সুকথা/যশস্করের বিচার: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Mahir256 (আলোচনা | অবদান)
"<pages index="সুকথা - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf" from=34 to=46 header=1/>" দিয়ে পাতা তৈরি
 
(কোনও পার্থক্য নেই)

০০:২৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

যশস্করের বিচার

 ৯৩৯ খৃঃ অব্দে ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক মনোনীত হইয়া যশস্কর কাশ্মীর-রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ইনি ৯ বৎসর ৬ মাস কাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। দোষে গুণে যশস্কর একজন অনন্যসাধারণ ভূপতি ছিলেন। বিচারকার্য্যে তাঁহার যশঃ কাশ্মীরে প্রবাদবাক্যের ন্যায় হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার বিচারের দুইটি দৃষ্টান্ত আমরা নিম্নে প্রদান করিতেছি।

একদা এক নিষ্ঠাবান্‌ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রাজসকাশে উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিলেন যে, তাঁহার অবস্থা এক সময় অতিশয় সমৃদ্ধ ছিল, ঋণজালে আবদ্ধ হইয়া তিনি শেষে এরূপ বিব্রত হইয়া পড়েন যে, তাঁহাকে স্বগৃহ এবং তৎসংলগ্ন ভূমি পর্য্যন্ত কোন ধনবান্‌ বণিকের নিকট বিক্রয় করিয়া ঋণ পরিশোধ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু সেই গৃহ-সীমায় অবস্থিত একটি কূপ ও তৎসংলগ্ন সোপানাবলী তিনি বিক্রয় করেন নাই, গ্রীষ্মাগমে যাহারা পর্ণ কিংবা ফুল সিক্ত রাখিতে ইচ্ছুক, তাহারা কূপ ও সোপান ভাড়া লইবে এবং তাহাতে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যয় অনায়াসে সংকুলান হইতে পারিবে, এই বিশ্বাসে ব্রাহ্মণ তাঁহার জায়াকে দেশে রাখিয়া বিদেশ-ভ্রমণে প্রবৃত্ত হন। ২৩ বৎসর পরে তিনি কাশ্মীরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া জানিতে পারিলেন, তাঁহার স্ত্রীর সুন্দর কান্তি মলিন হইয়া গিয়াছে; তিনি পরিচারিকার বৃত্তি অবলম্বন করিয়া অতি কষ্টে দিনপাত করিতেছেন।

তাঁহার এ দশা কেন হইল, সেই কূপ ও সোপানের আয়ে তাঁহার জীবিকানির্ব্বাহ হইবার কথা, ইহা জিজ্ঞাসা করাতে ব্রাহ্মণরমণী বলিলেন, ব্রাহ্মণ বিদেশ-ভ্রমণে বহির্গত হওয়া মাত্র তাঁহাদের বাটীক্রেতা ধনশালী বণিক্‌ তাঁহাকে কূপ প্রভৃতির অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া বলপূর্ব্বক তাড়াইয়া দিয়াছিল।

এই সংবাদে ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইয়া সেই বণিকের নামে অভিযোগ আনয়ন করেন, কিন্তু প্রতি বারেই বিচারকগণ তাঁহার ন্যায়সঙ্গত দাবী স্বীকার না করিয়া সেই মিথ্যাবাদী বণিকের অনুকূলে মোকদ্দমা নিম্পত্তি করিয়াছেন।

স্বীয় ইতিহাস এই ভাবে বর্ণনা করিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন, “মহারাজ! আমি এই সকল বিচার বুঝি না, সেই কূপ ও সোপানাবলী আমি কখনই বিক্রয় করি নাই, আপনি সদ্‌বিচারপূর্ব্বক আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির উপায় না করিয়া দিলে এই রাজদ্বারে আমি প্রায়োপবেশনপূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিব।”

রাজা বিচারাসনে উপবিষ্ট হইয়া বিচারকমণ্ডলীকে আহ্বান করিয়া আনিলেন, এবং এই অভিযোগের সম্বন্ধে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহারা একবাক্যে রাজাকে জানাইলেন, বহুবার তাঁহারা এই ব্রাহ্মণের বিষয় তদন্ত করিয়া নিষ্পত্তি করিয়াছেন, বণিকের কথা সত্য, এই ব্রাহ্মণ নিতান্ত ধূর্ত্ত, ইহার শাস্তি হওয়া উচিত। রাজা স্বয়ং সেই গৃহের বিক্রয়পত্র পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, তাহাতে কূপ ও সোপানাবলী সমেত বাটীবিক্রয়ের কথা লিখিত আছে।

