পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/২২৬: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(কোনও পার্থক্য নেই)

১৫:১৩, ১৭ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মাতৃদেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ স্থির হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই, পিতা বিবাহ করিতেছেন শুনিয়া ঠাকুরদাদা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েন এবং এই সময় হইতে আবার তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া অন্তরের সহিত তাঁহাকে পুনর্গ্রহণ করেন। তিনি কলিকাতায় আসিয়া মূল্যবান অলঙ্কার দ্বারা বধূর মুখদর্শন করেন এবং তখন হইতে মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আমাদের বাটীতে আসিয়া বাস করিতেন ও আমাদের লইয়া আহারাদি করিতেন। সেকালের হিসাবে তাঁহারও প্রকৃতি উদার ছিল। ব্রাহ্মণত্বের চিহ্ন পর্যন্ত পরিত্যাগ করায় তাঁহার মনে আঘাত লাগিয়াছিল কিন্তু অনেকগুলি ছোট ছোট কুসংস্কার তিনি নিজেই মানিতেন না।

 “বিবাহকালে পিতৃদেব মাতামহ পরিবারের ২টী রীতি গ্রহণ করেন নাইঃ— ১। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ, ২। ঘরজামাই থাকা। এই সময় তিনি ডেপুটী কলেক্টর ছিলেন। মাতৃদেবীর যখন বিবাহ হয়, তখন তাঁহার বয়স ১২ বৎসর মাত্র। মাতামহ কন্যার যে শিক্ষা পত্তন করেন স্বামীর যত্নে তাহা পরিস্ফুট হইয়া উঠে। পিতা তাঁহার কন্যাদ্বয়কে পুত্রনির্বিশেষে শিক্ষা দিয়া আসিয়াছেন, ইহা সকলেই জানেন। মাতৃদেবী ও আমরা যে কোন সৎকার্যের বা দেশহিতকর কার্যের প্রয়াস পাইয়াছি তাহার তিনি প্রধান সহায় ও উদ্যোগী ছিলেন। পূজনীয় মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজসংস্কার-প্রযত্নে তিনিই সর্বপ্রধান সহায় ছিলেন। তাঁহার বন্ধু-বাৎসল্য যে কি গভীর ছিল, তাহা প্রত্যক্ষ ফললাভ দ্বারা তাঁহার অনেক বন্ধুই বিশেষ ভাবে অবগত আছেন।...

 “বিবাহের পরেই পিতার বিলাত যাইবার প্রস্তাব হওয়ায় তিনি ডেপউটী কলেক্টরের পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু নানা অভাবিত কারণে সেই সময় বিলাত যাওয়ার বাধা পড়ায় তিনি স্বাধীন জীবিকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন। সেই সূত্রে বেরিণী কোম্পানীর হোমিওপ্যাথিক দোকান তিনি ক্রয় করেন। তাহা খুব লাভজনক ছিল। বিক্রয় করিবার অল্পদিন পরে—তাহার পূর্ব মালিক তাহা পুনর্লাভে ইচ্ছুক হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় পিতৃদেবের একজন বিশেষ বন্ধু ছিলেন। বিদ্যাসাগরের অনুরোধে পিতা গভীর স্বার্থত্যাগ করিয়া দোকান ফিরাইয়া দিলেন।...

 “রোগীর সেবা তাঁহার একটি প্রধান ব্রত ছিল। পরিবারের সকলেই এবিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারিবেন।...গরীব দুঃখীর সেবার জন্য তিনি ঘরে বসিয়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা করিয়া বিনা পয়সায় ডাক্তারী করিতেন। কাশিয়াবাগান বাগানবাড়িতে আমরা যখন ছিলাম—তখন দেখিয়াছি, রোজ সকালে পাড়ার আর্তলোকে বাড়ি ভরিয়া যাইত। ভোর হইতে রোগী দেখিয়া ঔষধ বিতরণ করিতে করিতে বেলা দশটা এগারটা বাজিয়া যাইত। তাহার পর তিনি স্নান আহার করিতেন।

 “আইনে তাঁহার বিশেষরূপ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে বিলাত যাইয়া ব্যারিষ্টার হইবার পরামর্শ দেন এবং তিনি আমাদের মাতুলালয়ে রাখিয়া বিলাত যাত্রা করেন। সেখানে অধিকাংশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েন কিন্তু শেষ পরীক্ষার পূর্বেই ছয় বৎসর বয়স্কা কনিষ্ঠা কন্যার মত্যু-সংবাদে তাঁহাকে দেশে ফিরতে হয়। ইচ্ছা ছিল আবার যাইয়া পরীক্ষা দিবেন এবং তজ্জন্য বরাবর ফি দিয়া নাম বজায় রাখিয়াছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে আর যাওয়া হয় নাই!...

 “কলিকাতায় প্রায় সব সাধারণ হিতকর কার্যেই তাঁহার যোগ ছিল। অনেক বৎসর তিনি মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ছিলেন। মেকেঞ্জি বিলের প্রতিবাদে যে ২৪ জন কমিশনার পদত্যাগ করেন, তন্মধ্যে তিনি একজন। শিয়ালদহ ও লালবাজার দুই কোর্টেই তিনি অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বৎসরাবধি তাঁহার শরীর অসুস্থ ছিল, মধ্যে মধ্যে এক একবার শয্যাগত থাকিতেন, কিন্তু একটু সুস্থবোধ করিলেই কোর্টে ও অন্যান্য কার্যে যাইতেন, আমাদের নিষেধ মানিতেন না। এরূপ কর্তব্যনিষ্ঠা বিরল।

২০৯