পালামৌ/দ্বিতীয় প্রবন্ধ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Faisal Hasan (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
Faisal Hasan (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
৯ নং লাইন:
<poem>
সেকালের হরকরা নামক ইংরেজি পত্রিকায় দেখিতাম, কোনো একজন মিলিটারি সাহেব 'পেরেড বৃত্তান্ত', 'ব্যান্ডের' বাদ্যচর্চা প্রভৃতি নানা কথা পালামৌ হইতে লিখিতেন। আমি তখন ভাবিতাম পালামৌ প্রবল শহর, সাহেবসমাকীর্ণ সুখের স্থান। তখন জানিতাম না যে পালামৌ শহর নহে, একটি প্রকান্ড পরগনামাত্র। শহর সে অঞ্চলেই নাই, নগর দূরে থাকুক, তথায় একখানি গন্ডগ্রামও নাই, কেবল পাহাড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
 
পাহাড় আর জঙ্গল বলিলে কে কী অনুভব করেন বলিতে পারি না। যাঁহারা 'কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারকৃত' পাহাড় দেখিয়াছেন, আর যাঁহাদের গৃহপ্বার্শে শৃগালশ্রান্তি সংবাহক ভাটভেরান্ডার জঙ্গল আছে, তাঁহারা যে এ-কথা সমগ্র অনুভব করিয়া লইবেন, ইহার আর সন্দেহ নাই। কিন্তু অন্য পাঠকের জন্য সেই পাহাড় জঙ্গলের কথা কিঞ্চিৎ উত্থাপন করা আবশ্যক হইয়াছে। সকলের অনুভবশক্তি তো সমান নহে।
রাঁচি হইতে পালামৌ যাইতে যাইতে যখন যখন বাহকগণের নির্দেশনামতো দূর হইতে পালামৌ দেখিতে পাইলাম, তখন আমার বোধ হইল যেন মর্তে মেঘ করিয়াছে। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া সেই মনোহর দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম। ঐ অন্ধকার মেঘমধ্যে এখনই যাইব এই মনে করিয়া আমার কতই আহ্লাদ হইতে লাগিল। কতক্ষণে পৌঁছিব মনে করিয়া আবার কতই ব্যস্ত হইলাম।
পরে চারি-পাঁচ ক্রোশ অগ্রসর হইয়া আবার পালামৌ দেখিবার নিমিত্ত পালকি হইতে অবতরণ করিলাম। তখন আর মেঘভ্রম হইলো না, পাহাড়গুলি স্পষ্ট চেনা যাইতে লাগিল; কিন্তু জঙ্গল ভালো চেনা গেল না। তাহার পরে আরও দুই-এক ক্রোশ অগ্রসর হইলে, তাম্রাভ অরণ্য চারিদিকে দেখা যাইতে লাগিল; কি পাহাড়, কি তলস্থ স্থান সমুদয় যেন মেঘদেহের ন্যায় কুঞ্চিত লোমরাজি দ্বারা সর্বত্র সমাচ্ছাদিত বোধ হইতে লাগিল। শেষ আরও কতদূর গেলে বন স্পষ্ট দেখা গেল। পাহাড়ের গায়ে, নিম্নে সর্বত্র জঙ্গল, কোথাও আর ছেদ নাই। কোথাও কর্ষিত ক্ষেত্র নাই, গ্রাম নাই, নদী নাই, পথ নাই, কেবল বন— ঘন নিবিড় বন।
 
