ব্যঙ্গকৌতুক/বশীকরণ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rp
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
→‎top: rplc
১০ নং লাইন:
|portal =
|categories =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
<center>
প্রথম অঙ্ক
১৬ নং লাইন:
আশু ও অন্নদা
</center>
আশু। আচ্ছা অন্নদা, তুমি যেন ব্রাহ্মই হয়েছিলে, কিন্তু তাই বলে স্ত্রী-পরিত্যাগ করতে গেলে কেন? স্ত্রী তো তেত্রিশ কোটির মধ্যে একটিও নয়। ঐটুকু পৌত্তলিকতা, রাখলেও ক্ষতি ছিল না।
 
অন্নদা। সে তো ঠিক কথা। স্ত্রী-পরিত্যাগ করা যায়, কিন্তু স্ত্রীজাতি তো বিদায় হন না— স্ত্রীকে ছাড়লে স্ত্রীজাতি বিশ্বব্যাপী হয়ে দেখা দেন, স্ত্রীপূজার মাত্রা মনে মনে বেড়ে ওঠে।
 
আশু। তবে?
 
অন্নদা। তবে শোনো। আমার শাশুড়ি ছিলেন না, শ্বশুর ভয়ংকর হিন্দু ছিলেন। যখন শুনলেন আমি ব্রাহ্ম হয়েছি, আমার স্ত্রীকে বিধবার বেশ পরিয়ে ব্রহ্মচারিণী করে কাশীতে গিয়ে বাস করলেন। তার পরে শুনছি হিন্দুশাস্ত্রের সমস্ত দেবতাতেও তৃপ্তি হয় নি, তার উপরে অল্‌কট্‌, ব্লাভাট্‌স্কি, অ্যানি বেসাণ্ট, সূক্ষ্মশরীর, মহাত্মা, প্লান্‌চেট, ভূতপ্রেত কিছুই বাদ যায় নি—
 
আশু। কেবল তুমি ছাড়া।
 
অন্নদা। আমাকে ব্রহ্মদৈত্য বলে বাদ দিলে।
 
আশু। তুমি তার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছ?
 
অন্নদা। আশার অপরাধ নেই— তার পশ্চাতে এত বড়ো রেজিমেণ্ট লেগেছে, সে আর টিঁকল না। শুনেছি আমার শ্বশুর মারা গেছেন, এবং আমার স্ত্রী এখন পতিত-উদ্ধার করে বেড়াচ্ছেন।
 
আশু। তুমি একবার চরণে পতিত হওগে-না, যদি উদ্ধার করেন।
 
অন্নদা। ঠিকানাও জানি নে, প্রবৃত্তিও নেই।
 
আশু। তুমি কি এইরকম উড়ে উড়ে বেড়াবে?
 
অন্নদা। না হে, সোনার খাঁচার সন্ধানে আছি।
 
আশু। খাঁচাওয়ালার অভাব নেই, তবে সোনা জিনিসটা দুর্লভ বটে।
 
অন্নদা। আচ্ছা, আমার আলোচনা পরে হবে, কিন্তু তোমার কী বলো দেখি। তোমার তো আইবড়োলোক-প্রাপ্তির বিধান কোনো শাস্ত্রেই লেখে না। তার বেলা চুপ। থিওসফিতে তোমাকে খেলে। মন্ত্রতন্ত্র প্রাণায়াম হঠযোগ সুষুম্না-ইড়া-পিঙ্গলা এ-সমস্তই তোমাকে ছাড়ে, যদি বিবাহ কর।
 
আশু। তুমি মনে কর, আমি সবই অন্ধভাবে বিশ্বাস করি— তা নয়। এ-সমস্ত বিশ্বাসের যোগ্য কি না তাই আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই। অবিশ্বাসকেও তো প্রমাণের উপর স্থাপন করতে হবে।
 
অন্নদা। বসে বসে তাই করো। মরীচিকা-স্থাপনের জন্য পাথরের ভিত্তি গাঁথো। আমি এখন চললেম।
 
আশু। কোথায় যাচ্ছ?
 
অন্নদা। শবসাধনায় নয়।
 
আশু। তা তো জানি।
অন্নদা। একটি সজীবের সন্ধান পেয়েছি।
 
আশু। তবে যাও, শুভকার্যে বাধা দেব না।
৬১ নং লাইন:
বাড়িওয়ালা ও তাহার স্ত্রী
</center>
স্ত্রী। মাতাজি যদি হবে, তবে অমন চেহারা কেন?
 
বাড়িওয়ালা। দেখতে শুনতে তাড়কা-রাক্ষসীর মতো না হলেই বুঝি আর মাতাজি হয় না।
 
স্ত্রী। হবে না কেন? কিন্তু তা হলে কি এই সমর্থবয়সে স্বামীর ঘরে না থেকে তোমার মতো বোকা ভোলাবার জন্যে মাতাজি-গিরি করতে বেরোত? তা হলে কি পিতাজি তোমার মাতাজিকে ছাড়ত? আর এত টাকাই বা পেলে কোথায়?
 
বাড়িওয়ালা। ওগো, যারা যোগবিদ্যা জানে তাদের যদি টাকা না হবে, চেহারা না হবে, তবে কি তোমার হবে? রোসো-না, ওঁর কাছে মন্তর-টন্তরগুলো শিখে নেওয়া যাক-না।
 
স্ত্রী। বুড়োবয়সে মন্তর শিখে হবে কী শুনি? কাকে বশ করবে?
 
বাড়িওয়ালা। যাঁকে কিছুতেই বশ মানাতে পারলেম না।
 
স্ত্রী। তিনি কে?
 
বাড়িওয়ালা। আগে বশ মানাই, তার পরে সাহস করে নাম বলব।
 
মাতাজির প্রবেশ
 
মাতাজি। এ বাড়িতে আমার থাকার সুবিধা হচ্ছে না। এর চেয়ে বড়ো বাড়ি আমাকে দিতে হবে।
 
বাড়িওয়ালা। এ বাড়ি ছাড়া আমার আর একটিমাত্র বড়ো বাড়ি আছে। সেটা বড়ো বটে, কিন্তু—
 
মাতাজি। তা, ভাড়া বেশি দেব, কিন্তু সেই বাড়িতেই আমি কাল যেতে চাই।
 
বাড়িওয়ালা। সবে পরশু দিন সেখানে একটি ভাড়াটে এসেছে। একটি কোন্‌ সদরআলার বিধবা স্ত্রী— পশ্চিম থেকে মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজতে এসে আমার সেই উনপঞ্চাশ নম্বরের বাড়িতে উঠেছে।
 
