গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড)/একটা আষাঢ়ে গল্প: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rp
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rplc
১ নং লাইন:
{{Header
|title= [[গল্পগুচ্ছ]]
|section = [[একটা আষাঢ়ে গল্প]]
|previous = [[একরাত্রি]]
|next = [[জীবিত ও মৃত]]
১০ নং লাইন:
|portal =
|categories = রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
__NOTOC__
== ১ ==
দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ । সেখানে কেবল তাসের সাহেব , তাসের বিবি , টেক্কা এবং গোলামের বাস । দুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে, কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে ।
 
টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ- তাহাদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে ।
 
কিন্তু, চমৎকার শৃঙ্খলা । কাহার কত মূল্য এবং মর্যাদা তাহা বহুকাল হইতে স্থির হইয়া গেছে , তাহার রেখামাত্র ইতস্তত হইবার জো নাই । সকলেই যথানির্দিষ্ট মতে আপন আপন কাজ করিয়া যায়। বংশাবলিক্রমে কেবল পূর্ববর্তীদিগের উপর দাগা বুলাইয়া চলা ।
 
সে যে কী কাজ তাহা বিদেশীর পক্ষে বোঝা শক্ত । হঠাৎ খেলা বলিয়া ভ্রম হয় । কেবল নিয়মে চলাফেরা , নিয়মে যাওয়া-আসা , নিয়মে ওঠাপড়া । অদৃশ্য হস্তে তাহাদিগকে চালনা করিতেছে এবং তাহারা চলিতেছে ।
 
তাহাদের মুখে কোনো ভাবের পরিবর্তন নাই । চিরকাল একমাত্র ভাব ছাপ মারা রহিয়াছে । যেন ফ্যাল্‌-ফ্যাল্‌ ছবির মতো । মান্ধাতার আমল হইতে মাথার টুপি অবধি পায়ের জুতা পর্যন্ত অবিকল সমভাবে রহিয়াছে ।
 
কখনো কাহাকেও চিন্তা করিতে হয় না , বিবেচনা করিতে হয় না ; সকলেই মৌন নির্জীবভাবে নিঃশব্দে পদচারণা করিয়া বেড়ায় ; পতনের সময় নিঃশব্দে পড়িয়া যায় এবং অবিচলিত মুখশ্রী লইয়া চিৎ হইয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে ।
 
কাহারো কোনো আশা নাই , অভিলাষ নাই , ভয় নাই, নূতন পথে চলিবার চেষ্টা নাই , হাসি নাই , কান্না নাই , সন্দেহ নাই , দ্বিধা নাই । খাঁচার মধ্যে যেমন পাখি ঝট্‌পট্‌ করে , এই চিত্রিতবৎ মূর্তিগুলির অন্তরে সেরূপ কোনো-একটা জীবন্ত প্রাণীর অশান্ত আক্ষেপের লক্ষণ দেখা যায় না ।
 
অথচ এককালে এই খাঁচাগুলির মধ্যে জীবের বসতি ছিল — তখন খাঁচা দুলিত এবং ভিতর হইতে পাখার শব্দ এবং গান শোনা যাইত । গভীর অরণ্য এবং বিস্তৃত আকাশের কথা মনে পড়িত । এখন কেবল পিঞ্জরের সংকীর্ণতা এবং সুশৃঙ্খল শ্রেণী-বিন্যস্ত লৌহশলাকাগুলাই অনুভব করা যায়— পাখি উড়িয়াছে কি মরিয়াছে কি জীবন্মৃত হইয়া আছে , তাহা কে বলিতে পারে ।
 
আশ্চর্য স্তব্ধতা এবং শান্তি । পরিপূর্ণ স্বস্তি এবং সন্তোষ । পথে ঘাটে গৃহে সকলই সুসংহত , সুবিহিত — শব্দ নাই , দ্বন্দ্ব নাই , উৎসাহ নাই , আগ্রহ নাই — কেবল নিত্য-নৈমিত্তিক ক্ষুদ্র কাজ এবং ক্ষুদ্র বিশ্রাম ।
 
