্—আবার যদি মত বদ্‌লায়! চীনেম্যান্ বোধ হয় নিতান্ত দায়ে পড়েছে।

 কেদার। দায় বলে দায়! শুন্‌লুম দেশে তার তিন শ্যালী আছে—তিনটিকেই এক কুলীন চীনেম্যানের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। কন্যাদায় দায় কিন্তু— কি বলে ভাল— শ্যালী দায়ের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না!

 বৈকুণ্ঠ। (হাসিয়া) বল কি কেদার বাবু!

 কেদার। সাধে বলি! ভুক্তভোগীর কথা! ওর নাম— শ্বশুর বাড়িতে শ্যালী অতি উত্তম জিনিষ— অমন জিনিষ আর হয় না—কিন্তু সেখান থেকে চ্যুত হয়ে হঠাৎ স্কন্ধের উপর এসে পড়লে, ওর নাম কি, সকলে সাম্‌লাতে পারে না!

 বৈকুণ্ঠ। সামলাতে পারে না! হাহা হাহা!

 কেদার। আজ্ঞে আমি ত পারচিনে! একে শ্যালী, তাতে নিখুঁৎসুন্দরী, তাতে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, ওর নাম কি ঘরে ত আর টেঁকা যায় না! চোখ মেলে চাইলে স্ত্রী ভাবে শ্যালীকে খুঁজচি, ওরনাম কি— চোখ বুজে থাকলে স্ত্রী ভাবে আমি শ্যালার ধ্যান করচি! কাশ্‌লে মনে করে কাশীর মধ্যে একটা অর্থ আছে— আবার, কি বলে ভাল— প্রাণপণে কাশি চেপে থাক্‌লে মনে করে তার অর্থ আরও সন্দেহজনক!

অবিনাশের প্রবেশ।

 অবিনাশ। কি দাদা! খাবার ঠাণ্ডা হয়ে এল, এখনো লেখা নিয়ে বসে আছ!

 বৈকুণ্ঠ। না, না, লেখাটেখা কিছু নয়, কেদার বাবুর সঙ্গে গল্প করচি।

 অবিনাশ। তাইত,কেদার দেখ্‌চি! কি সর্ব্বনাশ! তুমি কোথা থেকে হে! দাদাকে পেয়ে বসেছ বুঝি!

 কেদার। হাহাহাহাঃ! অবিনাশ, চিরকালই তুমি ছেলে মানুষ রয়ে গেলে হে!

 অবিনাশ। দাদা, তোমার লেখা শোনাবার আর লোক পেলে না! শেষকালে কেদারকে ধরেছ? ও যে তোমাকে ধরলে আর ছাড়বে না!

 বৈকুণ্ঠ। আঃ অবিনাশ—ছিঃ, কি বক্‌চ?

 কেদার। বৈকুণ্ঠ বাবু আপনি ব্যস্ত হবেন না—ওর নাম কি— অবিনাশের সঙ্গে একক্লাসে পড়েছি —আমার সঙ্গে দেখা হলেই ওর আর ঠাট্টা ছাড়া কথা নেই!

 অবিনাশ। তোমার ঠাট্টা যে আমার ঠাট্টার চেয়ে গুরুতর! এই সে দিন আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেলে আবার বুঝি দরকার পড়েছে তাই দাদার বই শুনতে এসেছ?

 কেদার। ভাই অবিনাশ, ওর নামকি— এক এক সময় তোমার কথা শুনে হঠাৎ ভ্রম হয় যে, যা বল্‌চ বুঝি, সত্যিই বল্‌চ! কি জানি বৈকুণ্ঠ বাবু মনে ভাবতে পারেন যে, কি বলে ভাল—

 বৈকুণ্ঠ। (ব্যস্ত হইয়া) না, না, কেদার বাবু! আমি কিছু মনে ভাব্‌চিনে! কিন্তু অবিনাশ, সত্যি কথা বল্‌তে কি তোমার ঠাট্টাগুলো কিছু রূঢ় হয়ে পড়চে! বন্ধুকেও—

 অবিনাশ। আমি ত ঠাট্টা করচিনে—

 বৈকুণ্ঠ। অ্যাঁ! ঠাট্টা নয়! অভদ্র কোথাকার। কেদার বাবু আমার ঘরে আসেন সে আমার সৌভাগা! তুই আমার সামনে তাঁকে অপমান করিস্!

 কেদার। আহা, রাগ করবেন না, বৈকুণ্ঠবাবু—

 অবিনাশ। দাদা মিথ্যা রাগ করচ কেন? কেদারের আবার অপমান কিসের?

 বৈকণ্ঠ। আবার! তোর সঙ্গে আর আমি কথা কবনা।

 অবিনাশ। মাপ কর দাদা! (বৈকুণ্ঠ নিরুত্তর) মাপ কর আমার অপরাধ হয়েছে! (নিরুত্তর) দাদা রাগ করে থেকো না—

 বৈকুণ্ঠ। তবে শোন্! কেদার বাবুর একটি বিবাহযোগ্যা পরমাসুন্দরী বয়ঃপ্রাপ্ত শ্যালী আছে, তোরও ত বিবাহযোগ্য বয়স হয়েছে— এখন

 কেদার। যোগ্যং যোগ্যেন যোজয়েৎ।

 বৈকুণ্ঠ। ঠিক বলেছেন, আমার মনের কথাটি বলেছেন।

 কেদার। আমারও ঠিক ঐ মনের কথা!

 অবিনাশ। কিন্তু দাদা, আমার মনের কথা একটু স্বতন্ত্র! আমার বিবাহ করবার ইচ্ছে নেই—

 কেদার। অবিনাশ তুমি হাসালে! বিবাহ করবার পূর্ব্বেই অনিচ্ছে! ওর নাম কি, করবার পরে যদি হত ত মানে পাওয়া যেত!

 বৈকুণ্ঠ। মেয়েটি ত সুন্দরী—

 অবিনাশ। তাকে দেখেচ না কি?

 বৈকুণ্ঠ। দেখ্‌তে হবে কেন? কেদার বাবু যে বলচেন! (অবিনাশ নিরুত্তর)

 কেদার। বিশ্বাস হল না? কি বলে, আমার আকৃতি দেখেই ভয় পেলে কিন্তু ওর নাম কি— সে যে আমার শ্যালী, আমার স্ত্রীর সহোদরা, আমার বংশের কেউ নয় একবার স্বচক্ষে দেখে এলে হয় না?

 বৈকুণ্ঠ। সে ত বেশ কথা— দেখে এসনা অবিনাশ।

 অবিনাশ। দেখে আর করব কি? ঘরের মধ্যে বাইরের লোক আন্‌তে চাইনে—

 কেদার! তা এনোনা— কিন্তু ওর নাম কি, বাইরের লোকের পানে একবার তাকাতে দোষ কি— কি বলে,— একবার দেখে এলে ঘরেরও ক্ষতি নেই, ওর নাম কি, বাইরের ও বিশেষ ক্ষয় হবে না।

 অবিনাশ। আচ্ছা তাই হবে। এখন খেতে যাও দাদা নীরু আমাকে পাঠিয়ে দিলে!

 বৈকুণ্ঠ। এই যে, কেদার বাবু এখনো— আগে ওঁর—

 কেদার। বিলক্ষণ!

 অবিনাশ। তা খাবার না বলে দিলে খাবার আসবে কোথা থেকে! ঈশেনকে একবার ডাকা যাক।

 কেদার। ঈশেনকে ডেকোনা ভাই— ওর নাম কি—তার সঙ্গে পূর্ব্বেই দুটো একটা কথাবার্ত্তা হয়ে গেছে।

খাবার চাঙারি হস্তে তিনকড়ির প্রবেশ।

 তিনকড়ি। এই নাও বসে যাও— আমি পরিবেশন করচি।

 বৈকুণ্ঠ। তুমিও বসনা বাপু—পরিবেশনের ব্যবস্থা আমি করচি!