মাতাজি। উনপঞ্চাশ নম্বর! ঠিক আমি যা চাই। তোমার এ বাড়ির নম্বর ভালো নয়।
 
বাড়িওয়ালা। বাইশ নম্বর ভালো নয় মাতাজি? কারণটা কী বুঝিয়ে বলুন।
 
মাতাজি। বুঝতে পারছ না— দুয়ের পিঠে দুই—
 
বাড়িওয়ালা। ঠিক বলেছেন মাতাজি, দুয়ের পিঠে দুইই তো বটে। এতদিন ওটা ভাবি নি।
 
মাতাজি। দুইয়েতে কিছু শেষ হয় না, তিন চাই। দেখো-না আমরা কথায় বলি, দু-তিন জন—
 
বাড়িওয়ালা। ঠিক ঠিক, তা তো বলেই থাকি।
 
মাতাজি। যদি দুই বললেই চুকে যেত, তা হলে তার সঙ্গে আবার তিন বলব কেন? বুঝে দেখো।
 
বাড়িওয়ালা। আমাদের কী বা বুদ্ধি, তাই বুঝব। সবই জানতুম, তবু তো বুঝি নি।
 
মাতাজি। তাই, ঐ দুইয়ের পিঠে দুই বলেই আমার মন্ত্র কিছুই সফল হচ্ছে না।
 
স্ত্রী। ( আত্মগত) বেঁচে থাক্‌ আমার দুয়ের পিঠে দুই। মন্ত্র সফল হয়ে কাজ নেই।
 
মাতাজি। উনপঞ্চাশের মতো এমন সংখ্যা আর হয় না।
 
বাড়িওয়ালা। ( জনান্তিকে) শুনলে তো গিন্নি?
 
স্ত্রী। ( জনান্তিকে) শুনে হবে কী? তোমার উনপঞ্চাশ যে অনেক কাল হল পেরিয়েছে।
 
বাড়িওয়ালা। কিন্তু মাতাজিকে কি কালই সে বাড়িতে যেতে হবে?
 
মাতাজি। কাল উনত্রিশ তারিখে মঙ্গলবার পড়েছে। এমন দিন আর পাওয়া যাবে না।
 
বাড়িওয়ালা। ঠিক কথা। কাল উনত্রিশেও বটে, আবার মঙ্গলবারও বটে। কী আশ্চর্য! তা হলে তো কালই যেতে হচ্ছে বটে। তা-ই ঠিক করে দেব। ( মাতাজির প্রস্থান) এখন আমার এই নতুন ভাড়াটেদের ওঠাই কী বলে? বিদেশ থেকে এসেছে, হঠাৎ তারা এখন বাড়িই বা পায় কোথায়?
 
স্ত্রী। তাদের আপাতত এই বাড়িতে এনেই রাখো-না। আমরা নাহয় কিছুদিন ঝামাপুকুরে জামাইবাড়ি গিয়েই থাকব। তোমার ঐ মন্তর-জানা মেয়েমানুষকে এখানে রেখে কাজ নেই। বিদেয় করে দাও। ছেলেপিলের ঘর, কার কখন অপরাধ হয়, বলা যায় কি?
 
বাড়িওয়ালা। সেই ভালো। তাদের কোনোরকম করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আজকের মধ্যেই উনপঞ্চাশ নম্বর থেকে বাইশ নম্বরে এনে ফেলা যাক‌। বলি গে, পাড়ায় প্লেগ দেখা দিয়েছে, উনপঞ্চাশ নম্বরে প্লেগ হাঁসপাতাল বসবে।
 
<center>
১২৮ নং লাইন:
আশু ও অন্নদা
</center>
অন্নদা। তোমার ঐ টাটকা লঙ্কার ধোঁয়ায় নাকের জলে চোখের জলে করলে যে হে! তোমার ঘরে আসা ছাড়তে হল।
 
আশু। টাটকা লঙ্কার ধোঁয়া তুমি কোথায় পেলে?
 
অন্নদা। ঐ যে তোমার তর্কালংকারের বকুনি। লোকটা তো বিস্তর টিকি নাড়লে, মাথামুণ্ডু কিছু পেলে কি?
 
আশু। মাথামুণ্ডু নইলে শুধু টিকি নড়বে কোথায়? কথাগুলো যদি শ্রদ্ধা করে শুনতে, তবে বুঝতে।
 
অন্নদা। যদি বুঝতেম, তবে শ্রদ্ধা করেতম। তুমি আশু, ফিজিকাল সায়ান্সে এম. এ. দিয়ে এলে— তুমি যে এত ঘন ঘন টিকি-নাড়া বরদাস্ত করছ এ যদি দেখতে পায় তবে প্রেসিডেন্সি কলেজের চুনকাম-করা দেওয়ালগুলো বিনি-খরচে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। আজ কথাটা কী হল বুঝিয়ে বলো দেখি।
 
আশু। পণ্ডিতমশায় পরিণয়তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছিলেন।
 
অন্নদা। তত্ত্বটা আমার জানা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। তর্কালংকারমশায় বলছিলেন, বিবাহের পূর্বে কন্যার সঙ্গে জানাশুনার চেষ্টা না করাই কর্তব্য। যুক্তিটা কী দিচ্ছিলেন, ভালো বোঝা গেল না।
 
আশু। তিনি বলছিলেন, সকল জিনিসের আরম্ভের মধ্যে একটা গোপনতা আছে। বীজ মাটির নীচে অন্ধকারের মধ্যে থাকে, তার পরে অঙ্কুরিত হলে তখন সূর্য-চন্দ্র-জল-বাতাসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করবার সময় আসে। বিবাহের পূর্বে কন্যার হৃদয়কে বিলাতি অনুকরণে বাইরে টানাটানি না করে তাকে আচ্ছন্ন আবৃত রাখাই কর্তব্য। তখন তার উপরে তাড়াতাড়ি দৃষ্টিক্ষেপ করতে যেয়ো না। সে যখন স্বভাবতই নিজে অঙ্কুরিত হয়ে তার অর্ধমুকুলিত সলজ্জ দৃষ্টিটুকু গোপনে তোমার দিকে অগ্রসর করতে থাকবে, তখনই তোমার অবসর।
 
অন্নদা। আমার অদৃষ্টে সে পরীক্ষা তো হয়ে গেছে। বিলাতি প্রথা মতে বিবাহের পূর্বে কন্যার হৃদয় নিয়ে টানা— হেঁচড়া করি নি; হৃদয়টা এত অন্ধকারের মধ্যে ছিল যে আমি তার কোনো খোঁজ পাই নি, তার পরে অঙ্কুরিত হল কি না হল তারও তো
 
কোনো ঠিকানা পেলেম না। এবারে উলটোরকম পরীক্ষা করতে চলেছি, এবার আগে হৃদয়, তার পরে অন্য কথা।
আশু। পরীক্ষার দিন কবে?
 
অন্নদা। কাল।
 
আশু। স্থান?
 
অন্নদা। উনপঞ্চাশ নম্বর রাম বৈরাগীর গলি।
 
আশু। নম্বরটা তো ভালো শোনাচ্ছে না।
 
অন্নদা। কেন? উনপঞ্চাশ বায়ুর কথা ভাবছ? সে আমাকে টলাতে পারবে না— তুমি হলে বিপদ ঘটত।
 
আশু। পাত্র?
 
অন্নদা। কন্যার বিধবা মা তাকে পশ্চিম থেকে সঙ্গে করে এনেছে। আমি ঘটককে বলে রেখেছি যে ভালো করে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করে নিয়ে তবে বিবাহের কথা হবে।
 
আশু। কিন্তু অন্নদা, শেষকালে বহুবিবাহে প্রবৃত্ত হলে?
 
