গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড)/একরাত্রি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
নতুন গল্প |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন:
{{Header
|title=
|section = [[একরাত্রি]]
|previous =[[
|next =[[
|notes =
|author =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি ,
আমার পিতা চৌধুরী-জমিদারের নায়েব ছিলেন । তাহার ইচ্ছা ছিল , আমার হাতটা পাকিলেই আমাকে জমিদারি-সেরেস্তার কাজ শিখাইয়া একটা কোথাও গোমস্তাগিরিতে প্রবৃত্ত করাইয়া দিবেন । কিন্তু, আমি মনে মনে তাহাতে নারাজ ছিলাম । আমাদের পাড়ার নীলরতন যেমন কলিকাতায় পালাইয়া লেখাপড়া শিখিয়া কালেক্টার সাহেবের নাজির হইয়াছে , আমারও জীবনের লক্ষ্য সেইরূপ অত্যুচ্চ ছিল — কালেক্টারের নাজির না হইতে পারি তো জজ-আদালতের হেডক্লার্ক হইব , ইহা আমি মনে মনে নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম ।
সর্বদাই দেখিতাম , আমার বাপ উক্ত আদালতজীবীদিগকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন — নানা উপলক্ষে মাছটা তরকারিটা টাকাটা-সিকেটা লইয়া যে তাঁহাদের পূজার্চনা করিতে হইত তাহাও শিশুকাল হইতে আমার জানা ছিল, এইজন্য আদালতে ছোটো কর্মচারী এমন-কি, পেয়াদাগুলাকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে খুব একটা সম্ভ্রমের আসন দিয়াছিলাম । ইঁহারা আমাদের বাংলাদেশের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটির ছোটো ছোটো নূতন সংস্করণ । বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইঁহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নির্ভর ঢের বেশী- সুতরাং পূর্বে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল , আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন ।
আমিও নীলরতনের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া একসময় বিশেষ সুবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম । প্রথমে গ্রামের একটি আলাপি লোকের বাসায় ছিলাম , তাহার পরে বাপের কাছ হইতেও কিছু কিছু অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম । লেখাপড়া যথা নিয়মে চলিতে লাগিল ।
ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম । দেশের জন্য হঠৎ প্রাণ বিসর্জন করা যে আশু আবশ্যক , এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না । কিন্তু, কী করিয়া উক্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে আমি জানিতাম না , এবং কেহ দৃষ্টান্তও দেখাইত না ।
কিন্তু তাহা বলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রুটি ছিল না । আমরা পাড়াগেঁয়ে ছেলে , কলিকাতার ইঁচড়ে-পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করিতে শিখি নাই, সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল । আমাদের সভার কর্তৃপক্ষীয়েরা বক্তৃতা দিতেন , আর আমরা চাঁদার খাতা লইয়া না-খাইয়া দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতাম , রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিতাম , সভাস্থলে গিয়া বেঞ্চি চৌকি সাজাইতাম , দলপতির নামে কেহ একটা কথা বলিলে কোমর বাঁধিয়া মারামারি করিতে উদ্যত হইতাম । শহরের ছেলেরা এইসব লক্ষণ দেখিয়া আমাদিগকে বাঙাল বলিত ।
নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম , কিন্তু মাট্সীনি গারিবাল্ডি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম ।
এমন সময়ে আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হইলেন ।
আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি , তখন সুরবালার বয়স আট ; এখন আমি আঠারো । পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে । কিন্তু, এ দিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি , আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব — বাপকে বলিলাম , বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না ।
দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম , উকিল রামলোচনবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে । পতিত ভারতের চাঁদা-আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম , এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল ।
