পাতা:ললিতা তথা মানস - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১০: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
পাইউইকিবট স্পর্শ সম্পাদনা |
Jayantanth (আলোচনা | অবদান) ট্যাগ: প্রতিস্থাপিত |
||
শীর্ষক (অন্তর্ভুক্ত হবে না): | শীর্ষক (অন্তর্ভুক্ত হবে না): | ||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
` |
|||
পাতার প্রধান অংশ (পরিলিখিত হবে): | পাতার প্রধান অংশ (পরিলিখিত হবে): | ||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
<poem>ললিতা। |
|||
ললিতা |
|||
978** *** |
|||
ভৌতিক গল্প |
|||
Svent such a wildernization |
|||
"bure transport niide security ertains, |
|||
“O Love! In such a wilderness as this. |
|||
This is the upc oi ti pelez bisero |
|||
Where transport with security entwine. |
|||
And !!ere at tiscu a cour indre livies |
|||
Here is the Empire of thy perfect bliss. |
|||
Gertrude | 11:43 |
|||
And there art thou a God indeed divine.” |
|||
But wertil pleasure, whaf art the pot proviis. |
|||
Gertrude of Wyoming. |
|||
The 1sient, siucorbness eie is dinge bebida |
|||
“But mortal pleasure, what art thou in truth! |
|||
</poem> |
|||
The torrents’ smoothness ere it dash below.” |
|||
Ibid. |
|||
২ |
|||
নদীতীরে বৃক্ষ নাহি ছিল এক স্থানে। |
|||
দীর্ঘ তৃণে চন্দ্রকর জ্বলিছে সেখানে || |
|||
ছোট গাছে তারামত ফুল্ল পুষ্পদলে। |
|||
স্থির তার প্রতিরূপ স্থির নদীজলে || |
|||
সুখস্বপ্নে যেন তারা, নিদ্রাভরে হাসে। |
|||
গগন গুমুরে মরে, সুখময় বাসে || |
|||
সেই স্থানে বসি এক নারী একাকিনী। |
|||
ফুলহীন বনে যেন স্থলকমলিনী || |
|||
মিশেছে সে চন্দ্রিকায়; ভাবে তার চিত্ত |
|||
শুধু সে স্বপ্নের ছায়া, অসত্য অনিতা || |
|||
যৌবন আশার সম ফুল্ল রূপ তার। |
|||
দেখিয়া ফিরালে আঁখি, দেখি ফিরে বার || |
|||
স্থিরা ধীরা সুকোমলা বিমলা অবলা। |
|||
সবে নব পুরিতেছে যৌবনের কলা || |
|||
মোহন সঙ্গীতে মন বেঁধেছে যতনে। |
|||
প্রেম যেন শুনিতেছে আশার বচনে || |
|||
বদনে ললিত রেখা কত হয়ে যায়। |
|||
রক্তিম নীরদ যেন শারদ সন্ধ্যায় || |
|||
গলিল নয়নপদ্ম; মুগ্ধ তার মন, |
|||
প্রাণ মন জ্ঞান ধন জীবন যৌবন, |
|||
সকলি করেছে যেন গীতে সমর্পণ || |
|||
কোথা হতে আসে সেই সুমধুর গান? |
|||
কেন তাতে এত আশা? কে হরিল প্রাণ? |
|||
