শেষ সপ্তক/বিয়াল্লিশ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rp
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rp
১ নং লাইন:
{{header
|title= [[শেষ সপ্তক]]
|section = তেতাল্লিশ. [[পঁচিশে বৈশাখ চলেছে]]
|section = বিয়াল্লিশ. [[তুমি গল্প জমাতে পার]]
|previous = বিয়াল্লিশ. [[তুমি গল্প জমাতে পার]]
|previous = একচল্লিশ. [[হালকা আমার স্বভাব]]
|next = চুয়াল্লিশ. [[আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি]]
|next = তেতাল্লিশ. [[পঁচিশে বৈশাখ চলেছে]]
|notes =
|author =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১২ নং লাইন:
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
<poem>
শ্রীমান অমিয়চন্দ্র চক্রবতী কল্যাণীয়েষু
শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত প্রিয়বরেষু
 
 
পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
তুমি গল্প জমাতে পার।
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
বসো তোমার কেদারায়,
মৃত্যুদিনের দিকে।
ধীরে ধীরে টান দাও গুড়গুড়িতে,
সেই চলতি আসনের উপর বসে
উছলে ওঠে আলাপ
কোন্‌ কারিগর গাঁথছে
তোমার ভিতর থেকে
ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়
হালকা ভাষায়,
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।
যেন নিরাসক্ত ঔৎসুক্যে,
রথে চড়ে চলেছে কাল;
তোমার কৌতুকে-ফেনিল মনের
পদাতিক পথিক চলতে চলতে
কৌতূহলের উৎস থেকে।
পাত্র তুলে ধরে,
ঘুরেছ নানা জায়গায়, নানা কাজে,
পায় কিছু পানীয়;--
আপন দেশে, অন্য দেশে।
পান সারা হলে
মনটা মেলে রেখেছিলে চারদিকে,
পিছিয়ে পড়ে অন্ধকারে;
চোখটা ছিলে খুলে।
চাকার তলায়
মানুষের যে-পরিচয়
ভাঙা পাত্র ধুলায় যায় গুঁড়িয়ে।
তার আপন সহজভাবে,
তার পিছনে পিছনে
যেমন-তেমন অখ্যাত ব্যাপারের ধারায়
নতুন পাত্র নিয়ে যে আসে ছুটে,
দিনে দিনে যা গাঁথা হয়ে ওঠে,
পায় নতুন রস,
সামান্য হলেও যাতে আছে
একই তার নাম,
সত্যের ছাপ,
কিন্তু সে বুঝি আর-একজন।
অকিঞ্চিৎকর হলেও যার আছে বিশেষত্ব,
একদিন ছিলেম বালক।
সেটা এড়ায়নি তোমার দৃষ্টি।
কয়েকটি জন্মদিনের ছাঁদের মধ্যে
সেইটে দেখাই সহজ নয়,
সেই যে-লোকটার মূর্তি হয়েছিল গড়া
পণ্ডিতের দেখা সহজ।
তোমরা তাকে কেউ জান না।
শুনেছি তোমার পাঠ ছিল সায়ান্সে,
সে সত্য ছিল যাদের জানার মধ্যে
শুনেছি শাস্ত্রও পড়েছ সংস্কৃত ভাষায়;
কেউ নেই তারা।
পার্সি জবানিও জানা আছে।
সেই বালক না আছে আপন স্বরূপে
গিয়েছ সমুদ্রপারে,
না আছে কারো স্মৃতিতে।
ভারতে রাজসরকারের
সে গেছে চলে তার ছোটো সংসারটাকে নিয়ে;
ইম্পীরিয়ল রথযাত্রার লম্বা দড়িতে
তার সেদিনকার কান্না-হাসির