 তিনকড়ি। ব্যস্ত হবেন না মশায়— নিজে আগে খেয়ে নিয়েছি।

 কেদার। দূর্ লক্ষীছাড়া পেটুক!

 তিন। ভাই তিনকড়ের ভাগ্যে বিঘ্নি ঢের আছে বরাবর দেখে আস্চি। জন্মাবামাত্র দুধ খাবার জন্যে কান্না ধরলুম, তার ঠিক পূর্ব্বেই মা গেল মরে! ভাই সবুর করতে আমার সাহস হয় না!

 অবিনাশ। এ ছোকরাটিকে কোথায় যোগাড় করলে কেদার!

 কেদার। ওর নাম কি—দেশ দেশান্তর খুঁজ্তে হয় নি আপনি জুটেছে। এখন এঁকে থোব কোথায়— কি বলে ভাল—তাই খুঁজচি।

 অবিনাশ। দাদা তাহলে তুমি এখন খেতে যাও!

 বৈকুণ্ঠ। বিলক্ষণ! আগে এঁদের হোক্!

 কেদার। সে কি কথা বৈকুণ্ঠ বাবু—

 বৈকুণ্ঠ। কেদার বাবু, আপনি কিছু সঙ্কোচ করবেন না— খেতে দেখ্‌তে আমার বড় আনন্দ!

 তিনকড়ি। বেশ ত আবার কাল দেখ্‌বেন! আমরা ত পালাচ্চিনে! কিছুতেই না!

 কেদার। তিনকড়ে, বরঞ্চ তুই ঐ চাঙারিটা বাড়ি নিয়ে চল্। কি বলে— এঁদের আর কেন মিছে বিরক্ত করা।

 তিন। আজ ত আর দরকার দেখিনে! আবার কাল আছে!

(অবিনাশের হাস্য)

 বৈকুণ্ঠ। এ ছোকরাটি বেশ কথা কয়। একে আমার বড় ভাল লাগ্‌চে। কিন্তু আহারটা এই খানেই করতে হচ্চে সে আমি কিছুতেই ছাড়চিনে—

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। বাবু!

 বৈকুণ্ঠ। আরে শুনেছি, এই যে যাচ্চি! আপনার তাহলে যাবেন দেখ্‌চি! তবে আর ধরে রাখ্‌ব না।

 তিনকড়ি। আজ্ঞে না, তাহলে বিপদে পড়বেন।

(বৈকুণ্ঠ অবিনাশ ও ঈশানের প্রস্থান।)

 (কেদারের প্রতি) এই নে ভাই— টাকা কটা বেঁচেছে— এ জিনিষ আমার হাতে ঢেঁকে না।

 কেদার। তোর বাবা তোর নাম দিয়েছে তিনকড়ি— তোকে ডাক্‌ব মাণিক। লাখো টাকা তোর দাম।

প্রস্থান। 


দ্বিতীয় দৃশ্য।

কেদার ও অবিনাশ।

 কেদার। ওর নাম কি— আজ় তবে উঠি—অনেক বিরক্ত করা গেছে—

 অবি। বিলক্ষণ! বিরক্ত আবার কিসের! একটু বসে যাওনা! শোন না— আমি চলে আসার পর সে দিন মনোরমা আমার কথা কিছু বল্লে?

 কেদার। সে আবার কিছু বল্‌বে! তোমার নাম করবামাত্র তার গাল—ওর নাম কি—বিলিতি বেগুনের মত টক্‌টক্ করে ওঠে!

 অবিনাশ। (হাসিতে হাসিতে) বল কি কেদার—এত লজ্জা!

 কেদার। কি বলে, ঐটেই হল খারাপ লক্ষণ!

 অবিনাশ। (ধাক্কা দিয়া) দূর্! কি বলিস্ তার ঠিক নেই! খারাপ লক্ষণটা কি হল শুনি!

 কেদার। ওর্ নাম কি—ওটা স্বভাবের নিয়ম। যেমন তীর ছোঁড়া—গোড়ায় পিছনের দিকে প্রাণপণে পড়ে টান—তার পরে—ওর নাম কি— ছাড়া পাবামাত্রই সামনের দিকে একেবারে বোঁ করে দেয় ছুট্! গোড়ায় যেখানে বেশি লজ্জা দেখা যাচ্চে— ওর নাম কি— ভালবাসার দৌড়টাও সেখানে বড্ড বেশি হবে।

 অবিনাশ। বল কি কেদার! তা কি রকম লজ্জাটা তার দেখ্‌লে, শুনিই না! তোমরা বুঝি আমার নাম করে তাকে ঠাট্টা করেছিলে?

 কেদার। ভাই সে অনেক কথা। আজ একটু কাজ আছে—আজ তবে—

 অবিনাশ। আঃ বোসনা কেদার। শোননা—একটা কথা আছে। বুঝেছ কেদার— একটা আংটি কেনা গেছে। বুঝেছ?

 কেদার। খুব সহজ কথা ওর নাম কি—বুঝেছি!

 অবিনাশ। সহজ? আচ্ছা কি বুঝেছ বল দেখি।

 কেদার। টাকা থাক্‌লে অংট কেনা সহজ—ওর নাম কি—এই বুঝেছি।

 অবি। কিছু বোঝনি। এই আংটিটি আমি তোমার হাত দিয়ে মনোরমাকে উপহার পাঠাতে চাই! তাতে কিছু দোষ আছে!

 কেদার। আমি ত কিছু দেখিনে। যদি বা থাকে ত দোষটুকু বাদ দিয়ে—ওর নাম কি— আংটিটুকু নিলেই হবে।

 অবি। আঃ তোমার ঠাট্টা রাখ! শোননা কেদার — ঐ সঙ্গে একটা চিঠিও দিই না!

 কেদার। সে আর বেশি কথা কি!

 অবিনাশ। তবে চট্ করে লিখে দিই। (লিখিতে প্রবৃত্ত)

 কেদার। আংটিটা ত লাভ করা গেল। কিন্তু দুই ভাইয়ের মাঝখানে পড়ে মেহন্নৎটাও বড্ড বেশি হচ্চে। এখন, বিবাহটা শীঘ্র চুকে গেলে একটু জিরোবার সময় সময় পাওয়া যায়।

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। (উঁকি মারিয়া স্বগত) এই যে ভায়া আমার কেদার বাবুকে নিয়ে পড়েছে! কনে দেখে ইস্তিক ওঁকে আর এক মুহূর্ত্ত ছাড়ে না। বাতিকগ্রস্ত মানুষ কি না, সকল বিষয়েই বাড়াবাড়ি! কেদার বাবু বোধ হয় একে বারে অস্থির হয়ে উঠেছেন! বেচারাকে আমি উদ্ধার না করলে উপায় নেই। (ঘরে ঢুকিয়া) এই যে কেদার বাবু আমার সেই নতুন পরিচ্ছেদটি শোনাবার জন্যে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্চি।

 কেদার। আর ত বাচিনে!—

 অবি। (চিঠি ঢাকিয়া) দাদা, কেদার বাবুর সঙ্গে একটা কাজের কথা ছিল।

 বৈকুণ্ঠ। কাজের ত সীমা নেই। ছোঁড়াটার মাথা একেবারে ঘুরে গেছে কিন্তু কেদার বাবুকে না পেলেত আমার চল্‌চে না!

ভৃত্যের প্রবেশ।

 ভৃত্য। বাবু, মাণিকতলা থেকে মালি এসেছে।

 অবিনাশ। এখন যেতে বলে দে! (ভৃত্যের প্রস্থান)

 বৈকুণ্ঠ। যাওনা, একবার শুনেই এস না! ততক্ষণ আমি কেদার বাবুর কাছে আছি—

 কেদার। আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না—ওর নাম কি আমি আজ তবে—

 অবিনাশ। না কেদার, একট বোস।

 বৈকুণ্ঠ। না, না, আপনি বসুন! দেখ অবিনাশ গাছপালা সম্বন্ধে তোমার যে আলোচনাটা ছিল সেটা অবহেলা কোরো না! সেটা বড় স্বাস্থ্যকর, বড়ই আনন্দজনক।

 অবিনাশ। কিছু অবহেলা করবনা দাদা— কিন্তু এখন একটা বড় দরকারী কাজ আছে।

 বৈকুণ্ঠ। আচ্ছা, তাহলে তোমরা একটু বোস। ভালমানুষ পেয়ে বেচারা কেদার বাবুকে ভারি মুষ্কিলে ফেলেছে— একটু বিবেচনা নেই— বয়সের ধর্ম্ম!

