বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/চতুর্থ প্রবাহ

চতুর্থ প্রবাহ

 পথিক ঊর্দ্ধশ্বাসে চলিতেছেন,—বিরাম নাই, মূহূর্ত্তকালের জন্য বিশ্রাম নাই। এজিদ গোপনে বলিয়া দিয়াছেন, যখন নিতান্ত ক্লান্ত হইবে, চলৎশক্তি রহিত হইবে, ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িবে, সেই সময়ে একটু বিশ্রাম করিও। কিন্তু বিশ্রামহেতু যে সময়টুকু অপব্যয় হইবে, বিশ্রামের পর দ্বিগুণ বেগে চলিয়া তাহা পরিপূর্ণ করিবে। পথিক এজিদ-আজ্ঞা লুঙ্ঘন না করিয়া অবিশ্রান্ত যাইতেছেন। একে মরুভূমি, তাহাতে প্রচণ্ড আতপতাপ, বিশেষ ছায়াশূন্য প্রান্তর,—বিশ্রাম করিবার স্থান অতি বিরল। দেশীয় পথিকের পক্ষে বরং সহজ, অপরিচিত ভিন্ন দেশীয় পথিকের পক্ষে এই মরুস্থানে ভ্রমণ করা নিতান্তই দুঃসাধ্য। এ পথিক দেশীয় এবং পরিচিত। দামেস্ক হইতে যাত্রা করিয়াছেন। কোথায় কোন পর্ব্বত, কোথায় কোন্ নির্ঝরিণীর জল পরিস্কার ও পানোপযােগী, তাহাও পূর্ব্ব হইতে তাহার জানা আছে। পথিক একটি ক্ষুদ্র পর্ব্বত লক্ষ্য করিয়া তদভিমুখে যাইতেছেন। কয়েক দিন পর্য্যন্ত অবিশ্রান্ত চলিয়া এক্ষণে অনেক দুর্ব্বল হইয়া অতিকষ্টে যাইতেছেন। নির্দ্দিষ্ট পর্ব্বতের নিকটস্থ হইলে পূর্ব্ব-পরিচিত আক্কাস ও তৎসহ কয়েকজন অনুচরের সহিত তাঁহার দেখা হইল।

 মােস্‌লমকে দেখিয়া আক্কাস্‌ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাই মােস্‌লেম! কোথায় যাইতেছ?”

 মােস্‌লেম উত্তর করিলেন, “পিপাসায় বড়ই কাতর, অগ্রে পিপাসা নিবৃত্তি করি, পরে আপনার কথার উত্তর দিতেছি।”

 আক্কাস্ বলিলেন, “জল অতি নিকটেই আছে। ঐ কয়েকটী খর্জ্জুরবৃক্ষের নিকট দিয়া সুশীতল নির্ঝরিণী অতি মৃদু মৃদুভাবে বহিয়া যাইতেছে। চল, ঐ খর্জ্জুর-বৃক্ষতলে সকলেই বসিয়া একটু বিশ্রাম করি। আমিও কয়েকদিন পর্য্যন্ত অত্যন্ত ক্লান্ত হইতেছি।”

 সকলে একত্র হইয়া সেই নির্দিষ্ট খর্জ্জুর-বৃক্ষতলে উপবেশন করিলেন। আক্কাস একখণ্ড প্রস্তর ভূমি হইতে উঠাইয়া তত্তলস্থ ঝর্ণার সুস্নিগ্ধ জলে জলপাত্র পূর্ণ করিয়া এবং থলিয়া হইতে কতক গুলি খাের্‌মা বাহির করিয়া মােসলেমের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। মােসলেম প্রথমে জল পান করিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন। দুইটি খাের্‌ম। মুখে দিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই আক্কাস্! এজিদের বিবাহ-পয়গাম (প্রস্তাব) লইয়া জয়নাবের ভবনে যাত্রা করিতেছি।”

 আক্কাস্‌ বলিলেন, “সে কি! আবদুল জব্বার কি মরিয়াছে?”