অন্নদা। তোমাদের মতো আমি নাম দেখে ভড়কাই নে। যে বহুবিবাহের মধ্যে আর সমস্ত আছে, কেবল বহুটুকুই নেই, তাকে দেখে চমকাও কেন ভাই?
 
আশু। তবু একটা প্রিন্সিপ্‌ল্‌ আছে তো? বহুবিবাহকে বহুবিবাহ বলতেই হবে।
 
অন্নদা। আমার নামমাত্র স্ত্রী যেখানে আছে প্রিন্সিপ্‌ল্‌ও সেইখানে আছে। সে স্ত্রীও আসছে না, প্রিন্সিপ্‌ল্‌ও রইল; অতএব এখন আমি ডঙ্কা মেরে বহুবিবাহ করব, প্রিন্সিপ্‌ল্‌জুজুকে ডরাব না।
 
 
১৭৫ নং লাইন:
 
রাধাচরণ। আশুবাবু!
 
আশু। কী হে রাধে?
 
রাধাচরণ। সেদিন আপনি আমার সঙ্গে মন্ত্র নিয়ে তর্ক করলেন— এক-একটা শব্দের যে এক-এক-প্রকার বিশেষ ক্ষমতা আছে, আমার বোধ হল আপনি যেন তা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন না।
 
অন্নদা। বল কী রাধে? তা হলে আশুর অবিশ্বাস করবার ক্ষমতা এখনো সম্পূর্ণ লোপ হয় নি! এখনো দুটো-একটা জায়গায় ঠেকছে!— শব্দের মধ্যে শক্তি আছে, এ কথা বাঙালির ছেলে বিশ্বাস কর না!
 
রাধাচরণ। বলুন তো অন্নদাবাবু! তা হলে মারণ, উচাটন, বশীকরণ— এগুলো কি বেবাক গাঁজাখুরি!
 
অন্নদা। তাও কি কখনো হয়? সংসারে কি এত গাঁজার চাষ হতে পারে?
 
রাধাচরণ। পশ্চিম থেকে একজন যোগসিদ্ধ মাতাজি এসেছেন। শুনেছি তিনি মন্ত্রের বল একেবারে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিতে পারেন। দেখতে গিয়েছিলেম, কিন্তু সকলকে তিনি দেখা দেন না; বলেছেন, যোগ্য লোক পেলে তাকে তিনি তাঁর সমস্ত বিদ্যে দেখিয়ে দেবেন। আশুবাবু, আপনি চেষ্টা করলে নিশ্চয় বিফল হবেন না।
 
আশু। তিনি থাকেন কোথায়?
 
রাধাচরণ। বাইশ নম্বর ভেড়াতলায়।
 
অন্নদা। বাইশ নম্বরটা উনপঞ্চাশের চেয়ে ভালো হতে পারে, কিন্তু জায়গাটা ভালো ঠেকছে না। একে বশীকরণ-বিদ্যে, তার উপরে ভেড়াতলা। মাতাজির কাছে মুণ্ডুজিটি খুইয়ে এসো না।
 
আশু। আরে ছি! কী বক তার ঠিক নেই। তাঁরা হলেন সাধু স্ত্রীলোক, সেখানে মুণ্ডুর ভাবনা ভাবতে হয় না। তুমি বুঝেসুঝে উনপঞ্চাশে পা বাড়িয়ো।
 
অন্নদা। তুমি ভাবছ বাইশ একেবারেই নির্বিষ। তা নয় হে। বিশেষ উপরের দুই মাত্রা চড়িয়ে তবে বাইশ। আপাদমস্তক জর্জর হয়ে ফিরবে।
 
<center>
২০৫ নং লাইন:
</center>
 
শ্যামা। পেলেগ শুনে ভয়ে বাঁচি নে। তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে তো এলুম। কিন্তু অন্নদা বলে ছেলেটির আজ যে সেই উনপঞ্চাশ নম্বরে আসবার কথা আছে, সে কি সেখান থেকে চিনে ঠিক এখানে আসতে পারবে! এত করে খাওয়াদাওয়ার জোগাড় করলেম, সব মাটি হবে না তো! যে তাড়াটা লাগালে, একবার খবর দেবার সময় দিলে না। ঘটক বলেছে, ছেলেটি আমার নিরুপমাকে ভালো করে দেখে-শুনে নিতে চায়, ওর পড়াশুনো গান-বাজনা সব পরীক্ষা করবে— তা করুক। কর্তা তো নিরুপমাকে সেইরকম করেই শিখিয়েছেন। বরাবর পশ্চিমে ছিলেন, আমাদের কখনো তো বন্ধ করে রাখেন নি। তবু কলকাতার ছেলে কী রকম জানি নে। ভয় হয়, আমাদের ধরন-ধারণ দেখে হয়তো অভদ্র মনে করবে। তারা মেয়ের সঙ্গে শেক্‌হ্যাণ্ড করে না কি, কে জানে! হয়তো ইংরেজিতে গুড্‌মর্নিং বলে! শুনেছি তাদের নিজের হাতে চুরুট জ্বালিয়ে দিতে হয়— এ-সব তো পারব না। ঘটক বললে, ছেলেটি হ্যাট-কোট পরে। আমার মেয়ে আবার ফিরিঙ্গির সাজ দু চক্ষে দেখতে পারে না। কী রকম যে হবে, বুঝতে পারছি নে। মন্ত্র পড়ে বিয়ে করতে রাজি হবে তো?
 
 
ভৃত্যের প্রবেশ
 
 
ভৃত্য। মাঠাকরুন, একটি বাবু এসেছেন। আমি তাঁকে বললেম বাড়িতে পুরুষ-মানুষ কেউ নেই। তিনি বললেন, তিনি মার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন।
 
শ্যামা। তবে ঠিক হয়েছে। সেই ছেলেটি এসেছে। ডেকে নিয়ে আয়। ( ভৃত্যের প্রস্থান) ভয় হচ্ছে— কলকাতার ছেলে, তার সঙ্গে কিরকম করে চলতে হবে! কী জানোয়ারই মনে করবে!
 
 
আশুর প্রবেশ
 
 
শ্যামাসুন্দরীর পায়ের কাছে একটি গিনি রাখিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম
 
শ্যামা। ( স্বগত) এ যে প্রণামী দিয়ে প্রণাম করলে গো! এ তো শেক্‌হ্যাণ্ড করে না। বাঁচালে! লক্ষ্মী ছেলে! কেমন ধুতিচাদর পরে এসেছে!
 
আশু। মাতাজি, আমাকে যে আপনি দর্শন দেবেন, এ আমি আশা করি নি। বড়ো অনুগ্রহ করেছেন।
 
শ্যামা। ( সস্নেহে সপুলকে) কেন বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো, তোমাকে দেখা দিতে দোষ কী!
 