এন্ট্রেন্স্ পাস করিয়াছি , ফার্স্ট্ আর্ট্স দিব , এমন সময় পিতার মৃত্যু হইল । সংসারে কেবল আমি একা নই, মাতা এবং দুটি ভগিনী আছেন । সুতরাং কালেজ ছাড়িয়া কাজের সন্ধানে ফিরিতে হইল । বহু চেষ্টায় নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোটো শহরে এন্ট্রেন্স্ স্কুলের সেকেন্ড্ মাস্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম ।
মনে করিলাম , আমার উপযুক্ত কাজ পাইয়াছি । উপদেশ এবং উৎসাহ দিয়া এক-একটি ছাত্রকে ভাবী ভারতের এক-একটি সেনাপতি করিয়া তুলিব ।
কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম । দেখিলাম , ভাবী ভারতবর্ষ অপেক্ষা আসন্ন এগ্জামিনের তাড়া ঢের বেশি । ছাত্রদিগকে গ্রামার অ্যাল্জেব্রার বহির্ভূত কোনো কথা বলিলে হেড্মাস্টার রাগ করে । মাস-দুয়েকের মধ্যে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হইয় আসিল ।
আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারূপ কল্পনা করে , অবশেষে কার্যক্ষেত্রে নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে ল্যাজমলা খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্রাত্যহিক মাটি-ভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জাবনা খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে ; লম্ফে ঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না ।
অগ্নিদাহের আশঙ্কায় একজন করিয়া মাস্টার স্কুলের ঘরেতেই বাস করিত । আমি একা মানুষ , আমার উপরেই সেই ভার পড়িয়াছিল । স্কুলের বড়ো আটচালার সংলগ্ন একটি চালায় আমি বাস করিতাম ।
স্কুলঘরটি লোকালয় হইতে কিছু দূরে। একটি বড়ো পুষ্করিণীর ধারে । চারি দিকে সুপারি নারিকেল এবং মাদারের গাছ , এবং স্কুলগৃহের প্রায় গায়েই দুটা প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হইয়া ছায়া দান করিতেছে ।
একটা কথা এতদিন উল্লেখ করি নাই এবং এতদিন উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে হয় নাই । এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা আমাদের স্কুলঘরের অনতিদূরে । এবং তাঁহার সঙ্গে তাঁহার স্ত্রী — আমার বাল্যসখী সুরবালা — ছিল , তাহা আমার জানা ছিল ।
রামলোচনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হইল । সুরবালার সহিত বাল্যকালে আমার জানাশোনা ছিল তাহা রামলোচনবাবু জানিতেন কি না জানি না , আমিও নূতন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলা সংগত বোধ করিলাম না । এবং সুরবালা যে কোনোকাল আমার জীবনের সঙ্গে কোনোরূপ জড়িত ছিল , সে কথা আমার ভালো করিয়া মনে উদয় হইল না ।
একদিন ছুটির দিনে রামলোচনবাবুর বাসায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছি । মনে নাই কী বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল , বোধ করি বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা সম্বন্ধে । তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মাণ ছিলেন তাহা নহে , কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক-দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে ।
এমন সময়ে পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু একটু চুড়ির টুংটাং , কাপড়ের একটুখানি খস্খস্ এবং পায়েরও একটুখানি শব্দ শুনিতে পাইলাম ; বেশ বুঝিতে পারিলাম, জানালার ফাঁক দিয়া কোনো কৌতূহলপূর্ণ নেত্র আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে ।
তৎক্ষণাৎ দুখানি চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল — বিশ্বাস , সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ , কালো কালো তারা , ঘনকৃষ্ণ পল্লব , স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি । সহসা হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টন টন করিয়া উঠিল ।
বাসায় ফিরিয়া আসিলাম কিন্তু সেই ব্যথা লাগিয়া রহিল । লিখি পড়ি, যাহা করি, কিছুতেই মনের ভার দূর হয় না ; মনটা সহসা একটা বৃহৎ বোঝার মতো হইয়া বুকের শিরা ধরিয়া দুলিতে লাগিল ।