 মােস্‌লেম বলিলেন,—না আবদুল জব্বার মরেন নাই। জয়নাবকে তালাক দিয়াছেন।”

 আক্কাস্‌ বলিলেন,—“আহা, এমন সুন্দরী স্ত্রীকে কি দোষে পরিত্যাগ করিল? জয়নাবের মত পতিপরায়ণ ধর্ম্মশীলা, পতিপ্রাণা, নম্রভাবা রমণী এ প্রদেশে অতি কমই দেখা যায়। আবদুল জব্বারের প্রাণ এত কঠিন, ইহা ত আমি আগে জানিতাম না। কোন্ প্রাণে সে সােণার জয়নাবকে পথের ভিখারিণী করিয়া বিষাদ-সমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়াছে।”

 মােসলেম বলিলেন, “ভাই! ঈশ্বরের কার্য্য মনুষ্যবুদ্ধির অগােচর। তিনি কি উদ্দেশ্য সাধন করিতে যে কি করেন, কাহার মনের কি গতি, কি কারণে কোন্ কার্য্য সাধনে কোন্ সময়ে কি কৌশলে কিরূপ করিয়া যে, কোন্ কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাহা তিনিই জানেন। আমরা ভ্রমপূর্ণ অজ্ঞ মানব। আমাদের এই ক্ষুদ্র মস্তকে, এই ক্ষুদ্র চিন্তায়, সেই অনন্ত বিশ্বকৌশলীর বিচিত্র কৌশলের অণুমাত্র বুঝিবার ক্ষমতাও নাই, সাধ্যও নাই।”

 আক্কাস্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কত দিন আবদুল জব্বার জয়নাবকে পরিত্যাগ করিয়াছে?”

 “অতি অল্প দিন মাত্র।”

 “বােধ হয়, এখনও এদ্দাৎ (শাস্ত্রসঙ্গত বৈধব্যব্রত) সময় উত্তীর্ণ হয় নাই?”

 “প্রস্তাবে ত আর কোন বাধা নাই। এদ্দাৎ সময় উত্তীর্ণ হইলেই শুভকার্য্য সম্পন্ন হইবে।”

 “ভাই মােস্‌লেম! আমিও তােমাকে আমার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করিলাম। জয়নাবের নিকট প্রথমে এজিদের প্রস্তাব, শেষে আমার প্রার্থনার বিষয়ও প্রকাশ করিও। রাজভােগ পরিত্যাগ করিয়া সে আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবে, যদিও ইহা সম্ভব নহে, তথাপি ভুলিও না। দেখ ভাই! আশাতেই সংসার, আশাতেই সুখ, এবং আশাতেই জীবন। আশা কাহারও কম নহে। আমার কথা ভুলিও না। জয়নাব রূপ-লাবণ্যে দেশ-বিখ্যাত, পুরুষমাত্রেরই চক্ষু জয়নাব-রূপে মােহিত; স্বভাব, চরিত্র, ধীরতা ও নম্রতাগুণে জয়নাব সকলেরই নিকটেই সমাদৃত—তাহা আমি বেশ জানি। এ অবস্থাতেও বােধ হয় আমার আশা দুরাশা নহে। দেখ ভাই,ভুলিও না। মনের অধিকারী-ঈশ্বর। তিনি যেদিকে মন ফিরাইবেন, যেদিকে মন চালাইবেন, তাহা নিবারণ করিতে এজিদের রূপের ক্ষমতা নাই, অর্থেরও কোন ক্ষমতা নাই। সেই ক্ষমতাতীতের নিকটে কোন ক্ষমতারই ক্ষমতা নাই। যাহা হউক, আমার প্রার্থনা জয়নাবের নিকট অবশ্যই জানাইবে। আমার মাথা খাও, ঈশ্বরের দোহাই, এ বিষয়ে অবহেলা করিও না।”