আশু। স্নেহ রাখবেন। আশীর্বাদ করবেন, এই অনুগ্রহ থেকে কখনো বঞ্চিত না হই।
 
শ্যামা। বাবা, তোমার কথা শুনে আমার কান জুড়োল, আমি নিশ্চয়ই অনেক তপস্যা করেছিলেম, তাই—
 
আশু। মাতাজি, আপনি তপস্যার দ্বারা যে নিরুপমা-সম্পদ লাভ করেছেন, আমাকে তার—
 
শ্যামা। তোমাকে দেবার জন্যেই তো প্রস্তুত হয়ে এসেছি। অনেক সন্ধান করে যোগ্যপাত্র পেয়েছি, এখন দিতে পারলেই তো নিশ্চিন্ত হই।
 
আশু। ( শ্যামার পদধূলি লইয়া) মাতাজি, আমাকে কৃতার্থ করলেন; এত সহজেই যে ফললাভ করব, এ আমি স্বপ্নেও জানতুম না।
 
শ্যামা। বল কী বাবা, তোমার আগ্রহ যত আমার আগ্রহ তার চেয়ে বেশি।
 
আশু। তা হলে যে কামনা করে এসেছিলেম, আজ কি তার কিছু পরিচয়—
 
শ্যামা। পরিচয় হবে বৈকি বাবা, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
 
আশু। আপত্তি নেই মাতাজি? শুনে বড়ো আরাম পেলেম—
 
শ্যামা। দেখাশুনা সমস্তই হবে বাবা, আগে কিছু খেয়ে নাও।
 
আশু। আবার খাওয়া! আপনি আমাকে যথার্থ জননীর মতোই স্নেহ দেখালেন।
 
শ্যামা। তুমিও আমাকে মার মতোই দেখবে, এই আমার প্রাণের ইচ্ছা। আমার তো ছেলে নেই, তুমিই আমার ছেলের মতো থাকবে।
 
 
আহার্য লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ
 
 
 
আশু। করেছেন কী! এত আয়োজন!
 
শ্যামা। আয়োজন আর কি করলেম? আজই ঠিক আসতে পারবে কি না মনে একটু সন্দেহ ছিল, তাই—
 
আশু। সন্দেহ ছিল? আপনি কি জানতেন আমি আসব?
 
শ্যামা। তা জানতেম বৈকি।
 
আশু। ( আত্মগত) কী আশ্চর্য! আমাকে না জেনেই আমার জন্যে পূর্ব হতেই অপেক্ষা করছিলেন? তবু অন্নদা যোগবলে বিশ্বাস করে না! তাকে বললে বোধ হয় ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দেবে।
 
 
আহারে প্রবৃত্ত
 
 
শ্যামা। ( আত্মগত) ছেলেটি সোনার টুকরো। যেমন কার্তিকের মতো দেখতে তেমনি মধু-ঢালা কথা। আমাকে প্রথম থেকেই মাতাজি বলে ডাকছে। পশ্চিম থেকে এসেছি কিনা, তাই বোধ হয় মা না বলে মাতাজি বলছে। ( প্রকাশ্যে) কিছুই খেলে না যে বাবা!
 
আশু। আমার যা সাধ্য, তার চেয়ে বরঞ্চ বেশিই খেয়েছি মাতাজি।
 
শ্যামা। তা হলে একটু বোসো আমি ডেকে নিয়ে আসি।
 
 
[ প্রস্থান
 
 
আশু। রাধে বলেছিল বটে, মাতাজি কুমারী কন্যার দ্বারা মন্ত্রের ফল দেখিয়ে থাকেন। বশীকরণ-বিদ্যায় আমার একটু বিশ্বাস জন্মাচ্ছে। এরই মধ্যে মাতাজির মাতৃস্নেহে আমার চিত্ত কেমন যেন আর্দ্র হয়ে এসেছে। আমার মা নেই, মনে হচ্ছে যেন মাকে পেলেম। এ কোন্‌ মন্ত্রবলে কে জানে! মাতাজি স্নিগ্ধ দৃষ্টিদ্বারা আমার সমস্ত শরীর যেন অভিষিক্ত করে দিয়েছেন। প্রথম দেখাতেই উনি যে আমাকে তাঁর পুত্রস্থানীয় করে নিয়েছেন, এ যেন পূর্বজন্মের একটা সম্বন্ধের স্মৃতি।
 
 
নিরুপমাকে লইয়া শ্যামার প্রবেশ
 
 
আশু। ( স্বগত) আহা, কী সুন্দর! মাতাজির বশীকরণ-বিদ্যা যেন মূর্তিমতী! এঁর মুখে কোনো মন্ত্রই বিফল হতে পারে না।
 
শ্যামা। যাও, লজ্জা কোরো না মা! উনি যা জিজ্ঞাসা করেন উত্তর দিয়ো।
 
আশু। লজ্জা করবেন না। মাতাজি আমার প্রতি যেরকম অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আপনিও আমাকে আপনার লোকের মতোই দেখবেন। ( আত্মগত) মেয়েটি কী লাজুক! আমার কথা শুনে আরো যেন লাল হয়ে উঠল।
 
শ্যামা। বাবা, তোমার ইচ্ছামত ওকে জিজ্ঞাসাপত্র করো।
 
আশু। আপনার কোন্‌ কোন্‌ বিদ্যায় অধিকার আছে, জানতে উৎসুক হয়ে আছি।
 
শ্যামা। বয়স অল্প, বিদ্যা কতই বা বেশি হবে— তবে—
 
আশু। যত অল্পই হোক মাতাজি, আমাদের মতো লোকের পক্ষে যথেষ্ট হবে।
 
শ্যামা। ( আত্মগত) বিদ্যার কোনো পরিচয় না পেয়েই যখন এত সন্তুষ্ট তখন মেয়েকে পছন্দ করেছে বলেই বোধ হচ্ছে। বাঁচা গেল, আমার বড়ো ভাবনা ছিল। ( প্রকাশ্যে) নিরু, একটি গান শুনিয়ে দাও তো মা!
 
আশু। গান! এ আমার আশার অতীত। আপনি বোধ হয় পূর্বে থেকেই জানেন, গানের চেয়ে আমি কিছুই ভালোবাসি নে। ( স্বগত) অন্নদার মতো এতবড়ো সন্দেহী, সে থাকলে আজ যোগের বল প্রত্যক্ষ করতে পারত। ( প্রকাশ্যে নিরুপমার প্রতি) আপনারা আমাকে এক দিনেই চিরঋণী করেছেন, যদি গান করেন তবে বিক্রীত হয়ে থাকব।
৩০৬ নং লাইন:
নিরুপমার গান
<poem>
আমি কী বলে করিব নিবেদন
 
আমার হৃদয় প্রাণ মন!
 
চিত্তে এসে দয়া করি নিজে লহো অপহরি,
 
করো তারে আপনার ধন—
 
আমার হৃদয় প্রাণ মন।
 
শুধু ধূলি, শুধু ছাই, মূল্য যার কিছু নাই
 
মূল্য তারে করো সমর্পণ
 
তব স্পর্শে পরশরতন!
 
তোমার গৌরবে যবে আমার গৌরব হবে
 
একেবারে দিব বিসর্জন
 
চরণে হৃদয় প্রাণ মন।
৩৩০ নং লাইন:
</center>
 
আশু। ( স্বগত) আর মন্ত্রের দরকার নেই। বশীকরণের আর কী বাকি রইল! কন্যাটি দেবকন্যা। ( প্রকাশ্যে) মাতাজি!
 
শ্যামা। কী বাবা?
 