তিনকড়ির প্রবেশ।

 কেদার। আবার এখানে কি কর্ত্তে এলি?

 তিনকড়ি। ভয় কি দাদা, দুজন আছে— একটিকে তুমি নাও, একটি আমাকে দাও!

 বৈকুণ্ঠ। বেশ কথা বাবা, এস আমার ঘরে এস!

 কেদার। তিনকড়ে তুই আমাকে মাটি করলি!

 তিনকড়ি। সব্বাই বলে তুমিই আমাকে মাটি করেচ। (কাছে গিয়া) রাগ কর কেন দাদা—যে অবধি তোমাকে দেখেছি সেই অবধি আপন বাপ দাদা খুড়ো কাউকে দুচক্ষে দেখ্‌তে পারিনে! এত ভালবাসা!

 কেদার। বাজে বকিস্ কেন— তোর আবার বাপ দাদা কোথা!

 তিনকড়ি। বল্লে বিশ্বাস করবিনে কিন্তু আছে ভাই। ওতেত খরচও নেই মাহাত্মিও নেই— তিনকড়েরও বাপ দাদা থাকে— যদি আমার নিজে করে নিতে হত তবে কি আর থাক্‌ত? কখ্‌খন না!

 বৈকুণ্ঠ। হাহাহাহাঃ। ছেলেটি বেশ কথা কয়! চল বাবা, আমার ঘরে চল।

(উভয়ের প্রস্থান) 

 অবিনাশ। খুব সংক্ষেপে লিখ্‌লুম, বুঝেছ কেদার—কেবল একটি লাইন—“দেবী পদতলে বিমুগ্ধ ভক্তের পূজোপহার।”

 কেদার। তা কোন কথাটিই বাদ দেওয়া হয় নি—দিব্যি হয়েছে— তবে আজ উঠি!

 অবিনাশ। কিন্তু “পদতলে” কথাটা কি ঠিক খাট্‌ল— ওটা কিনা আংটি—

 কেদার। কি বলে ভাল— তা “করতলে”ই লিখে দাও না।

 অবিনাশ। কিন্তু করতলে পূজোপহারটা কেমন শোনাচ্চে।

 কেদার। তা না হয় পূজোপহার নাই হল— ওর নাম কি—

 অবিনাশ। শুধু “উপহার” লিখ্‌লে বড় ফাঁকা শোনায়, “পূজোপহার”ই থাক্‌

 কেদার। তা থাক্ না—

 অবিনাশ। কিন্তু তা হলে “করতলে"টা কি করা যায়—

 কেদার। ওটা পদতলেই করে দাও না ওর নাম কি—তাতে ক্ষতি কি! আমি তা হলে উঠি!

 অবিনাশ। এক্‌টু রোস না— আংটি সম্বন্ধে পদতলে কথাটা খাপছাড়া শোনাচ্চে।

 কেদার। খাপছাড়া কেন হবে! তুমিত পদতলে দিয়ে খালাস্— তার পরে ওর নাম কি— তিনি করতলে তুলে নেবেন কি বলে— যদি স্বয়ং না নেন্ ত অন্য লোক আছে!

 অবিনাশ। আচ্ছা পূজোপহার না লিখে যদি প্রণয়োপহার লেখা যায়!

 কেদার। সেটা যদি খুব চট্ করে লেখা যায় ত সেইটেই ভাল!

 অবিনাশ। কিন্তু রোস একটু ভেবে দেখি।

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে এল যে।

 অবিনাশ। আচ্ছ। সে হবে এখন— তুই যা!

 ঈশান। দিদি ঠাকরুণ বসে আছে—

 অবিনাশ। আচ্ছ। আচ্ছা তুই এখন পালা

 ঈশান। (কেদারের প্রতি) বড় বাবুর ত আহার নিদ্রা বন্ধ, আবার ছোট বাবুকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছ?

 কেদার। ভাই ঈশেন, যদিচ আমার নিমক খাওনা তবু— ওর নাম কি— আমার কথাটাও একবার ভেবে দেখো! তোমার বড় বাবু খুব বিস্তারিত করে লিখে থাকেন আর তোমার ছোট বাবু—কি বলে— অত্যন্ত সংক্ষেপেই লেখেন—কিন্তু আমার কপালক্রমে দুইই সমান হয়ে ওঠে। অবিনাশ, তোমার খাবার এসেছে— ওর নাম কি— আমি উঠি!

 অবিনাশ। বিলক্ষণ! তুমিও খেয়ে যাও না। ঈশেন, বাবুর জন্যে খাবার ঠিক কর।

 ঈশান। সময়মত বল না, এখন আমি খাবার ঠিক করি কোত্থেকে!

 অবিনাশ। তোর মাথা থেকে! বেটা ভূত!

 ঈশান। এও যে ঠিক বড় বাবুর মত হয়ে এল, আমাকে আর টিক্‌তে দিলে না।

(প্রস্থান) 

 অবিনাশ। এখানে “প্রণয়োপহার” লিখ্‌লে “দেবী" কথাটা বদ্‌লাতে হয়! দেবীর সঙ্গে প্রণয় হবে কি করে!

 কেদার। কেন হবে না! তা হলে দেবতাগুলো— ওর নাম কি, বাঁচে কি করে? ভাই অবিনাশ, স্ত্রীজাতি স্বর্গে মর্ত্ত্যে পাতালে যেখানেই থাকুক্— ওর নাম কি— তাদের সঙ্গে প্রণয় হতে পারে—কি বলে ভাল— হয়েও থাকে। তুমি অত ভেবো না! (স্বগত) এখন ছাড়লে বাঁচি!

তিনকড়ির প্রবেশ।

 তিনকড়ি। ও দাদা! তোমার বদল ভেঙ্গে নাও! তুমি সেখানে যাও, আমি বরঞ্চ এখানে একবার চেষ্টা করে দেখি।

 কেদার। কেনরে কি হয়েছে!

 তিনকড়ি। ওরে বাস্‌রে! সে কি খাতা! আমি তার মধ্যে সেঁধলে আমাকে আর খুঁটে পাওয়া যাবে না! সেইটে পড়তে দিয়ে বুড়ো কোথায় উঠে গেল— আমি ত এক দৌড়ে পালিয়ে এসেচি।

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। কি তিনকড়ি পালিয়ে এলে যে!

 তিনকড়ি। আপনি অত বড় একখানা বই লিখ্‌লেন আর এইটুক বুঝ্‌লেন না!

 বৈকুণ্ঠ। কেদার বাবু, আপনি যদি একবার আসেন তাহলে—

 কেদার। চলুন! (স্বগত) রামে মারলেও মরব, রাবণে মারলেও মরব— কিন্তু অবিনাশের ঐ একটি লাইন নিয়ে ত আর পারিনে!

 অবিনাশ। কেদার তুমি যাও কোথায়! দাদা আমার সেই কাজটা!

 বৈকুণ্ঠ। (রাগিয়া উঠিয়া) দিন রাত্তির তোমার কাজ। কেদার বাবু ভদ্রলোক— ওঁকে একটু বিশ্রাম দেবে না। তোমাদের একটু বিবেচনা নেই! আসুন্ কেদার বাবু।

 কেদার। ওর নাম কি, চলুন্। (উভয়ের প্রস্থান)

 অবিনাশ। মনোরমা তোমার কে হন তিনকড়ি?