সমুদ্র অবিশ্রাম একতানশব্দপূর্বক তটের উপর সহস্র ফেনশুভ্র কোমল করতলের আঘাত করিয়া সমস্ত দ্বীপকে নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে — পক্ষীমাতার দুই প্রসারিত নীলপক্ষের মতো আকাশ দিগ্‌দিগন্তের শান্তিরক্ষা করিতেছে । অতিদূর পরপারে গাঢ় নীল রেখার মতো বিদেশের আভাস দেখা যায় — সেখান হইতে রাগদ্বেষের দ্বন্দ্বকোলাহল সমুদ্র পার হইয়া আসিতে পারে না ।
 
== ২ ==
সেই পরপারে , সেই বিদেশে, এক দুয়ারানীর ছেলে এক রাজপুত্র বাস করে । সে তাহার নির্বাসিত মাতার সহিত সমুদ্রতীরে আপনমনে বাল্যকাল যাপন করিতে থাকে ।
 
সে একা বসিয়া বসিয়া মনে মনে এক অত্যন্ত বৃহৎ অভিলাষের জাল বুনিতেছে । সেই জাল দিগ্‌দিগন্তরে নিক্ষেপ করিয়া কল্পনায় বিশ্বজগতের নব নব রহস্যরাশি সংগ্রহ করিয়া আপনার দ্বারের কাছে টানিয়া তুলিতেছে । তাহার অশান্ত চিত্ত সমুদ্রের তীরে আকাশের সীমায় ঐ দিগন্তরোধী নীল গিরিমালার পরপারে সর্বদা সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছে — খুঁজিতে চায় কোথায় পক্ষীরাজ ঘোড়া , সাপের মাথায় মানিক , পারিজাত পুষ্প , সোনার কাঠি , রুপার কাঠি পাওয়া যায়, কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে দুর্গম দৈত্যভবনে স্বপ্নসম্ভবা অলোকসুন্দরী রাজকুমারী ঘুমাইয়া রহিয়াছেন ।
 
রাজপুত্র পাঠশালে পড়িতে যায় , সেখানে পাঠান্তে সদাগরের পুত্রের কাছে দেশ-বিদেশের কথা এবং কোটালের পুত্রের কাছে তাল-বেতালের কাহিনী শোনে ।
 
ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ করিয়া বৃষ্টি পড়ে , মেঘে অন্ধকার হইয়া থাকে — গৃহদ্বারে মায়ের কাছে বসিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিয়া রাজপুত্র বলে , মা , একটা খুব দূর দেশের গল্প বলো । মা অনেক ক্ষণ ধরিয়া তাঁহার বাল্যশ্রুত এক অপূর্ব দেশের অপূর্ব গল্প বলিতেন- বৃষ্টির ঝর্‌ঝর্‌ শব্দের মধ্যে সেই গল্প শুনিয়া রাজপুত্রের হৃদয় উদাস হইয়া যাইত ।
 
একদিন সদাগরের পুত্র আসিয়া রাজপুত্রকে কহিল , সাঙাত , পড়াশুনা তো সাঙ্গ করিয়াছি, এখন একবার দেশভ্রমণে বাহির হইব, তাই বিদায় লইতে আসিলাম । ”
 
রাজার পুত্র কহিল , “ আমিও তোমার সঙ্গে যাইব । ”
 
কোটালের পুত্র কহিল , “ আমাকে কি একা ফেলিয়া যাইবে। আমিও তোমাদের সঙ্গী । ”
 
রাজপুত্র দুঃখিনী মাকে গিয়া বলিল , “ মা , আমি ভ্রমণে বাহির হইতেছি — এবার তোমার দুঃখমোচনের উপায় করিয়া আসিব । ”
 
তিন বন্ধুতে বাহির হইয়া পড়িল ।
 
== ৩ ==
সমুদ্রে সদাগরের দ্বাদশতরী প্রস্তুত ছিল- তিন বন্ধু চড়িয়া বসিল । দক্ষিণের বাতাসে পাল ভরিয়া উঠিল, নৌকাগুলা রাজপুত্রের হৃদয়বাসনার মতো ছুটিয়া চলিল ।
 
শঙ্খদ্বীপে গিয়া একনৌকা শঙ্খ , চন্দনদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা চন্দন , প্রবালদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা প্রবাল বোঝাই হইল ।
 
তাহার পর আর চারি বৎসরে গজদন্ত মৃগনাভি লবঙ্গ জায়ফলে যখন আর-চারিটি নৌকা পূর্ণ হইল তখন সহসা একটা বিপর্যয় ঝড় আসিল ।
 