আশু। আমাকে আপনার পুত্র করেই রাখবেন, এমন সুধাসংগীত শোনবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না। যা পাওয়া গেল এই আমি পরম লাভ মনে করছি। মন্ত্রতন্ত্রের কথা ভুলেই গেছি। এখন বুঝতে পারছি, মন্ত্রের কোনো দরকার নেই।
 
শ্যামা। অমন কথা বোলো না বাবা! মন্ত্রের দরকার আছে বৈকি। নইলে শাস্ত্রে—
 
আশু। সে তো ঠিক কথা। মন্ত্র আমি অগ্রাহ্য করি নে। আমি বলছিলেম মন্ত্র পড়লেই যে মন বশ হয় তা নয়, গানের মোহিনী শক্তির কাছে কিছুই লাগে না। ( স্বগত) মেয়েটি আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ভারি লাজুক!
 
শ্যামা। ( আত্মগত) ছেলেটি খুব ভালো। কিন্তু একটু যেন লজ্জা কম বলে বোধ হয়। মন বশ করার কথাগুলো শাশুড়ির সামনে না বললেই ভালো হত।
 
আশু। কিন্তু আপনি বিরক্ত হবেন না, আমার যা মনে উদয় হচ্ছে আমি বলি, তার পরে—
 
শ্যামা। তা বাবা, সে-সব কথা এখন থাক্‌। আগে—
 
আশু। আমি বলছিলেম, গানে যে মন বশ হয় সেও তো শব্দমাত্র; মনের সঙ্গে তার যদি যোগ থাকে তা হলে মন্ত্রের শব্দশক্তিকেই বা না মানি কী বলে?
 
শ্যামা। ঠিক কথা। মন্ত্রটা মানাই ভালো।
 
আশু। ( সোৎসাহে ) আপনার কাছে এ-সব কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা, কিন্তু শাব্দী শক্তির সঙ্গে আত্মার যে একটি নিগূঢ় যোগ আছে তার স্বরূপ নিরূপণ করা কঠিন, তর্কালংকারমশায় বলেন সে অনির্বচনীয়। শাস্ত্রে যে বলে শব্দ ব্রহ্ম, তার কারণ কী? ব্রহ্মই যে শব্দ বা শব্দই সে ব্রহ্ম তা নয়; কিন্তু ব্রহ্মের ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে শব্দস্বরূপেই ব্রহ্মের প্রকাশ যেন নিকটতম। ( নিরুপমার প্রতি) আপনি তো এ-সকল বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছেন, আপনার কি মনে হয় না রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের চেয়ে শব্দই যেন আমাদের আত্মার অব্যবহিত প্রত্যক্ষের বিষয়? সেইজন্যই এক আত্মার সঙ্গে আর-এক আত্মার মিলনসাধনের প্রধান উপায় শব্দ। আপনি কী বলেন? ( স্বগত) মেয়েটি ভারি লাজুক!
 
শ্যামা। বলো-না মা, যা জিজ্ঞাসা করছেন বলো। এত বিদ্যে শিখলে, এই কথাটার উত্তর দিতে পারছ না?— বাবা, প্রথম দিন কিনা, তাই লজ্জা করছে। ও যে কিছু শেখে নি তা মনে কোরো না।
 
আশু। ওঁর বিদ্যার উজ্জ্বলতা মুখশ্রীতেই প্রকাশ পাচ্ছে। আমি কিছুমাত্র সন্দেহ করছি নে।
 
শ্যামা। নিরু, মা, একবার ও ঘরে যাও তো।
 
 
[নিরুপমার প্রস্থান
 
 
দেখো বাবা, মেয়েটির বাপ নেই, সকল কথা আমাকেই কইতে হচ্ছে, তুমি কিছু মনে কোরো না।
 
আশু। মনে করব! বলেন কী! আপনার কথা শুনতেই তো এসেছিলেম— বাচালের মতো কেবল নিজেই কতকগুলো বকে গেলেম। আমাকে মাপ করবেন।
 
শ্যামা। তোমার যদি মত থাকে তা হলে একটা দিনস্থির করতে হচ্ছে তো?
 
আশু। ( স্বগত) আমি ভেবেছিলেম, আজই সমস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আজ বৃহস্পতি বার, তাই বোধ হয় হল না। ( প্রকাশ্যে) তা, আসছে রবিবারেই যদি স্থির করেন?
 
শ্যামা। বল কী বাবা? আজ বৃহস্পতিবার, মাঝে তো কেবল দুটো দিন আছে।
 
আশু। এর জন্যে কি অনেক আয়োজনের দরকার হবে?
 
শ্যামা। তা হবে বৈকি বাবা; যথাসাধ্য করতে হবে। তা ছাড়া, পাঁজি দেখে একটা শুভদিন স্থির করতে হবে তো।
 
আশু। তা বটে, শুভদিন দেখতে হবে বৈকি। আসল কথা, যত শীঘ্র হয়। আমার যেরকম আগ্রহ, ইচ্ছে হচ্ছে, এই মুহূর্তেই—
 
শ্যামা। তা, আমি অনর্থক দেরি করব না বাবা! আসছে অঘ্রান মাসেই হয়ে যাবে। মেয়েটিরও বিবাহযোগ্য বয়স হয়ে এসেছে, ওকেও তো আর রাখা যাবে না।
 
আশু। ওঁর বিবাহ হয়ে গেলেই বুঝি—
 
শ্যামা। তা হলে আবার আমি কাশীতে ফিরে যেতে পারি।
 
আশু। তাহলে তার আগেই আমাদের—
 
শ্যামা। সব ঠিক করে নিতে হবে।
 
আশু। তবে দিনক্ষণ দেখুন।
 
শ্যামা। তুমি তো রাজি আছ বাবা?
 
আশু। বিলক্ষণ! রাজি যদি না থাকব তো এখানে এলেম কেন! আপনাকে নিয়ে কি আমি পরিহাস করছি! আমার সেরকম স্বভাব নয়। আমি এখনকার ছেলেদের মতো এ-সকল বিষয় নিয়ে তামাশা করি নে।
 
শ্যামা। তোমার আর মত বদলাবে না?
 
আশু। কিছুতেই না। আপনার পদস্পর্শ করে আমি বলছি, আপনার কাছ থেকে যা সংগ্রহ করতে এসেছি তা আমি গ্রহণ করে তবে নিরস্ত হব।
 
শ্যামা। দেওয়া-থোওয়ার কথা কিছু হল না যে।
 
আশু। আপনি কী চান বলুন।
 
শ্যামা। আমি কী চাইব বাবা? তুমি কী চাও, সেইটে বলো।
 
আশু। আমি কেবল বিদ্যে চাই, আর কিছু চাই নে।
 
শ্যামা। ( স্বগত) ছেলেটি কিন্তু বেহায়া, তা বলতেই হবে! ছি ছি ছি, বিদ্যেসুন্দরের কথা আমার কাছে পাড়লে কী করে! আমার নিরুকে বলে কিনা বিদ্যে! (প্রকাশ্যে) তা হলে পানপাত্রটার কথা কী বল বাবা?
 
আশু। ( স্বগত) পানপাত্র! এঁর দেখছি সমস্তই শাক্তমতে। এ দিকে কুমারী কন্যা, তার পরে আবার পানপাত্র!
 
