গৌড়রাজমালা/ধর্ম্মপাল ও নাগভট্ট: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
"{{header | title = ../ | author = রমাপ্রসাদ চন্দ | translator = | section = ধর্ম্মপাল..." দিয়ে পাতা তৈরি
(কোনও পার্থক্য নেই)

০৯:৪৪, ২৩ আগস্ট ২০১৬ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

টেমপ্লেট ত্রুটি: দয়া করে খালি প্যারামিটার অপসারণ করবেন না (শৈলীর নির্দেশিকা টেমপ্লেটের নথি দেখুন)।


সুবর্ণবর্ষের [বরোদায় প্রাপ্ত] ৭৩৪ শকাব্দের [৮১২ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন হইতে জানা যায়,—রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দ, কর্ক্করাজের পিতা ইন্দ্ররাজকে “লাট”-মণ্ডলের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং এই নিমিত্তই হয়ত রাষ্ট্রকূট-পরবলকে লাট (গুজরাত) ত্যাগ করিয়া, পথরি-প্রদেশে সরিয়া আসিতে হইয়াছিল। গুর্জ্জরের উচ্চাভিলাষী প্রতীহার-রাজগণ এখানে হয়ত পরবলকে উৎপাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুতরাং প্রতীহার-রাজের প্রবল-প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম্মপালের আশ্রয় গ্রহণ ভিন্ন, পরবলের আত্মরক্ষার উপায়ান্তর ছিল না। সম্ভবতঃ এই সূত্রেই পরবল রণ্ণাদেবীকে ধর্ম্মপালের হস্তে সম্প্রদান করিয়াছিলেন।

 ধর্ম্মপাল পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করিবার পূর্ব্বেই, গুর্জ্জরের অধীশ্বর বৎসরাজ পরলোক গমন করিয়াছিলেন; এবং তদীয় পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট [নাগভট] গুর্জ্জর-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। যোধপুর-রাজ্যের অন্তর্গত বুচকলা নামক স্থানে প্রাপ্ত ৮৭২ সম্বতের [৮১৫ খৃষ্টাব্দের] একখানি শিলালিপিতে[১] “মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর শ্রীবৎসরাজদেব-পাদানুধ্যাত পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর শ্রীনাগভট্টদেবের প্রবর্দ্ধমান-রাজ্যের” উল্লেখ দৃষ্ট হয়। নাগভট্ট পিতৃরাজ্যের ন্যায় উত্তরাধিকারিসূত্রে পিতার উচ্চাভিলাষও লাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মপাল ও নাগভট্টের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইতে বিলম্ব হইল না। পাল-রাজগণের তাম্রশাসনে পাল-প্রতীহার-যুদ্ধের কোনও বিবরণ পরিরক্ষিত হয় নাই। নাগভট্টের পৌত্র মিহিরভোজের [গোয়ালিয়রে প্রাপ্ত] শিলালিপিতে নাগভট্টের কীর্ত্তিকলাপের এইরূপ পরিচয় পাওয়া যায়—[২]

“आद्यः पुमान् पुनरपि स्फुटकीर्त्ति रस्मा-
ज्जात स्स एव किल नागभट स्तदाख्यः।
यत्रान्ध्र-सैन्धव-विदर्भ-कलिङ्ग-भूपेः
कौमार-धामनि पतङ्गसमै रपाति॥
त्रय्यास्पदस्य सुकृतस्य समृद्धि मिच्छु-
र्यः क्षत्रधाम-विधिबद्ध-बलि-प्रबन्धः।
जित्वा पराश्रयकृत-स्फुटनीचभावं
चक्रायुधं विनयनम्र-वपु र्व्व्यराजत्॥
दुर्व्वार-वैरि(?)वरवारण-वाजिवार-
याणौघ-संघटन-घोर-घनान्धकारं।

