পালামৌ/তৃতীয় প্রবন্ধ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
fix using AWB
linked with scanned page
১ নং লাইন:
{{header
|title=[[পালামৌ../]]
|section = পালামৌ/'''তৃতীয় প্রবন্ধ'''
|previous = [[পালামৌ/দ্বিতীয় প্রবন্ধ|দ্বিতীয় প্রবন্ধ]]
|next =[[পালামৌ/চতুর্থ প্রবন্ধ|চতুর্থ প্রবন্ধ]]
|notes =
|categoriesauthor = সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়}}
|author =
|year =
|notes =
|portal =
|categories =পালামৌ}}
|categories =সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়}}
 
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
<div class="indented-page">
<poem>
<pages index="পালামৌ.djvu" from="28" fromsection= B28 to="35" tosection= A35/>
পূর্বে একবার 'লাতেহার' নামক পাহাড়ের উল্লেখ করিয়াছিলাম। সেই পাহাড়ের কথা আবার লিখিতে বসিয়াছি বলিয়া আমার আহলাদ হইতেছে। পুরাতন কথা বলিতে বড় সুখ, আবার বিশেষ সুখ এই যে আমি শ্রোতা পাইয়াছি। তিন-চারিটি নিরীহ ভদ্রলোক, বোধহয় তাঁহাদের বয়স হইয়া আসিতেছে, পুরাতন কথা বলিতে শীঘ্র আরম্ভ করিবেন এমন উমেদ রাখেন, বঙ্গদর্শনে আমার লিখিত পালামৌ পর্যটন পড়িয়াছেন; আবার ভালো বলিয়াছেন। প্রশংসা অতিরিক্ত; তুমি প্রশংসা কর আর না-কর, বৃদ্ধ বসিয়া তোমার পুরাতন কথা শুনিবে; তুমি শুন বা না-শুন সে তোমায় কথা শুনাবে। পুরাতন কথা এইরূপে থেকে যায়, সমাজের পুঁজি বাড়ে। আমার গল্পে কাহারো পুঁজি বাড়িবে না, কেননা আমার নিজের পুঁজি নাই। তথাপি গল্প করি, তোমরা শুনিয়া আমায় চিরবাধিত কর।
</poemdiv>
 
নিত্য অপরাহ্নে আমি লাতেহার পাহাড়ের কোলে গিয়া বসিতাম, তাঁবুতে শত কার্য থাকিলেও আমি তাহা ফেলিয়া যাইতাম। চারিটা বাজিলে আমি অস্থির হইতাম; কেন তাহা কখনো ভাবিতাম না; পাহাড়ে কিছুই নূতন নাই, কাহারো সহিত সাক্ষাৎ হইবে না, কোনো গল্প হইবে না, তথাপি কেন আমাকে সেখানে যাইতে হইত জানি না। এখন দেখি এ বেগ আমার একার নহে। যে সময় উঠানে ছায়া পড়ে, নিত্য সে সময় কুলবধূর মন মাতিয়া উঠে, জল আনিতে যাইবে; জল আছে বলিলেও তাহারা জল ফেলিয়া জল আনিতে যাইবে; জলে যে যাইতে পাইল না সে অভাগিনী। সে গৃহে বসিয়া দেখে উঠানে ছায়া পড়িতেছে, আকাশে ছায়া পড়িতেছে, পৃথিবীর রং ফিরিতেছে, বাহির হইয়া সে তাহা দেখিতে পাইল না, তাহার কত দুঃখ। বোধহয়, আমিও পৃথিবীর রং ফেরা দেখিতে যাইতাম। কিন্তু আর একটু আছে, সেই নির্জন স্থানে মনকে একা পাইতাম, বালকের ন্যায় মনের সহিত ক্রীড়া করিতাম। এই পাহাড়ের ক্রোড় অতি নির্জন, কোথাও ছোট জঙ্গল নাই, সর্বত্র ঘাস। অতি পরিষ্কার, তাহাও বাতাস আসিয়া নিত্য ঝাড়িয়া দেয়। মৌয়া গাছ তথায় বিস্তর। কতকগুলি একত্রে গলাগলি করিয়া বাস করে, আর কতকগুলি বিধবার ন্যায় এখানে সেখানে একাকী থাকে। তাহারই মধ্যে একটিকে আমি বড় ভালোবাসিতাম, তাহার নাম 'কুমারী' রাখিয়াছিলাম। তখন তাহার ফল কি ফুল হয় নাই; কিন্তু তাহার ছায়া বড় শীতল ছিল। আমি সেই ছায়ায় বসিয়া 'দুনিয়া' দেখিতাম। এই উচ্চ স্থানে বসিলে পাঁচ-সাত ক্রোশ পর্যন্ত দেখা যাইত। দূরে চারিদিকে পাহাড়ের পরিখা, যেন সেইখানে পৃথিবীর শেষ হইয়া গিয়াছে। সেই পরিখার নিম্নে গাঢ় ছায়া, অল্প অন্ধকার বলিলেও বলা যায়। তাহার পর জঙ্গল। জঙ্গল নামিয়া ক্রমে স্পষ্ট হইয়াছে। জঙ্গলের মধ্যে দুই-একটি গ্রাম হইতে ধীরে ধীরে ধূম উঠিতেছে, কোনো গ্রাম হইতে হয়ত বিষণ্ণভাবে মাদল বাজিতেছে, তাহার পরে আমার তাঁবু, যেন একটি শ্বেত কপোতী, জঙ্গলের মধ্যে একাকী বসিয়া কী ভাবিতেছে। আমি অন্যমনস্কে এই সকল দেখিতাম; আর ভাবিতাম এই আমার 'দুনিয়া'।
 
