বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/দশম প্রবাহ

দশম প্রবাহ

 নূরনবী মোহাম্মদের রওজায়[১] অর্থাৎ সমাধি-প্রাঙ্গণে হাসান-হোসেন, সহচর আবদুল্লাহ, ওমর এবং রহমান একত্রে বসিয়া পরামর্শ করিতেছেন। যখন কোন বিপদভার মস্তকে আসিয়া পড়ে, কোনরূপ গুরুতর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হয়, অথবা কোন অভাবনীয় চিন্তা সদ্‌যুক্তি সৎপরামর্শ করিবার আবশ্যক হইয়া উঠিত, হাসান-হোসেন উভয়ে মাতামহের সমাধিপ্রাঙ্গণে আসিয়া যুক্তি, পরামর্শ এবং কর্ত্তব্য বিষয়ে মত স্থির করিতেন। আজ কিসের মন্ত্রণা? কি বিপদ? বাহ্যিকভাবে, মুখের আকৃতিতে স্পষ্টই যেন কোন ভয়ানক চিন্তার চিত্র চিত্রিত। কি চিন্তা? পাঠক! ঐ দেখুন, সমাধিপ্রাঙ্গণে সীমানির্দ্দিষ্ট স্থানের নিকটে কে দাঁড়াইয়া আছে।

 প্রভু মোহাম্মদের সমাধিপ্রাঙ্গণের সীমামধ্যে অন্য কাহারও যাইবার রীতি নাই। দর্শক, পূজক, আগন্তুক সকলের জন্যই চতুষ্পার্শস্থ নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে থাকিয়া জেয়ারাত (ভক্তিভাবে দর্শন) করিবার প্রথা প্রচলিত আছে।

 পাঠক! যে লোক দাঁড়াইয়া আছে, উহাকে কি কখনও দেখিয়াছেন? একটু স্মরণ করুন, অবশ্যই মনে পড়িবে। এই আগন্তুক দামেস্কের কাসেদ। আর হাসানের হস্তে ঐ যে কাগজ দেখিতেছেন, ঐখানি সেই পত্র—যাহা দামেস্কের রাজদরবারে মারওয়ান পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন। ওমর বলিলেন, “কালে আরও কত হইবে। এজিদ মাবিয়ার পুত্র। যে মাবিয়া নূরনবী হজরত মোহাম্মদের প্রধান ভক্ত ছিলেন, দেহ-মন-প্রাণ সকলই আপনার মাতামহের চরণে সমর্পণ করিয়াছিলেন, আজ তাঁহার পুত্র মক্কা-মদিনার খাজানা চাহিতেছে! এজিদের নামে খোৎবা পাঠ করিতে লিখিয়াছে! কি আশ্চর্য্য! আরও কতই হইবে, তাহা কে বলিতে পারে?”

 আবদর রহমান বলিলেন, “এজিদ পাগল হইয়াছে! নিশ্চয়ই পাগল! পাগল ভিন্ন আর কি বলিব? এই অসীম জগতে এমন কেহই নাই যে আমরা বাঁচিয়া থাকিতে মক্কা-মদিনার কর চাহিতে পারে। এজিদ যে মুখে এই সকল কথা বলিয়াছে, সেই মুখের শাস্তি বিশেষ করিয়া দেওয়া উচিত। ইহাতে পরামর্শ আর কি? আমার মতে কাসেদকে পত্রসহ অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেওয়াই সমুচিত বিধি। এ পাপপূর্ণ কথাঙ্কিত পত্র পুণ্যভূমি মদিনায় থাকিবার উপযুক্ত নহে।”

 ওমর বলিলেন, “ভাই! তোমার কথা অবহেলা করিতে পারি না। দুরাত্মার কি সাহস! কোন মুখে এমন কথা উচ্চারণ করিল? কি হিসাবে পত্র লিখিয়া কাসেদের হস্তে দিয়া পাঠাইল? উহার নিকটে কি কোন ভাল লোক নাই? এক মাবিয়ার সঙ্গে সঙ্গে দামেস্ক হইতে কি সকলেই চলিয়া গিয়াছে?”

 আবদুর রহমান বলিলেন, “পশুর নিকটে কি মানুষের আদর আছে? হামান—নামে মাত্র মন্ত্রী। হামানের কোন কথাই এজিদ শুনিতে চায় না। মারওয়ানই আজকাল দামেস্কের প্রধান মন্ত্রী, সভাসদ, প্রধান মন্ত্রদাতা, এজিদের প্রধান গুরু; বুদ্ধি, বল, যাহা কিছু সকলই মারওয়ান—এই ত সকলের মুখে শুনিতে পাই!”