निर्ज्जित्य वङ्गपति माविरभू द्विवस्वा-
नुद्यन्निव त्रिजगदेक-विकाश-कोषः॥
आनर्त्त-मालव-किरात-तुरूष्क-वत्स-
मत्स्यादिराज-गिरिदुर्ग-हठापहारैः।
यस्यात्म-वैभव मतीन्द्रिय माकुमार-
माविर्ब्बभूव भुवि विश्वजनीन-वृत्तेः॥” (८—११ श्लोकाः)

 “আদিপুরুষ (বিষ্ণু) পুনরায় বৎসরাজ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়া, বিখ্যাতকীর্ত্তি এবং গজসেনাবিশিষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়া, সেই [নাগভট] নামধারী হইয়াছিলেন। (তাঁহার) কৌমার-কালের প্রজ্জ্বলিত প্রতাপবহ্নিতে অন্ধ্র, সৈন্ধব, বিদর্ভ এবং কলিঙ্গের ভূপতিগণ পতঙ্গের মত পতিত হইয়াছিলেন।

 “বেদোক্ত পুণ্যকর্ম্মের সমৃদ্ধি ইচ্ছা করিয়া, তিনি ক্ষত্রিয়ের নিয়মানুসারে করধার্য্য করিয়াছিলেন। পরাধীনতা যাঁহার নীচভাব প্রকাশ করিয়াছিল, সেই চক্রায়ুধকে পরাজিত করিয়াও, তিনি বিনয়াবনতদেহে বিরাজ করিতেন।

 “দুর্জ্জয় শক্রর (বঙ্গপতির স্বকীয়) শ্রেষ্ঠ গজ, অশ্ব, রথসমূহের একত্র সমাবেশে গাঢ় মেঘের ন্যায় অন্ধকাররূপে প্রতীয়মান বঙ্গপতিকে পরাজিত করিয়া, তিনি ত্রিলোকের একমাত্র আলোকদাতা উদীয়মান সূর্য্যের ন্যায় আবির্ভূত হইয়াছিলেন।

 “বিশ্ববাসিগণের হিতে রত তাঁহার অসাধারণ [অতীন্দ্রিয়] পরাক্রম [আত্মবৈভব] আনর্ত্ত, মালব, তুরূষ্ক, বৎস, মৎস্য প্রভৃতি দেশের রাজগণের গিরিদুর্গ বলপূর্ব্বক অধিকার দ্বারা, শৈশব কাল হইতে [আকুমারং] পৃথিবীতে প্রকাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল।”

 এই পরাশ্রিত চক্রায়ুধ যে ধর্ম্মপালকর্ত্তৃক কান্যকুব্জের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত চক্রায়ুধ, এবং এই “বঙ্গপতি” যে স্বয়ং ধর্ম্মপাল, এ বিষয়ে কোন সংশয়ই উপস্থিত হইতে পারে না। ধর্ম্মপাল এবং তাঁহার অনুগত কান্যকুব্জেশ্বরের সহিত নিশ্চয়ই প্রতীহার-রাজ নাগভট্টের বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল; এবং পাল-রাজগণের তাম্রশাসনে যখন ধর্ম্মপাল কর্তৃক নাগভট্টের পরাজয়ের উল্লেখ নাই, পক্ষাত্তরে প্রতীহার-রাজগণের প্রশস্তিতে নাগভট্ট কর্তৃক চক্রায়ুধ এবং ধর্ম্মপাল উভয়েরই পরাজয়ের উল্লেখ আছে, তখন প্রতীহার রাজগণের প্রশস্তিকারের কথায় অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু যাঁহারা বলেন, নাগভট্টই চক্রায়ুধকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া, স্বয়ং কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন,[৩] তাঁহাদের সিদ্ধান্তের অনুকূল প্রমাণ গোয়ালিয়রের প্রশস্তিতে দেখিতে পাওয়া যায় না। এখানে চক্রায়ুধ-সম্বন্ধে “জিত্বা” বা “জয় করিয়া”, এই মাত্রই বলা হইয়াছে; তাঁহার পদচ্যুতির কোনও আভাস পাওয়া যায় না। প্রশস্তিকার, নাগভট্ট কর্ত্তৃক আনর্ত্ত, মালব, তুরূষ্ক, বৎস, মৎস্যাদি-রাজ্যের গিরিদুর্গ-অধিকারের উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু কান্যকুব্জ-অধিকারের উল্লেখ করেন নাই। এই সকল কারণে অনুমান হয়, নাগভট্ট কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন না, মৎস্য প্রভৃতি কান্যকুব্জ-রাজের অনুগত রাজ্যনিচয় আক্রমণ করায়, তাঁহার সহিত “বঙ্গপতির” এবং চক্রায়ুধের যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল, এবং সেই যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করিয়াছিলেন।