 তিনকড়ি। তিনি আমার দূর সম্পর্কে বোন হন কিন্তু সে পরিচয় প্রকাশ হলে তিনি ভারি লজ্জা পাবেন!

 অবিনাশ। তাঁর খুব লজ্জা।—না তিনকড়ি!

 তিনকড়ি। আমার সম্বন্ধে ভারি লজ্জা! কাউকে মুখ দেখাবার যো নেই!

 অবিনাশ। না, তোমার সম্বন্ধে বল্‌চিনে— আমার সম্বন্ধে! জান ত তিনকড়ি, আমার সঙ্গে তাঁর একটা সম্বন্ধ—

 তিনকড়ি। ওঃ বুঝেছি! তা ত হতেই পারে! আমার সঙ্গেও একটি কন্যের সম্বন্ধ হয়েছিল—বিবাহের পূর্ব্বে সেত লজ্জায় মরেই গেল।

 অবিনাশ। আঃ, কি বল তিনকড়ি।

 তিনকড়ি। শুধু লজ্জা নয় শুন্‌লুম তার যকৃৎও ছিল

 অবিনাশ। মনোরমার—

 তিনকড়ি। যকৃতের দোষ নেই।

 অবিনাশ। আঃ সে কথা আমি জিজ্ঞাসা করচি নে— আমি হৃদয়ের কথা বল্‌চি—

 তিনকড়ি। মশায় ও সব বড় শক্ত কথা— আমি বুঝিনে। মেয়ে মানুষের হৃদয় তিনকড়ি কখনো পায়নি কখনো প্রত্যাশাও করেনি। দিব্যি আছি।

 অবিনাশ। আচ্ছ। সে থাক্— কিন্তু মনোরমাকে আমি একটি আংট উপহার দেব—বুঝলে? সেই সঙ্গে এক লাইন চিঠি দিতে চাই—

 তিনকড়ি। ক্ষতি কি! একটা লাইন্ বই ত নয় চট্ করে হয়ে যাবে!

 অবিনাপ। এই দেখ না— আমি লিখেছিলুন—“দেবীপদতলে বিমুগ্ধ ভক্তের পূজোপহার।” তুমি কি বল?

 তিন। তোমার কথা তুমি বল্‌বে— ওর মধ্যে আমার কিছু বলা ভাল হয় না—সে হল আমার ভগ্নী!

 অবিনাশ। না, না, তা বলচিনে! আংটি কি ঠিক পদতলে দেওয়া যায়! করতলে লিখ্‌লে—

 তিনকড়ি। তা ওটা লেখা বইত না— পদতলে লিখে করতলে দিলেই হবে—সে জন্যে ত কেউ আদালতে নালিশ করবে না!

 অবিনাশ। না হে না, লেখার ত একটা মানে থাকা চাই—

 তিনকড়ি। আংটি থাকলে আর মানে থাকার দরকার কি? ওতেই ত বোঝা গেল!

 অবিনাশ। আংটির চেয়ে কথার দাম বেশি তা জান?

 তিনকড়ি। তা হলে আজ আর তিনকড়েকে হাহাকার করে বেড়াতে হত না।

 অবি। আঃ কি বক্‌চ তুমি তার ঠিক নেই! একটু মন দিয়ে শোন দিখি। ও লাইনটা যদি এই রকম লেখা যায় ত কেমন হও—“প্রেয়সীর করপদ্মে অনুরক্ত সেবকের প্রণয়োপহার!”

 তিনকড়ি। বেশ হয়!

 অবিনাশ। বেশ হয়! একটা কথা বলে দিলেই হল “বেশ হয়!” একটু ভেবে চিন্তে বল না!

 তিনকড়ি। ও বাবা! এ যে আবার রাগ করে! বুড়োর শরীরে কিন্তু রাগ নেই! (প্রকাশ্যে) তা ভেবে চিন্তে দেখ্‌লে বোধ হয় গোড়ারটাই ছিল ভাল!

 অবিনাশ। কেন বল দেখি! এটাতে কি দোষ হয়েছে!

 তিনকড়ি। ও বাবা! এটাতে যদি দোষই না থাক্‌বে ত খামকা আমাকে ভাব্‌তে বলে কেন? এত বড় মুষ্কিলেই পড়া গেল দেখ্‌চি!— দোষ কি জানেন অবিনাশ বাবু, ও ভাব্‌তে গেলেই দোষ না ভাব্‌লে কিছুতেই দোষ নেই আমি ত এই বুঝি!

 অবি। ওঃ বুঝেছি— তুমি বল্‌চ, আগে থাকতে ঐ প্রেয়সী সম্বোধনটায় লোকে কিছু মনে ভাব্‌তে পারে—

 তিন। বাঁচা গেল! হাঁ তাই বটে! কিন্তু কি জানেন আপনাআপনির মধ্যে না হয় তাকে প্রেয়সীই বল্লেন! তা কি আর অন্য কেউ বলে না! ঐটেই লিখে ফেলুন্!

 অবি। কাজ নেই গোড়ায় যেটা ছিল সেইটেই—

 তিনকড়ি। সেইটেইত আমার পছন্দ

 অবিনাশ। কিন্তু একটু ভেবে দেখ না, ওটা যেন—

 তিনকড়ি। ও বাবা! আবার ভাব্‌তে বলে! অবিনাশ বাবু, শিশুকাল থেকে আমিও কারো জন্যে ভাবি নি, আমার জন্যেও কেউ ভাবে নি, ওটা আমার আর অভ্যাস হলই না! এরকম আরো আমার অনেক গুলি শিক্ষার দোষ আছে—

 অবিনাশ। আঃ তিনকড়ি, তুমি একটু থাম্‌লে বাঁচি! নিজের কথা নিয়েই কেবল বক্‌বক্ করে মরচ, আমাকে একটু ভাব্‌তে দাও দেখি!

 তিনকড়ি। আপনি ভাবুন্ না। আমাকে ভাবতে বলেন কেন? একটু বসুন্ অবিনাশ বাবু— আমি কেদারদাকে ডেকে আনি। সে আমার চেয়ে ভাব্‌তেও জানে ভেবে কিনারা করতেও পারে!—আমার পক্ষে বুড়োই ভাল!  (প্রস্থান।)

কেদার, বৈকুণ্ঠ এবং তিনকড়ির প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। অবিনাশ, কেদার বাবুকে আবার তোমার কি দরকার হল! আমি ওঁকে আমার নতুন পরিচ্ছেদটা শোনাচ্ছিলুম তিনকড়ি কিছুতেই ছাড়লে না শেষকালে হাতে পায়ে ধরতে লাগ্‌ল।

 অবিনাশ। আমার সেই কাজটা শেষ হয় নি, তাই।

 বৈকুণ্ঠ। (রাগিয়া) তোমার ত কাজ শেষ হয় নি, আমারি সে পরিচ্ছেদটা শেষ হয়েছিল না কি?

 অবিনাশ। তা দাদা, ওঁকে নিয়ে যাওনা—

 কেদার। (ব্যস্ত হইয়া) ওর নাম কি অবিনাশ— তোমারও সে কাজটাত জরুরি কি বলে— আর ত দেরী করা চলে ন!

 বৈকুণ্ঠ। বিলক্ষণ! আপনি সে জন্যে ভাব্‌বেন না। নিজের কাজ নিয়ে কেদার বাবুকে এরকম কষ্ট দেওয়া উচিত হয় না অবিনাশ! অমন করলে উনি আর এখানে আস্‌বেন না!

 তিনকড়ি। সে ভয় করবেন না বৈকুণ্ঠ বাবু— আমাদের দুটিকে না চাইলেও পাওয়া যায়, তাড়ালেও ফিরে পাবেন— মলেও ফিরে আস্‌ব এম্‌নি সকলে সন্দেহ করে!

 কেদার। তিনকড়ে! ফের!

 তিনকড়ি। ভাই, আগে থাকতে বলে রাখাই ভাল— শেষকালে ওঁয়ারা কি মনে করবেন!