সন্ধ্যাবেলায় একটু স্থির হইয়া ভাবিতে লাগিলাম , এমনটা হইল কেন । মনের মধ্য হইতে উত্তর আসিল , তোমার সে সুরবালা কোথায় গেল ।
আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম , আমি তো তাহাকে ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছি । সে কি চিরকাল আমার জন্য বসিয়া থাকিবে ।
মনের ভিতরে কে বলিল , তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না । সেই শৈশবের সুরবালা তোমার যত কাছেই থাকুক , তাহার চুড়ির শব্দ শুনিতে পাও , তাহার মাথাঘষার গন্ধ অনুভব কর , কিন্তু মাঝখানে বরাবর একখানি করিয়া দেয়াল থাকিবে ।
আমি বলিলাম , তা থাক্-না , সুরবালা আমার কে ।
উত্তর শুনিলাম , সুরবালা আজ তোমার কেহই নয় , কিন্তু সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত ।
সে কথা সত্য । সুরবালা আমার কী না হইতে পারিত । আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ , আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী , আমার জীবনের সমস্ত সুখদুঃখভাগিনী হইতে পারিত — সে আজ এত দূর , এত পর , আজ তাহাকে দেখা নিষেধ , তাহার সঙ্গে কথা কওয়া দোষ , তাহার বিষয়ে চিন্তা করা পাপ । আর , একটা রামলোচন, কোথাও কিছু নাই হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত; কেবল গোটা-দুয়েক মুখস্থ মন্ত্র পড়িয়া সুরাবালাকে পৃথিবীর আর-সকলের নিকট হইতে একমুহূর্তে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল ।
আমি মানবসমাজে নূতন নীতি প্রচার করিতে বসি নাই , সমাজ ভাঙিতে আসি নাই, বন্ধন ছিঁড়িতে চাই না । আমি আমার মনের প্রকৃত ভাবটা ব্যক্ত করিতেছি মাত্র । আপন-মনে যে-সকল ভাব উদয় হয় তাহার কি সবই বিবেচনাসংগত । রামলোচনের গৃহভিত্তির আড়ালে যে সুরবালা বিরাজ করিতেছিল সে যে রামলোচনের অপেক্ষাও বেশি করিয়া আমার , এ কথা আমি কিছুতেই মন হইতে তাড়াইতে পারিতেছিলাম না । এরূপ চিন্তা নিতান্ত অসংগত এবং অন্যায় তাহা স্বীকার করি কিন্তু অস্বাভাবিক নহে ।
এখন হইতে আর কোনো কাজে মনঃসংযোগ করিতে পারি না । দুপুরবেলায় ক্লাসে যখন ছাত্রেরা গুন্ গুন্ করিতে থাকিত , বাহিরে সমস্ত ঝাঁ ঝাঁ করিত , ঈষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিমগাছের পুষ্পমঞ্জরির সুগন্ধ বহন করিয়া আনিত , তখন ইচ্ছা করিত — কী ইচ্ছা করিত জানি না — এই পর্যন্ত বলিতে পারি , ভারতবর্ষের এই সমস্ত ভাবী আশাস্পদদিগের ব্যাকরণের ভ্রম সংশোধন করিয়া জীবনযাপন করিতে ইচ্ছা করিত না ।
স্কুলের ছুটি হইয়া গেলে আমার বৃহৎ ঘরে একলা থাকিতে মন টিঁকিত না , অথচ কোনো ভদ্রলোক দেখা করিতে আসিলেও অসহ্য বোধ হইত । সন্ধ্যাবেলায় পুষ্করিণীর ধারে সুপারি-নারিকেলের অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনিতে শুনিতে ভাবিতাম , মনুষ্যসমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল । ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না , তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে ।
তোমার মতো লোক সুরবালার স্বামীটি হইয়া বুড়াবয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকিতে পারিত, তুমি কিনা হইতে গেলে গারিবাল্ডি এবং হইলে শেষে একটি পাড়াগেঁয়ে স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। আর, রামলোচন রায় উকিল , তাহার বিশেষ করিয়া সুরাবালারই স্বামী হইবার কোনো জরুরি আবশ্যক ছিল না ; বিবাহের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাহার পক্ষে সুরবালাও যেমন ভবশংকরীও তেমন , সেই কিনা কিছুমাত্র না ভাবিয়া-চিন্তিয়া বিবাহ করিয়া সরকারি উকিল হইয়া দিব্য পাঁচটাকা রোজগার করিতেছে — যেদিন দুধে ধোঁয়ার গন্ধ হয় সেদিন সুরাবালাকে তিরস্কার করে , যেদিন মন প্রসন্ন থাকে সেদিন সুরবালার জন্য গহনা গড়াইতে দেয় । বেশ মোটাসোটা , চাপকান-পরা , কোনো অসন্তোষ নাই। পুষ্করিণীর ধারে বসিয়া আকাশের তারার দিকে চাহিয়া কোনোদিন হাহুতাশ করিয়া সন্ধ্যযাপন করে না ।
রামলোচন একটা বড়ো মকদ্দমায় কিছুকালের জন্য অন্যত্র গিয়াছে । আমার স্কুলঘরে আমি যেমন একলা ছিলাম সেদিন সুরবালার ঘরেও সুরবালা বোধ করি সেইরূপ একা ছিল ।
