লিপিকা/ঘোড়া: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Nazmus Sakib Rabbi (আলোচনা | অবদান)
"{{Header |title= ../ |section = '''ঘোড়া''' |previous =../বিদূষক/ |next =../কর্ত্তার ভূত/..." দিয়ে পাতা তৈরি
(কোনও পার্থক্য নেই)

০৬:০১, ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

টেমপ্লেট ত্রুটি: দয়া করে খালি প্যারামিটার অপসারণ করবেন না (শৈলীর নির্দেশিকা টেমপ্লেটের নথি দেখুন)।


ঘোড়া

সৃষ্টির কাজ প্রায় শেষ হয়ে যখন ছুটির ঘণ্টা বাজে বলে’, হেনকালে ব্রহ্মার মাথায় একটা ভাবোদয় হল।

ভাণ্ডারীকে ডেকে বললেন, “ওহে ভাণ্ডারী, আমার কারখানা ঘরে কিছু কিছু পঞ্চভূতের জোগাড় করে আন, আর একটা নতুন প্রাণী সৃষ্টি করব।”

ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বললে, “পিতামহ, আপনি যখন উৎসাহ করে’ হাতি গড়লেন, তিমি গড়লেন, অজগর সর্প গড়লেন, সিংহ-ব্যাঘ্র গড়লেন, তখন হিসাবের দিকে আদৌ খেয়াল করলেন না। যতগুলো ভারী আর কড়া জাতের ভূত ছিল সব প্রায় নিকাশ হয়ে এল। ক্ষিতি অপ্ তেজ তলায় এসে ঠেকেচে। থাকবার মধ্যে আছে মরুৎ-ব্যোম, তা’ সে যত চাই।”

চতুর্ম্মুখ কিছুক্ষণ ধরে চার জোড়া গোঁফে তা’ দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ভালো, ভাণ্ডারে যা আছে তাই নিয়ে এস, দেখা যাক্‌!” এবারে প্রাণীটিকে গড়বার বেলা ব্রহ্মা ক্ষিতি অপ্‌ তেজটাকে খুব হাতে রেখে খরচ করলেন। তাকে না দিলেন শিং, না দিলেন নখ; আর দাঁত যা দিলেন তা’তে চিবনো চলে, কামড়ানো চলে না। তেজের ভাণ্ড থেকে কিছু খরচ করলেন বটে, তাতে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো কোনো কাজে লাগ্‌বার মতো হল কিন্তু তার লড়াইয়ের সখ রইল না। এই প্রাণীটি হচ্ছে ঘোড়া। এ ডিম পাড়ে না তবু বাজারে তার ডিম নিয়ে একটা গুজব আছে, তাই এ’কে দ্বিজ বলা চলে।

আর যাই হোক্‌, সৃষ্টিকর্ত্তা এর গড়নের মধ্যে মরুৎ আর ব্যোম একেবারে ঠেসে দিলেন। ফল হল এই যে, এর মনটা প্রায় ষোলো-আনা গেল মুক্তির দিকে। এ হাওয়ার আগে ছুটতে চায়, অসীম আকাশকে পেরিয়ে যাবে বলে পণ করে বসে। অন্য সকল প্রাণী, কারণ উপস্থিত হলে, দৌড়য়; এ দৌড়য় বিনা কারণে; যেন তার নিজেই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। কিছু কাড়তে চায় না, কাউকে মারতে চায় না, কেবলই পালাতে চায়। পালাতে পালাতে একেবারে বূঁদ হয়ে যাবে, ঝিম্‌ হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পরে না হয়ে যাবে, এই তার মৎলব। জ্ঞানীরা বলেন, ধাতের মধ্যে মরুৎব্যোম যখন ক্ষিতি অপ্‌ তেজকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ওঠে তখন এই রকমই ঘটে।

ব্রহ্মা বড় খুসি হলেন। বাসার জন্যে তিনি অন্য জন্তুর কাউকে দিলেন বন, কাউকে দিলেন গুহা, কিন্তু এর দৌড় দেখ্‌তে ভালোবাসেন বলে এ’কে দিলেন খোলা মাঠ।

মাঠের ধারে থাকে মানুষ। কাড়াকুড়ি করে সে যা-কিছু জমায় সমস্তই মস্ত বোঝা হয়ে ওঠে। তাই যখন মাঠের মধ্যে ঘোড়াটাকে ছুটতে দেখে, মনে মনে ভাবে এটাকে কোন গতিকে বাঁধতে পারলে আমাদের হাট করার বড় সুবিধে।

ফাঁস লাগিয়ে ধরলে একদিন ঘোড়াটাকে। তার পিঠে দিলে জিন, মুখে দিলে কাঁটা-লাগাম। ঘাড়ে তার লাগায় চাবুক আর কাঁধে মারে জুতোর শেল। তা ছাড়া আছে দলামলা।

মাঠে ছেড়ে রাখ্‌লে হাতছাড়া হবে, তাই ঘোড়াটার চারিদিকে পাঁচিল তুলে দিলে। বাঘের ছিল বন, তার বনই রইল; সিংহের ছিল গুহা কেউ কাড়ল না। কিন্তু ঘোড়ার ছিল খোলা মাঠ, সে এসে ঠেকল আস্তাবলে। প্রাণীটাকে মরুৎব্যোম মুক্তির দিকে অত্যন্ত উসকে দিলে কিন্তু বন্ধন থেকে বাঁচাতে পারলে না।

