বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/পঞ্চম প্রবাহ

পঞ্চম প্রবাহ

 স্বাধীনতা—কি মধুমাখা কথা! স্বাধীন জীবন কি আনন্দময়! স্বাধীন দেশ কি আরামের স্থান! স্বাধীন ভাবের কথাগুলি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলে হৃদয়ের সূক্ষ্ম শিরা পর্যন্ত আনন্দোচ্ছ্বাসে স্ফীত হইয়া উঠে এবং অন্তরে বিবিধ ভাবের উদয় হয়; মহাহর্ষে মন নাচিতে থাকে, না হয় মহাদুঃখে অশুর ফাটিয়া যায়। স্বাধীন মন, স্বাধীন জীবন পরাধীনতা স্বীকার করিতে যেরূপ কষ্ট বোধ করে, আবার অন্যকে অধীনতা স্বীকার করাইতে পারিলে ঐ অন্তরেই তেমনি অসীম আনন্দ অনুভূত হয়। এক পয়ে দুঃখ, অপর পক্ষের সুখ!

 এজিদ স্বরাজ্যে স্বাধীন। সকলেই তাহার আদেশের অধীন। জয়নালকে তিনি হাসি-রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “তুই কি করিবি?” জয়নালের মুখে তাহার উত্তরও তিনি শুনিয়াছেন। “ক্রমে বশে আনিয়া, ক্রমে শান্তভার ধরাইয়া, কার্যসিদ্ধির উপায় না করিলে এইক্ষণে কিছুই হইবে না। জয়নালকে প্রাণে মারিয়া, মদিনার সিংহাসনে বসিলে কোন লাভ নাই। জয়নাল নিয়মিতরূপে মদিনার কর দামেস্কে যোগাইলে, দামেস্কসিংহাসনের সহ প্রকারে গৌরব! কিন্তু সিংহশাবককে বশে আনা সহজ কথা নহে। কিছু দিন চেষ্টা করিয়া দেখা কর্ত্তব্য। প্রথমেই নিরাশ হইয়া হোসেন-বংশ একেবারে বিনাশ করিলে বাহাদুরী কি?” এই সকল আশার কুহকে পড়িয়া এজিদ বন্দিগণের প্রতি সুব্যবস্থার অনুমতি করিয়াছিলেন।

 জয়নাল কিসে বশ্যতা স্বীকার করে, কিসে সে প্রভু বলিয়া মান্য করে, কি উপায় করিলে নির্বিঘ্নে মদিনা-রাজ্য করতলস্থ হয়,অধীনতা,দাস কলরেখা জয়নালের সুপ্রশস্ত ললাটে অক্ষরূপে অঙ্কিত হয়,এজিদ এই সকল মহাচিন্তার ভার নিজ মস্তকে লইয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। বিনা যুদ্ধে মদিনার সম্রাট হওয়া সহজ কথা নহে! এজিদের মন্তক কেন—লোকমান, আফ্‌লাতুন প্রভৃতি মহা মহা চিন্তাশীল মহাজনের মস্তিষ্কও চিন্তায় ঘুরিয়া যায়। কিন্তু এজিদের এমনই দৃঢ় বিশ্বাস যে, মারওয়ান চেষ্টা করিলে অবশ্যই ইহার কোন এক প্রকারের সদুপায় বাহির করিতে পারিবে। মনের ব্যগ্রতায় দামেস্কের বহু লোকের প্রতি তাঁহার চক্ষু পড়িল, কিন্তু মারওয়ান ভিন্ন ইহার স্থির সিদ্ধান্ত করার উপযুক্ত পাত্র মানস-চক্ষে কাহাকেও তিনি দেখিতে পাইলেন না।