পরে পালামৌ প্রবেশ করিয়া দেখিলাম নদী, গ্রাম সকলই আছে, দূর হইতে তাহা কিছুই দেখা যায় নাই। পালামৌ পরগণায় অসংখ্য পাহাড়, পাহাড়ের পর পাহাড়, তাহার পর পাহাড়, আবার পাহাড়; যেন বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ। আবার বোধহয় যেন অবনীর অন্তরাগ্নি একদিনেই সেই তরঙ্গ তুলিয়াছিল। এখন আমার ঠিক স্মরণ হয় না, কিন্তু বোধহয় যেন দেখিয়াছিলাম সকল তরঙ্গগুলি পূর্বদিক হইতে উঠিয়াছিল, কোনো কোনোটি পূর্বদিক হইতে উঠিয়া পশ্চিমদিকে নামে নাই। এইরূপ অর্ধপাহাড় লাতেহার গ্রামপ্বার্শে একটি আছে, আমি প্রায় নিত্য তথায় গিয়া বসিয়া থাকিতাম। এই পাহাড়ের পশ্চিমভাগে মৃত্তিকা নাই, সুতরাং তাহার অন্তরস্থ সকল স্তর দেখা যায়; এক স্তরে নুড়ি, আর এক স্তরে কালো পাথর, ইত্যাদি। কিন্তু কোনো স্তরই সমসূত্র নহে, প্রত্যেকটি কোথাও উঠিয়াছে, কোথাও নামিয়াছে। আমি তাহা পূর্বে লক্ষ করি নাই, লক্ষ করিবার কারণ পরে ঘটিয়াছিল। একদিন অপরাহ্নে এই পাহাড়ের মূলে দাঁড়াইয়া আছি, এমত সময় আমার একটা নেমকহারাম ফরাসিস কুক্কুর (poodle) আপন ইচ্ছামতো তাঁবুতে চলিয়া গেল, আমি রাগত হইয়া চিৎকার করিয়া তাহাকে ডাকিলাম। আমার পশ্চাতে সেই চিৎকার অত্যাশ্চর্যরূপে প্রতিধ্বনিত হইল। পশ্চাৎ পাহাড়ের প্রতি চাহিয়া আবার চিৎকার করিলাম, প্রতিধ্বনি আবার পূর্বমতো হ্রস্ব-দীর্ঘ হইতে হইতে পাহাড়ের অপর প্রান্তে চলিয়া গেল। আবার চিৎকার করিলাম, শব্দ পূর্ববৎ পাহাড়ের গায়ে লাগিয়া উচ্চ-নিচ হইতে লাগিল। এইবার বুঝিলাম শব্দ কোনো একটি বিশেষ স্তর অবলম্বন করিয়া যায়। সেই স্তর যেখানে উঠিয়াছে বা নামিয়াছে শব্দও সেইখানে উঠিতে নামিতে থাকে। কিন্তু শব্দ দীর্ঘকাল কেন স্থায়ী হয়, যতদূর পর্যন্ত সেই স্তরটি আছে, ততদূর পর্যন্ত কেন যায়, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; ঠিক যেন সেই স্তরটি শব্দ কনডকটার (conductor); যে পর্যন্ত ননকনডকটরের সঙ্গে সংস্পর্শ না হয়, সে পর্যন্ত শব্দ ছুটিতে থাকে।
 
আর একটি পাহাড় দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছিলাম। সেটি একশিলা, সমুদয়ে একখানি প্রস্তর। তাহাতে একেবারে কোথাও কণামাত্র মৃত্তিকা নাই, সমুদয় পরিষ্কার ঝরঝর করিতেছে। তাহার একস্থান অনেক দূর পর্যন্ত ফাটিয়া গিয়াছে, সেই ফাটার ওপর বৃহৎ এক অশ্বত্থগাছ জন্মিয়াছে। তখন মনে হইয়াছিল, অশ্বত্থবৃক্ষ বড় রসিক,এই নীরস পাষাণ হইতেও রসগ্রহণ করিতেছে। কিছুকাল পরে আর একদিন এই অশ্বত্থগাছ আমার মনে পড়িয়াছিল, তখন ভাবিয়াছিলাম বৃক্ষটি বড় শোষক, ইহার নিকট নীরস পাষাণেরও নিস্তার নাই। এখন বোধহয় অশ্বত্থগাছটি আপন অবস্থানুরূপ কার্য করিতেছে; সকল বৃক্ষই যে বাঙ্গালার রসপূর্ণ জন্মগ্রহণ করিয়া বিনাকষ্টে কাল যাপন করিবে, এমত সম্ভব নহে। যাহার ভাগ্যে কঠিন পাষাণ, পাষাণই তাহার অবলম্বন। এখন আমি অশ্বত্থটির প্রশংসা করি। এক্ষণে সে-সকল কথা যাউক, প্রথম দিনের কথা দুই-একটি বলি। অপরাহ্নে পালামৌয়ে প্রবেশ করিয়া উভয়পার্শ্বস্থ পর্বতশ্রেণী দেখিতে দেখিতে বনমধ্য দিয়া যাইতে লাগিলাম। বাঁধা পথ নাই, কেবল এক সংকীর্ণ গো-পথ দিয়া আমার পালকি চলিতে লাগিল, অনেক স্থলে উভয়প্বার্শস্থ লতা-পল্লব পালকি স্পর্শ করিতে লাগিল। বনবর্ণনায় যেরূও 'শাল তাল তমাল, হিন্তাল' শুনিয়াছিলাম, সেরূপ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তাল, হিন্তাল একেবারেই নাই; কেবল শালবন, অন্য বন্য গাছও আছে। শালের মধ্যে প্রকান্ড গাছ একটিও নাই, সকলগুলিই আমাদের দেশীয় কদম্ববৃক্ষের মতো, নাহয় কিছু বড়; কিন্তু তাহা হইলেও জঙ্গল অতি দুর্গম, কোথায়ও তাহার ছেদ নাই, এইজন্য ভয়ানক। মধ্যে মধ্যে যে ছেদ আছে, তাহা অতি সামান্য। এইরূপ বন দিয়া যাইতে যাইতে এক স্থানে হঠাৎ কাষ্ঠঘন্টার বিস্ময়কর শব্দ কর্ণগোচর হইল, কাষ্ঠঘন্টা পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে দেখিয়াছিলাম। গৃহপালিত পশু বনে পথ হারাইলে, শব্দানুসরণ করিয়া তাহাদের অনুসন্ধান করিতে হয়, এইজন্য গলঘন্টার উৎপত্তি। কাষ্ঠঘন্টার শব্দ শুনিলে প্রাণের ভিতর কেমন করে। পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে সে শব্দে আরও যেন অবসন্ন করে; কিন্তু সকলকে করে কি না, তাহা বলিতে পারি না।
 