যখন অসহ্য হল তখন ঘোড়া তার দেয়ালটার পরে লাথি চালাতে লাগল। তার পা যতটা জখম হল দেয়াল ততটা হল না; তবু, চুন বালি খসে’ দেয়ালের সৌন্দর্য নষ্ট হতে লাগ্‌ল।

এতে মানুষের মনে বড় রাগ হল। বললে, ‘একেই বলে অকৃতজ্ঞতা। দানাপানি খাওয়াই, মোটা মাইনের সইস আনিয়ে আট প্রহর ওর পিছনে খাড়া রাখি, তবু মন পাই নে।’

মন পাবার জন্যে সইসগুলো এমনি উঠেপড়ে ডাণ্ডা চালালে যে ওর আর লাথি চল্‌ল না। মানুষ তার পাড়াপড়শিকে ডেকে বললে, “আমার এই বাহনটির মতো এমন ভক্ত বাহন আর নেই।”

তারা তারিফ করে বল্‌লে, ‘তাইত, একেবারে জলের মতো ঠাণ্ডা! তোমারই ধর্ম্মের মতো ঠাণ্ডা!”

একে তো গোড়া থেকেই ওর উপযুক্ত দাঁত নেই, নখ নেই, শিঙ নেই, তার পরে দেয়ালে এবং তদভাবে শূন্যে লাথি ছোঁড়াও বন্ধ। তাই মনটাকে খোলসা করবার জন্যে আকাশে মাথা তুলে সে চিঁহি চিঁহি করতে লাগ্‌ল। তাতে মানুষের ঘুম ভেঙে যায় আর পাড়াপড়শিরাও ভাবে, আওয়াজটা তো ঠিক ভক্তি-গদ্‌গদ শোনাচ্ছে না। মুখ বন্ধ করবার অনেকরকম যন্ত্র বেরোল। কিন্তু, দম বন্ধ না করলে মুখ তো একেবারে বন্ধ হয় না। তাই চাপা আওয়াজ মুমূর্ষুর খাবির মত মাঝে মাঝে বেরতে থাকে।

একদিন সেই আওয়াজ গেল ব্রহ্মার কানে। তিনি ধ্যান ভেঙে একবার পৃথিবীর খোলা মাঠের দিকে তাকালেন। সেখানে ঘোড়ার চিহ্ন নেই।

পিতামহ যমকে ডেকে বললেন, “নিশ্চয় তোমারি কীর্ত্তি! আমার ঘোড়াটিকে নিয়েচ।”

যম বল্‌লেন “সৃষ্টিকর্ত্তা, আমাকেই তোমার যত সন্দেহ! একবার মানুষের পাড়ার দিকে তাকিয়ে দেখ!”

ব্রহ্মা দেখেন, অতি ছোট জায়গা, চারদিকে পাঁচিল তোলা; তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্ষীণস্বরে ঘোড়াটি চিঁহি চিঁহি করচে।

হৃদয় তার বিচলিত হল। মানুষকে বল্‌লেন, “আমার এই জীবকে যদি মুক্তি না দাও তবে বাঘের মত ওর নখ দন্ত বানিয়ে দেব, ও তোমার কোনো কাজে লাগ্‌বে না”

মানুষ বল্‌লে, “ছিছি তাতে হিংস্রতার বড় প্রশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু যাই বল, পিতামহ, তোমার এই প্রাণীটি মুক্তির যোগ্যই নয়। ওর হিতের জন্যেই অনেক খরচে আস্তাবল বানিয়েচি। খাসা আস্তাবল।”

ব্রহ্মা জেদ করে বললেন “ওকে ছেড়ে দিতেই হবে।”

মানুষ বললে, আচ্ছা ছেড়ে দেব। কিন্তু সাত দিনের মেয়াদে, তার পরে যদি বল তোমার মাঠের চেয়ে আমার আস্তাবল ওর পক্ষে ভাল নয় তাহলে নাকে খৎ দিতে রাজি আছি।”

মানুষ করলে কি, ঘোড়াটাকে মাঠে দিলে ছেড়ে; কিন্তু তার সামনের দুটো পায়ে কসে রসি বাঁধ্‌ল। তখন ঘোড়া এমনি চল্‌তে লাগল যে ব্যাঙের চাল তার চেয়ে সুন্দর।

ব্রহ্মা থাকেন সুদূর স্বর্গে; তিনি ঘোড়াটার চাল দেখ্‌তে পান, তার হাঁটুর বাধন দেখ্‌তে পান না। তিনি নিজের কীর্ত্তির এই ভাঁড়ের মত চালচলন দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। বল্‌লেন “ভুল করেচি ত!”

মানুষ হাত জোড় করে বললে, “এখন এটাকে নিয়ে করি কি? আপনার ব্রহ্মলোকে যদি মাঠ থাকে ত বরঞ্চ সেইখানে রওনা করে দিই।”

ব্রহ্মা ব্যাকুল হয়ে বল্‌লেন, “যাও, যাও, ফিরে নিয়ে যাও তোমার আস্তাবলে!”

মানুষ বল্‌লে, “আদিদেব, মানুষের পক্ষে এ যে এক বিষম বোঝা!”

ব্রহ্মা বল্‌লেন, “সেই ত মানুষের মনুষ্যত্ব।