 মারওয়ান উপস্থিত হইলে, এজিদ ঐ সকল গুপ্ত বিষয়ের স্থির সিদ্ধান্ত করিতে বলিলেন। মারওয়ান একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “আগামী জুম্মাবারে (শুক্রবারে) জয়নাল দ্বারা মহারাজের নামে খোৎবা পাঠ করাই। একণে সমগ্র প্রদেশে হোসেনের নামে খোৎবা হইতেছে। কারণ, হোসেনের পর এ পর্যন্ত মদিনার রাজা কেহ হন নাই। জয়নাল যদি আপন পিতার নাম পরিত্যাগ করিয়া মহারাজের নামে খোৎবা পাঠ করে, তবেই কার্য্যসিদ্ধি — তবেই দামেস্কের জয়-তবেই বিনা যুদ্ধে মদিনা করতলে। যাহার নামে খোৎবা, তিনি মক্কা-মদিনার রাজা! এখনই রাজ্য মধ্যে ঘোষণা করিয়া দিতেছি যে, আগামী জুম্মাবারে শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন দামেস্কসম্রাট-মহারাজাধিরাজ এজিদ নামদারের নামে খোৎবা পাঠ করিবেন। নগরের যাবতীয় ঈশ্বরভক্ত লোককেই উপাসনা-মন্দিরে খোৎবা শুনিতে উপস্থিত হইতে হইবে। যিনি রাজ-আজ্ঞা অবহেলা করিবেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহার শিরচ্ছেদ করা যাইবে।”

 এজিদ মহাতুষ্ট হইয়া মারওয়ানকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করিলেন। মুহূর্তমধ্যে রাজ-ঘোষণা দামেস্ক নগরের ঘরে ঘরে প্রচারিত হইল! ঘোষণার মর্ম্মে অনেকেই সুখী হইল, আবার অনেকে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তাহাদের হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগিল। প্রকাশ্যে কোন কথা বলিবার সাধ্য নাই—পাছে রাজদ্রোহী সাব্যস্ত হইয়া প্রাণ যায়? গোপনে গোপনে তাহারা বলিতে লাগিলেন, “এত দিন পরে নূরনবী মোহাম্মদের প্রচারিত ধর্ম্মে কলঙ্ক-রেখা পতিত হইল! হায় হায়! কি মর্মভেদী ঘোষাণা! হায় হায়! ইসলাম ধর্মের এত অবমাননা! কাফেরের নামে খোৎবা। বিধর্ম্মী নারকী ঈশ্বরদ্রোহীর নামে খোৎবা! হা ইসলাম ধর্ম্ম! দুরন্ত জালেমের হস্তে পড়িয়া তোমার এই দুর্দ্দশা! হায় হায়! পুণ্যভূমি মদিনার সিংহাসন যাহার আসন, সেই শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন, কাফেরের নামে খোৎবা পড়িবে? সে খোৎবা শুনিবে কে? আমরা অধীন প্রজা, না যাইয়া, নিস্তার নাই! জগদীশ! আমাদের কর্ণ বধির কর, চক্ষুর জ্যোতিঃ হরণ কর, চলৎ শক্তি রহিত কর।”

 মোহাম্মদীয়গণ নানাপ্রকারে অনুতাপ করিতে লাগিলেন। এজিদপক্ষীয় বিধর্ম্মীরা দর্প করিয়া বলিতে লাগিল, “মোহাম্মদ-বংশের বংশমর্য্যাদার চিরগৌরব এখন কোথায় রহিল? ধন্য মন্ত্রী মারওয়ান!”

 এ সকল সংবাদ বন্দীরা এখনও পর্যন্ত জানিতে পারেন নাই। এজিদ মনে করিয়াছেনঃ “উহাদের জীবন আমার হস্তে,—উহাদের প্রাণ রাখিতে পারি, মুহূর্ত্তে বিনাশও করিতে পারি। জুম্মার দিন জয়নালকে ধরিয়া আনিয়া মসজিদে পাঠাইয়া দিব। যদি সে আমার নামে খোৎবা পড়িতে অস্বীকার করে, রাজাজ্ঞা অমান্য করা অপরাধে তখনই উহার প্রাণবিনাশ করিব।”

 জুম্মাবার উপস্থিত। নির্ধারিত সময়ের পূর্ব্বেই মোহাম্মদীয়গণ প্রাণের ভয়ে উপাসনামন্দিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জয়নাল আবেদীনের নিকটে যাইয়া মারওয়ান বলিল, “আজ তোমাকে মজিদে খোৎবা পড়িতে হইবে।”

 জয়নাল বলিলেন, “আমি প্রস্তুত আছি। ইমামদিগের কার্য্যই উপাসনায় অগ্রবর্তী হওয়া, খোৎবা পাঠ, ধর্ম্মের আলোচনা, শিষ্যদিগকে উপদেশ দান;—সুতরাং ঐ সকল আমার কর্তব্য কার্য্য। তুমি অপেক্ষা কর, আমি আমার মায়ের অনুমতি লইয়া আসি।”

 “তোমার মা’র অনুমতি লইতেই যদি চলিলে, আর একটি কথা শুনিয়া যাও।”

 “কি কথা?”