"হেঁইয়ো' ব'লে দিতে হয়েছে টান।
প্রতিধ্বনি আসে না কোনো হাওয়ায়।
অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি
তার ভাঙা খেলনার টুকরোগুলোও
মগজে বোঝাই হয়েছে কম নয়,
দেখিনে ধুলোর 'পরে।
পুঁথির থেকেও কিছু,
সেদিন জীবনের ছোটো গবাক্ষের কাছে
মানুষের প্রাণযাত্রা থেকেও বিস্তর।
সে বসে থাকত বাইরের দিকে চেয়ে।
তবু সব-কিছু নিয়ে
তার বিশ্ব ছিল
তোমার যে পরিচয় মুখ্য
সেইটুকু ফাঁকের বেষ্টনীর মধ্যে।
সে তোমার আলাপ-পরিচয়ে।
তার অবোধ চোখ-মেলে চাওয়া
তুমি গল্প জমাতে পার।
ঠেকে যেত বাগানের পাঁচিলটাতে
তাই যখন-তখন দেখি,
সারি সারি নারকেল গাছে।
তোমার ঘরে মানুষ লেগেই আছে,
সন্ধ্যেবেলাটা রূপকথার রসে নিবিড়;
কেউ তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো
বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে
কেউ বয়সে বেশি।
বেড়া ছিল না উঁচু,
গল্প করতে গিয়ে মাস্টারি কর না,
মনটা এদিক থেকে ওদিকে
এই তোমার বাহাদুরি।
ডিঙিয়ে যেত অনায়াসেই।
তুমি মানুষকে জান, মানুষকে জানাও,
প্রদোষের আলো-আঁধারে
জীবলীলার মানুষকে।
বস্তুর সঙ্গে ছায়াগুলো ছিল জড়িয়ে,
একে নাম দিতে পারি সাহিত্য,--
দুইই ছিল একগোত্রের।
সব-কিছুর কাছে-থাকা।
সে-কয়দিনের জন্মদিন
তুমি জমা করেছ তোমার মনে
একটা দ্বীপ,
নানা লোকের সঙ্গ,
কিছুকাল ছিল আলোতে,
সেইটে দিতে পার সবাইকে
কাল-সমুদ্রের তলায় গেছে ডুবে।
অনায়াসে,--
ভাঁটার সময় কখনো কখনো
সেইটেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের তকমা পরিয়ে
দেখা যায় তার পাহাড়ের চূড়া,
পণ্ডিত-পেয়াদা সাজাও না
দেখা যায় প্রবালের রক্তিম তটরেখা।
থমকিয়ে দিতে ভালোমানুষকে।
পঁচিশে বৈশাখ তার পরে দেখা দিল
তোমার জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারটা
আর-এক কালান্তরে,
পূর্ণ আছে যথাস্থানেই।
ফাল্গুনের প্রত্যুষে
সেটা বৈঠকখানাকে কোণ-ঠেসা করে রাখেনি।
রঙিন আভার অস্পষ্টতায়।
যেখানে আসন পাত'
তরুণ যৌবনের বাউল
গল্পের ভোজে
সুর বেঁধে নিল আপন একতারাতে,
সেখানে ক্ষুধিতের পাতের থেকে ঠেকিয়ে রাখ
ডেকে বেড়াল
লাইব্রেরি ল্যাবরেটরিকে।
নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে
একটিমাত্র কারণ,--
অনির্দেশ্য বেদনার খ্যাপা সুরে।
মানুষের 'পরে আছে তোমার দরদ,--
সেই শুনে কোনো-কোনোদিন বা
যে-মানুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে
বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর আসন টলেছিল,
সুখদুঃখের দুর্গম পথে,
তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন
বাঁধা পড়ে নানা বন্ধনে
তাঁর কোনো কোনো দূতীকে
ইচ্ছায় অনিচ্ছায়,--
পলাশবনের রঙমাতাল ছায়াপথে