পরে দেখিলাম, একটি মহিষ সভয়ে মুখ তুলিয়া আমার পালকির প্রতি একদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে, তাহার গলায় কাষ্ঠঘন্টা ঝুলিতেছে। আমি ভাবিলাম, পালিত মহিষ যখন নিকটে, তখন গ্রাম আর দূরে নহে। অল্প বিলম্বেই অর্ধশুষ্ক তৃণাবৃত একটি শুষ্ক প্রান্তর দেখা গেল, এখানে-সেখানে দুই-একটি মধু বা মৌয়াবৃক্ষ ভিন্ন সে-প্রান্তরে গুল্ম কি লতা কিছুই নাই, সর্বত্র অতি পরিষ্কার। পর্বতছায়ায় সে-প্রান্তর আরও রম্য হইয়াছে; তথায় কতকগুলি কোলবালক একত্র মহিষ চরাইতেছিল, সেরূপ কৃষ্ণবর্ণ কান্তি আর কখনো দেখি নাই; সকলের গলায় পুঁতির সাতনরী, ধুকধুকির পরিবর্তে এক-একখানি গোল আরশি; পরিধানে ধড়া, কর্ণে বনফুল; কেহ মহিষপৃষ্ঠে শয়ন করিয়া আছে, কেহ বা মহিষপৃষ্ঠে বসিয়া আছে, কেহ কেহ নৃত্য করিতেছে। সকলগুলিই যেন কৃষ্ণঠাকুর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। যেরূপ স্থান তাহাতে এই পাথুরে ছেলেগুলি উপযোগী বলিয়া বিশেষ সুন্দর দেখাইতেছিল; চারিদিকে কালো পাথর, পশুও পাথুরে; তাহাদের রাখালও সেইরূপ। এই স্থলে বলা আবশ্যক এ অঞ্চলে মহিষ ভিন্ন গোরু নাই। আর বালকগুলি কোলের সন্তান।
 
এই অঞ্চলে প্রধানত কোলের বাস। কোলেরা বন্য জাতি, খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ; দেখিতে কুৎসিত কি রূপবান তাহা আমি মীমাংসা করিতে পারি না! যে-সকল কোল কলিকাতা আইসে বা চা-বাগানে যায় তাহাদের মধ্যে আমি কাহাকেও রূপবান দেখি নাই; বরং অতি কুৎসিত বলিয়া বোধ করিয়াছি। কিন্তু স্বদেশে কোলমাত্রেই রূপবান, অন্তত আমার চক্ষে। বন্যেরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
প্রান্তরের পর এক ক্ষুদ্র গ্রাম, তাহার নাম স্মরণ নাই; তথায় ত্রিশ-বত্রিশটি গৃহস্থ বাস করে। সকলেরইও পর্ণকুটির। আমার পালকি দেখিতে যাবতীয় স্ত্রীলোক ছুটিয়া আসিল। সকলেই আবলুসের মতো কালো, সকলেই যুবতী, সকলেরই কটিদেশে একখানি করিয়া ক্ষুদ্র কাপড় জড়ানো; সকলেরই কক্ষ, বক্ষ আবরণশুণ্য। সেই নিরাবৃত বক্ষে পুঁতির সাতনরী, তাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরশি ঝুলিতেছে, কর্ণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনফুল, মাথায় বড় বড় বনফুল। যুবতীরা পরষ্পর কাঁধ ধরাধরি করিয়া দেখিতে লাগিল, কিন্তু দেখিল কেবল পালকি আর বেহারা। পালকির ভিতরে কে বা কী, তাহা কেহই দেখিল না। আমাদের বাঙ্গালায়ও দেখিয়াছি, পল্লিগ্রামে বালক-বালিকারা প্রায় পালকি আর বেহারা দেখিয়া ক্ষান্ত হয়। তবে যদি সঙ্গে বাদ্য থাকে, তাহা হইলে 'বরকনে' দেখিবার নিমিত্ত পালকির ভিতরে দৃষ্টিপাত করে। যিনি পালকি চড়েন, সুতরাং তিনি দুর্ভাগ্য, কিন্তু গ্রাম্য বালক-বালিকারাও অতি নিষ্ঠুর, অতি নির্দয়।
 