৩ |
|||
ললিতা তাহার নাম-রাজার নন্দিনী। |
|||
জননী না ছিল তার, বিমাতা বাঘিনী। |
|||
রাজা বড় নিষ্ঠুর সতত দেয় জ্বালা; |
|||
গোপনে কতই কাঁদে মাতৃহীনা বালা। |
|||
দুর্জ্জনের সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ- |
|||
শুনে কেঁদে কেঁদে তার চক্ষু যেন অন্ধ। |
|||
মন্মথ নামেতে যুবা, সুঠাম, সুন্দর, |
|||
বচনে অমিয় ক্ষরে নারীমনোহর। |
|||
মোহিল ললিতাচিত তার দরশনে। |
|||
গোপনে বিবাহ হৈল মিলিল দুজনে। |
|||
জানিল বিবাহবার্ত্তা দুরন্ত রাজন্। |
|||
কন্যারে ডাকিয়া বলে পরুষ বচন || |
|||
এ পুরী আঁধার কেন কর কলঙ্কিনী। |
|||
শীঘ্র যাও দেশান্তরে না হতে যামিনী || |
|||
কাল যদি দেখি তোরে, বধিব পরাণ। |
|||
ভয়ে বালা সেই দণ্ডে করিলা প্রস্থান || |
|||
মন্মথ লইয়া তারে তুলিল নৌকায়। |
|||
ভয়ে ভীত দুই জনে নদী বেয়ে যায় || |
|||
পথিমধ্যে দস্যুদল আসিয়া রোধিল। |
|||
ললিতারে কাড়ি লয়ে বনে প্রবেশিল || |
|||
অলঙ্কার কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল তারে। |
|||
ললিতা একাকী ফিরে নদী ধারে ধারে || |
|||
কোথায় মন্মথ গেল, তরি কোন্ ভিতে। |
|||
রজনী গভীরা তবু ভয় নাই চিতে। |
|||
এমন সময়ে শোনে সঙ্গীতের ধ্বনি। |
|||
মন্মথ গাইছে গীত বুঝিল অমনি || |
|||
বুঝিল সঙ্কেত করে সেই প্রিয়জন, |
|||
নদীতীরে চন্দ্রালোকে বসিল তখন। |
|||
তীরেতে লাগিল তরি অতিদ্রুত হয়ে। |
|||
দেখিতে দেখিতে দুয়ে দুয়ের হৃদয়ে || |
|||
কতই আদর করে, পেয়ে সোহাগিনী। |
|||
কতই রোদন করে কাতরা কামিনী || |
|||
৪ |
|||
তখন ললিতা কয়, “আর জ্বালা নাহি সয়, |
|||
পড়িয়া দস্যুর হাতে, যে দুঃখ হে পেয়েছি। |
|||
কাড়ি নিল অলঙ্কার, লাঞ্ছনা কত আমার, |
|||
তীরে তীরে কেঁদে কেঁদে এতদূর এয়েছি || |
|||
দেখা হবে তব সাথ, হেন নাহি জানি নাথ, |
|||
দয়া করি কালী আজি রেখেছেন চরণে।” |
|||
পতি বলে “শুন প্রিয়ে, তোমা ধনে হারাইয়ে, |
|||
মরিব বলিয়ে আজি, প্রবেশিনু কাননে || |
|||
দেখিলাম দুই ধার, মহারণ্যে অন্ধকার, |
|||
নীরবে নির্ম্মলা নদী, তার মাঝে বহিছে। |
|||
ভীষণ বিজন স্তব্ধ, নাহি জীব নাহি শব্দ, |
|||
তরুদলে ঢুলে জলে, ঘুমাইয়া রহিছে || |
|||
যে স্থির অরণ্য নদী, যেন বা সৃজনাবধি, |
|||
কোন জীব কোন কীট, তথা নাহি নড়েছে। |
|||
প্রথমে যে ছিল যথা, এখনও রয়েছে তথা, |
|||
মৃত্যুর ভীষণ ছায়া, সর্ব্বস্থানে পড়েছে || |
|||
ভয়েতে গগন পানে, চাহিলে ভুলিনু প্রাণে, |
|||
বিমল সুনীলকাশে, শশী হেসে যেতেছে। |