এইটে আমার ভালো ঠেকছে না। ( প্রকাশ্যে) তা, মাতাজি, আপনি কিছু মনে করবেন না— অবশ্য যে কাজের
 
যা অঙ্গ তা করতেই হয়— কিন্তু ঐ-যে পানপাত্রের কথা বললেন, ওটা তো আমার দ্বারা হবে না।
 
শ্যামা। বাবা, তোমরা একালের ছেলে, তোমরা ওটাকে অসভ্যতা মনে কর, কিন্তু আমি তো ওতে কোনো দোষ দেখি নে—
 
আশু। আপনি ওতে কোনো দোষই দেখেন না! বলেন কী মাতাজি!
 
শ্যামা। তা, নাহয় পানপাত্র রইল, ওর জন্যে কিছু আটকাবে না, এখন বিবাহের কথা তো পাকা?
 
আশু। কার বিবাহের কথা?
 
শ্যামা। তুমি আমাকে অবাক করলে বাপু! এতক্ষণ কথাবার্তার পর জিজ্ঞাসা করছ কার বিবাহের কথা! তোমারই তো বিবাহের কথা হচ্ছিল; কেবল পানপাত্রের কথা শুনেই তুমি চমকে উঠলে। তা, পানপাত্র নাহয় নাই হল।
 
আশু। ( হতবুদ্ধিভাবে) ও, হাঁ, তা বুঝেছি, তাই হচ্ছিল বটে! (স্বগত) মস্ত একটা কী ভুল হয়ে গেছে। না বুঝে একেবারে জড়িয়ে পড়েছি। কী করা যায়! (প্রকাশ্যে) কিন্তু, এত তাড়াতাড়ি কিসের, আর-এক দিন এ-সব কথা খোলসা করে আলোচনা করা যাবে। কী বলেন?
 
শ্যামা। খোলসার আর কী বাকি রেখেছ বাবা! আর-একদিন এর চেয়ে আর কত খোলসা হবে! তাড়াতাড়ি তো তুমিই করছিলে। আসছে রবিবারেই তুমি দিন স্থির করতে চেয়েছিলে।
 
আশু। তা চেয়েছিলেম বটে।
 
শ্যামা। তুমি দেখাশুনা করতে চাইলে বলেই আমি মেয়েকে তোমার সাক্ষাতে বের করলুম, তার গানও শুনলে, এখন পানপাত্রের কথা শুনেই যদি বেঁকে দাঁড়াও তা হলে তো আমার আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না। তোমাকেই বা লোকে কী বলবে বাবা! ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার কি ভালো! আমার নিরু তোমার কাছে কী দোষ করেছিল যে—
 
 
ক্রন্দন
 
নিরুপমার দ্রুত প্রবেশ
 
 
নিরুপমা। মা, কী হয়েছে মা, অমন করে কাঁদছ কেন!
 
আশু। ( স্বগত) কী সর্বনাশ! আমাকে এঁরা সবাই কী মনে করবেন না-জানি! (প্রকাশ্যে) কিছুই হয় নি, আমি সমস্তই ঠিক করে দিচ্ছি। আপনারা কান্নাকাটি করবেন না। শুভকর্মে ওতে অমঙ্গল হয়। ( শ্যামার প্রতি) তা, আপনি একটা দিন স্থির করে দিন, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
 
শ্যামা। তা বাবা, যদি ভালো দিন হয়, তা হলে তুমি যা বলেছিলে আসছে রবিবারেই হয়ে যাক। আমার আয়োজনে কাজ নেই। এই কটা দিন তোমার মত স্থির থাকলে বাঁচি।
 
আশু। অমন কথা বলবেন না, আমার মতের কখনো নড়চড় হয় না।
 
শ্যামা। আমার পা ছুঁয়ে তো তাই বলেওছিলে, কিন্তু দশ মিনিট না যেতেই এক পানপাত্রের কথা শুনেই তোমার মত বদলে গেল।
 
আশু। তা বটে। পানপাত্রটা আমি আদবে পছন্দ করি না—
 
শ্যামা। কেন বলো তো বাবা?
 
আশু। তা ঠিক বলতে পারছি নে— ঐ আমার কেমন— বোধ হয়, ওটা— কী জানেন, পানপাত্রটা যেন— কে জানে ও কথাটাই কেমন— হঠাৎ শুনলে কী যেন— তা, এই বাড়িটার নম্বর কী বলুন দেখি।
 
শ্যামা। ওঃ, তাই বুঝি ভাবছ? আমরা তোমাকে ভাঁড়াচ্ছি নে বাবা। আমরাই উনপঞ্চাশ নম্বরে ছিলুম, কাল এই বাইশ নম্বরে উঠে এসেছি। যদি মনে কোনো সন্দেহ থাকে, উনপঞ্চাশ নম্বরে বরঞ্চ একবার খোঁজ করে আসতে পারো।
 
আশু। ( স্বগত) উঃ, কী ভুলই করেছি! যা হোক, এখন একটা পরিত্রাণের রাস্তা পাওয়া গেছে। অন্নদাকে এনে দিলেই সমস্ত গোল মিটে যাবে। যা হোক, অন্নদার অদৃষ্ট ভালো। এক-একবার মনে হচ্ছে, ভুলটা শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না।
 
শ্যামা। কী বাবা? এত ভাবছ কেন? আমরা ভদ্রঘরের মেয়ে, তোমাকে ঠকাবার জন্যে পশ্চিম থেকে এখেনে আসি নি।
 
আশু। ও কথা বলবেন না, আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমি যাচ্ছি, এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব, আজকের দিনের মধ্যেই একটা সন্তোষজনক বন্দোবস্ত করবই— এ আমি আপনার পা ছুঁয়ে শপথ করে যাচ্ছি।
 
শ্যামা। বাবা, ও শপথে কাজ নেই— পা ছুঁয়ে আরো একবার শপথ করেছিলে—
 
আশু। আচ্ছা, আমি আমার ইষ্টদেবতার শপথ করে যাচ্ছি, আজকের মধ্যেই সমস্ত পাকা করে তবে অন্য কথা।
 
শ্যামা। ( স্বগত) ছেলেটি কথাবার্তায় বেশ, কিন্তু ওকে কিছুই বুঝবার জো নেই। কখনো-বা তাড়া দেয়, কখনো-বা ঢিল দেয়, অথচ মুখ দেখে ওর প্রতি অবিশ্বাসও হয় না।
 
আশু। তবে অনুমতি করেন তো এখন আসি।
 
শ্যামা। তা, এসো বাবা।
 
 
৪৮২ নং লাইন:
</center>
 
অন্নদা। ব্যাপারখানা তো কিছুই বুঝতে পারলেম না। ঘটকের কথা শুনে এলেম কন্যা দেখতে। যিনি দেখা দিলেন, তাঁকে তো বয়স দেখে কোনোমতেই কন্যার মা বলে মনে হয় না, চেহারা দেখে বোধ হল অপ্সরী-যদিচ অপ্সরীর চেহারা কিরকম পূর্বে কখনো দেখি নি। শেক্‌হ্যাণ্ড করতে যেমনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছি অমনি ফস্‌ করে আমার হাতে কড়ি-বাঁধা একগাছি লাল সুতো বেঁধে দিলে। আর-কেউ হলে গোলমাল করতেম; কিন্তু যে সুন্দর চেহারা, গোলমাল করবার জো কী! কিন্তু, এ-সমস্ত কোন্‌দেশী দস্তুর তা তো বুঝতে পারছি নে।
 