ঈশানের প্রবেশ।

 ঈশান। (অবিনাশ ও কেদারের প্রতি) বাবু, তোমাদের দুজনেরই খাবার জায়গা হয়েছে!

 তিন। আর আমাকে বুঝি ফাঁকি! জন্মাবামাত্র যার নিজের মা ফাঁকি দিরে মল, বন্ধুবা তার আর কি করবে! কিন্তু দাদা, তিনকড়ে তোমাকে ভাগ না দিয়ে খায় না!

 কেদার। তিনকড়ে, ফের!

 তিনকড়ি। তা যা ভাই, চট্‌ করে খেয়ে আর গে! দেরী করলে বড় লোভ হবে— মনে হবে ছত্রিশ ব্যঞ্জন লুঠ্‌চিস্!

 বৈকুণ্ঠ। সে কি কথা তিনকড়ি! তুমি না খেয়ে যাবে! সে কি হয়! ঈশেন!

 ঈশান। আমি জানিনে! আমি চল্লুম!

(প্রস্থান।)

 অবিনাশ। চলনা তিনকড়ি! একরকম করে হয়ে যাবে!

 তিনকড়ি। টানাটানি করে দরকার কি। আপনারা এগোন্! খাওয়াবার রাস্তা বৈকুণ্ঠ বাবু জানেন্ —সেদিন টের পেয়েছি।  (তিনকড়ি ও বৈকুণ্ঠের প্রস্থান।)

 অবিনাশ। তা হলে ও লাইনটা—

 কেদার। ওর নাম কি, খেয়ে এসে হবে!



তৃতীয় দৃশ্য।

কেদার।

 কেদার। শ্যালীর বিবাহত নির্ব্বিঘ্নে হয়ে গেছে। কিন্তু বৈকুণ্ঠ থাক তে এখানে বাস করে সুখ হচ্চে না। উপদ্রবত করা যাচ্ছে কিন্তু বুড়ো নড়ে না!

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। এই যে কেদার বাবু, আপনাকে শুকনো দেখাচ্চে যে? অসুখ করেনিত?

 কেদার। ওর নাম কি— ডাক্তারে সকল রকম মানসিক পরিশ্রন নিষেধ করেছে—

 বৈকুণ্ঠ। আহা, কি দুঃখের বিষয়! আপনি এখানেই কিছু দিন বিশ্রাম করুন!

 কেদার। সেই রকমইত স্থির করেছি!

 বৈকুণ্ঠ। তা দেখুন্—বেণী বাবুকে—

 কেদার। বেণী বাবু নয়, বিপিন বাবুর কথা বল্‌চেন বোধ হয়—

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ হাঁ, বিপিন বাবুই বটে—ঐ যে তিনি ছোট বৌমার কে হন্—

 কেদার। খুড়ো হন্—

 বৈকুণ্ঠ। খুড়োই হবেন। তা তাঁকে আমার এই ঘরে থাক্‌তে দিয়েছেন—সেকি তাঁর—

 কেদার। না, ওর নাম কি, তাঁর কোন অসুবিধে হয় নি—তিনি বেশ আছেন—

 বৈকুণ্ঠ। জানেন্ ত কেদার বাবু, আমি এই ঘরেই লিখে থাকি—

 কেদার। তা বেশ ত, আপনি লিখ্‌বেন— ওর নাম কি—আপনি লিখ্‌বেন—তাতে বিপিন বাবুর কোন আপত্তি নেই।

 বৈকুণ্ঠ। না, আপত্তি কেন করবেন, লোকটি বেশ— কিন্তু তাঁর একটি অভ্যাস আছে, তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রায় সর্ব্বদাই গুন্ গুন্ করে গান করেন—তাতে লেখবার সময়—

 কেদার। কি বলে— সে জন্যে ভাবনা কি! আপনি তাঁকে ডেকেই বলুন না—

 বৈকুণ্ঠ। না না না না! সে থাক্! তিনি ভদ্রলোক—

 কেদার। ওর নাম কি, আমিই তাঁকে ডেকে খুব করে ভর্ৎসনা করে দিচ্চি—

 বৈকুণ্ঠ। না না কেদার বাবু, সে করবেন না— লেখার সময় গান ত আমার ভালই লাগে। কিন্তু আমি ভাবছিলুম হয় ত আর কোনো ঘরে বেণী বাবু একলা থাক্‌লে বেশ মন খুলে গাইতে পারেন।

 কেদার। ওর নাম কি—ঠিক উল্টো! বিপিন বাবুর একটি লোক সর্ব্বদাই চাই—

 বৈকুণ্ঠ। তা দেখেছি—বড় মিশুক্—হয় গান, নয় গল্প, করচেন্‌ই—তা আমি তাঁর কথা মন দিয়ে শুনে থাকি!— কিন্তু দেখ কেদার বাবু— কিছু মনে কোরো না ভাই—একটা বড় গুরুতর বেদনা পেয়েছি, সে কথা তোমাকে না বলে থাক্‌তে পাচ্চিনে। ভাই আমার সেই স্বরসূত্রসার পুঁথিখানি কে নিয়েছে!

 কেদার। কোথায় ছিল বলুন্ দেখি!

 বৈকুণ্ঠ। সে ত আপনি জানেন। এই ঘরে ঐ শেল্‌ফের উপর ছিল। আজকাল এঘরে সর্ব্বদা লোক আনাগোনা করচেন আমি কাউকে কিছুই বল্‌তে পারচিনে——কিন্তু শেল্‌ফের ঐ জায়গাটা শূন্য দেখচি আর মনে হচ্চে আমার বুকের ক’খানা পাঁজর খালি হয়ে গেছে!

 কেদার। তবে আপনাকে—ওর নাম কি—খুলে বলি— অবিনাশ আপনার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায়!

 বৈকুণ্ঠ। অবু! সেত এ সব বই পড়ে না!

 কেদার। পড়েনা—ওর নাম কি—বিক্রি করে!

 বৈকুণ্ঠ। বিক্রি করে!

 কেদার। নতুন প্রণয়—নতুন সখ্—ওর নাম কি—খরচ বেশি। আমি তাকে বলি, অবু—কি বলে ভাল—মাইনের টাকা থেকে কিছু কিছু কেটে নিয়ে দাদাকে দিলেই হয়। অবু বলে লজ্জা করে।

 বৈকুণ্ঠ। ছেলেমানুষ! প্রণয়ের খাতিরও এড়াতে পারে না, আবার দাদার সম্মানটিও রাখ্‌তে হবে!

 কেদার। ওর নাম কি—আমি আপনার বইখানি উদ্ধার করে আন্‌ব—

 বৈকুণ্ঠ। তা যত টাকা লাগে! আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাক্‌ব।

 কেদার। (স্বগত) বাজারে ত তার চার পয়সা দামও হল না— এ আরও হল ভাল— ধর্ম্ম ও রইল, কিছু পাওয়া ও গেল।

(প্রস্থান।)

অবিনাশের প্রবেশ।

 অবিনাশ। দাদা!

 বৈকুণ্ঠ। কি ভাই অবু!

 অবিনাশ। আমার কিছু টাকার দরকার হয়েছে—

 বৈকুণ্ঠ। তাতে লজ্জা কি অবু! আমি বল্‌চি কি এখন থেকে তোমার টাকা তুমিই রাখ না ভাই—আমি বুড়ো হয়ে গেলুম— হারিয়ে ফেলি কি ভুলেই যাই—আমার কি মনের ঠিক আছে!