 এইরূপ কথোপকথনের পর পরস্পর অভিবাদন করিয়া উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়া গেলেন। মোস্‌লেম কিছু দূর যাইয়াই দেখিলেন, মাননীয় এমাম হাসান সশস্ত্র মৃগয়ার্থ বহির্গত হইয়াছেন। এমাম হাসান এক্ষণে স্বয়ং মদিনার সিংহাসনে বসিয়া শাহীমুকুট শিরে ধারণ করিয়াছেন; রাজ্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করিয়াছেন। মোস্‌লেমকে দূর হইতে আগমন করিতে দেখিয়া তিনি আলিঙ্গনার্থ হস্ত প্রসারণ করিলেন। মোস্‌লেম পদানত হইয়া হাসানের পদচুম্বন করিয়া জোড়করে সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন।

 শাহজাদা হাসান বলিলেন, “ভাই মোস্‌লেম। আমার নিকট এত বিনয় কেন? কি বলিতে ইচ্ছা করিতেছ, অসঙ্কোচে প্রকাশ কর। তুমি ত আমার বাল্যকালের বন্ধু।”

 মোস্‌লেম কহিলেন, “আপনি ধর্ম্মের অবতার, ঐহিক-পারত্রিক—উভয় রাজ্যের রাজা। আপনার পদাশ্রয়েই সমস্ত মুসলমানের পরিত্রাণ, আপনার পবিত্র চরণযুগল দর্শনেই মহাপুণ্য; আপনার পদধূলি পাপ-বিমোচনের উপযুক্ত মহৌষধি; আপনাকে অন্তরের সহিত ভক্তি করিতে কাহার না ইচ্ছা করে? আপনার পদসেবা করিতে কে না লালায়িত হয়? আপনার উপদেশ শ্রবণ করিতে কে না সমুৎসুক হইয়া থাকে। আমি দাসানুদাস, আদেশ প্রতিপালনই আমার সৌভাগ্য।”

 “আজ আমার শিকারযাত্রা সু-যাত্রা। আজিকার প্রভাত আমার সু-প্রভাত। বহুদিনান্তে আজ বাল্যসখার দেখা পাইলাম। এক্ষণে তুমি ভাই কোথায় যাইতেছ?

 “এজিদের পরিণয়ের পয়গাম জয়নাবের নিকট লইয়া যাইতেছি। হজরত মাবিয়ার আদেশ, যত শীঘ্ন হয়, জয়নাবের অভিপ্রায় জানিয়া সংবাদ দিতে হইবে।”

 “এজিদ যে-কৌশলে এই ঘটনা ঘটাইয়াছে, তাহা সকলই আমি শুনিয়াছি। হজরত মাবিয়া যে যে কারণে এজিদের কার্য্যের প্রতিপোষকতা করিয়াছেন, তাহাও জানিয়াছি। অথচ, মাবিয়া যে, ঐ সকল ষড়যন্ত্রের মূল বৃত্তান্ত ঘুণাক্ষরেও অবগত নহেন, তাহাও আমার জানিতে বাকী নাই।”

 “আক্কাস্‌ও জয়নাবের প্রার্থী। বিশেষ অনুনয় করিয়া, এমন কি, ঈশ্বরের শপথ করিয়া তিনি বলিয়াছেন,—অগ্রে এজিদের প্রস্তাব করিয়া, পরিশেষে আমার প্রস্তাবটি করিও।— এজিদ ও আক্কাস, উভয়েরই পয়গাম লইয়া আমি জয়নাবের নিকট যাইতেছি। তিনি যে কাহার প্রস্তাব গ্রাহ্য করিবেন, তাহা ঈশ্বরই জানেন।”