সব-কটা নৌকা ডুবিল , কেবল একটি নৌকা তিন বন্ধুকে একটা দ্বীপে আছাড়িয়া ফেলিয়া খান্‌ খান্‌ হইয়া গেল ।
 
এই দ্বীপে তাসের টেক্কা , তাসের সাহেব , তাসের বিবি , তাসের গোলাম যথানিয়মে বাস করে এবং দহলা-নহলাগুলাও তাহাদের পদানুবর্তী হইয়া যথানিয়মে কাল কাটায় ।
 
== ৪ ==
তাসের রাজ্যে এতদিন কোনো উপদ্রব ছিল না । এই প্রথম গোলযোগের সূত্রপাত হইল ।
 
এতদিন পরে প্রথম এই একটা তর্ক উঠিল — এই-যে তিনটে লোক হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্র হইতে উঠিয়া আসিল , ইহাদিগকে কোন্‌ শ্রেণীতে ফেলা যাইবে ।
 
প্রথমত , ইহারা কোন্‌ জাতি — টেক্কা , সাহেব , গোলাম না দহলা-নহলা ?
 
দ্বিতীয়ত , ইহারা কোন্‌ গোত্র — ইস্কাবন , চিড়েতন , হরতন অথবা রুহিতন ?
 
এ-সমস্ত স্থির না হইলে ইহাদের সহিত কোনোরূপ ব্যবহার করাই কঠিন । ইহারা কাহার অন্ন খাইবে , কাহার সহিত বাস করিবে, ইহাদের মধ্যে অধিকারভেদে কেই বা বায়ুকোণে , কেই বা নৈর্ঋতকোণে , কেই বা ঈশানকোণে মাথা রাখিয়া এবং কেই বা দণ্ডায়মান হইয়া নিদ্রা দিবে, তাহার কিছুই স্থির হয় না ।
 
এ রাজ্যে এতবড়ো বিষম দুশ্চিন্তার কারণ ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটে নাই ।
 
কিন্তু ক্ষুধাকাতর বিদেশী বন্ধু তিনটির এ-সকল গুরুতর বিষয়ে তিলমাত্র চিন্তা নাই । তাহারা কোনো গতিকে আহার পাইলে বাঁচে । যখন দেখিল তাহাদের আহারাদি দিতে সকলে ইতস্তত করিতে লাগিল এবং বিধান খুঁজিবার জন্য টেক্কারা বিরাট সভা আহ্বান করিল , তখন তাহারা যে যেখানে যে-খাদ্য পাইল খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল ।
 
এই ব্যবহারে দুরি তিরি পর্যন্ত অবাক । তিরি কহিল , ভাই দুরি , ইহাদের বাচবিচার কিছুই নাই । দুরি কহিল , “ ভাই তিরি , বেশ দেখিতেছি ইহারা আমাদের অপেক্ষাও নীচজাতীয় ” ।
 
আহারাদি করিয়া ঠাণ্ডা হইয়া তিন বন্ধু দেখিল , এখানকার মানুষগুলা কিছু নূতন রকমের । যেন জগতে ইহাদের কোথাও মূল নাই । যেন ইহাদের টিকি ধরিয়া কে উৎপাটন করিয়া লইয়াছে , ইহারা একপ্রকার হতবুদ্ধিভাবে সংসারের স্পর্শ পরিত্যাগ করিয়া দুলিয়া দুলিয়া বেড়াইতেছে । যাহা-কিছু করিতেছে তাহা যেন আর-একজন কে করাইতেছে । ঠিক যেন পুৎলাবাজির দোদুল্যমান পুতুলগুলি মতো । তাই কাহারও মুখে ভাব নাই , ভাবনা নাই , সকলেই নিরতিশয় গম্ভীর চালে যথানিয়মে চলাফেরা করিতেছে । অথচ সবসুদ্ধ ভারি অদ্ভুত দেখাইতেছে ।
 
চারি দিকে এই জীবন্ত নির্জীবতার পরম গম্ভীর রকমসকম দেখিয়া রাজপুত্র আকাশে মুখ তুলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল । এই আন্তরিক কৌতুকের উচ্চ হাস্যধ্বনি তাসরাজ্যের কলরবহীন রাজপথে ভারি বিচিত্র শুনাইল । এখানে সকলই এমনি একান্ত যথাযথ , এমনি পরিপাটি , এমনি প্রাচীন , এমনি সুগম্ভীর যে কৌতুক আপনার অকস্মাৎ-উচ্ছ্বসিত , উচ্ছৃঙ্খল শব্দে আপনি চকিত হইয়া, ম্লান হইয়া, নির্বাপিত হইয়া গেল — চারিদিকের লোকপ্রবাহ পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ স্তব্ধ গম্ভীর অনুভূত হইল ।
 
কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্র ব্যাকুল হইয়া রাজপুত্রকে কহিল , ভাই সাঙাত , এই নিরানন্দ ভূমিতে আর একদণ্ড নয় । এখানে আর দুই দিন থাকিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে হইবে জীবিত আছি কি না ।
 
রাজপুত্র কহিল , “ না ভাই , আমার কৌতূহল হইতেছে । ইহারা মানুষের মতো দেখিতে – ইহাদের মধ্যে এক-ফোঁটা জীবন্ত পদার্থ আছে কি না একবার নাড়া দিয়া দেখিতে হইবে । ”
 
== ৫ ==
এমনি তো কিছুকাল যায় । কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয় না । যেখানে যখন ওঠা , বসা , মুখ ফেরানো , উপুড় হওয়া , চিৎ হওয়া , মাথা নাড়া , ডিগবাজি খাওয়া উচিত , ইহারা তাহার কিছুই করে না বরং সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে এবং হাসে । এই - সমস্ত যথাবিহিত অশেষ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে - একটি দিগ্‌গজ গাম্ভীর্য আছে ইহারা তদ্দ্বারা অভিভূত হয় না ।
 
একদিক টেক্কা সাহেব গোলাম আসিয়া রাজপুত্র, কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্রকে হাঁড়ির মতো গলা করিয়া অবিচলিত গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল , “ তোমরা বিধানমতে চলিতেছ না কেন । ”
 
তিন বন্ধু উত্তর করিল , “ আমাদের ইচ্ছা । ”
 
হাঁড়ির মতো গলা করিয়া তাসরাজ্যের তিন অধিনায়ক স্বপ্নাভিভূতের মতো বলিল , ইচ্ছা? সে বেটা কে ?
 
ইচ্ছা কী সেদিন বুঝিল না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে বুঝিল । প্রতিদিন দেখিতে লাগিল, এমন করিয়া না চলিয়া অমন করিয়া চলাও সম্ভব , যেমন এদিক আছে তেমনি ও দিকও আছে — বিদেশ হইতে তিনটে জীবন্ত দৃষ্টান্ত আসিয়া জানাইয়া দিল, বিধানের মধ্যেই মানবের সমস্ত স্বাধীনতার সীমা নহে । এমনি করিয়া তাহারা ইচ্ছানামক একটা রাজশক্তির প্রভাব অস্পষ্টভাবে অনুভব করিতে লাগিল ।
 
ঐ সেটি যেমনি অনুভব করা অমনি তাসরাজ্যের আগাগোড়া অল্প অল্প করিয়া আন্দোলিত হইতে আরম্ভ হইল — গতনিদ্র প্রকাণ্ড অজগরসর্পের অনেকগুলা কুণ্ডলীর মধ্যে জাগরণ যেমন অত্যন্ত মন্দগতিতে সঞ্চলন করিতে থাকে সেইরূপ ।
 
== ৬ ==
নির্বিকারমূর্তি বিবি এতদিন কাহারো দিকে দৃষ্টিপাত করে নাই , নির্বাক্‌ নিরুদ্‌বিগ্নভাবে আপনার কাজ করিয়া গেছে । এখন একদিন বসন্তের অপরাহ্নে ইহাদের মধ্যে একজন চকিতের মতো ঘনকৃষ্ণ পক্ষ্ম ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করিয়া রাজপুত্রের দিকে মুগ্ধনেত্রের কটাক্ষপাত করিল । রাজপুত্র চমকিয়া উঠিয়া কহিল , এ কী সর্বনাশ! আমি জানিতাম , ইহারা এক-একটা মূর্তিবৎ তাহা তো নহে , দেখিতেছি এ যে নারী ।
 