তথাপি রাজা সেই ব্রাহ্মণের অভিযোগ সত্য বলিয়া মনে মনে সন্দিহান হইলেন। তিনি মনের ভাব গোপন করিয়া উপস্থিত সকলের সহিত নানারূপ আমোদজনক কথাবার্ত্তায় নিযুক্ত রহিলেন, এবং ক্রীড়াচ্ছলে তাঁহাদের পরিহিত মণিরত্ন গ্রহণপূর্ব্বক পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন, সেই স্থানে ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক অভিযুক্ত বণিক্‌ও উপস্থিত ছিলেন। রাজা অপরাপরের সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করিতেছিলেন, সেই ভাবে বণিকের অঙ্গুলি হইতে তাঁহার একটি অঙ্গুরীয়কও গ্রহণ করিয়া তাহা দেখিতে লাগিলেন, সহসা হস্তপদ ধৌত করিবার ছলে রাজা সভাসদ্‌দিগকে তথায় অপেক্ষা করিতে আদেশ করিয়া গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইলেন।

গৃহে প্রবেশ করিয়া রাজা সেই অঙ্গুরীয়ক একজন দূতের হস্তে প্রদান করিয়া তাহাকে বণিকের বাটীতে পাঠাইয়া দিলেন, দূতকে শিখাইয়া দিলেন সে যেন সেই অঙ্গুরী বণিকের বাটীর হিসাবপত্ররক্ষক কর্ম্মচারীর হস্তে প্রদান করিয়া বলে যে, বণিক্‌ তাহাকে সত্বর পাঠাইয়া দিয়াছেন; বণিকের অনুজ্ঞাক্রমে সেই ব্রাহ্মণের বাটী বিক্রয় করিবার তারিখ হইতে সমস্ত হিসাব পত্র এখনই তাহার নিকট দিতে হইবে। দূত রাজার আদেশানুসারে সেই বণিকের নাম করিয়া কর্ম্মচারীকে অঙ্গুরীয়ক প্রদান করিল এবং হিসাবপাত্রের জন্য তথায় অপেক্ষা করিতে লাগিল। কর্ম্মচারী প্রভুর করাচিহ্ন অঙ্গুরী প্রাপ্ত হইয়া নিঃসন্দেহে সমস্ত হিসাবপত্র দূতের হস্তে অর্পণ করিল।

রাজা নিভৃত কক্ষে স্বয়ং সেই হিসাব মনোযোগপূর্ব্বক পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, তাহাতে বাটী ক্রয় সম্বন্ধীয় ব্যয়ের মধ্যে বিক্রয়-পত্রলেখক রাজকর্ম্মচারীকে ১০০০ দীনার প্রদানের উল্লেখ আছে। এরূপই কাগজ লেখার পারিশ্রমিক অতি সামান্য, তাহার তুলনায় ১০০০ দীনার অসন্তব পরিমাণে অধিক। দলিললেখক রাজকর্ম্মচারীটীকে এত অধিক অর্থ কেন দেওয়া হইল এই সম্বন্ধে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া রাজা দলিলটি বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, তাহার এক স্থানে “র"কে “স"তে পরিণত করা হইয়াছে, দেবনাগরী অক্ষরে সামান্য পরিবর্ত্তন করিলেই “র"কে “স"তে পরিণত করা যায়, “সোপানকূপরহিত” কথার স্থলে “সোপানকূপসহিত” হইয়া গিয়াছিল। রাজা দলিল-লেখককে আনাইলেন, তাহাকে অভয়বাণী প্রদান করিয়া সত্য বলিতে আদেশ করিলে, সে স্বীয় অপরাধ স্বীকার করিল।

রাজা সেই দলিল সভাসদ্‌ ও বিচারকমণ্ডলীর নিকট উপস্থিত করিয়া বণিকের দোষ প্রতিপন্ন করিলেন। বণিক্‌ কাশ্মীর হইতে নির্ব্বাসিত হইল এবং ব্রাহ্মণ তাঁহার বাটী ও ধনের অধিকারী হইলেন।

একদা মহারাজ যশস্কর সায়ং সন্ধ্যা সমাপনান্তে আহারে প্রবৃত্ত হইবেন এমন সময় দৌবারিক আসিয়া জ্ঞাপন করিল, জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁহার সঙ্গে দেখা করিবার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করিতেছেন, তাঁহার কি অভিযোগ আছে, তাহা তিনি রাজসকাশে জ্ঞাপন করিবেন। দৌবারিক তাঁহাকে বুঝাইয়াছে যে, বিচারের সময় অতিবাহিত হইয়াছে; এখন রাজার সঙ্গে দেখা করিবার সময় নাই, কল্য যেন ব্রাহ্মণ রাজসভায় উপস্থিত হইয়া অভিযোগের কথা নিবেদন করেন,—কিন্তু ব্রাহ্মণ কিছুতেই ছাড়িতেছেন না, তিনি তাহাকে বলিয়াছেন সে যদি রাজসকাশে আজই তাঁহার কথা না বলে, তবে তিনি রাজদ্বারে উপবাসী হইয়া থাকিবেন।