 
মাতাজির প্রবেশ
 
 
মাতাজি। ( স্বগত) অনেক সন্ধান করে তবে পেয়েছি। আগে আমার গুরুদত্ত বশীকরণ-মন্ত্রটা খাটাই, তার পরে পরিচয় দেব। ( অন্নদার কপালে নরকপাল ঠেকাইয়া) বলো, হুর্‌লিং।
 
অন্নদা। হুর্‌লিং।
 
মাতাজি। ( অন্নদার গলায় জবার মালা পরাইয়া) বলো, কুড়বং কড়বং ক্‌ড়াং।
 
অন্নদা। ( স্বগত) ছি ছি! ভারি হাস্যকর হয়ে উঠছে। একে আমার কোটের উপর জবার মালা, তার উপরে আবার এই অদ্ভূত শব্দগুলো উচ্চারণ!
 
মাতাজি। চুপ করে রইলে যে?
 
অন্নদা। বলছি। কী বলছিলেন বলুন।
 
মাতাজি। কুড়বং কড়বং ক্‌ড়াং।
 
অন্নদা। কুড়বং কড়বং ক্‌ড়াং। ( স্বগত) রিডিক্লাস!
 
মাতাজি। মাথাটা নিচু করো। কপালে সিঁদুর দিতে হবে।
 
অন্নদা। সিঁদুর! সিঁদুর কি এই বেশে আমাকে ঠিক মানাবে?
 
মাতাজি। তা জানি নে, কিন্তু ওটা দিতে হবে।
 
 
অন্নদার কপালে সিঁদুর-লেপন
 
 
অন্নদা। ইস! সমস্ত কপালে যে একেবারে লেপে দিলেন!
 
মাতাজি। বলো বজ্রযোগিন্যৈ নমঃ। ( অন্নদার অনুরূপ আবৃত্তি) প্রণাম করো। (অন্নদাকর্তৃক তথাকৃত) বলো কুড়বে কড়বে নমঃ। প্রণাম করো। বলো হুর্‌লিঙে ঘুর্‌লিঙে নমঃ। প্রণাম করো।
 
অন্নদা। ( স্বগত) প্রহসনটা ক্রমেই জমে উঠছে।
 
মাতাজি। এইবার মাতা বজ্রযোগিনীর এই প্রসাদী বস্ত্রখণ্ডও মাথায় বাঁধো।
 
অন্নদা। ( স্বগত) এই শালুর টুকরোটা মাথায় বাঁধতে হবে! ক্রমেই যে বাড়াবাড়ি হতে চলল। ( প্রকাশ্যে) দেখুন, এর চেয়ে বরঞ্চ আমি পাগড়ি পরতেও রাজি আছি, এমন-কি, বাঙলিবাবুরা যে টুপি পরে তাও পরতে পারি—
 
মাতাজি। সে-সমস্ত পরে হবে, আপাতত এইটে জড়িয়ে দিই।
 
অন্নদা। দিন।
 
মাতাজি। এইবারে এই পিঁড়িটাতে বসুন।
 
অন্নদা। ( স্বগত) মুশকিলে ফেললে। আমি আবার ট্রাউজার পরে এসেছি! যাই হোক, কোনোমতে বসতেই হবে।
 
 
উপবেশন
 
 
মাতাজি। চোখ বোজো। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। প্রণাম করো। ( অন্নদার তথাকরণ) কিছু দেখতে পাচ্ছ?
 
অন্নদা। কিচ্ছু না।
 
মাতাজি। আচ্ছা, তা হলে পুবমুখো হয়ে বোসো, ডান কানে হাত দাও। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। প্রণাম করো। এবার কিছু দেখতে পাচ্ছ?
 
অন্নদা। কিছুই না।
 
মাতাজি। আচ্ছা, তা হলে পিছন ফিরে বোসো। দুই কানে দুই হাত দাও। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। কিছু দেখতে পাচ্ছ?
 
অন্নদা। কী দেখতে পাওয়া উচিত, আগে আমাকে বলুন।
 
মাতাজি। একটা গর্দভ দেখতে পাচ্ছ তো?
 
অন্নদা। পাচ্ছি বৈকি! অত্যন্ত নিকটেই দেখতে পাচ্ছি।
 
মাতাজি। তবে মন্ত্র ফলেছে। তার পিঠের উপরে—
 
অন্নদা। হাঁ হাঁ, তার পিঠের উপরে একজনকে দেখতে পাচ্ছি বৈকি।
 
মাতাজি। গর্দভের দুই কান হাতে চেপে ধরে—
 
অন্নদা। ঠিক বলেছেন, কষে চেপে ধরেছে—
 
মাতাজি। একটি সুন্দরী কন্যা—
 
অন্নদা। পরমা সুন্দরী—
 
মাতাজি। ঈশানকোণের দিকে চলেছেন—
 
অন্নদা। দিক্‌ভ্রম হয়ে গেছে, কোন্‌ কোণে যাচ্ছেন তা ঠিক বলতে পারছি নে। কিছু ছুটিয়ে চলেছেন বটে! গাধাটার হাঁফ ধরে গেল।
 
মাতাজি। ছুটিয়ে যাচ্ছেন না কি? তবে তো আর-একবার—
 
অন্নদা। না না, ছুটিয়ে যাবেন কেন— কিরকম যাওয়াটা আপনি স্থির করছেন বলুন দেখি।
 
মাতাজি। একবার এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার পিছু হটে পিছিয়ে আসছেন।
 
অন্নদা। ঠিক তাই। এগোচ্ছেন আর পিছোচ্ছেন। গাধাটার জিভ বেরিয়ে পড়েছে।
 
মাতাজি। তা হলে ঠিক হয়েছে। এবার সময় হল। ওলো মাতঙ্গিনী, তোরা সবাই আয়।
 
 
হুলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে স্ত্রীদলের প্রবেশ
 
অন্নদার বামে মাতাজির উপবেশন ও তাহার হস্তে হস্তস্থাপন
 
 
অন্নদা। এটা বেশ লাগছে। কিন্তু ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারছি নে।
 