 অবিনাশ। এ আবার কি নতুন কথা হল দাদা।

 বৈকুণ্ঠ। নতুন কথা নয় ভাই—তুমি বিয়ে থাওয়া করে সংসারী হয়েছ— আমি ত সন্যাসী মানুষ—

 অবিনাশ। তুমিই ত দাদা, আমার বিয়ে দিয়ে দিলে তাতেই যদি পর হয়ে থাকি, তবে থাক্— টাকা কড়ির কথা আর আমি বল্‌ব না! (প্রস্থান)

 বৈকুণ্ঠ। আহা অবু রাগ কোরো না— শোনো আমার কথাটা আহা শুনে যাও!—

(“ভাব্‌তে পারিনে পরের ভাবনা” গাহিতে

গাহিতে বিপিনের প্রবেশ।)

 বৈকুণ্ঠ। এই যে বেণী বাবু—

 বিপিন। আমার নাম বিপিন বিহারী।

 বৈকুণ্ঠ। হাঁহাঁ, বিপিন বাবু। আপনার বিছানায় ঐ যে বইগুলি রেখেচেন, ও গুলি পড়চেন বুঝি?

 বিপিন। নাঃ পড়িনে, বাজাই।

 বৈকুণ্ঠ। বাজান্? তা আপনাকে যদি বাঁয়া তব্‌লা, কি মৃদঙ্গ—

 বিপিন। সে ত আমার আসে না— আমি বই বাজাই।

দেখুন্ বৈকুণ্ঠ বাবু, আপনাকে রোজ বল্‌ব মনে করি ভুলে যাই— আপনার এই ডেক্‌সো আর ঐ গোটাকতক শেল্‌ফ এখান থেকে সরাতে হচ্চে— আমার বন্ধুরা সর্ব্বদাই আসচে তাদের বসাবার জায়গা পাচ্চিনে—

 বৈকুণ্ঠ। আর ত ঘর দেখিনে— দক্ষিণের ঘরে কেদার বাবু আছেন—ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম করতে বলেচে— পূবের ঘরটায় কে কে আছেন আমি ঠিক চিনিনে— তা বেণী বাবু—

 বিপিন। বিপিন বাবু।

 বৈকুণ্ঠ। হাঁহাঁ বিপিন বাবু— তা যদি ওগুলো এই এক পাশে সরিয়ে রাখি তাহলে কি কিছু অসুবিধে হয়?

 বিপিন। অসুবিধা আর কি, থাকবার কষ্ট হয়। আমি আবার বেশ একটু ফাঁকা না হয়ে থাক্‌তে পারিনে। “ভাব্‌তে পারিনে পরের ভাবনা লো সই!—

ঈশানের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, এ ঘরে বেণী বাবুর—

 বিপিন। বিপিন বাবুর—

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিপিন বাবুর থাকার কিছু কষ্ট হচ্ছে।

 ঈশান। কষ্ট হয়ে থাকে ত আর আবশ্যক কি, ওঁর বাপের ঘর দুয়োর কিছু নেই, না কি!

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, চুপ্ কর!

 বিপিন। কি রাস্কেল, তুই এত বড় কথা বলিস!

 ঈশান। দেখ, গালমন্দ দিয়ো না বল্‌চি—

 বৈকুণ্ঠ। আঃ ঈশেন থাম—

 বিপিন। আমি তোদের এ ঘরে পায়ের ধুলো মুছতে চাইনে। আমি এখনি চল্লুম।

 বৈকুণ্ঠ। যাবেন না বেণী বাবু। আমি গলবস্ত্র হয়ে বল্‌চি মাপ কর্‌বেন— (বৈকুণ্ঠকে ঠেলিয়া বিপিনের প্রস্থান) ঈশেন তুই কি করলি বল্ দেখি—তুই আর আমাকে বাড়িতে টিঁক্‌তে দিলিনে দেখ্‌চি।

 ঈশান। আমিই দিলুম না বটে!

 বৈকুণ্ঠ। দেখ্ ঈশেন, অনেক কাল থেকে আছিস তোর কথাবার্ত্তাগুলো আমাদের অভ্যাস হয়ে এসেছে, এরা নতুন মানুষ এরা সইতে পারবে কেন? তুই একটু ঠাণ্ডা হয়ে কথা কইতে পারিস্‌নে?

 ঈশান। আমি ঠাণ্ডা হয়ে থাকি কি করে। এদের রকম দেখে আমার সর্ব্বশরীর জ্বল্‌তে থাকে!

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, ওরা আমাদের নতুন কুটুম্ব— ওরা কিছুতে ক্ষুণ্ণ হলে অবিনাশের গায়ে লাগ্‌বে— সে আমাকেও কিছু বল্‌তে পারবে না—অথচ তার হল—

 ঈশান। সে ত সব বুঝেছি। সেই জন্যেই ত ছোট বয়সে ছোট বাবুকে বিয়ে দেবার জন্যে কতবার বলেছি— সময়কালে বিয়ে হলে এতটা বাড়াবাড়ি হয় না।

 বৈকুণ্ঠ। যা আর বকিস্‌নে ঈশেন—এখন যা— আমি সকল কথা একবার ভেবে দেখি!

 ঈশান। ভেবে দেখো! এখন যে কথাটা বল্‌তে এসেছিলুম বলে নিই। আমাদের ছোট মার খুড়ি না পিসি, না কে এক বুড়ি এসে দিদি ঠাকরুণকে যে দুঃখ দিচ্চে সে ত আমার আর সহ্য হয় না!

 বৈকুণ্ঠ। আমার নীরুমাকে! সে ত কারো কিছুতে থাকে না!

 ঈশান। তাঁকে ত দিনরাত্তির দাসীর মত খাটিয়ে মারচে— তার পরে আবার মাগী তোমার নামে খোঁটা দিয়ে তাঁকে বলে কি না যে, তুমি তোমার ছোট ভাইয়ের টাকায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বড়মানুষী করে বেড়াচ্চ। মাগীর যদি দাঁত থাক্‌ত ত নোড়া দিয়ে ভেঙ্গে দিতুন না!

 বৈকুণ্ঠ। তা নীরু কি বলে?

 ঈশান। তিনি ত তাঁর বাপেরই মেয়ে—মুখখানি যেন ফুলের মত শুকিয়ে যায়—একটি কথা বলে না—

 বৈকুণ্ঠ। (কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া) একটা কথা আছে, যে সয় তারই জয়—

 ঈশান। সে কথাটা আমি ভাল বুঝিনে! আমি একবার ছোট বাবুকে—

 বৈকুণ্ঠ। খবরদার ঈশেন আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বল্‌চি—অবিনাশকে কোন কথা বল্‌তে পারবিনে।

 ঈশান। তবে চুপ করে বসে থাক্‌ব?

 বৈকুণ্ঠ। না, আমি একটা উপায় ঠাউরেছি! এখানে জায়গাতেও আর কুলচ্চেনা—এঁদের সকলেরই অসুবিধে হচ্চে দেখতে পাচ্চি—তা ছাড়া অবিনাশের এখন ঘরসংসার হল—তার টাকা কড়ির দরকার, তার উপরে ভার চাপাতে আমার আর ইচ্ছে নেই—আমি এখান থেকে যেতে চাই—

 ঈশান। সে ত মন্দ কথা নয়— কিন্তু—

 বৈকুণ্ঠ। ওর আর কিন্তু টিন্তু নেই ঈশেন। সময় উপস্থিত হলেই প্রস্তুত হতে হয়।

 ঈশান। তোমার লেখা পড়ার কি হবে?

 বৈকুণ্ঠ। (হাসিয়া) আমার লেখা! সে আবার একটা জিনিষ! সবাই হাসে আমি কি তা জানিনে ঈশেন? ওসব রইল পড়ে। সংসারে লেখায় কারো কোন দরকার নেই!

 ঈশান। ছোট বাবুকে ত বলে কয়ে যেতে হবে?

 বৈকুণ্ঠ। তা হলে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। সে ত আর আমাকে যাও বল্‌তে পারবে না ঈশেন! গোপনেই যেতে হবে— তার পরে তাকে লিখে জানাব। যাই আমার নীরুকে একবার দেখে আসিগে!

(উভয়ের প্রস্থান)

তিনকড়ি ও কেদারের প্রবেশ।

 তিনকড়ি। দাদা, তুইত আমাকে ফাঁকি দিয়ে হাঁসপাতালে পাঠালি—সেখান থেকেও আমি ফাঁকি দিয়ে ফিরেছি—কিছুতেই মলেম না!