মনে আছে, সেদিন সোমবার । সকাল হইতেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া আছে । বেলা দশটা হইতে টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিল । আকাশের ভাবগতিক দেখিয়া হেড্মাস্টার সকাল সকাল স্কুলের ছুটি দিলেন । খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ যেন একটা কী মহা আয়োজনে সমস্ত দিন আকাশময় আনাগোনা করিয়া বেড়াইতে লাগিল । তাহার পরদিন বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হইল । যত রাত্রি হইতে লাগিল বৃষ্টি এবং ঝড়ের বেগ বাড়িতে চলিল । প্রথমে পূর্ব দিক হইতে বাতাস বহিতেছিল , ক্রমে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিয়া বহিতে লাগিল ।
এ রাত্রে ঘুমাইবার চেষ্টা করা বৃথা । মনে পড়িল , এই দুর্যোগে সুরবালা ঘরে একলা আছে । আমাদের স্কুলঘর তাহাদের ঘরের অপেক্ষা অনেক মজবুত । কতবার মনে করিলাম , তাহাকে স্কুলঘরে ডাকিয়া আনিয়া আমি পুষ্করিণীর পাড়ের উপর রাত্রিযাপন করিব । কিন্তু কিছুতেই মন স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না ।
রাত্রি যখন একটা-দেড়টা হইবে হঠাৎ বানের ডাক শোনা গেল — সমুদ্র ছুটিয়া আসিতেছে । ঘর ছাড়িয়া বাহির হইলাম । সুরবালার বাড়ির দিকে চলিলাম । পথে আমাদের পুষ্করিণীর পাড় — সে পর্যন্ত যাইতে না-যাইতে আমার হাঁটুজল হইল । পাড়ের উপর যখন উঠিয়া দাঁড়াইলাম তখন দ্বিতীয় আর-একটা তরঙ্গ আসিয়া উপস্থিত হইল ।
আমাদের পুকুরের পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উচ্চ হইবে । পাড়ের উপরে আমিও যখন উঠিলাম , বিপরীত দিক হইতে আর-একটি লোকও উঠিল । লোকটি কে তাহা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা , আমার মাথা হইতে পা পর্যন্ত বুঝিতে পারিল । এবং সেও যে আমাকে জানিতে পারিল তাহাতে আমার সন্দেহ নাই ।
আর-সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে কেবল হাত-পাঁচ-ছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম ।
তখন প্রলয়কাল , তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে — তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না — কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না । কেহ কাহাকেও একটা কুশলপ্রশ্নও করিল না ।
কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম । পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল ।
আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছাড়িয়া সুরবালা আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে । আজ আমি ছাড়া সুরবালার আর কেহ নাই । কবেকার সেই শৈশবে সুরবালা , কোন্-এক জন্মান্তর , কোন্-এক পুরাতন রহস্যান্ধকার হইতে ভাসিয়া , এই সূর্যচন্দ্রালোকিত লোকপরিপূর্ণ পৃথিবীর উপরে আমারই পার্শ্বে আসিয়া সংলগ্ন হইয়াছিল ; আর , আজ কতদিন পরে সেই আলোকময় লোকময় পৃথিবী ছাড়িয়া এই ভয়ংকর জনশূন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে সুরবালা একাকিনী আমারই পার্শ্বে আসিয়া উপনীত হইয়াছে । জন্মস্রোতে সেই নবকলিকাকে আমার কাছে আনিয়া ফেলিয়াছিল , মৃত্যুস্রোতে সেই বিকশিত পুষ্পটিকে আমারই কাছে আনিয়া ফেলিয়াছে — এখন কেবল আর-একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃন্তটুকু হইতে , খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই।
সে ঢেউ না আসুক । স্বামীপুত্রগৃহধনজন লইয়া সুরবালা চিরদিন সুখে থাকুক । আমি এই এক রাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি ।
রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল — ঝড় থামিয়া গেল , জল নামিয়া গেল — সুরবালা কোনো কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল , আমিও কোনো কথা না বলিয়া আমার ঘরে গেলাম ।
ভাবিলাম , আমি নাজিরও হই নাই , সেরেস্তাদারও হই নাই , গারিবাল্ডিও হই নাই , আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার , আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্তরাত্রির উদয় হইয়াছিল — আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা ।
জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯</div>
[[Category:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]]
[[Category:গল্প]]
|