কোটালের পুত্র ও সদাগরের পুত্রকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া রাজকুমার কহিল , “ ভাই , ইহার মধ্যে বড়ো মাধুর্য আছে । তাহার সেই নবভাবোদ্দীপ্ত কৃষ্ণনেত্রের প্রথম কটাক্ষপাতে আমার মনে হইল, যেন আমি এক নূতনসৃষ্ট জগতের প্রথম উষার প্রথম উদয় দেখিতে পাইলাম । এতদিন যে ধৈর্য ধরিয়া অবস্থান করিতেছি আজ তাহা সার্থক হইল । ”
 
দুই বন্ধু পরম কৌতূহলের সহিত সহাস্যে কহিল , “ সত্য নাকি, সাঙাত । ”
 
সেই হতভাগিনী হরতনের বিবিটি আজ হইতে প্রতিদিন নিয়ম ভুলিতে লাগিল । তাহার যখন যেখানে হাজির হওয়া বিধান , মুহুর্মুহু তাহার ব্যতিক্রম হইতে আরম্ভ হইল । মনে করো , যখন তাহাকে গোলামের পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁডাইতে হইবে তখন সে হঠাৎ রাজপুত্রের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ায়; গোলাম অবিচলিত ভাবে সুগম্ভীর কন্ঠে বলে , “ বিবি , তোমার ভুল হইল । ” শুনিয়া হরতনের বিবির স্বভাবত রক্তকপোল অধিকতর রক্তবর্ণ হইয়া উঠে , তাহার নির্নিমেষ প্রশান্ত দৃষ্টি নত হইয়া যায় । রাজপুত্র উত্তর দেয় , “ কিছু ভুল নাই , আজ হইতে আমিই গোলাম । ”
নবপ্রস্ফুটিত রমণীহৃদয় হইতে এ কী অভূতপূর্ব শোভা , এ কী অভাবনীয় লাবণ্য বিস্ফুরিত হইতে লাগিল । তাহার গতিতে এ কী সুমধুর চাঞ্চল্য , তাহার দৃষ্টিপাতে এ কী হৃদয়ের হিল্লোল , তাহার সমস্ত অস্তিত্ব হইতে এ কী একটি সুগন্ধি আরতি-উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে ।
 
এই নব অপরাধিনীর ভ্রমসংশোধনে সাতিশয় মনোযোগ করিতে গিয়া আজকাল সকলেরই ভ্রম হইতে লাগিল । টেক্কা আপনার চিরন্তন মর্যাদারক্ষার কথা বিস্মৃত হইল , সাহেবে গোলামে আর প্রভেদ থাকে না , দহলা-নহলাগুলা পর্যন্ত কেমন হইয়া গেল ।
 
এই পুরাতন দ্বীপে বসন্তের কোকিল অনেকবার ডাকিয়াছে, কিন্তু সেইবার যেমন ডাকিল এমন আর-কখনো ডাকে নাই । সমুদ্র চিরদিন একতান কলধ্বনিতে গান করিয়া আসিতেছে; কিন্তু এতদিন সে সনাতন বিধানের অলঙ্ঘ্য মহিমা একসুরে ঘোষণা করিয়া আসিয়াছে — আজ সহসা দক্ষিণবায়ুচঞ্চল বিশ্বব্যাপী দুরন্ত যৌবনতরঙ্গরাশির মতো আলোতে ছায়াতে ভঙ্গীতে ভাষাতে আপনার অগাধ আকুলতা ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল ।
 
== ৭ ==
এই কি সেই টেক্কা , সেই সাহেব , সেই গোলাম । কোথায় গেল সেই পরিতুষ্ট পরিপুষ্ট সুগোল মুখচ্ছবি । কেহ বা আকাশের দিকে চায় , কেহ বা সমুদ্রের ধারে বসিয়া থাকে , কাহারো বা রাত্রে নিদ্রা হয় না , কাহারো বা আহারে মন নাই ।
 
মুখে কাহারো ঈর্ষা , কাহারো অনুরাগ , কাহারো ব্যাকুলতা , কাহারো সংশয়। কোথাও হাসি , কোথাও রোদন , কোথাও সংগীত । সকলেরই নিজের নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি দৃষ্টি পড়িয়াছে । সকলেই আপনার সহিত অন্যের তুলনা করিতেছে ।
 
টেক্কা ভাবিতেছে , ‘ সাহেব ছোকরাটাকে দেখিতে নেহাত মন্দ না হউক কিন্তু উহার শ্রী নাই — আমার চাল-চলনের মধ্যে এমন একটা মাহাত্ম্য আছে যে , কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টি আমার দিকে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না । '
 