 হাসান বলিলেন, এ যে মারওয়ানের কার্য্য তাহা আমি পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছি। যাহা হউক, আমার বিবেচনায় এ পত্র ফিরাইয়া দেওয়াই উচিত।”

 হজরত এমাম হাসানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হজরত হোসেন একটু রোষভরে বলিতে লাগিলেন, “আপনারা যাহাই বলুন, আর যাহাই বিবেচনা করুন, কেবলমাত্র পত্রখানা ফেরত দেওয়া আমার ইচ্ছা নহে। কম্‌জাৎ বাঁদীবাচ্ছা কী ভাবিয়াছে? ওর এতদূর স্পর্ধা যে, আমাদিগকে তার অধীনতা স্বীকার করিতে পত্র লিখে? আমরা তাকে শাহান্‌শাহ (সম্রাট) বলিয়া মান্য করিব? যাহাদের পিতার নামে দামেস্ক-রাজ্য কাঁপিয়া উঠিয়াছে, তাঁহাদের আজ এতদূর অপমান! যাঁহার পদভরে দামেস্ক-রাজ্য দলিত হইয়া বক্ষে সিংহাসন পাতিয়া তাঁহাকে বসিবার স্থান দিয়াছে এবং নিয়মিতরূপে কর যোগাইয়াছে, আমরা তাঁহারই সম্ভান—তাঁহারই উত্তরাধিকারী। আমরাই দামেস্কের রাজা, দামেস্কের সিংহাসন আমাদেরই বসিবার স্থান। কম্‌জাৎ কাফের সেই সিংহাসনে বসিয়া আমাদেরই নিকট মক্কা-মদিনার খাজানা চাহিয়াছে, ইহা কি সহ্য হয়?”

 হাসান বলিলেন, “ভ্রাতঃ! একটু বিবেচনা করিয়া কার্য্য করাই ভাল। আমরা অগ্রে কিছুই বলিব না, এজিদ যাহা লিখিয়াছে, তাহার কোন উত্তর দিব না। দেখি সে কোন্ পথে যায়, কি উপায় অবলম্বন করে।”

 আবদর রহমান বলিলেন, “ভ্রাতঃ! আপনার কথা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বিষধর সর্প যখন ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়, তখনি তাহার মাথা চূর্ণ করা আবশ্যক; নতুবা সময় পাইলে সে নিশ্চয়ই দংশন করে। এজিদও কালসর্প। উহার মস্তক প্রথম উত্তোলনেই চূর্ণ করিয়া ফেলা বিধেয়, বিশেষতঃ আপনার প্রতিই উহার বেশী লক্ষ্য।”

 গম্ভীরভাবে হাসান কহিলেন, “এখনও সে সময় হয় নাই, আর একবার পরীক্ষা করিয়া দেখি। এবারে নিরুত্তরই সদুত্তর মনে করিয়াছি।”

 হোসেন বলিলেন, “আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য্য। কিন্তু একেবারে নিরুত্তর হইয়া থাকা আমার বিবেচনায় যুক্তিযুক্ত নহে; আপনার আদেশ লঙ্ঘন করিব না। আমি কাসেদকে বিদায় করিতেছি। পত্রখানা আমার হস্তে প্রদান করুন।”

 হোসেনের হস্তে পত্র দিয়া হাসান রওজা হইতে নিকটস্থ উপাসনা মন্দিরাভিমুখে চলিয়া গেলেন। কাসেদকে সম্বোধন করিয়া হোসেন বলিতে লাগিলেন, “কাসেদ! আজ আমি রাজনীতির মস্তকে শত পদাঘাত করিতাম, আজ আমি চিরপদ্ধতি, প্রাচীন নীতি উপেক্ষা করিয়া এই পত্রের সমুচিত উত্তর প্রদান করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াও ভ্রাতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন মহাপাপ জানিয়া তোমার প্রাণ তোমাকে অর্পণ করিলাম। কম্‌জাৎ এজিদ যে পত্র দিয়া তোমাকে মদিনায় পাঠাইয়াছে, ইহার প্রতি অক্ষরে শত শত বার পাদুকাঘাত করিলেও আমার ক্রোধের অণুমাত্র উপশম হয় না। কি করি, ধর্ম্মগ্রন্থে লিখিত ভাষার অক্ষর ইহাতে সন্নিবেশিত আছে বলিয়াই তাহা করিলাম না। ফিরিয়া গিয়া সেই কম্‌জাৎকে এই সকল কথা অবিকল বলিও এবং দেখাইও যে তাহার পত্রের উত্তর এই—