যে-মানুষ বাঁচে,
কাজ-ভোলানো সকাল-বিকালে।
যে-মানুষ মরে
তখন কানে কানে মৃদু গলায় তাদের কথা শুনেছি,
অদৃষ্টের গোলকধাঁদার পাকে।
কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি।
সে-মানুষ রাজাই হোক ভিখিরিই হোক
দেখেছি কালো চোখের পক্ষ্ণরেখায়
তার কথা শুনতে মানুষের অসীম আগ্রহ।
জলের আভাস;
তার কথা যে-লোক পারে বলতে সহজেই
দেখেছি কম্পিত অধরে নিমীলিত বাণীর
সে-ই পারে,
বেদনা;
অন্যে পারে না।
শুনেছি ক্বণিত কঙ্কণে
বিশেষ এই হাল-আমলে।
চঞ্চল আগ্রহের চকিত ঝংকার।
আজ মানুষের জানাশোনা
তারা রেখে গেছে আমার অজানিতে
তার দেখাশোনাকে
পঁচিশে বৈশাখের
দিয়েছে আপাদমস্তক ঢেকে।
প্রথম ঘুমভাঙা প্রভাতে
একটু ধাক্কা পেলে
নতুন ফোটা বেলফুলের মালা;
তার মুখে নানা কথা অনর্গল ছিটকে পড়ে--
ভোরের স্বপ্ন
নানা সমস্যা, নানা তর্ক,
তারি গন্ধে ছিল বিহ্বল।
একান্ত মানুষের আসল কথাটা
সেদিনকার জন্মদিনের কিশোর জগৎ
যায় খাটো হয়ে।
ছিল রূপকথার পাড়ার গায়ে-গায়েই,
আজ বিপুল হল সমস্যা,
জানা না-জানার সংশয়ে।
বিচিত্র হল তর্ক,
সেখানে রাজকন্যা আপন এলোচুলের আবরণে
দুর্ভেদ্য হল সংশয়,--
কখনো বা ছিল ঘুমিয়ে,
আজকের দিনে
কখনো বা জেগেছিল চমকে উঠে'
সেইজন্যেই এত করে বন্ধুকে খুঁজি,
সোনার কাঠির পরশ লেগে।
মানুষের সহজ বন্ধুকে
দিন গেল।
যে গল্প জমাতে পারে।
সেই বসন্তীরঙের পঁচিশে বৈশাখের
এ দুর্দিনে
রঙ-করা প্রাচীরগুলো
মাস্টারমশায়কেও অত্যন্ত দরকার।
পড়ল ভেঙে।
তাঁর জন্যে ক্লাস আছে
যে পথে বকুলবনের পাতার দোলনে
পাড়ায় পাড়ায়--
ছায়ায় লাগত কাঁপন,
প্রায়মারি, সেকেণ্ডারি।
হাওয়ায় জাগত মর্মর,
গল্পের মজলিস জোটে দৈবাৎ।
বিরহী কোকিলের
সমুদ্রের ওপারে
কুহুরবের মিনতিতে
একদিন ওরা গল্পের আসর খুলেছিল,
আতুর হত মধ্যাহ্ন,
তখন ছিল অবকাশ;
মৌমাছির ডানায় লাগত গুঞ্জন
ওরা ছেলেদের কাছে শুনিয়েছিল,
ফুলগন্ধের অদৃশ্য ইশারা বেয়ে,
রবিন্‌সন্‌ ক্রুসো,
সেই তৃণ-বিছানো বীথিকা
সকল বয়সের মানুষের কাছে
পৌঁছল এসে পাথরে-বাঁধানো রাজপথে।
ডন্‌ কুইক্‌সোট্‌।
সেদিনকার কিশোরক
দুরূহ ভাবনার আঁধি লাগল
সুর সেধেছিল যে-একতারায়
দিকে দিকে;
একে একে তাতে চড়িয়ে দিল
লেক্‌চারের বান ডেকে এল,
তারের পর নতুন তার।
জলে স্থলে কাদায় পাঁকে
সেদিন পঁচিশে বৈশাখ
গেল ঘুলিয়ে।
আমাকে আনল ডেকে
অগত্যা
বন্ধুর পথ দিয়ে
অধ্যাপকেরা জানিয়ে দিলে
তরঙ্গমন্দ্রিত জনসমুদ্রতীরে।
একেই বলে গল্প।
বেলা-অবেলায়
বন্ধু,
ধ্বনিতে ধ্বনিতে গেঁথে
দুঃখ জানাতে এলুম
জাল ফেলেছি মাঝদরিয়ায়;
তোমার বৈঠকে।
কোনো মন দিয়েছে ধরা,
আজকাল-এর ছাত্রেরা দেয়
ছিন্ন জালের ভিতর থেকে
আজকাল-এর দোহাই।
কেউ বা গেছে পালিয়ে।
আজকাল-এর মুখরতায়
কখনো দিন এসেছে ম্লান হয়ে,