সাহেব ভাবিতেছে , ‘ টেক্কা সর্বদা ভারি টক্‌টক্‌ করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বেড়াইতেছে; মনে করিতেছে , উহাকে দেখিয়া বিবিগুলা বুক ফাটিয়া মারা গেল । ' – বলিয়া ঈষৎ বক্র হাসিয়া দর্পণে মুখ দেখিতেছে ।
 
দেশে যতগুলি বিবি ছিলেন সকলেই প্রাণপণে সাজসজ্জা করেন আর পরস্পরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন , ‘ আ মরিয়া যাই । গর্বিণীর এত সাজের ধুম কিসের জন্য গো, বাপু । উহার রকম-সকম দেখিয়া লজ্জা করে! ' বলিয়া দ্বিগুণ প্রযত্নে হাবভাব বিস্তার করিতে থাকেন ।
 
আবার কোথাও দুই সখায়, কোথাও দুই সখীতে গলা ধরিয়া নিভৃতে বসিয়া গোপন কথাবার্তা হইতে থাকে । কখনো হাসে , কখনো কাঁদে , কখনো রাগ করে , কখনো মান-অভিমান চলে , কখনো সাধাসাধি হয় ।
 
যুবকগুলা পথের ধারে বনের ছায়ায় তরুমূলে পৃষ্ঠ রাখিয়া, শুষ্কপত্ররাশির উপর পা ছড়াইয়া অলসভাবে বসিয়া থাকে । বালা সুনীল বসন পরিয়া সেই ছায়াপথ দিয়া আপনমনে চলিতে চলিতে সেইখানে আসিয়া মুখ নত করিয়া চোখ ফিরাইয়া লয় — যেন কাহাকেও দেখিতে পায় নাই , যেন কাহাকেও দেখা দিতে আসে নাই, এমনি ভাব করিয়া চলিয়া যায় ।
 
তাই দেখিয়া কোনো কোনো খেপা যুবক দুঃসাহসে ভর করিয়া তাড়াতাড়ি কাছে অগ্রসর হয় , কিন্তু মনের মতো একটাও কথা জোগায় না , অপ্রতিভ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে , অনুকূল অবসর চলিয়া যায় এবং রমণীও অতীত মুহূর্তের মতো ক্রমে ক্রমে দূরে বিলীন হইয়া যায় ।
 
মাথার উপরে পাখি ডাকিতে থাকে , বাতাস অঞ্চল ও অলক উড়াইয়া হূহু করিয়া বহিয়া যায় , তরুপল্লব ঝর্‌ঝর্‌ মর্‌মর্‌ করে এবং সমুদ্রের অবিশ্রাম উচ্ছ্বসিত ধ্বনি হৃদয়ের অব্যক্ত বাসনাকে দ্বিগুণ দোদুল্যমান করিয়া তোলে ।
 
একটা বসন্তে তিনটে বিদেশী যুবক আসিয়া মরা গাঙে এমনি একটা ভরা তুফান তুলিয়া দিল ।
 
== ৮ ==
রাজপুত্র দেখিলেন , জোয়ার-ভাঁটার মাঝখানে সমস্ত দেশটা থম্‌থম করিতেছে — কথা নাই , কেবল মুখ চাওয়াচাওয়ি ; কেবল এক পা এগোনো , দুই পা পিছনো ; কেবল আপনার মনের বাসনা স্তূপাকার করিয়া বালির ঘর গড়া এবং বালির ঘর ভাঙা । সকলেই যেন ঘরের কোণে বসিয়া আপনার অগ্নিতে আপনাকে আহুতি দিতেছে , এবং প্রতিদিন কৃশ ও বাক্যহীন হইয়া যাইতেছে। কেবল চোখ-দুটা জ্বলিতেছে , এবং অন্তর্নিহিত বাণীর আন্দোলনে ওষ্ঠাধর বায়ুকম্পিত পল্লবের মতো স্পন্দিত হইতেছে ।
 
রাজপুত্র সকলকে ডাকিয়া বলিলেন , “ বাঁশি আনো , তূরীভেরী বাজাও , সকলে আনন্দধ্বনি করো , হরতনের বিবি স্বয়ম্বরা হইবেন । ”
 