|||
ভাবিলাম প্রকৃতির, সকলি গভীর স্থির, |
|||
শুধু এ হৃদয় কেন, এত দুঃখ পেতেছে! |
|||
মরি যদি পারিতাম, গোলে জল হইতাম, |
|||
এ স্থির সলিলে মিশে, হৃদয় ঘুমাইত। |
|||
তথা রিপু চিন্তাহীন, রহিতাম চিরদিন, |
|||
ললিতার দুঃখ তবে, কিসে হৃদে আইত || |
|||
৫ |
|||
“ভাবি এ প্রকার, ছাড়িতে হুঙ্কার, |
|||
কাঁপিল কানন স্তব্ধ। |
|||
শিহরি অন্তরে, কি জানি কি ডরে, |
|||
কাঁপে হৃদি শুনি শব্দ || |
|||
হুতাশ নাশিতে, সঙ্কেত বাঁশীতে, |
|||
গায়িলাম দুখ যত। |
|||
বাজাইয়া তায়, মরি লো তোমায়, |
|||
সঙ্কেত করেছি কত! |
|||
একবার যাই, মুরলী বাজাই, |
|||
আপনি নয়ন ঝোরে। |
|||
গলে হৃদি দুখে, এক মাত্র সুখে; |
|||
বাঁশী কি মোহিল মোরে! |
|||
গাই পরক্ষণে, দেখি নিশাবনে, |
|||
একাকিনী রূপবতী। |
|||
হয়ে চমকিত, তীরে এই ভীত, |
|||
লইলাম শীঘ্রগতি || |
|||
কে জানে কেমনে, আশা এলো মনে, |
|||
আমারি ললিতা হবে। |
|||
কত ভাগ্য ধনি, পাই হারা মণি, |
|||
আর ছাড়া নাহি হবে?” |
|||
৬ |
|||
ললিতা |
|||
“নারে প্রাণ নারে, আর হে তোমারে, |
|||
আঁখি ছাড়া করিব না। |
|||
রহিব দুজনে, গোপন কাননে, |
|||
দেখিবে না কোন জনা || |
|||
কাজ নাই দেশে, তথা শুধু দ্বেষে, |
|||
হেন প্রেম নাশ করে। |
|||
গঞ্জন যন্ত্রণা, কলঙ্ক রটনা, |
|||
মিলন না হয় ডরে || |
|||
যেখানে প্রণয়, হৃদয়ে না রয়, |
|||
যেখানে তোমা না পাই। |
|||
সে দেশ কি দেশ, সে গৃহে বিদ্বেষ, |
|||
কখন যেন না যাই || |
|||
এখানে মন্মথ, প্রণয়ের পথ, |
|||
কলঙ্কের কাঁটা হীন। |
|||
হেরি তব মুখে, নিরমল সুখে, |
|||
স্বর্গসুখে হব লীন || |
|||
জ্বালা পৃথিবীর, সব হবে স্থির, |
|||
শুধু সুখময় মন। |
|||
লইয়ে মন্মথ, যাহা মনোমত, |
|||
করিব সকল ক্ষণ ||” |
|||
মন্মথ |
|||
“হে বিধি হে বিধি, কর কর বিধি, |
|||
এই কপালে আমার। |
|||
বল তার চেয়ে, স্বর্গপদ পেয়ে, |
|||
কি সুখে আছে হে আর || |
|||
বিচ্ছেদ যাতনা, দিব না দিব না, |
|||
এ জনমে প্রেয়সীরে। |
|||
কাল পূর্ণ হলে, সুখে তব কোলে, |
|||
মরে যাব ধীরে ধীরে ||” |
|||
দ্বিতীয় সর্গ |
|||
১ |
|||
মরি প্রেম যার মনে, সে কি চায় রাজ্যধনে, |
|||
প্রিয়মুখ ত্রিসংসার তায়। |
|||
হৃদে তার যে রতন, আলো করে ত্রিভুবন, |
|||
অন্য মণি নিবায় বিভায় || |
|||
এক মোহে সদা মত্ত, না জানে আপনি মর্ত্ত্য, |
|||
যাহা দেখে তাই প্রেমাকুল। |
|||
রবি শশী তারাকাশ, পয়োদ পবনশ্বাস, |
|||
সাগর শিখর বনফুল || |
|||