 খোৎবা পড়িতে হইবে বটে, কিন্তু তোমার নামে পড়িতে পারিবে না।” বিষাদ-সিন্ন জয়নাল চক্ষু পাকাইয়া বলিলেন, “কেন পারিব না?

 “কেন-র কোন উত্তর নাই,—রাজার আজ্ঞা।”

 “ধর্ম্মচর্চায় বিধর্ম্ম্মী রাজার আজ্ঞা কি? আমার ধর্ম্মকর্ম্ম আমি করিব, তাহতে তোমাদের কথা কি? আমি যত দিন মদিনায় সিংহাসনে না বসিব, তত দিন পিতার নামেই খোৎবা পাঠ করিব; এই ত রাজার আজ্ঞা। তুমি কোন্ রাজার কথা বলিতেছে?”

 “তুমি নিতান্তই অবোধ, কিছুই বুঝিতেছ না। তোমার মা'র নিকট বলিলে, তিনি সকলই বুঝিতে পারিবেন।”

 “আমি অবোধ না হইলে তোমাদের বন্দীখানায় কেন আসিব? আর কি কথা আছে বল। আমি মার নিকটে যাইতেছি।”

 “যিনি দামেস্কের রাজা, তিনিই এক্ষণে মদিনার রাজা। মক্কা ও মদিনা একই রাজার রাজ্য হইয়াছে। এখন ভাব দেখি কাহার নামে খোৎবা পাঠ করা কর্ত্তব্য?”

 “আমি ও-প্রকারের কথা বুঝিতে পারি না। যাহা বলিবার হয়, স্পষ্টভাবে বল।”

 “তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান নাই; কেবল থাকিবার মধ্যে আছে রাগ আর নিজের অহঙ্কার। বাদশাহ-নামদার এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে হইবে।”

 জয়নাল আবেদীন রোষে ও দুঃখে সজলনয়নে বলিতে লাগিলেন, “কাফেরের নামে আমি খোৎবা পড়িব? এজিদ কোন দেশের রাজা? আর সে কোন্ রাজার পুত্র?”

 মারওয়ান অতি ব্যস্তে জয়নাল আবেদীনকে ধরিয়া সস্নেহে বলিতে লাগিল, “সাবধান! সাবধান!! ও কথা মুখে আনিও না। মুখে আনিলে নিশ্চয়ই তোমার মাথা-কাটা যাইবে।”

 “আমি মাথা-কাটাতে ভয় করি না। তুমি আমার নিকট হইতে চলিয়া যাও-অমি খোৎবা পড়িতে যাইব না।” মারওয়ান মনে করিয়াছিল যে, জয়নালকে বলিরামাত্রই তিনি খোৎবা পড়িতে আসিবেন; কিন্তু জয়নাবের কথা শুনিয়া সে অবাক হইল। এদিকেও উপাসনার সময় অতি নিকট। মারওয়ান মনে মনে বলিতে লাগিল। “এ সিংহ-শাবকের নিকট চাতুরী চলিবে না, বল প্রকাশ করিলেও কার্য্য উদ্ধার হইবে না। সালেমা বিবির নিকটে যাইয়া বলি;—তিনি সর্বশ্রেষ্ঠা, বয়সেও প্রবীণা; অবশ্যই ভালমন্দ বিবেচনা করিয়া জয়নালকে সম্মত করাইয়া দিবেন। সকলেই ত একই বন্দীগৃহে রহিয়াছেন!”