একদিন এই স্থানে সুখে বসিয়া চারিদিক দেখিতেছি, হঠাৎ একটি লতার উপর দৃষ্টি পড়িল; তাহার একটি ডালে অনেক দিনের পর চারি-পাঁচটি ফুল ফুটিয়াছিল। লতা আহ্লাদে তাহা গোপন করিতে পারে নাই, যেন কাহারে দেখাইবার জন্য ডালটি বাড়াইয়া দিয়াছিল; একটি কালো কালো বড় গোছের ভ্রমর তাহার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল; আর এক-একবার সেই লতায় বসিতেছিল। লতা তাহাতে নারাজ, ভ্রমর বসিলেই অস্থির হইয়া মাথা নাড়িয়া উঠে। লতাকে এইরূপ সচেতনের ন্যায় রঙ্গ করিতে দেখিয়া আমি হাসিতেছিলাম, এমত সময়ে আমার পশ্চাতে উচ্চারিত হইল :
<blockquote>'রাধে মন্যুং পরিহর হরিঃ পাদমূলে তবায়ম্।'</blockquote> আমি পশ্চাতে ফিরিলাম, দেখিলাম কেহই নাই, চারিদিক চাহিলাম কোথায়ও কেহ নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া ভাবিতেছি, এমত সময় আর-একদিকে শব্দিত হইল :
</blockquote>'রাধে মন্যুং' ইত্যাদি।'</blockquote>
আমার শরীরে রোমাঞ্চ হইল, আমি সেই দিকে কতক সভয়ে, কতক কৌতুহলপরবশে গেলাম। সেদিকে গিয়া আর কিছুই শুনিতে পারিলাম না। কিয়ৎ পরেই 'কুমারী'র ডাল হইতে সেই শ্লোক আবার উচ্চারিত হইল, কিন্তু শ্লোকের স্পষ্টতা আর পূর্বমতো বোধ হইল না। কেবল সুর আর ছন্দ শুনা গেল। 'কুমারী'র মূলে আসিয়া দেখি, হরিয়াল ঘুঘুর ন্যায় একটি পক্ষী আর একটির নিকট মাথা নাড়িয়া এই ছন্দে আস্ফালন করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছে, পক্ষিণী তাহাকে ডানা মারিয়া সরিয়া যাইতেছে, কখনো কখনো অন্য ডালে গিয়া বসিতেছে। এবার আমার ভ্রান্তি দূর হইল, আমি মন্দাক্রান্তাচ্ছন্দের একটি মাত্র শ্লোক জানিতাম; ছন্দটি উচ্চারণ মাত্রেই শ্লোকটি আমার মনে আসিল, সঙ্গে সঙ্গে কর্ণেও তাহার কার্য হইয়াছিল; আমি তাহাই শুনিয়াছিলাম 'রাধে মন্যুং!' কিন্তু পক্ষী বর্ণ উচ্চারণ করে নাই, কেবল ছন্দ উচ্চারণ করিয়াছিল।
</poem>
</div>
{{Footer|পালামৌ/চতুর্থ প্রবন্ধ}}
 
[[বিষয়শ্রেণী:সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]]
[[বিষয়শ্রেণী:ভ্রমণকাহিনী]]