যেন লক্ষ বিদ্যাধরে, সদা কর্ণে গান করে, |
|||
কি মধুর শব্দহীন ভাষা। |
|||
হেরিয়ে সামান্য কলি, নয়ন সলিলে গলি, |
|||
উছলে অনন্ত ভালবাসা || |
|||
প্রেমে যার মন বাঁধা, না পারে দিবারে বাধা, |
|||
সমুদ্র শিখর নদী বনে। |
|||
কলঙ্ক বিপদ ক্লেশ, ঝটিকার ধরি বেশ, |
|||
শিরোপরি গরজয়ে যত। |
|||
আশ্রয় করিয়া আশা, প্রণয়ীতে ভালবাসা, |
|||
প্রণয়ীর প্রাণে বাড়ে তত || |
|||
জ্বালা সয় নিরবধি, সেও ভাল পায় যদি, |
|||
একবার আঁখির মিলন। |
|||
দুঃখের গভীর বনে, সেই স্বপ্নে সুখ মনে, |
|||
প্রেম রীতি কে জানে কেমন || |
|||
২ |
|||
চলিল চরণ চন্দ্রবদনী। |
|||
ঢলিয়ে ঢলিয়ে মন্দচরণী। |
|||
ঊষার প্রখর তারকা ধনী। |
|||
চলিল গজেশগামিনী || |
|||
উভয়ে মরেছে হৃদি যাতনে। |
|||
উভয়ে পেয়েছে প্রাণরতনে। |
|||
কাঁধে কাঁধে ধরি চলে কাননে। |
|||
গভীর নীরব যামিনী || |
|||
শিরোপরে শাখা বিনান ঘন। |
|||
আসিবে কেমনে শশিকিরণ। |
|||
তরল তিমির ভীষণ বন। |
|||
দেখিয়া শিহরে কামিনী। |
|||
আঁধার আকাশে নক্ষত্রাবলি। |
|||
তেমনি কাননে কুসুম কলি। |
|||
আমোদে হৃদয়ে যেতেছে গলি। |
|||
সে নব নীরদ দামিনী || |
|||
ষণ তিমিরে ভীষণ স্থির। |
|||
মাঝে মাঝে খসে পত্র শাখীর। |
|||
ধীরে ধীরে ঝরে নির্ঝর নীর। |
|||
আঁধারে নিরখে রঙ্গিণী || |
|||
লাগিয়া নির্ঝরে ঈষৎ আলো। |
|||
দেখে ফুলময় সে জল কালো। |
|||
আঁধারে কুসুম পরশে গাল। |
|||
শিহরে সরোজ অঙ্গিনী || |
|||
যেতে পতি সনে চন্দ্রবদনী |
|||
মরি কি সঙ্গীত শুনিল ধনী। |
|||
ললিত মোহন গভীর ধ্বনি। |
|||
নির্ঝর নিনাদ সঙ্গিনী || |
|||
নীরব কানন উঠে শিহরি। |
|||
শিহরে দুজনে দুজনে ধরি। |
|||
হৃদয়ে হৃদয়ে গাঁথিল মরি। |
|||
বাঁধিল মনঃকুরঙ্গিনী || |
|||
৩ |
|||
স্তব্ধ বনে অন্ধকারে, ভেসে ভেসে চারি ধারে |
|||
মোহে তায় দুই জনে, আপনাকে ভুলিল। |
|||
দুজনার মুখ চেয়ে, দুজনারে বুকে পেয়ে, |
|||
প্রেম আর সেই গানে, এক হয়ে মিলিল | |
|||
জ্ঞান পেয়ে কহে কেন, এ গহনে ধ্বনি হেন, |
|||
এ ধ্বনি দেবের যেন, চল দেখি যাইয়ে। |
|||
আ মরি! কহিছে ধনী, শুনি নাই হেন ধ্বনি, |
|||
হরিল কানন ভয়, হৃদয় নাচাইয়ে || |
|||
বনমাঝে যায় যত, ধ্বনি সুনিকট তত, |
|||
দেখে শেষে তরু কত, কুঞ্জ এক ঘেরেছে। |
|||
স্থির শোভা কিবা তার, বুঝি প্রেম আপনার, |
|||
সাধের প্রমোদাগার, তার মাঝে করেছে || |
|||
৪ |
|||
এ কুঞ্জ হইতে যেন আসিছে সঙ্গীত। |
|||
হেন ভাবি দুই জনে আইল ত্বরিত || |
|||