<center>
৫৯০ নং লাইন:
<poem>
এবার সখী, সোনার মৃগ
 
দেয় বুঝি দেয় ধরা।
 
আয় গো তোরা পুরাঙ্গনা,
 
আয় সবে আয় ত্বরা।
 
ছুটেছিল পিয়াস-ভরে
 
মরীচিকা-বারির তরে,
 
ধ'রে তারে কোমল করে
 
কঠিন ফাঁসি পরা।
 
দয়ামায়া করিস নে গো,
 
ওদের নয় সে ধারা।
 
দয়ার দোহাই মানবে না গো
 
একটু পেলেই ছাড়া।
 
বাঁধন-কাটা বন্যটাকে
 
মায়ার ফাঁদে ফেলাও পাকে,
 
ভুলাও তাকে বাঁশির ডাকে
 
বুদ্ধি-বিচার-হরা।।
৬২৬ নং লাইন:
অন্নদা। বুদ্ধি-বিচার একেবারেই যায় নি। অতি সামান্যই বাকি আছে। তার থেকে মনে হচ্ছে, ঐ-যে যাকে জন্তু-জানোয়ার বলা হল সে সৌভাগ্যশালী আমি ছাড়া, উপস্থিত ক্ষেত্রে, আর কেউ হতেই পারে না। গানটি ভালো, সুরটিও বেশ, কন্ঠস্বরেরও নিন্দা করা যায় না, কিন্তু রূপক ভেঙে সাদা ভাষায় একটু স্পষ্ট করে সবটা খুলে বলুন দেখি— আমার সম্বন্ধে আপনারা কী করতে চান? পালাব এমন আশঙ্কা করবেন না, আপনারা তাড়া দিলেও নয়। কিন্তু কোথায় এলুম, কেন এলুম, কোথায় যাব, এ-সকল গুরুতর প্রশ্ন মানবমনে স্বভাবতই উদয় হয়ে থাকে।
 
মাতাজি। তোমার স্ত্রীকে কি মাঝে মাঝে স্মরণ কর?
 
অন্নদা। করে লাভ কী, কেবল সময় নষ্ট। তাঁকে স্মরণ করে যেটুকু সুখ আপনাদের দর্শন করে তার চেয়ে ঢের বেশি আনন্দ।
 
মাতাজি। তোমার স্ত্রী যদি তোমাকে স্মরণ করে সময় নষ্ট করেন?
 
অন্নদা। তা হলে তাঁর প্রতি আমার উপদেশ এই যে, আর অধিক নষ্ট করা উচিত হয় না; হয় বিস্মরণ করতে আরম্ভ করুন নয় দর্শন দিন— সময়টা মূল্যবান জিনিস।
 
মাতাজি। সেই উপদেশই শিরোধার্য। আমিই তোমার সেবিকা শ্রীমতী মহীমোহিনী দেবী
 
অন্নদা। বাঁচালে! মনে যেরকম ভাবোদ্রেক করেছিলে, নিজের স্ত্রী না হলে গলায় দড়ি দিতে হত। কিন্তু নিজের স্বামীর জন্য এ-সমস্ত ব্যাপার কেন?
 
মাতাজি। গুরুর কাছে যে বশীকরণ-মন্ত্র শিখেছিলেম আগে সেইটে প্রয়োগ করে তবে আত্মপরিচয় দিলেম, এখন আর তোমর
 
নিস্কৃতি নেই।
অন্নদা। আর-কারও উপর এ মন্ত্রের পরীক্ষা করা হয়েছে?
 
মাতাজি। না, তোমার জন্যই এতদিন এ মন্ত্র ধারণ করে রেখেছিলেম। আজ এর আশ্চর্য প্রত্যক্ষ ফল পেয়ে গুরুর চরণে মনে মনে শতবার প্রমাণ করছি। অব্যর্থ মন্ত্র। মন্ত্রে তোমার কি বিশ্বাস হল না?
 
অন্নদা। বশীকরণের কথা অস্বীকার করতে পারি নে। এখন তোমাকে একবার এই মন্ত্রগুলো পড়িয়ে নিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হই।
 
 
দাসীকর্তৃক সম্মুখে আহার্য-স্থাপন
 
 
অন্নদা। এও বশীকরণের অঙ্গ। বন্যমৃগই হোক আর শহুরে গাধাই হোক পোষ মানাবার পক্ষে এটা খুব দরকারি।
 
 
আহারে প্রবৃত্ত
 
আশুর দ্রুত প্রবেশ
 
[মাতাজি প্রভৃতির প্রস্থান
 
 
আশু। ওহে অন্নদা, ভারি গোলমাল বেধে গেছে। বাঃ, তুমি যে দিব্যি আহার করতে বসেছে! তোমার এ কী রকমের সাজ! (উচ্চহাস্য) ব্যাপারখানা কী? নরমুণ্ড, খাঁড়া, বাতি, জবার মালা! তোমার বলিদান হবে নাকি?
 
অন্নদা। হয়ে গেছে।
 
আশু। হয়ে গেছে কী রকম?
 
অন্নদা। সে-সকল ব্যাখ্যা পরে করব। তোমার খবরটা আগে বলো।
 
আশু। তুমি বিবাহের জন্য যে কন্যাটিকে দেখবে বলে স্থির করেছিলে, তাঁরা হঠাৎ উনপঞ্চাশ নম্বর থেকে বাইশ নম্বরে উঠে গেছেন। আমি কন্যার বিধবা মাকে মাতাজি মনে করে বারবার এমন নির্বোধের মতো কথাবার্তা কয়ে গেছি যে, তাঁরা ঠিক করে নিয়েছেন, আমি মেয়েটিকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছি। এখন তুমি না গেলে তো আর উদ্ধার নেই।
 
অন্নদা। মেয়েটি দেখতে কেমন?
 
আশু। দেবকন্যার মতো।
 
অন্নদা। তা হোক, বহুবিবাহ আমার মতবিরুদ্ধ।
 
আশু। বল কী! সেদিন এত তর্ক করলে—
 
অন্নদা। সেদিনকার চেয়ে ঢের ভালো যুক্তি আজ পাওয়া গেছে—
 
আশু। একেবারে অখণ্ডনীয়?
 
অন্নদা। অখণ্ডনীয়।
 
আশু। যুক্তিটা কিরকম দেখা যাক।
 
অন্নদা। তবে একটু বোসো। ( প্রস্থান ও মাতাজিকে লইয়া প্রবেশ) ইনি আমার স্ত্রী শ্রীমতী মহীমোহিনী দেবী।
 
আশু। অ্যাঁ! ইনি তোমার— আপনি আমাদের অন্নদার— কী আশ্চর্য! তা হলে তো হতে পারে না!
 
অন্নদা। হতে পারে না কী বলছ? হয়েছে, আবার হতে পারে না কী? একবার হয়েছে, এই আবার দুবার হল. তুমি বলছ হতে পারে না!
 
আশু। না, আমি তা বলছি নে। আমি বলছি, সেই বাইশ নম্বরের কী করা যায়!
 
অন্নদা। সে আর শক্ত কী! সহজ উপায় আছে।
 
আশু। কী বলো দেখি।
 
অন্নদা। বিয়ে করে ফেলো।
 
আশু। সমস্ত বিসর্জন দেব— আমার হঠযোগ, প্রাণায়াম, মন্ত্রসাধন—
 
অন্নদা। ভয় কী, তুমি যেগুলো ছাড়বে আমি সেগুলো গ্রহণ করব। সে যাই হোক, তোমার বশীকরণটা কিরকম হল?
 
আশু। তা, নিতান্ত কম হয় নি। তোমার এই একটা ঠাট্টা করবার বিষয় হল।
 
অন্নদা। আর ঠাট্টা চলবে না।
 
আশু। কেন বলো দেখি।
 
অন্নদা। আমারও বশীকরণ হয়ে গেছে।