তৎক্ষণাৎ দহলা নহলা বাঁশিতে ফুঁ দিতে লাগিল , দুরি তিরি তূরীভেরী লইয়া পড়িল । হঠাৎ এই তুমুল আনন্দতরঙ্গে সেই কানাকানি, চাওয়াচাওয়ি ভাঙিয়া গেল ।
 
উৎসবে নরনারী একত্র মিলিত হইয়া কত কথা , কত হাসি , কত পরিহাস । কত রহস্যচ্ছলে মনের কথা বলা , কত ছল করিয়া অবিশ্বাস দেখানো , কত উচ্চহাস্যে তুচ্ছ আলাপ । ঘন অরণ্যে বাতাস উঠিলে যেমন শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়, লতায় বৃক্ষে, নানা ভঙ্গিতে হেলাদোলা মেলামেলি হইতে থাকে , ইহাদের মধ্যে তেমনি হইতে লাগিল ।
 
এমনি কলরব আনন্দোৎসবের মধ্যে বাঁশিতে সকাল হইতে বড়ো মধুর স্বরে সাহানা বাজিতে লাগিল । আনন্দের মধ্যে গভীরতা , মিলনের মধ্যে ব্যাকুলতা , বিশ্বদৃশ্যের মধ্যে সৌন্দর্য , হৃদয়ে হৃদয়ে প্রীতির বেদনা সঞ্চার করিল । যাহারা ভালো করিয়া ভালোবাসে নাই তাহারা ভালোবাসিল , যাহারা ভালোবাসিয়াছিল তাহারা আনন্দে উদাস হইয়া গেল ।
 
হরতনের বিবি রাঙা বসন পরিয়া সমস্তদিন একটা গোপন ছায়াকুঞ্জে বসিয়া ছিল । তাহার কানেও দূর হইতে সাহানার তান প্রবেশ করিতেছিল এবং তাহার দুটি চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিয়াছিল ; হঠাৎ এক সময়ে চক্ষু মেলিয়া দেখিল , সম্মুখে রাজপুত্র বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে ; সে অমনি কম্পিতদেহে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ভূমিতে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িল ।
 
রাজপুত্র সমস্তদিন একাকী সমুদ্রতীরে পদচারণা করিতে করিতে সেই সন্ত্রস্ত নেত্রক্ষেপ এবং সলজ্জ লুণ্ঠন মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন ।
 
== ৯ ==
রাত্রে শতসহস্র দীপের আলোকে , মালার সুগন্ধে , বাঁশির সংগীতে , অলংকৃত সুসজ্জিত সহাস্য শ্রেণীবদ্ধ যুবকদের সভায় একটি বালিকা ধীরে ধীরে কম্পিত চরণে মালা হাতে করিয়া রাজপুত্রের সম্মুখে আসিয়া নতশিরে দাঁড়াইল । অভিলষিত কণ্ঠে মালাও উঠিল না , অভিলষিত মুখে চোখও তুলিতে পারিল না । রাজপুত্র তখন আপনি শির নত করিলেন এবং মাল্য স্খলিত হইয়া তাঁহার কণ্ঠে পড়িয়া গেল । চিত্রবৎ নিস্তব্ধ সভা সহসা আনন্দোচ্ছ্বাসে আলোড়িত হইয়া উঠিল ।
 
সকলে বরকন্যাকে সমাদর করিয়া সিংহাসনে লইয়া বসাইল । রাজপুত্রকে সকলে মিলিয়া রাজ্যে অভিষেক করিল ।
 
== ১০ ==
সমুদ্রপারের দুঃখিনী দুয়ারানী সোনার তরীতে চড়িয়া পুত্রের নবরাজ্যে আগমন করিলেন ।
 
ছবির দল হঠাৎ মানুষ হইয়া উঠিয়াছে । এখন আর পূর্বের মতো সেই অবিচ্ছিন্ন শান্তি এবং অপরিবর্তনীয় গাম্ভীর্য নাই । সংসারপ্রবাহ আপনার সুখদুঃখ রাগদ্বেষ বিপদসম্পদ লইয়া এই নবীন রাজার নবরাজ্যকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল । এখন, কেহ ভালো , কেহ মন্দ , কাহারো আনন্দ , কাহারো বিষাদ — এখন সকলে মানুষ । এখন সকলে অলঙ্ঘ্য বিধানমতে নিরীহ না হইয়া নিজের ইচ্ছামতে সাধু এবং অসাধু ।
 
 
আষাঢ় ১২৯৯