তাদের অটুট বিশ্বাস।
সাধনায় এসেছে নৈরাশ্য,
হায় রে আজকাল
গ্লানিভারে নত হয়েছে মন।
কত ডুবে গেল কালের মহাপ্লাবনে
এমন সময়ে অবসাদের অপরাহ্নে
মোটাদামের মার্কা-মারা
অপ্রত্যাশিত পথে এসেছে
পসরা নিয়ে।
অমরাবতীর মর্ত্যপ্রতিমা;
যা চিরকাল-এর
সেবাকে তারা সুন্দর করে,
তা আজ যদি বা ঢাকা পড়ে
তপঃক্লান্তের জন্যে তারা
কাল উঠবে জেগে।
আনে সুধার পাত্র;
তখন মানুষ আবার বলবে খুশি হয়ে,--
ভয়কে তারা অপমানিত করে
গল্প বলো।
উল্লোল হাস্যের কলোচ্ছ্বাসে;
তারা জাগিয়ে তোলে দুঃসাহসের শিখা
ভস্মে-ঢাকা অঙ্গারের থেকে;
তারা আকাশবাণীকে ডেকে আনে
প্রকাশের তপস্যায়।
তারা আমার নিবে-আসা দীপে
জ্বালিয়ে গেছে শিখা,
শিথিল-হওয়া তারে
বেঁধে দিয়েছে সুর,
পঁচিশে বৈশাখকে
বরণমাল্য পরিয়েছে
আপন হাতে গেঁথে।
তাদের পরশমণির ছোঁওয়া
আজো আছে
আমার গানে আমার বাণীতে।
সেদিন জীবনের রণক্ষেত্রে
দিকে দিকে জেগে উঠল সংগ্রামের সংঘাত
গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে।
একতারা ফেলে দিয়ে
কখনো বা নিতে হল ভেরী।
খর মধ্যাহ্নের তাপে
ছুটতে হল
জয়পরাজয়ের আবর্তনের মধ্যে।
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা,
ক্ষত বক্ষে পড়েছে রক্তধারা।
নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ
আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে,
জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে
নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে।
বিদ্বেষে অনুরাগে
ঈর্ষায় মৈত্রীতে,
সংগীতে পরুষ কোলাহলে
আলোড়িত তপ্ত বাষ্পনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে
আমার জগৎ গিয়েছে তার কক্ষপথে।
এই দুর্গমে, এই বিরোধ-সংক্ষোভের মধ্যে
পঁচিশে বৈশাখের প্রৌঢ় প্রহরে
তোমরা এসেছ আমার কাছে।
জেনেছ কি,
আমার প্রকাশে
অনেক আছে অসমাপ্ত
অনেক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন
অনেক উপেক্ষিত?
অন্তরে বাহিরে
সেই ভালো মন্দ,
স্পষ্ট অস্পষ্ট,
খ্যাত অখ্যাত,
ব্যর্থ চরিতার্থের জটিল সম্মিশ্রণের মধ্য থেকে
যে আমার মূর্তি
তোমাদের শ্রদ্ধায়, তোমাদের ভালোবাসায়,
তোমাদের ক্ষমায়
আজ প্রতিফলিত,
আজ যার সামনে এনেছ তোমাদের মালা,
তাকেই আমার পঁচিশে বৈশাখের
শেষবেলাকার পরিচয় বলে
নিলেম স্বীকার করে,
আর রেখে গেলেম তোমাদের জন্যে
আমার আশীর্বাদ।
যাবার সময় এই মানসী মূর্তি
রইল তোমাদের চিত্তে,
কালের হাতে রইল বলে
করব না অহংকার।
তার পরে দাও আমাকে ছুটি
জীবনের কালো-সাদা সূত্রে গাঁথা
সকল পরিচয়ের অন্তরালে;
নির্জন নামহীন নিভৃতে;
নানা সুরের নানা তারের যন্ত্রে
সুর মিলিয়ে নিতে দাও
এক চরম সংগীতের গভীরতায়।
 
 
</poem>