 কেদার। তাইতরে দিব্যি টিঁকে আছিস্ যে!

 তিনকড়ি। ভাগ্যে দাদা একদিনও দেখ্‌তে যাও নি—

 কেদার। কেনরে!

 তিনকড়ি। যম বেটা ঠাউরালে এ ছোঁড়ার দুনিয়ায় কেউ নেই—নেহাৎ তাচ্ছিল্য করে নিলে না। ভাই তোকে বল্‌ব কি, এই তিনকড়ের ভিতরে কতটা পদার্থ আছে সেইটে দেখবার জন্যে মেডিকাল কালেজের ছোকরাগুলো সব ছুরি উঁচিয়ে বসে ছিল—দেখে আমার অহঙ্কার হত! যাই হোক্ দাদা তুমি ত এখানে দিব্যি জমিয়ে বসেচ।

 কেদার। যা, যা, মেলা বকিস্‌নে। এখন এ আমার আত্মীয় বাড়ি তা জানিস্?

 তিনকড়ি। সমস্তই জানি— আমার অগোচর কিছুই নেই। কিন্তু বুড়ো বৈকুণ্ঠকে দেখ্‌চিনে যে! তাকে বুঝি ঠেলে দিয়েছিস্? ঐটে তোর দোষ! কাজ ফুরলেই—

 কেদার। তিনকড়ে! ফের! কানমলা খাবি!

 তিনকড়ি। তা দে মলে। কিন্তু সত্যি কথা বল্‌তে হয়, বৈকুণ্ঠকে যদি তুই ফাঁকি দিস্ তা হলে অধর্ম্ম হবে— আমার সঙ্গে যা করিস্ সে আলাদা—

 কেদার। ইস্ এত ধর্ম্ম শিখে এলি কোথা!

 তিনকড়ি। তা যা বলিস্ ভাই— যদিচ তুমি আমি এত দিন টিঁকে আছি তবু ধর্ম্ম বলে একটা কিছু আছে। দেখ কেদার দা, আমি যখন হাঁসপাতালে পড়েছিলুম, বুড়োর কথা আমার সর্ব্বদা মনে হত— পড়ে পড়ে ভাবতুম, তিনকড়ি নেই এখন কেদারদার হাত থেকে বুড়োকে কে ঠেকাবে! বড় দুঃখ হত।

 কেদার। দেখ্ তিনকড়ে তুই যদি এখানে আমাকে জ্বালাতে আসিস্ তা হলে—

 তিনকড়ি। মিথ্যে ভয় করচ দাদা! আমাকে আর হাঁসপাতালে পাঠাতে হবে না। এখানে তুমি একলাই রাজত্ব করবে। আমি দুদিনের বেশি কোথাও টিঁকতে পারিনে, এ জায়গাও আমার সহ্য হবে না।

 কেদার। তাহলে আর আমাকে দগ্ধাস্ কেন— না হয় দুটো দিন আগেই গেলি।

 তিনকড়ি। বৈকুণ্ঠের খাতাখানা না চুকিয়ে যেতে পারচিনে—তুমি তাকে ফাঁকি দেবে জানি। অদৃষ্টে যা থাকে ওটা এই অভাগাকেই শুন্‌তে হবে।

 কেদার। এ ছোঁড়াটাকে মেরে ধরে গাল দিয়ে কিছুতেই তাড়াবার যো নেই।—তিনকড়ে তোর ক্ষিধে পেয়েছে?

 তিনকড়ি। কেন আর মনে করিয়ে দাও ভাই?

 কেদার। চল্‌ তোকে কিছু পয়সা দিই গে—বাজার থেকে জলখাবার কিনে এনে খাবি।

 তিনকড়ি। এ কি হল! তোমারও ধর্ম্মজ্ঞান! হঠাৎ ভালমন্দ একটা কিছু হবেনাত!  (উভয়ের প্রস্থান)

ঈশান ও বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।

 বৈকুণ্ঠ। ভেবেছিলুম, খাতাপত্রগুলো আর সঙ্গে নেব না—শুনে মা নীরু কাঁদ্‌তে লাগ্‌লে— ভাব্‌লে বুড়ো বয়সের খেলাগুলো বাবা কোথায় ফেলে যাচ্চে। এগুলো নে ঈশেন!—ঈশেন।

 ঈশান। কি বাবু!

 বৈকুণ্ঠ। ছোটর উপর বড়র যে রকম স্নেহ, বড়র উপর ছোটর সে রকম হয় না—না ঈশেন!

 ঈশান। তাইত দেখ্‌তে পাই।

 বৈকুণ্ঠ। আমি চলে গেলে অবু বোধ হয় বিশেষ কষ্ট পাবে না!

 ঈশান। না পাবারই সম্ভব। বিশেষ—

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিশেষ তার নতুন সংসার হয়েছে—আর ত আত্মীয় স্বজনের অভাব নেই—কি বলিস্ ঈশেন—

 ঈশান। আমিও তাই বল্‌ছিলুম।

 বৈকুণ্ঠ। বোধ হয় নীরুমার জন্যে তার মনটা—নীরুকে অবু বড় ভালবাসে; না ঈশেন!

 ঈশান। আগে ত তাই বোধ হত, কিন্তু—

 বৈকুণ্ঠ। অবিনাশ কি এ সব জানে?

 ঈশান। তা কি আর জানেন না? তিনি যদি এর মধ্যে না থাক তেন, তা হলে কি আর বুড়িটা সাহস কর ত—

 বৈকুণ্ঠ। দেখ্‌ ঈশেন, তোর কথাগুলো বড় অসহ্য! তুই একটা মিষ্টি কথা বানিয়েও বলতে পারিস নে? এতটুকু বেলা থেকে আমি তাকে মানুষ করলুম,—একদিনের জন্যেও চোখের আড়াল করি নি,—আমি চলে গেলে তার কষ্ট হবে না—এমন কথা তুই মুখে আনিস্ হারামজাদা বেটা! সে জেনে শুনে আমার নীরুকে কষ্ট দিয়েছে! লক্ষ্মীছাড়া পাজি, তার কথা শুনলে বুক ফেটে যায়!

(“ভাব্‌তে পারিনে পরের ভাবনা” গাহিতে

গাহিতে বিপিনের প্রবেশ।)

 বিপিন। ভেবেছিলুম ফিরে ডাকবে। ডাকে না যে! এই যে বুড়ো এইখেনেই আছে। বৈকুণ্ঠ বাবু আমার জিনিষপত্র নিতে এলুম। আমার ঐ হুঁকোটা, আর ঐ ক্যাম্বিসের ব্যাগটা। ঈশেন শীগ্‌গির মুটে ডাক।

 বৈকুণ্ঠ। সে কি কথা—আপনি এখানেই থাকুন! আমি করযোড় করে বল্‌চি আমাকে মাপ করুন্ বেণী বাবু।

 বিপিন। বিপিন বাবু।

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ, হাঁ, বিপিন বাবু! আপনি থাকুন্— আমরা এখনি ঘর খালি করে দিচ্চি।

 বিপিন। এ বইগুলো কি হবে?

 বৈকুণ্ঠ। সমস্তই সরাচ্চি। (শেল্‌ফ হইতে বই ভূমিতে নাবাইতে প্রবৃত্ত)

 ঈশান। এ বই গুলিকে বাবু যেন বিধবার পুত্রসন্তানের মত দেখ্‌ত—ধূলো নিজের হাতে ঝাড়ত— আজ ধূলোয় ফেলে দিচ্চে! (চক্ষু মোচন)

 বিপিন। কেদারের ঘরে আফিমের কৌটা ফেলে এসেছি—নিয়ে আসিগে! ভাব্‌তে পারিনে পরের ভাবনা লো সই!”

(প্রস্থান।)

তিনকড়ির প্রবেশ।

 তিন। এই যে পেয়েছি, বৈকুণ্ঠ বাবু! ভাল ত?