নিকুঞ্জ প্রবেশ মাত্র থামিল সে ধ্বনি। |
|||
কানন পূর্ব্বের মত নীরব অমনি || |
|||
আশ্চর্য্য হইয়া দোঁহে রহিলেক স্থির। |
|||
দেখিতেছে শোভা কুঞ্জ গগন শরীর || |
|||
কেহ নাই বন কিম্বা গগন ভিতর। |
|||
তথাপি কেমনে এলো এ মধুর স্বর || |
|||
ললিতার জ্ঞান হলো প্রবেশ সময়। |
|||
যেন কোন স্বপ্ন-দৃষ্ট মত শোভাময় |
|||
দুই মনোরম রূপ নারী নরাকারে, |
|||
দেখিল চকিত মত নিকুঞ্জের ধারে || |
|||
মন্মথ মোহিনী প্রতি কহিছে হে প্রিয়ে। |
|||
দেখি কালিকার দিন এখানে রহিয়ে || |
|||
আজিকার মত যদি কালিকায় হবে। |
|||
দেব কি মানব যক্ষ জানা যাবে তবে || |
|||
আজিকার মত এসো রই এই স্থানে। |
|||
এমন মোহন স্থান পাবে কোন্খানে || |
|||
৫ |
|||
মোহিনী মন্মথ সনে মনোমত স্থলে। |
|||
এমন যামিনী যাপে এমন বিরলে || |
|||
এমন বিপদহীন বিজন কানন। |
|||
এমন বিরল প্রেম গম্ভীর এমন || |
|||
কে জানে সে সত্য কি না স্বপন নিশার। |
|||
বলে এলে কে জানিত হেন তবে তার || |
|||
রবে না এমন সুখ মানব কপালে। |
|||
ভাবিয়ে বিচল চিত্ত এ সুখের কালে || |
|||
এই ভয় মনোমাঝে হয় আর যায়। |
|||
যেন কোন মেঘ-ছায়া পড়িছে ধরায় || |
|||
এই মত গেল নিশি নিকুঞ্জ মন্দিরে। |
|||
সে দিন কাটালে সুখে নিশি এলো ফিরে || |
|||
৬ |
|||
কাননে যামিনী পরকাশে, নিরমল নীলে শশী ভাসে। |
|||
নিশীথে নিদ্রিত বন, নিদ্রা যায় মেঘগণ, |
|||
নিদ্রা যায় বাতাস আকাশে || |
|||
উঠিল নীরবে আচম্বিত, প্রেমময় ললিত সঙ্গীত। |
|||
স্থির শূন্যে ভেসে যায়, গগন গহন তায়, |
|||
শিহরিছে পুলক পূরিত || |
|||
যেন কেহ বিরহের জ্বরে, প্রেমময়ী পরশে শিহরে। |
|||
নাথহৃদে ছিল ধনী, গলিল শুনিয়ে ধ্বনি, |
|||
মোহে মিশে প্রাণে প্রাণেশ্বরে || |
|||
গভীর নিশ্বাসে থামে গান, অবকাশে তারা পায় জ্ঞান। |
|||
জানিল সে কালিকার, সেই ধ্বনি পুনর্ব্বার, |
|||
হেথা হতে গেছে অন্য স্থান || |
|||
প্রেয়সীরে কহিছে মন্মথ, ধ্বনি যে জুড়ায় শ্রুতিপথ। |
|||
এখানে গেয়েছে কাল, কামিনি লো কি কপাল! |
|||
আজ ধ্বনি অন্য স্থান গত || |
|||
আজি গীত গাইছে যথায়, চল মোরা যাইব তথায়। |
|||
কে গায় কিসের তরে, কেন গায় স্থানান্তরে, |
|||
করি চল যাহে জানা যায় || |
|||
নাথ সনে লক্ষ্য করি ধ্বনি, চলে বনে শশাঙ্কবদনী। |
|||
ঘন গাঁথা তরুদলে, ঘন তম তার তলে, |
|||
ভয়ঙ্কর নীরব কেমনি || |
|||
পূর্ব্বমত নিকুঞ্জ মণ্ডলে, আসিল সে প্রেমিক যুগলে |
|||
পূর্ব্বমত স্বপ্নসম, দুই রূপ নিরুপম, |
|||
যথা হইতে দ্রুত গেল চলে || |