তাহার পর আবার কতদূর গিয়া দেখিলাম, পথশ্রান্তা যুবতীরা মদের ভাঁটিতে বসিয়া মদ্যপান করিতেছে। গ্রামমধ্যে যে-যুবতীদের দেখিয়া আসিয়াছি ইহারাও আকারে অলঙ্কারে অবিকল সেইরূপ, যেন তাহারাই আসিয়া বসিয়াছে। যুবতীরা উভয় জানুদ্বারা ভূমি স্পর্শ করিয়া দুই হস্তে শালপত্রের পাত্র ধরিয়া মদ্যপান করিতেছে, আর ঈষৎ হাস্যবদনে সঙ্গীদের দেখিতেছে। জানু স্পর্শ করিয়া উপবেশন করা কোলজাতির স্ত্রীলোকদিগের রীতি; বোধহয় যেন সাঁওতালদিগেরও এই রীতি দেখিয়াছি। বনের মধ্যে যেখানে-সেখানে মদের ভাঁটি দেখিলাম, কিন্তু বাঙ্গালায় ভাঁটিখানায় যেরূপ মাতাল দেখা যায়, পালামৌ পরগণায় কোন ভাঁটিখানায় তাহা দেখিলাম না। আমি পরে তাহাদের আহার-ব্যবহার সকলই দেখিতাম, কিছুই তাহারা আমার নিকট গোপন করিত না, কিন্তু কখনো স্ত্রীলোকদের মাতাল হইতে দেখি নাই, অথচ তাহারা পানকুণ্ঠ নহে। তাহাদের মদের মাদকতা নাই, এ-কথাও বলিতে পারি না। সেই মস পুরুষেরা খাইয়া সর্বদা মাতাল হইয়া থাকে।
 
পূর্বে কয়েকবার যুবতীদের কথাই বলিয়াছি, ইচ্ছাপূর্বক বলিইয়াছি এমন নহে। বাঙ্গালার পথঘাটে বৃদ্ধাই অধিক দেখা যায়, কিন্তু পালামৌ অঞ্চলে যুবতীই অধিক দেখা যায়। কোলের মধ্যে বৃদ্ধা অতি অল্প, তাহারা অধিকবয়সী হইলেও যুবতীই থাকে, অশীতিপরায়ণা না হইলে তাহারা লোলচর্মা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলিয়া গৃহকার্য কৃষিকার্য সকল কার্যই তাহারা করে। পুরুষেরা স্ত্রীলোকের ন্যায় কেবল বসিয়া সন্তান রক্ষা করে, কখনো কখনো চাটাই বুনে। আলস্য জন্য পুরুষেরা বঙ্গমহিলাদের ন্যায় শীঘ্র বৃদ্ধ হইয়া যায়; স্ত্রীলোকেরা শ্রমহেতু চিরযৌবনা থাকে। লোকে বলে পশুপক্ষীর মধ্যে পুরুষজাতিই বলিষ্ঠ ও সুন্দর; মনুষ্যমধ্যেও সেই নিয়ম। কিন্তু কোলদের দেখিলে তাহা বোধ হয় না, তাহাদের স্ত্রীজাতিরাই বলিষ্ঠা ও আশ্চর্য কান্তিবিশিষ্টা। কিন্তু তাহাদের বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষদের গায়ে খড়ি উঠিতেছে, চক্ষে মাছি উড়িতেছে, মুখে হাসি নাই, যেন সকলেরই জীবনীশক্তি কমিয়া আসিয়াছে। আমার বোধহয় কোলজাতির ক্ষয় ধরিয়াছে। ব্যক্তিবিশেষের জীবনীশক্তি যেরূপ কমিয়া যায়, জাতিবিশেষেরও জীবনীশক্তি সেইরূপ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ক্রমে ক্রমে লোপ পায়। মানুষের মৃত্যু আছে, জাতিরও লোপ আছে।
এই পরগনায় পর্বতে স্থানে স্থানে অসুরেরা বাস করে, আমি তাহাদের দেখি নাই, তাহারা কোলদের সহিত বা অন্য কোন বন্য জাতির সহিত বাস করে না। শুনিয়াছি, অন্য জাতীয় মনুষ্য দেখিলে তাহারা পলায়; পর্বতের অতি নিভৃত স্থানে থাকে বলিয়া তাহাদের অনুসন্ধান করা কঠিন। তাহাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প হইয়া পড়িয়াছে। পূর্বকালে যখন আর্যেরা প্রথমে ভারতবর্ষে আসেন, তখন অসুরগণ অতি প্রবল ও তাহাদের সংখ্যা অসীম ছিল। অসুরেরা আসিয়া আর্যগণের গোরু কাড়িয়া লইয়া যাইত, ঘৃত খাইয়া পলাইত, আর্যেরা নিরুপায় হইয়া কেবল ইন্দ্রকে ডাকিতেন, কখনো কখনো দলবল জুটাইয়া লাঠালাঠিও করিতেন। শেষে বহুকাল পরে যখন আর্যগণ উন্নত ও শক্তিসম্পন্ন হইলেন, তখন অসুরগণকে তাড়াইয়াছিলেন। পরাজিত অসুরগণ ভালো ভালো স্থান আর্যদের ছাড়িয়া দিয়া আপনারা দুর্গম পর্বতে গিয়া বাসস্থাপন করে। অদ্যাবধি সেই পাহাড় পর্বতে তাহারা আছে, কিন্তু আর তাহাদের বলবীর্য নাই; আর সে অসীম সংখ্যাও তাহাদের নাই। এক্ষণে যেরূপ অবস্থা, তাহাতে অসুরকুল ধ্বংস হইয়াছে বলিলেও অন্যায় হয় না; যে দশ-পাঁচ জন এখানে-সেখানে বাস করে, আর কিছুদিনের পর তাহারাও থাকিবে না।
 