 এই কথাগুলি বলিয়া পত্রখানি শত খণ্ড করিয়া কাসেদের হস্তে দিয়া হোসেন আবার বলিলেন, “যাও!—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া যাও যে, আজ এই উপস্থিত সন্ধ্যাতেই তোমার জীবনের শেষ সন্ধ্যা হইতে তুমি মুক্তি পাইলে।” হোসেন এই বলিয়া কাসেদের নিকট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। এদিকে সন্ধ্যাকালীন উপাসনার সময়ে আহ্বানসূচক সুমধুরধ্বনি (আজান) ঘোষিত হইল; সকলেই উপাসনা করিতে গমন করিলেন। কাসেদের প্রত্যাগমনের পূর্ব্বেই এজিদ সমরসজ্জায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। সৈন্যগণের পরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্রের পারিপাট্য, আহার্য্য দ্রব্যের সংগ্রহ, পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত, বহনোপযোগী বাহন ও বস্ত্রাবাস প্রভৃতি যাহা যাহা আবশ্যক, তৎসমস্তই প্রস্তুত করিয়াছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানিয়াছিলেন যে, পত্র পাইয়া হাসান-হোসেন একেবারে জ্বলিয়া উঠিবে। এমন কি, কাসেদের প্রাণ লইয়া দামেস্কে ফিরিয়া আসা সন্দেহ বিবেচনা করিয়া তিনি গুপ্তচরও নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ভাবিয়াছিলেন নিশ্চয়ই যুদ্ধ হইবে, কেবলমাত্র সংবাদ-প্রাপ্তির অপেক্ষায় ছিলেন। এক দিন আপন সৈন্য-সামন্তগণকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া প্রথমতঃ অশ্বারোহী সৈন্যদিগের যুদ্ধকৌশল ও অস্ত্রচালনা দেখিয়া পরে পদাতিক সৈন্যের ব্যুহ-নির্মাণের নৈপুণ্য, আত্মরক্ষা করিয়া বিপক্ষের প্রতি অস্ত্র-চালনার সুকৌশল এবং সমর প্রাঙ্গণে পদচালনার চাতুর্য্য দেখিয়া এজিদ মহানন্দে বলিতে লাগিলেন, “আমার এই শিক্ষিত সৈন্যগণের অস্ত্রের সম্মুখে দাঁড়ায় এমন সুশিক্ষিত সাহসী সৈন্য কাহার আছে? ইহাদের নির্ম্মিত ব্যুহ ভেদ করিয়া যুদ্ধে জয়ী হওয়া কাহার সাধ্য? হাসান ত দূরের কথা, তাহাদের পিতা যে অত বড় যোদ্ধা ছিল, সেই আলীও যদি কবর হইতে উঠিয়া যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখীন হয়, তাহা হইলেও তাহার পরাজয় ভিন্ন জয়ের আশা নাই।”

 এজিদ এইরূপ আত্মগৌরব ও আত্মপ্রশংসায় মত্ত ছিলেন, এমন সময় মদিনা হইতে কাসেদ ফিরিয়া আসিয়া সমুচিত অভিবাদনপূর্ব্বক এজিদের হস্তে সেই ছিন্ন পত্রটি দিয়া, হোসেন যাহা বলিয়াছিলেন, অবিকল তাহা বলিল।

 এজিদ ক্রোধে অধীর হইয়া কিঞ্চিৎ উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন,—সৈন্যগণ! তোমরা আমার দক্ষিণ বাহু, তোমরাই আমার একমাত্র ভরসা। আমি তোমাদিগকে যথাযোগ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত করিয়াছি। পূর্ব্ব হইতেই তোমাদের বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছি, যে যেমন উপযুক্ত, তাহাকে সেই প্রকার সম্মানে সম্মানিত করিয়াছি। এত দিন তোমাদিগকে যত্ন করিয়া প্রতিপালন করিয়াছি। আজ আমার এই আদেশ যে, এই সজ্জিত বেশ আর পরিত্যাগ করিও না, হস্তস্থিত অসিও আর কোষে রাখিও না। ধনুর্দ্ধরগণ! তোমরা আর তূণীরের দিকে লক্ষ্য করিও না। মদিনার সম্মুখে অগ্রসর ভিন্ন আর যেন পশ্চাতে ফিরিও না। এই বেশে এই যাত্রাই শুভযাত্রা জ্ঞান করিয়া হাসান-হোসেন-বধে এখনই যাত্রা কর। যত শীঘ্র পার, প্রথমে হাসানের মস্তক অনিয়া আমাকে দেখাও। লক্ষ টাকা পুরস্কার! আমি নিশ্চয়ই জানি, তোমরা মনোযোগী হইয়া একটু চেষ্টা করিলেই উভয়ের মস্তক তোমাদের হস্তেই দামেস্কে আনীত হইবে। আমার মন ডাকিয়া বলিতেছে, তোমাদের তরবারি সেই উভয় ভ্রাতার শোণিত পান করিতে লোলুপ হইয়াছে।”