 নাগভট্টের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী রামভদ্র কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন, এরূপ উল্লেখও গোয়ালিয়রের প্রশস্তিতে দেখিতে পাওয়া যায় না। রামভদ্রের সহিত কান্যকুব্জের অধিরাজ “বঙ্গপতি”র সংঘর্ষেরও উল্লেখ নাই। কিন্তু রামভদ্রের পুত্র মিহির-ভোজ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—

“यस्य वैरि-वृहद्वङ्गा न्दहतः कोप-वह्निना।
प्रतापादर्णसां राशीन् पातु र्व्वै तृष्ण माबभौ॥“ (२१ श्लोकः)

 “কোপাগ্নির দ্বারা পরাক্রান্ত শত্রু বঙ্গগণকে দহনকারী এবং প্রতাপের দ্বারা সাগরের জলরাশী পানকারী তাঁহার তৃষ্ণাভাব শোভা পাইয়াছিল।”

 ধর্ম্মপালের সহিত প্রতীহার-রাজ ভোজের যে সমর উপস্থিত হইয়াছিল, সৌরাষ্ট্রের মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মার ৯৫৬ সম্বতের [৮৯৯ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মা, ভোজদেবের পাদানুধ্যাত মহেন্দ্রপালদেবের, সৌরাষ্ট্রের মহাসামন্ত ছিলেন। ৫৭৪ বলভী সম্বতের [৮৯৩ খৃষ্টাব্দের] একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায়,—দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মার পিতা বলবর্ম্মাও ভোজদেব-পাদানুধ্যাত মহেন্দ্রায়ুধের [মহেন্দ্রপালের] মহাসামন্ত ছিলেন।[৪] ইহাতে অনুমান হয়,—বলবর্ম্মার পিতামহও প্রতীহার-রাজগণের সামন্ত-শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। প্রথমোক্ত তাম্রশাসনে বলবর্ম্মার পিতামহ-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—

अजनि ततोऽपि श्रीमान् वाहुकधवलो महानुभावो यः।
धर्म्म मवन्नपि नित्यं रणोद्यतो निनशाद धर्म्मं॥“ (८ श्लोकः)[৫]

 “তৎপর মহানুভাব শ্রীমান্ বাহুকধবল জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যিনি নিত্য ধর্ম্মপালন করিলেও, রণোদ্যত হইয়া, ধর্ম্মকে ধ্বংস করিয়াছিলেন।”

 এই তাম্রশাসনখানিতে অনেক ভুল আছে। এ স্থলে ডাঃ কিল্‌হর্ণের সংশোধিত পাঠই উদ্ধৃত হইল। কিল্‌হর্ণ মনে করেন, বাহুকধবল মিহির-ভোজের সামন্ত ছিলেন, এবং এই ধর্ম্ম, বঙ্গ-পতি ধর্ম্মপাল। গোয়লিয়র-প্রশস্তিতে মিহির-ভোজ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ-অধিকারের উল্লেখ নাই; কিন্তু

  1. Epigraphia Indica, Vol. IX., pp. 198-200,
  2. Archæological Survey of India, Annual Report, 1903-4, p. 281.
  3. V. A. Smith’s Early History of India; pp. 349—350.
  4. Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 5.
  5. Ibid, p. 7.