|||
৭ |
|||
কাঁপিয়ে বিষম ভয়ে বলে হাঁ রে বিধি। |
|||
এমন সুখেতে কেন হেন কর বিধি || |
|||
পৃথিবীতে কোন স্থান সুখের কি নয়? |
|||
কানন বাসেও কি গো বিপদ নিশ্চয় || |
|||
দেবতা কুপিত বলি দুজনাতে ভীত। |
|||
কি হবে তৃতীয় রাত্রে দেখিতে চিন্তিত || |
|||
তৃতীয় নিশীথে গীত আর এক স্থানে। |
|||
পূর্ব্বমত তথা গিয়া ভয়ে মরে প্রাণে || |
|||
সেই মত পেলে ভয় চতুর্থ রজনী। |
|||
পঞ্চম রজনীযোগে কোথায় সে ধ্বনি? |
|||
৮ |
|||
তমিস্রা পঞ্চম নিশা, গগন মণ্ডলে। |
|||
ভীষণ আঁধার বসি, ঘন বনতলে || |
|||
নীরব নিস্পন্দ তম, সঙ্গীতের আশে। |
|||
সময় হইল তবু, সে ধ্বনি না আসে || |
|||
বিকট আননে ভয়, ঘুমায় কাননে। |
|||
দেখে স্তব্ধ স্পন্দহীন, যত তরুগণে- |
|||
পাপান্ধ-তিমিরময়, যেন কার মন, |
|||
নীরবে করাল কার্য্য, করিছে কল্পন || |
|||
শুষ্ক শুষ্ক পাতা খসি, মাঝে মাঝে পড়ে। |
|||
যথা পড়ে তথা পচে, নাহি আর নড়ে || |
|||
পাইয়া অলক্ষ্য লক্ষ্য, কুসুমের বাস। |
|||
আমোদে আঁধার দেহ, না ছাড়ে নিশ্বাস || |
|||
পত্র-চন্দ্রাতপ তলে, ক্ষুদ্র খাল চলে। |
|||
নাহি দেখা যায় ভাল, নাহি শব্দ জলে || |
|||
ঘুমায়ে পড়িলে জলে, পুষ্পবৃক্ষাবলী। |
|||
আঁধারে কলিকাগুচ্ছ, নিরখি কেবলি || |
|||
নীরবে ঝরিয়া ফুল, স্তব্ধে ভেসে যায়। |
|||
পতিহীনা বিরহীর, প্রেম আশা প্রায় || |
|||
শুষ্ক ফল খসি জলে, পড়ে একবার। |
|||
অমনি চমকে বুক, মন্মথ বামার || |
|||
অন্ধকার মাঝে আলো দুয়ের বদন। |
|||
বরষার শশী যেন, মেঘে আচ্ছাদন || |
|||
ভীম স্তব্ধে ভয়ে ভীত, বসি তারা তথা। |
|||
উড়ু উড়ু করে প্রাণ, নাহি সরে কথা || |
|||
ভাবে আজি কেন, এত কাঁদিছে অন্তর। |
|||
বলিতে বলিতে নারে, হৃদি গরগর || |
|||
সুখের কাননে আজি, কেন কাল ভাব। |
|||
ভীষণ স্বপন যেন, দেখিছে স্বভাব || |
|||
আপনি নয়ন কেন, ঝরে অকারণ। |
|||
বুঝি আজি ছেড়ে যাবে, জীবন রতন || |
|||
হৃদে ধরি পরস্পরে, মুখপানে চায়। |
|||
কেঁদে যেন কি বলিবে, বলিতে না পায় || |
|||
ললিতা লুকাল মাথা, প্রাণনাথ কোলে। |
|||
কাঁদিয়ে মুছায় পতি, প্রিয়া আঁখিজলে || |
|||
৯ |
|||
এখনো এলো না কেন সঙ্গীতের ধ্বনি। |
|||
ভীষণ নীরব! হা রে! আছে কি ধরণী? |
|||
অকস্মাৎ কোথা হয় গভীর গর্জ্জন। |
|||
কাঁপিল গভীর বন কাঁপিল দুজন || |
|||
অদ্ভুত নিনাদ উড়ে যায় বন দিয়ে। |
|||
অন্ধকার ভীমতল হইল আসিয়ে || |
|||
ভীমতর নাদে যেন কাঁপে নভ হৃদি। |
|||
কাঁদিয়া উঠিল দোঁহে, “হা বিধি! হা বিধি!” |