রাজা আহার না করিয়াই ব্রাহ্মণকে ডাকাইলেন, ব্রাহ্মণ তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ, বহু স্থান পর্য্যটন করিয়া ১০০ স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহপূর্ব্বক আমি কাশ্মীরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছি, কাশ্মীর আমার স্বদেশ; শুনিয়াছিলাম আপনার শাসনে কাশ্মীর শান্তিপূর্ণ হইয়াছে, এ দেশে দস্যুতস্করের ভীতি নাই, গত রাত্রি আমি লবণোৎসের পার্শ্বস্থিত এক বৃক্ষনিম্নে যাপন করি, অতি প্রত্যুষে যখন উঠিয়া পথ চলিতেছিলাম, তখন আমার স্বর্ণমুদ্রার থলিয়া সমেত ক্ষুদ্র পুঁটুলিটি হস্তচ্যুত হইয়া একটি কূপে পড়িয়া যায়, আমি অধীর হইয়া সেই কূপেই প্রাণত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম, কিন্তু চারি দিকের লোকজন সমাগত হইয়া আমাকে বাধা দেয়। সেই সমবেত লোকবৃন্দের মধ্যে বলিষ্ঠাকায় সাহসী এক বণিক্‌ আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “যদি থলিয়াটি উদ্ধার করিয়া দিতে পারি তবে আপনি আমায় কি দিবেন?”—আমি বলিলাম—“তাহা হইলে থলিয়াটি আপনারই হইল; আপনি তাহা হইতে আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই আমাকে দিবেন।” তখন সেই বণিক্‌ কূপনিম্নে অবতরণ করিয়া থলিয়াটি উদ্ধার করিল, এবং নিজে ৯৮টি স্বর্ণমুদ্রা রাখিয়া দুইটি মাত্র আমাকে প্রদান করিল। আমি মৌখিক যে সর্ত্ত করিয়াছিলাম, তাহার ফল এই দাঁড়াইল দেখিয়া সমবেত লোকবৃন্দ আমার নিন্দা করিতে লাগিল। এই সর্ত্ত রাজবিধি অনুসারে অপরিবর্ত্তনীয়, সুতরাং সকল লোক আমায় বলিল, ইহার আর কোন উপায় হইতে পারে না।” রাজা সেই বণিকের নাম ও আকৃতি প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করাতে ব্রাহ্মণ কিছুই বলিতে পারিলেন না; শুধু তাহার মুখ দেখিলে চিনিতে পারেন, এই বলিলেন। রাজা ব্রাহ্মণকে আশ্বাস প্রদান করিয়া সে রাত্রে তাঁহাকে স্বগৃহে ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ করিলেন, এবং পরদিন প্রভাতে লবণোৎসের বণিক্‌বৃন্দকে আহ্বান করাইয়া আনিলেন, ব্রাহ্মণ তাহাদের মধ্যে একজনকে দেখাইয়া বলিলেন, এই সেই বণিক্‌।

সেই বণিক্‌কে জিজ্ঞাসা করা হইলে ব্রাহ্মণ যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, সে তাহার সকলই সত্য বলিয়া স্বীকার করিল এবং এ সম্বন্ধে রাজ-বিধি যে তাহার অনুকূলে তাহাও গাইতে ছাড়িল না। ব্রাহ্মণ স্বয়ং সত্যপাশে বদ্ধ হইয়াছিলেন, সুতরাং সভাসদ্‌-বৃন্দ রাজা এই অভিযোগের কি বিচার করেন, দেখিতে উৎসুক হইয়া রহিলেন।

রাজা বিচারাসনে উপবেশনপূর্ব্বক ৯৮টি সুবর্ণমুদ্রা ব্রাহ্মণকে ও দুইটি মাত্র বণিক্‌কে প্রদান করিলেন। এই বিচারের সমর্থনে তিনি বলিলেন, “ব্রাহ্মণ একথা কহেন নাই যে, বণিক্‌ যাহাই দিবে, তিনি তাহাই গ্রহণ করিবেন।” ব্রাহ্মণ বলিয়াছিলেন,—“আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই আমাকে দিবেন।” এখন বণিকের ইচ্ছা বা কামনা ৯৮টি স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করা, সর্ত্ত অনুসারে বণিকের যাহা ইচ্ছা তাহাই ব্রাহ্মণের প্রাপ্য হয়। লুব্ধ বণিক্‌ দুইটি স্বর্ণমুদ্রা পাইতে ইচ্ছা করে নাই, সে যাহা ইচ্ছা করিয়াছে (অর্থাৎ ৯৮টি মুদ্রা) তাহা আমি ব্রাহ্মণকে প্রদান করিলাম।

যদিও এই বিচারে রাজা সর্ত্তের প্রকৃত মর্ম্ম গ্রহণ না করিয়া শুধু কথার অর্থ দ্বারা অভিযোগের মীমাংসা করিলেন, তথাপি যখন কোন লোভপরায়ণ দুষ্ট ব্যক্তি অপরের সততার সুবিধা গ্রহণ করিয়া রাজবিধির বলে স্বীয় দুষ্ট অভিসন্ধি চরিতার্থ করিতে ইচ্ছা করে, তখন রাজবিধি লঙ্ঘন না করিয়া কৌশলক্রমে শব্দের অর্থগ্রহণ পূর্ব্বক যদি কোন সাধু ব্যক্তির সাহায্য করা যায়, তবে সে কার্য্য যে ন্যায়সঙ্গত হয়, তাহা কেহ অস্বীকার করিতে পারে না।