কমলাকান্ত/কমলাকান্তের দপ্তর/একাদশ সংখ্যা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন:
{{শীর্ষক
|শিরোনাম=[[../]]
|অনুচ্ছেদ =একাদশ সংখ্যা - আমার দুর্গোৎসব
|পূর্ববর্তী =[[কমলাকান্তের দপ্তর../দশম সংখ্যা/]]
|পরবর্তী =[[কমলাকান্তের দপ্তর../দ্বাদশ সংখ্যা/]]
|টীকা =
|টীকা =<center>লেখক কর্তৃক ব্যবহৃত পুরনো বানান অপরিবর্তিত ও অক্ষুণ্ন রাখা হল।</center>
|লেখক = বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
|বছর =
|প্রবেশদ্বার =
}}
<pages index="কমলাকান্ত - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu" from=2151 to=2157/>
<div style="padding-left:2em;">
 
সপ্তমীপূজার দিন কে আমাকে এত আফিঙ্গ চড়াইতে বলিল! আমি কেন আফিঙ্গ খাইলাম! আমি কেন প্রতিমা দেখিতে গেলাম। যাহা কখন দেখিব না, তাহা কেন দেখিলাম! এ কুহক কে দেখাইল!
 
দেখিলাম - অকস্মাৎ কালের স্রোত, দিগন্ত ব্যাপিয়া প্রবলবেগে ছুটিতেছে - আমি ভেলায় চড়িয়া ভাসিয়া যাইতেছি। দেখিলাম - অনন্ত, অকূল, অন্ধকারে, বাত্যাবিক্ষুদ্ধ তরঙ্গসঙ্কুল সেই স্রোত - মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ উদয় হইতেছে, নিবিতেছে - আবার উঠিতেছে। আমি নিতান্ত একা - একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল - নিতান্ত একা - মাতৃহীন - মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি। আমি এই কাল-সমুদ্রে মাতৃসন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা! কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত-প্রসূতি বঙ্গভূমি! এ ঘোর কাল-সমুদ্রে কোথায় তুমি? সহসা স্বর্গীয় বাদ্যে কর্ণরন্ধ্র পরিপূর্ণ হইল - দিঙ্মমণ্ডলে প্রভাতারুণোদয়বৎ লোহিতোজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ হইল - স্নিগ্ধ মন্দ পবন বহিল - সেই তরঙ্গসঙ্কুল জলরাশির উপরে, দূরপ্রান্তে দেখিলাম - সূবর্ণমণ্ডিতা, এই সপ্তমীর শারদীয়া প্রতিমা! জলে হাসিতেছে, ভাসিতেছে, আলোক বিকীর্ণ করিতেছে! এই কি মা? হাঁ, এই মা। চিনিলাম, এই আমার জননী জন্মভূমি - এই মৃন্ময়ী - মৃত্তিকারূপিণী - অনন্তরত্নভূষিতা - এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্নমণ্ডিত দশ ভুজ - দশ দিক্‌ - দশ দিকে প্রসারিত তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত; পদতলে শত্রু-বিমর্ন্দিত বীরজন কেশরী শত্রু-নিষ্পীড়নে নিযুক্ত! এ মূর্ত্তি এখন দেখি না - আজি দেখিব না, কাল দেখিব না - কালস্রোত পার না হইলে দেখিব না - কিন্তু এক দিন দেখিব - দিগ্‌ভুজা, নানা প্রহরণপ্রহারিণী, শত্রুমর্দ্দিনী, বীরেন্দ্রপৃষ্ঠবিহারিণী - দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্ত্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্য্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতোমধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা!
 
কোথায় ফুল পাইলাম, বলিতে পারি না - কিন্তু সেই প্রতিমার পদতলে পুষ্পাঞ্জলি দিলাম - ডাকিলাম, "সর্ব্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, আমার সর্ব্বার্থসাধিকে! অসংখ্যসন্তানকূলপালিকে! ধর্ম্ম, অর্থ, সুখ, দুঃখদায়িকে! আমার পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ কর। এই ভক্তি প্রীতি বৃত্তি শক্তি করে লইয়া তোমার পদতলে পুষ্পাঞ্জলি দিতেছি, তুমি এই অনন্তজলমণ্ডল ত্যাগ করিয়া এই বিশ্ববিমোহিনী মূর্ত্তি একবার জগৎসমীপে প্রকাশ কর। এসো মা! নবরাগরঙ্গিণি নববলধারিণি, নবদর্পে দর্পিণি, নবস্বপ্নদর্শিনি! - এসো মা, গৃহে এসো - ছয় কোটি সন্তানে একত্রে, এক কালে, দ্বাদশ কোটি কর যোড় করিয়া, তোমার পাদপদ্ম পূজা করিব। ছয় কোটি মুখে ডাকিব, মা প্রসূতি অম্বিকে! ধাত্রি ধরিত্রি ধনধান্যদায়িকে! নগাঙ্কশোভিনি নগেন্দ্রবালিকে! শরৎসুন্দরি চারুপূর্ণচন্দ্রভালিকে! ডাকিব,- সিন্ধুসেবিতে সিন্ধু-পূজিতে সিন্ধু-মথনকারিণি! শত্রুবধে দশভূজে দশপ্রহরণধারিণি! অনন্তশ্রী অনন্তকালস্থায়িনি! শক্তি দাও সন্তানে, অনন্তশক্তিপ্রদায়িনি! তোমায় কি বলিয়া ডাকিব মা? ঐ ছয় কোটি মুণ্ড ঐ পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত করিব - এই ছয় কোটি কণ্ঠে ঐ নাম করিয়া হুঙ্কার করিব, - এই ছয় কোটি দেহ তোমার জন্য পতন করিব - না পারি, এই দ্বাদশ কোটি চক্ষে তোমার জন্য কাঁদিব। এসো মা, গৃহে এসো - যাঁহার ছয় কোটি সন্তান - তাঁহার ভাবনা কি?
 