 হাস্য করিয়া হাসান কহিলেন, “মোস্‌লেম! আক্কাসের প্রস্তাব লইয়া যাইতে যখন সম্মত হইয়াছ, তখন এ গরীবের কথাটিই বা বাকী থাকে কেন? আমিও তোমাকে উকিল নিযুক্ত করিলাম। সকলের শেষে আমার প্রার্থনাটিও জয়নাবকে জ্ঞাপন করিও। স্ত্রীজাতি প্রায়ই ধনপিপাসু হয়, আবার কেহ কেহ রূপের প্রত্যাশিনী হইয়াও থাকে, আমার না আছে ধন, না আছে রূপ। এজিদের ত কথাই নাই, আক্কাস্‌ও যেমন ধনবান, তেমনি রূপবান। অবশ্য ইহাদের প্রার্থনাই অগ্রগণ্য। জয়নাব-রত্ন ইহাদেরই হৃদয়-ভাণ্ডারে থাকিবার উপযুক্ত ধন। সে ভাণ্ডারে যত্নের ত্রুটি হইবে না, আদরেরও সীমা থাকিবে। স্ত্রীলোকেরা প্রায়ই বাহ্যিক সুখকেই যথার্থ সুখ বিবেচনা করিয়া থাকে। আমার গৃহে সংসারিক সুখ যত হইবে, তাহা তোমার অবিদিত কিছুই নাই। যদিও আমি মদিনার সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছি, কিন্তু ধরিতে গেলে আমি ভিখারী। আমার গৃহে ঈশ্বরের উপাসনা ব্যতীত কোন প্রকার সুখ-বিলাসের আশা নাই। বাহ্য জগতে সুখী হইবার এমন কোন উপকরণ নাই যে, তাহাতে জয়নাব সুখী হইবে। সকলের শেষে আমার এই প্রস্তাব জয়নাবকে জানাইতে ভুলিও না। দেখ ভাই! মনে রাখিও। ফিরিয়া যাইবার সময় যেন জানিতে পারি যে, জয়নাব কাহার প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন।” এই বলিয়া পরস্পর অভিবাদনপূর্ব্বক উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে গমন করিলেন।

 পথিক যাইতেছেন! মনে মনে বলিতেছেন, “হাঁ! ঈশ্বরের কি মহিমা! এক জয়নাব-রত্নের তিন প্রার্থী—এজিদ, আক্কাস্ আর মাননীয় হাসান! এজিদ ত পূর্ব্ব হইতেই জয়নাবের রূপে আত্মসমর্পণ করিয়া বসিয়া আছে! এজিদ যে দিন জয়নাবকে দেখিয়াছে, জয়নাবের অজ্ঞাতে যে দিন এজিদের নয়ন-চকোর জয়নাবের মুখচন্দ্রিমার পরিমল-সুধা পান করিয়াছে, সেই দিন এজিদ জয়নাবকেই মনঃপ্রাণ সমর্পণ করিয়া জয়নাবের রূপ-সাগরে আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছে; জয়নাবকেই জপমালা করিয়া দিবানিশি জয়নাব নাম জপ করিতেছে। জয়নাব ধ্যান, জয়নাব জ্ঞান!—আক্কাস্ ত এত অর্থশালী, এমন রূপবান পুরুষ, তাহারও মন আজ জয়নাব-নামে গলিয়া গেল। এমাম হাসান —যাঁহার পদছায়াতেই আমাদের মুক্তি, যাঁহার মাতামহ প্রসাদাৎ আমরা এই অক্ষয় ধর্ম্মের সুবিস্তারিত পবিত্র পথ দেখিয়া পরম কারুণিক পরমেশ্বরকে চিনিয়াছি, যাঁহার ভক্তের জন্যই সর্ব্বদা স্বর্গের দ্বার বিমোচিত রহিয়াছে, এমন মহাপুরুষও জয়নাব লাভের অভিলাষী! অহো! জয়নাব কি ভাগ্যবতী?” পথিক মনে মনে এইরূপ নানা কথা আন্দোলন করিতে করিতে পথবাহন করিতে লাগিলেন। চিন্তারও বিরাম নাই, গতিরও বিশ্রাম নাই।