 বৈকুণ্ঠ। কি বাবা, তুমি ভাল আছ? অনেক দিন দেখিনি।

 তিনকড়ি। ভয় কি বৈকুণ্ঠ বাবু, আবার অনেক দিন দেখ্‌তে পারেন। ধরা দিয়েছি; এখন আপনার খাতাপত্র বের করুন্!

 বৈকুণ্ঠ। সে সব আর নেই তিনকড়ি— তুমি এখন নিশ্চিন্তমনে এখানে থাকতে পারবে।

 তিনকড়ি। তা হলে আর লিখ্‌বেন না?

 বৈকুণ্ঠ। না, সে সব খেয়াল ছেড়ে দিয়েছি।

 তিনকড়ি। ছেড়ে দিয়েছেন সত্যি বল্‌চেন?

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ ছেড়ে দিয়েছি।

 তিনকড়ি। আঃ বাঁচ্‌লেম! তা হলে ছুটি— আমি যেতে পারি?

 বৈকুণ্ঠ। কোথায় যাবে বাপু?

 তিনকড়ি। অলক্ষ্মী যেখানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান্! ভেবেছিলুম মেয়াদ ফুরোয়নি—খাতা এখনো অনেকখানি বাকি আছে—শুনে যেতে হবে।— তা হলে প্রণাম হই।

 বৈকুণ্ঠ। এস বাবা, ঈশ্বর তোমার ভাল করুন!

 তিনকড়ি। উঁহুঁ! একটা কি গোল হয়েছে ঠিক বুঝ্‌তে পারচিনে! ভাই ঈশেন, এতদিন পরে দেখা, তুমিও ত আমাকে মার মার শব্দে খেদিয়ে এলে না— তোমার জন্যে ভাবনা হচ্চে!

অবিনাশের প্রবেশ।

 অবিনাশ। দাদা, কোথা থেকে তুমি যত সব লোক জুটিয়েছ—বাড়ির মধ্যে বাইরে কোথাও ত আর টিঁকতে দিলে না!

 বৈকুণ্ঠ। তারা কি আমার লোক অবু? তোমারই ত সব—

 অবিনাশ। আমার কে! আমি তাদের চিনিনে! কেদারের সব আত্মীয়— তুমিই ত তাদের স্থান দিয়েছ! সেই জন্যেই ত আমি তাদের কিছু বল্‌তে পারিনে। তা, তুমি যদি পার ত তাদের সাম্‌লাও দাদা— আমি বাড়ি ছেড়ে চল্লুম।

 বৈকুণ্ঠ। আমিই ত যাব মনে করছিলুম—

 তিনকড়ি। তার চেয়ে তাঁরা গেলেই ত ভাল হয়। আপনারা দুজনেই গেলে তাঁদের আদর অভ্যর্থনা করবে কে?

 অবিনাশ। বাড়ির মধ্যে একটা কে বুড়ি এসেছে, সে ত ঝগড়া করে একটাও দাসী টিঁক্‌তে দিলে না—তাও সয়েছিলুম—কিন্তু আজ আমি স্বচক্ষে দেখ্‌লুম, সে নীরুর গায়ে হাত তুল্‌লে— আর সহ্য হল না—তাকে এইমাত্র গঙ্গা পার করে দিয়ে আসচি!

 ঈশান। বেঁচে থাক ছোট বাবু— বেঁচে থাক!

 বৈকুণ্ঠ। অবিনাশ, তিনি ছোট বৌমার আত্মীয়া হন্—তাঁকে—

 তিনকড়ি। কেউ না, কেউ না, ও বুড়ি কেদারদার পিসি। ওকে বিবাহ করে কেদারের পিসে আর বাঁচতে পারলে না— বিধবা হয়ে ভাইয়ের বাড়ি আস্‌তে ভাইও মরে’ বাঁচ্‌ল, এখন কেদারদা নিজের প্রাণ রক্ষে করতে ওকে তোমাদের এখানে চালান করেছে!

 অবিনাশ। দাদা, তোমার এ বইগুলো মাটিতে নাবাচ্চ কেন? তোমার ডেক্‌সো গেল কোথায়?

 ঈশান। এ ঘরে যে বাবুটি থাকেন বই থাক্‌লে তাঁর থাক্‌বার অসুবিধে হয়, বড় বাবুকে তিনি লুটিস্ দিয়েছেন—

 অবিনাশ। কি! দাদাকে ঘর ছেড়ে যেতে হবে!

বিপিনের প্রবেশ।

 বিপিন। “ভাব্‌তে পারিনে পরের ভাবনা”—

 অবিনাশ। (তাড়া করিয়া গিয়া) বেরও, বেরও, বেরও বল্‌চি, বেরও এখান থেকে— বেরও এখনি—

 বৈকুণ্ঠ। আহা, থাম অবু থাম, থাম, কি কর—বেণী বাবুকে—

 বিপিন। বিপিন বাবুকে—

 বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিপিন বাবুকে অপমান কোর না—

 তিনকড়ি। কেদারদাকে ডেকে আন্‌তে হচ্চে— এ তামাসা দেখা উচিত।  (প্রস্থান)

(ঈশান বিপিনকে বলপূর্ব্বক বাহির করিল)

 বিপিন। ঈশেন একটা মুটে ডাক— আমার হুঁকো আর ক্যাম্বিশের ব্যাগটা—  (প্রস্থান)

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, হারামজাদা কোথাকার—ভদ্রলোককে তুই— তোকে আর—

 ঈশান। আজ আমাকে গাল দাও, ধরে মার, আমি কিছু বল্‌ব না—প্রাণ বড় খুসি হয়েছে।

কেদারকে লইয়া তিনকড়ির প্রবেশ।

 কেদার। ওর নাম কি, অবিনাশ ডাক্‌চ?

 অবিনাশ। হাঁ—তোমার চুলো প্রস্তুত হয়েছে, এখন ঘর থেকে নাব্‌তে হবে!

 কেদার। তোমার ঠাট্টাটা অবিনাশ অন্য লোকের ঠাট্টার চেয়ে— ওর নাম কি— কিছু কড়া হয়!

 বৈকুণ্ঠ। আহা, অবিনাশ, তুমি থাম!—কেদার বাবু, অবিনাশের উদ্ধত বয়েস— আপনার আত্মীয়দের সঙ্গে ওঁর ঠিক্—

 অবিনাশ। বন্‌ছিল না! তাই তিনি তাঁদের হাত ধরে সদর দরজার বার করে দিয়ে এসেছেন—

 তিনকড়ি। এতক্ষণে আবার তাঁরা খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেচেন—সাবধান থাক্‌বেন—

 অবিনাশ। এখন তোমাকেও তাঁদের পথে—

 তিনকড়ি। ওকে দোস্‌রা পথ দেখাবেন, সব কটিকে একত্রে মিল্‌তে দেবেন না—

 কেদার। অবু— ওর নাম কি— তা হলে আমার সম্বন্ধে করতলের পরিবর্ত্তে পদতলেই স্থির হল—

 অবিনাশ। হাঁ—যার যেখানে স্থান—

 কেদার। ঈশেন, তা হলে একটা ভাল দেখে সেকেণ্ডক্লাস্ গাড়ি ডেকে দাওত!

 তিনকড়ি। ভেবেছিলুম এবার বুঝি একলা বেরতে হবে— শেষ, দাদাও জুট্‌ল। বরাবর দেখে আস্‌চি কেদারদা, শেষকালটা তুমি ধরা পড়ই, আমি সর্ব্বাগ্রেই সেটা সেরে রাখি—আমার আর ভাবনা থাকে না!

 কেদার। তিনকড়ে! ফের!—

 বৈকুণ্ঠ। কেদার বাবু, এখনি যাচ্ছেন কেন? আসুন্, কিঞ্চিৎ জলযোগ করে নিন্—

 তিন। তা বেশ ত, আমাদের তাড়া নেই!

 বৈকুণ্ঠ। ঈশেন!