দেখিতে দেখিতে আর দেখিলাম না - সেই অনন্ত কাল-সমুদ্রে এই প্রতিমা ডুবিল! অন্ধকারে সেই তরঙ্গসঙ্কুল জলরাশি ব্যাপিল, জলকল্লোলে বিশ্বসংসার পূরিল! তখন যুক্ত করে, সজল নয়নে, ডাকিতে লাগিলাম, উঠ মা হিরন্ময়ি বঙ্গভূমি! উঠ মা! এবার সুসন্তান হইব, সৎপথে চলিব - তোমার মুখ রাখিব। উঠ মা, দেবী দেবানুগৃহীত - এবার আপনা ভুলিব - ভ্রাতৃবৎসল হইব, পরের মঙ্গল সাধিব - অধর্ম্ম, আলস্য, ইন্দ্রিয়ভক্তি ত্যাগ করিব - উঠ মা - একা রোদন করিতেছি, কাঁদিতে কাঁদিতে চক্ষু গেল মা! উঠ উঠ, উঠ মা বঙ্গজননী!
 
মা উঠিলেন না। উঠিবেন না কি?
 
এস, ভাই সকল! আমরা এই অন্ধকারে কালস্রোতে ঝাঁপ দিই। এস, আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি। এস, অন্ধকারে ভয় কি? ঐ যে নক্ষত্রসকল মধ্যে মধ্যে উঠিতেছে, নিবিতেছে, উহারা পথ দেখাইবে - চল! চল! অসংখ্য বাহুর প্রক্ষেপে, এই কাল-সমুদ্র তাড়িত, মথিত, ব্যস্ত করিয়া, আমরা সন্তরণ করি - সেই স্বর্ণপ্রতিমা মাথায় করিয়া আনি। ভয় কি? না হয় ডুবিব; মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি? আইস, প্রতিমা তুলিয়া আনি, বড় পূজার ধুম বাধিবে। দ্বেষক ছাগকে হাড়িকাটে ফেলিয়া সৎকীর্ত্তি খড়্গে মায়ের কাছে বলি দিব - কত পুরাবৃত্তকার ঢাকী, ঢাক ঘাড়ে করিয়া, বঙ্গের বাজনাবাজাইয়া আকাশ ফাটাইবে - কত ঢোল, কাঁসি, কাড়া, নাগরায় বঙ্গের জয় বাদিত হইবে। কত সানাই পোঁ ধরিয়া গাইবে "কত নাচ গো!-" বড় পূজার ধুম বাধিবে। কত ব্রাহ্মণপণ্ডিত লুচি মণ্ডার লোভে বঙ্গপূজায় আসিয়া পাতড়া মারিবে - কত দেশী বিদেশী ভদ্রাভদ্র আসিয়া মায়ের চরণে প্রণামি দিবে - কত দীন দুঃখী প্রসাদ খাইয়া উদর পুরিবে। কত নর্ত্তকী নাচিবে, কত গায়কে মঙ্গল গায়িবে, কত কোটি ভক্তে ডাকিবে, মা! মা! মা! -
 
:::::::জয় জয় জয় জয়া জয়দাত্রি।
:::::::জয় জয় জয় বঙ্গজগদ্ধাত্রি।।
:::::::জয় জয় জয় সুখদে অন্নদে।
:::::::জয় জয় জয় বরদে শর্ম্মদে।।
:::::::জয় জয় জয়শুভে শুভঙ্করি।
:::::::জয় জয় জয় শান্তি ক্ষেমঙ্করি।।
:::::::দ্বেকদলনি, সন্তানপালিনি।
:::::::জয় জয় দুর্গে দুর্ঘতিনাশিনি।।
:::::::জয় জয় লক্ষ্মি বারীন্দ্রবালিকে।
:::::::জয় জয় কমলাকান্তপালিকে।।
:::::::জয় জয় ভক্তিশক্তিদায়িকে।
:::::::পাপতাপভয়শোকনাশিকে।।
:::::::মৃদুল গম্ভীর ধীর ভাষিকে।
:::::::জয় মা কালি করালি অম্বিকে।।
:::::::জয় হিমালয়নগবালিকে।
:::::::অতুলিত পূর্ণচন্দ্রভালিকে।।
:::::::শুভে শোভনে সর্ব্বাতর্থসাধিকে।
:::::::জয় জয় শান্তি শক্তি কালিকে।।
:::::::জয় মা কমলাকান্তপালিকে।।
:::::::নমোহস্তু তে দেবি বরপ্রদে শুভে।
:::::::নমোহস্তু তে কামচরে সদা ধ্রুবে।।
::::ব্রহ্মাণীন্দ্রাণি রুদ্রাণি ভূতভব্যে যশস্বিনি।
::::ত্রাহিং মাং সর্ব্বদুঃখেভ্যো দানবানাং ভয়ঙ্করি।।
::::নমোহস্তু তে জগন্নাথে জনার্দ্দনি নমোহস্তু তে।
::::প্রিয়দান্তে জগন্মাতঃ শৈলপুত্রি বসুন্ধরে।।
::::ত্রায়স্ব মাং বিশালাক্ষি ভক্তানামার্ত্তিনাশিনি।
::::নমামি শিরসা দেবীং বন্ধনোহস্তু বিমোচিতঃ।।*
 
(*) আর্য্যাস্তোত্র দেখ।
</div>
 
<pages index="কমলাকান্ত - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu" from=2 to=2/>