 মারওয়ান সালেমা বিবির নিকট যাইয়া বলিল, “আপনাদের কপালের এমনই গুণ যে, ভাল করিতে গেলেও মন্দ হইয়া যায়। আমার ইচ্ছা-যে কোনও প্রকারে যেন এই বিপদ হইতে আপনারা উদ্ধার পান।”

 সালেমা বিবি বলিলেন, “কি প্রকারে ভাল করিতে ইচ্ছা কর?”

 “মহারাজ এজিদ-নামদার আজ্ঞা করিয়াছেন যে, জয়নাল আবেদীনের দ্বারা আজিকার জুম্মার খোৎবা পড়াইয়া তাহাদিগকে কারামুক্ত করিয়া দাও।”

  “ভাল কথা। জয়নাল কৈ? তাহাকে এ কথা বলিয়াছ?”

 “বলিয়াছি এবং তাহার উত্তরও শুনিয়াছি।”

 “সে কি উত্তর করিল? তার বুদ্ধি আছে কি?”

 “বুদ্ধিও খুব আছে, ক্রোধও খুব আছে।”

 “ক্রোধের কথা বলিও না। তাহারা ধর্মের দাস, ধর্ম্মই তাদের জীবন; বোধ হয়, সে ধর্ম্মসংক্রান্ত কোন কথা বলিয়া থাকিবে। ধর্ম্মবিরোধী কথা তাহাদের কর্ণে প্রবেশ না করলে কখনই সে-শরীরে ক্রোধের সঞ্চার হয় না।”

 “মহারাজ আজ্ঞা করিয়াছেনঃ আজ হোসেনের নাম পরিবর্ত্তন করিয়া মক্কা ও মদিনা এইক্ষণে যাহার করতলে, জয়নাল আবেদীন তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ করুক। আমি আজই তাহাদিগকে বন্দীগৃহ হইতে মুক্ত কনিয়া মদিনায় পাঠাইয়া দিব। জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিয়া রাজত্ব করুক-কিন্তু তাহাকে দামেস্করাজের অধীনে থাকিতে হইবে।”

 “এ কি কথা? বন্দী হইয়া আসিয়াছি বলিয়াই কি তিনি ধর্ম্মের প্রতি হক্ষেপ করিবেন। আমাদের প্রতি তিনি এত অত্যাচার করিতেছেন, তাঁহাকে যথার্থ ধার্ম্মিক বলিয়া কিরূপে স্বীকার করিব? হজরত মোহাম্মদ রসুলেল্লার প্রচারিত ধর্ম্মে যিনি দীক্ষিত নহেন, মদিনার সিংহাসনের যিনি অধীশ্বর নহেন, তাহার নামে কি প্রকারে খোৎবা পাঠ হইতে পারে? তাও আবার পাঠ করিবে—জয়নাল আবেদীন! এ কি কথা?”

 “আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, একটু শান্ত হউন। বন্দীভাবে থাকিয়া এতদূর বলা নিতান্তই অন্যায়। যাহা হউক, আমি বলি,—যদি খোৎবাটা পড়িলেই মুক্তিলাভ হয়, তাহাতে দোষ কি? জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিলে কি আর তাহার উপর দামেস্করাজের কোন ক্ষমতা থাকিবে? তখন যাহা ইচ্ছা তাহাই সে করিতে পারিবে, ইহাতে আর আপনাদের ক্ষতি কি?

 “ক্ষতি কিছুই নাই;—কিন্তু—”

 “আর ‘কিন্তু’ মুখে আনিবেন না, প্রাণ বাঁচাইতে অনেক—

 “জয়নালকে একবার ডাকিতে বল।”

 জয়নাল আবেদীন আড়ালে থাকিয়া সকলই শুনিতেছিলেন, সালেমা বিবির কথার অভাষেই নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মহারোষের চিহ্ন এবং ক্রোধের লক্ষণ দেখিয়া সালেমা বিবি অনুমানেই অনেক বুঝিলেন; সস্নেহে জয়নালের কপোলদেশ চুম্বন করিয়া অতি নম্রভাবে বলিতে লাগিলেন, “এজিদের নামে খোৎবা পড়ায় দোষ কি? যদি ভগবান কখনও তোমায় সুখ-সূর্য্যের মুখ দেখান, তোমার নামেই লক্ষ লক্ষ, কোটা কোটা লোক খোৎবা পাঠ করিবে। এখন মারওয়ানের কথা শুনিলে, বোধ হয়, ঈশ্বর ভালই করিবেন।”

 জয়নাল বলিলেন, “আপনিও কি এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে অনুমতি করেন?”