|||
১০ |
|||
গভীর জলদ নাদ, গড়ায় আকাশ ছাদ, |
|||
থেকে থেকে উচ্চতর স্বনে। |
|||
পবন করিছে জোর, যেন সাগরের সোর, |
|||
হুঙ্কারে গরজে প্রাণপণে || |
|||
বারেক চঞ্চলাভায়, দেখি নীল মেঘ গায়, |
|||
কটা মাথা নাড়ে ক্ষিপ্তবন। |
|||
পাতা উড়ে ঢাকে ঘনে, পড়িতেছে ঘোর স্বনে, |
|||
বড় বড় মহীরুহগণ || |
|||
ঘোরতর চীৎকার, লক্ষ লক্ষ অনিবার, |
|||
মানুষ চিবায় ভূতগণে। |
|||
সমুদ্র সমান সোরে, বরিষা আছাড়ে জোরে |
|||
রেগে রেগে গর্জ্জে বায়ু সনে || |
|||
উপরি উপরি ধ্বনি, আছাড়ে সহস্রাশনি, |
|||
খণ্ডে খণ্ডে ছেঁড়ে বা গগন। |
|||
বিদারিয়ে বিটপীরে, বজ্রাগ্নি পোড়ায় শিরে, |
|||
কাঁদে যত সিংহ ব্যাঘ্রগণ || |
|||
১১ |
|||
ভীষণ নীরব। যেন মরেছে ধরণী। |
|||
হে ধাতঃ কাঁপালো স্তব্ধ আবার কি ধ্বনি || |
|||
বলিছে গম্ভীর স্বরে, “রে নরযুগল। |
|||
দেবের নিকুঞ্জে এসে পাও কর্ম্মফল ||” |
|||
ফিরে বার ঘর ঘর, গরজিল জলধর, |
|||
মাতিল মরুৎ ফিরে বার। |
|||
চেচায় অশনি ঘন, ভীমবলে তরুগণ, |
|||
মত্ত শির নাড়িছে আবার || |
|||
১২ |
|||
থামিল ঝটিকারণ, হলো নিশাশেষ। |
|||
শ্বেতমেঘময়াকাশে, উদিল নিশেশ || |
|||
জলে করে জলময়, কানন নিকুঞ্জ। |
|||
তরু লতা তৃণ ভূম, পুষ্পলতা পুঞ্জ || |
|||
ফুলময় ছোট খাল বিমল চঞ্চল। |
|||
ছায়াকারী শাখা হতে ঝরে বিন্দুজল || |
|||
উজ্জ্বল পুলিনতলে ম্লান তারা মত। |
|||
মরিয়ে রয়েছে ঝড়ে ললিতা মন্মথ || |
|||
মানবের কি কপাল! সংসার কি ছার! |
|||
বহিতে জীবন ভার কে চাহিবে আর |
|||
নাথভুজে মাথা দিয়ে পড়েছে মোহিনী। |
|||
মুখে মুখে কাঁদে যেন দুটি সরোজিনী || |
|||
ললিতার মুখশশী ভিজে বরিষায়। |
|||
সরোজ শিশির মাথা মাটিতে লোটায় || |
|||
শীতল ললাটে জলে জ্বলে শশধর। |
|||
জলে ভিজে পড়ে আছে অলকানিকর || |
|||
ফুটায় কবরী চারু, দীর্ঘ তৃণোপরে। |
|||
মন্মথ রয়েছে তবু নাহি তুলে ধরে || |
|||
এখনো সুস্থির মুখ রূপের ছায়ায়। |
|||
প্রাণ গেল তবু রূপ নাহি ছাড়ে তায় || |
|||
সেরূপ ঘুমায় যেন, সন্ধ্যা ধরাপরে; |
|||
ভয়ে প্রকৃতির যেন নিশ্বাস না সরে || |
|||
স্থির শ্বেত ভাল সেই, নহে নিরমল। |
|||
দেখিলে শিহর হয় শরীর বিকল || |
|||
পড়ি তায় মরণের ভয়ঙ্কর ছায়া। |
|||
চন্দ্রিকায় যেন কালো, কাদম্বিনী কায়া || |
|||
যেন চন্দ্রকরে স্থির বারিধি বিস্তার। |
|||
পড়ে তায় শিখরীর ছায়া অন্ধকার || |
|||
কোমল পল্লব নীল মুদেছে নয়ন। |
|||
এরি কি কটাক্ষে ছিল সুখের স্বপন? |
|||