জাতিলোপ মধ্যে মধ্যে হইয়া থাকে; অনেক আদিম জাতির লোপ হইয়া গিয়াছে, অদ্যাপি হইতেছে। জাতিলোপের হেতু দর্শনবিদদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন যে, পরাজিত জাতিরা বিজয়ী কর্তৃক বিতারিত হইয়া অতি অযোগ্য স্থানে গিয়া বাস করিলে, পূর্বস্থানে যে সকল সুবিধা ছিল, তাহার অভাবে ক্রমে তাহারা অবনত ও অবসন্ন হইয়া পড়ে। এ-কথা অনেক স্থলে সত্য, সন্দেহ নাই; অসুরগণের পক্ষে তাহাই খাটিয়াছিল বোধহয়। কিন্তু সাঁওতালেরাও একসময় আর্যগণ কর্তৃক বিতারিত হইয়া দামিনীকোতে পলায়ন করিয়াছিল। সেই অবধি অনেককাল তথায় বাস করে, অদ্যপি তথায় খাস সাঁওতালেরা বাস করিতেছে, পূর্বাপেক্ষা তাহাদের-যে কুলক্ষয় হইয়াছে এমত শুনা যায় না।
 
মারকিন ও অন্যান্য দেশে যেখানে সাহেবরা গিয়া রাজ্য স্থাপন করিয়াছেন, সেখানকার আদিবাসীরা ক্রমে ক্রমে লোপ পাইতেছে, তাহার কারণ কিছুই অনুভব হয় না। রেড ইন্ডিয়ান, নাটিক ইন্ডিয়ান, নিউজিলান্ডার, তাস্মানীয় প্রভৃতি কত জাতি লোপ পাইতেছে। মৌরি নামক আদিম জাতি বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান, কর্মঠ বলিয়া পরিচিত, তাহারাও সাহেবদের অধিকারে ক্রমে লোপ পাইতেছে। ১৮৪৮ সালে তাহাদের সংখ্যা এক লক্ষ ছিল, বিশ বৎসর পরে ৩৮ হাজার হইয়া গিয়াছিল, এক্ষণে সে জাতির অবস্থা কী তাহা জানি না। বোধহয় এতদিনে লোপ পাইয়া থাকিবে, অথবা যদি এতদিন থাকে, তবে অতি সামান্য অবস্থায় আছে। মৌরি দুর্বল নহে, তৎসম্বন্ধে একজন সাহেব লিখিয়াছেন :
'He is the noblest of savages, not equalled by the best of Red Indians.'