 “আমি অনুমতি করি না; তবে ইহা বলিতে পারি যে, তোমার মুক্তির জন্য আমরা সকলে প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি। এক দিন খোৎবা-পড়িলেই যদি তুমি সপরিবারে বন্দীগৃহ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পার, মদিনার সিংহাসনে নির্ব্বিবাদে বসিতে পার, তবে তাহাতে ক্ষতি কি ভাই? আরও এক কথা, তুমি ইচ্ছা করিয়া এই কুকার্যে রত হইতেছ না। এ পাপ তোমাকে স্পর্শ করিবে না।”

 “সামান্য কারামুক্তি আর মদিনার রাজ্যলাভের জন্য আমি এজিদের নামে খোৎবা পড়িব? এ বন্দীগৃহ হইতে মুক্তির জন্য ভয় কি? শক্তি থাকিলেই মুক্তি হইবে। যদি কেহ রাজ্য কাড়িয়া লইয়া থাকে, তাহার নিকট ভিক্ষা করিয়া রাজ্যগ্রহণ করা অপেক্ষা অস্ত্রে তাহার মস্তক নিপাত করাই শ্রেয়ঃ—এই আমার কথা।”

 সালেমা বিবি জয়নালের মুখে শত শত চুম্বন পুর্ব্বক আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হউক। ঈশ্বর তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন?”

 মারওয়ান বলিতে লাগিল, “আপনারা এরূপ গোলযোগ করিলে কোন কার্য্যই সিদ্ধ হইবে না। আর সময় নাই; যদি মদিনা যাইবার ইচ্ছা থাকে, এজিদের হস্ত হইতে পরিত্রাণের আশা থাকে, জয়নালকে খোৎবা পাঠ করিতে প্রেরণ করুন। ইহাতে সম্মত না হন, আমার অপরাধ নাই, আমি নাচার।”

 সালেমা বিবি বলিলেন, “জয়নাল! তুমি ঈশ্বরের নাম করিয়া মসজিদে ধাও! তোমার ভাল হইবে।”

 জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “আপনি যাইতে আজ্ঞা করিলেন?”

 “হ্যাঁ, আমি যাইতে আজ্ঞা করিলাম। তোমার কোনও চিন্তা নাই। আরও একটি কথা বলিতেছি, শুন। শুনিয়া মনে মনে বিচার করিলেই ভাল মন্দ বুঝিতে পারিবেঃ একদা তোমার পিতামহ হজরত আলী কাফেরদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আম্বাজ নামে এক নগরে গমন করিয়াছিলেন। সেখানে যাইয়া তিনি শুনিলেনঃ সে দেশ পুরুষাধিকারে নহে, হানুফা নামে একজন রাজ্ঞীর অধিকারভুক্ত। আরও আশ্চর্য কথা এই যে,—রাজ্ঞী সে পর্য্যন্ত বিবাহ করেন নাই; তাঁহার পণ এই,—বাহুযুদ্ধে যিনি তাহাকে পরাস্ত করিবেন, তাঁহাকেই তিনি পতিত্বে বরণ করিবেন। আর রাজ্ঞী জয়ী হইলে পরাজিত পক্ষকে আজীবন দাসত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহার দাসের মত থাকিতে হইবে। মহাবীর আলী স্ত্রীলোকের এই পণের কথা শুনিয়া যুদ্ধে প্রস্তুত হইলেন। হনুফাও কম ছিলেন না। যাবতীয় আরবীয় বীরকে তিনি জানিতেন। তাঁহারও মনে ইচ্ছা ছিল যে, আলীকে পরাস্ত করিয়া তিনি একজন মহাবীর দাস লাভ করিবেন। ঘটনাক্রমে সুযোগ ও সময় উপস্থিত!—দিন নির্ণয় হইল। রূপের গরিমায় যৌবনের জ্বলন্ত প্রতিভায় বিবি হনুফা আরবের সুবিখ্যাত বীরকেও তুচ্ছজ্ঞানে সমরাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু ঈশ্বরের মহিমায় যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া মোহাম্মদীয় ধর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক মহাবীর অলীকে স্বামীত্বে বরণ করিলেন। হজরত আলী বিবি ফাতেমার ভয়ে একথা মদিনায় কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই। সময়ে বিবি হনুফার গর্ভে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। আলী সে সময় মহা চিন্তিত হইলেন,—কি করেন? কথাও গোপন থাকে না! বিবি ফাতেমার ভয়ও কম নহে! পুত্রকে গোপনে আনাইয়া একদা তিনি প্রভু মোহাম্মদের পদপ্রান্তে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান হইলেন। প্রভু মোহাম্মদ পুত্রটিকে ক্রোড়ে লইয়া মুখে চুমা দিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানি। আমি ইহার নাম, ইহার মাতার নামের সহিত এবং আমার নামের সহিত যোগ দিয়া রাখিলাম।” বিবি ফাতেমা দেখিলেন যে, একটি অপরিচিত সন্তানকে প্রভু ক্রোড়ে করিয়া বারবার চুমা দিতেছেন। বিবি ফাতেমা ঐ সন্তানটির কথা জিজ্ঞাসা করায় সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ পাইল। বিবি ফাতেমা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া পিতাকে এক প্রকার ভৎসনা করিয়াই কহিলেন, “আমার সপত্নীপুত্রকে আপনি স্নেহ করিয়াছেন। আর কোন্ বিবেচনায় আপনার নামের সহিত যোগ করিয়া ইহার নাম রাখিলেন?”