এখনি কেঁদেছে কত কাঁদিবে না আর। |
|||
সফরী সমান নাহি নাচিবে আবার || |
|||
বুঝি তার প্রিয় তারা মন্মথ বদনে। |
|||
চাহিতে চাহিতে বুঝি মুদেছে মরণে || |
|||
মানবের কি কপাল! এই সে হৃদয়। |
|||
কোথা তার প্রেম মোহ কোথা আশা ভয়! |
|||
বিবাস বিমল পড়ি শশীর কিরণে। |
|||
ভিতরে নিস্পন্দ যেন জগৎ এক্ষণে || |
|||
এক বৃন্তে দুটি ফুল মুখে মুখ দিয়ে। |
|||
সে হৃদি কুসুমাসনে পড়েছে ছিঁড়িয়ে || |
|||
তেমনি একাঙ্গে এরা থেকে চিরকাল। |
|||
মরিল অধরাধরে কি সুখ কপাল || |
|||
যার লাগি ছিল বেঁচে পারিত বাঁচিতে। |
|||
তারি সনে মরে গেল তাহারি হৃদিতে || |
|||
সুখের কপাল! কত সংসার যাতনা। |
|||
বিকার বিয়োগ শোক সহিতে হলো না || |
|||
ছিঁড়িয়াছে ভীম ঝড়ে একই প্রহারে। |
|||
কাটে নি ক্রমশঃ কীট, প্রাণের সুসারে || |
|||
গভীর গোপনগামী সুখ-স্রোতোপরে। |
|||
পড়ে নাই ভেসে ভেসে ডুবিতে সাগরে || |
|||
যা হবার হইয়াছে এই মাত্র স্থির। |
|||
এই আছে অবশেষ, সে প্রেমশশীর || |
|||
ওইখানে দেহাম্বুজ মাটি হয়ে যাবে। |
|||
জানিবে কে? দেখিবে কে? কেঁদে কে ভিজাবে? |
|||
চন্দ্রিকার নীলাকাশ গায়, দুটি দেবদারু দেখা যায়। |
|||
ভীম বনে তলে তার, অতি স্তব্ধ অনিবার, |
|||
কাল যেন প্রহরী তাহায় || |
|||
সেই নদী সেই তরুবরে, দুখময় তর তর স্বরে, |
|||
বারেক না ক্ষান্ত আছে, নক্ষত্রমণ্ডলী আছে, |
|||
অদ্যাপি বিলাপ কেন করে || |
|||
গম্ভীর সে ধ্বনি নিরবধি, যেন বা সন্ধ্যায় শরন্নদী। |
|||
শুনিলে শিহরি স্মরি, মেধার মারুতোপরি, |
|||
জানিনে যেতেছি কি জলধি || |
|||
শ্যামলা গুল্মিনী চির নব, ব্যাপিয়াছে সেই স্থান সব। |
|||
তারাফুল তারা ধরে, অনন্ত আমোদ করে, |
|||
সুধাপানে শিহরিছে নভ || |
|||
এ কাননে গভীর এমন, কে করে রে বাঁশরী বাদন। |
|||
অনিবার নিশাভাগে, যেন কার অনুরাগে, |
|||
গায়ে সাধে মনের যাতন || |
|||
মোহমন্ত্রে তার স্থির বন, শোনে ধ্বনি-বিহীন স্পন্দন। |
|||
পত্রটি নাহিক সরে, যেতে যেতে শুনে স্বরে, |
|||
নাহি সরে নীরধরগণ || |
|||
চন্দ্রিকার শূন্য কুঞ্জোপর, মোহন স্বপ্নজ শোভাধর। |
|||
কারা যেন শুনে তায়, উড়ে নীল নভ গায়, |
|||
মর্ম্মরিত প্রচুর অম্বর || |
|||
তাহে কত সুধাবাস ঝরে, কুসুম বরিষে কুঞ্জোপরে। |
|||
ভাঙ্গে স্বপ্ন ঊষা আসি, অমনি নীরব বাঁশী, |
|||
গল্যে যায় সে রূপ নিকরে || |
|||
ধূলি হয়ে এই কুঞ্জবনে মন্মথ-মোহিনী নাথ সনে। |
|||
প্রতি নিশি এই মত, হয় যথা নিদ্রাগত, |
|||
ললিতা মন্মথ দুই জনে || |