 প্রভু বলিলেন,—ফাতেমা, শান্ত হও! এই মোহাম্মদ হানিফা তোমার কি কি উপকার করিবে, শুন। যে সময় প্রিয়পুত্র হোসেন কারবালার মহাপ্রান্তরে এজিদের আজ্ঞায় সীমার-হস্তে শহীদ হইবে, তৎকালে তোমার বংশে এক জয়নাল আবেদীন ভিন্ন পুরুষপক্ষে আর কেহই থাকিবে না; তোমার আত্মীয়স্বজন, ভগিনী, পুত্রবধুরা এজিদের সৈন্যহস্তে কারবালা হইতে দামেস্কে বন্দীভাবে আসিবে, তাহাদের কষ্টের সীমা থাকিবে না। সেই কঠিন সময়ে এই মোহাম্মদ হানিফা যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে উদ্ধার করিবে, জয়নাল আবেদীনকে মদিনার সিংহাসনে বসাইবে।” বিবি ফাতেমা পিতৃমুখে এই সকল কথা শুনিয়া মোহাম্মদ হানিফাকে আহ্লা‌দে ক্রোড়ে করিয়া তাহার আপাদমস্তকে চুমা দিয়া আশীর্ব্বাদপূর্ব্বক বলিলেন, “প্রাণাধিক! তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার হৃদয়ের ধন, মস্তকের মণি। তোমার দেহস্থ আমার চুম্বিত স্থানে কোনরূপ অস্ত্র প্রবেশ করিবে না! তুমি সর্ব্বদা সর্ব্বজয়ী হইয়া জগতে মহাকীর্ত্তি স্থাপন করিবে। আশীর্ব্বাদ করি, দীর্ঘজীবী হও!” প্রই পর্য্যন্ত বলিয়া সালেমা বিবি কহিলেনঃ যে সময় কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধের সূচনা হয়, সেই সময় আমি গোপনে একজন কাসেদকে মোহাম্মদ হানিফার নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বলিয়া পাঠাইয়াছি। মোহাম্মদ হানিফা শীঘ্রই দামেস্কে আসিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিবে। এই ত শাস্ত্রের কথা, এখন সকলই ঈশ্বরের হাত। আরও একটি কথা,—হোসেন যুদ্ধকালে কি বলিয়া গিয়াছিলেন, মনে হয়? তিনি বলিয়াছিলেন, “তোমরা ভাবিও না, এমন একটি লোক আছে, যদি তাহার কর্ণে এই সকল ঘটনার অণুমাত্রও প্রবেশ করে, তবে ইহার প্রতিশোধ সে অবশ্যই লইবে। সে কে?—সে এই মোহাম্মদ হানিফা।”

 জয়নাল আবেদীন এই পর্যন্ত শুনিয়া আর বিলম্ব করিলেন না। খোৎবা পাঠ করিবেন স্বীকার করিয়া উপাসনার সমুচিত পরিধেয় লইয়া তিনি বহির্গত হইলেন; মারওয়ান সঙ্গে সঙ্গে যাইতে লাগিল। নগরে হুলুস্থুল পড়িয়াছে!—আজ জয়নাল আবেদীন এজিদের নামে খোৎবা পাঠ করিবেন! মারওয়ানের আনন্দের সীমা নাই। আজ এজিদের আশা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হইবে। জয়নাল উপাসনা মন্দিরে প্রবেশ করিয়া উপাসনাস্তে খোৎবা পাঠ আরম্ভ করিলেন। মোহাম্মদীয়গণের অন্তরে খোৎবার শব্দগুলি সুতীক্ষ ছুরিকার ন্যায় বিদ্ধ হইতে লাগিল। কোন মুখে জয়নাল আবেদীন, মদিনার ইমামের নাম অর্থাৎ, হোসেনের নামের স্থানে এজিদের নাম উচ্চারণ করিবেন? হায়! হায়! এ কি হইল? কিন্তু সময় উপস্থিত হইলে . মদিনার সিংহাসনের যথার্থ উত্তরাধিকারী যিনি, তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ হইল। খতিবের[] মুখে কেহ এজিদের নাম শুনিল না, পূর্ব্বেও যে নাম, এখনও সেই হোসেনের নাম স্পষ্ট শুনিল।

 মোহাম্মদীয়গণ মনের আবেগে আনন্দ-উল্লাসে ‘জয় জয়’ শব্দ করিয়া উঠিল। এজিদপক্ষীয়গণ ক্রোধে অগ্নিমুর্ত্তি হইয়া জয়নাল আবেদীনকে নানা প্রকার কটুবাক্যে ভর্ৎ‌সনা করিতে করিতে ভজনালয় হইতে বাহির হইল।

 নিষ্কোষিত অসিহস্তে এজিদ ক্রোধে অধীর। কম্পিত-কলেবরে কর্কশস্বরে অসির ঝনঝন্ শব্দের সহিত রসনা সঞ্চালন করিয়া তিনি বলিলেন, “এখনই জয়নালের শিরশ্চেদ করিব। এত চাতুরী আমার সঙ্গে?”

 মারওয়ান বলিতে লাগিল, “বাদশাহ্‌-নামদার! আশাসিন্ধু এখনও পার হই নাই। বহুদুর আসিয়াছি বলিয়া ভরসা হইয়াছে;—অচিরেই তীরে উঠিব। কিন্তু মহারাজ। আজ যে একটা গোপনীয় কথা শুনিয়াছি, তাহাতে জয়নাল আবেদীনের জীবন শেষ করিলেও এমামবংশ সমুলে বিনাশ হইবে না, বরং সমরানল সতেজে জ্বলিয়া উঠিবে। সে দুর্দ্দান্ত প্রমত্ত বারণকে মারওয়ান যত দিন কৌশলাঙ্কুশে হোসেনের দাদ-উদ্ধার পর্য্যবেক্ষণ হইতে নিবারণ করিতে না পারিবে, ততদিন মারওয়ানের মনে শান্তি নাই, আপনার জীবনে আশা নাই।”

 এজিদ মৃত্তিকায় তরবারি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “সে কি কথা! হোসেনবংশে এখনও প্রমত্ত কুরসম বীরশ্রেষ্ঠ বীর আছে! আমি ত আর কাহাকেও দেখিতে পাই নাই?”

 মারওয়ান বলিল, “জয়নালকে নির্দিষ্ট বন্দীগৃহে প্রেরণ করিবার আদেশ হউক। আমি সে গুপ্তকথা—নিগূঢ়-তত্ত্ব এখনই বলিতেছি।”

  1. খতিব—যে খোৎবা পাঠ করে