 সৈন্যগণকে ইহা বলিয়া মন্ত্রীকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই মারওয়ান! তুমি আমার বাল্যসহচর। আজ আমার প্রতিনিধিস্বরূপ তোমাকেই এই বীরদলের অধিনায়ক হইতে হইবে। তোমাকেই সেনাপত্যের ভার গ্রহণ করিতে হইবে। কারণ, হাসান-হোসেনের বধসাধনের জন্য সৈন্যদলকে মদিনায় পাঠাইতেছি। যদি এজিদের মানরক্ষা করিতে চাও, যদি এজিদের অন্তরাগ্নি নির্ব্বাণ করিতে চাও; যদি এজিদের মনের দুঃখ দূর করিতে তাহার জয়নাব-লাভের আশাতরী বিষাদ-সিন্ধু হইতে উদ্ধার করিতে চাও, তবে এখনই অগ্রসর হও, আর পশ্চাতে ফিরিও না। পূর্ব্ব হইতে সকলই আমি সমুচিতরূপে আয়োজন করিয়া রাখিয়াছি। আজ এজিদের প্রাণ তোমারই হস্তে সমর্পিত হইল। যেদিন হাসান-হোসেনের মৃত্যুসংবাদ এই নগরে আসিবে, সেই দিন জানিও যে, এজিদ পুনর্জ্জীবিত হইয়া দামেস্ক রাজভাণ্ডারের দ্বার অবারিত করিয়া দিবে; সংখ্যা করিয়া, কি হস্তে তুলিয়া দিবে না; সকলেই যথেচ্ছরূপে যথেচ্ছ পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করিবে; কাহারও আদেশের অপেক্ষায় থাকিতে হইবে না। মারওয়ান! সকল কার্য্যে ও সকল কথাতেই ‘যদি’ নামে একটি শব্দ আছে। জগতে আমি যদি কিছু ভয় করি, তবে ঐ ‘যদি’ শব্দেই সময়ে সময়ে আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠে। যদি যুদ্ধে পরাস্ত হও, নিরুৎসাহ হইও না, হাসান-হোসেনের বধ-সঙ্কল্প হইতে কখনই চ্যুত হইও না, দামেস্কেও ফিরিও না। মদিনার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে থাকিয়া তোমার চিরবন্ধুর চিরশত্রুর প্রাণসংহার করিতে যত্ন করিও। ছলে হউক, বলে হউক, কৌশলে হউক, কিংবা অর্থে ই হউক, প্রথমে হাসানের জীবন-প্রদীপ তোমার হস্তে নির্ব্বাণ হওয়ার শুভ-সংবাদ আমি শুনিতে চাই। হাসানের প্রাণবিয়োগজনিত জয়নাবের পুনঃ বৈধব্য ব্রত আমি সানন্দচিত্তে শুনিতে চাই। আর কি বলিব? তোমর অজানা আর কি আছে?”

 সৈন্যদিগকে সম্বোধন করিয়া মারওয়ান বলিতে লাগিলেন, “বীরগণ! তোমাদের প্রভুর আজ্ঞা সকলেই স্বকর্ণে শুনিলে। আমার আর বলিবার কিছুই নাই। ভ্রাতৃগণ! এখন একবার দামেস্ক-রাজের জয়নাদে আকাশ ফটাইয়া, জগৎ কঁপাইয়া, মনের আনন্দে দ্বিগুণ উৎসাহে এখনই যাত্রা কর। মারওয়ান ছায়ার ন্যায় তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকিবে।”

 সৈন্যগণ বীরদর্পে ঘোর নাদে বলিয়া উঠিল, “জয় মহারাজ এজিদের জয়! জয় মহরাজ দানেস্করাজের জয়!”

 কাড়া, নাকাড়া, ডঙ্কা গুড়্ গুড়্ শব্দে বাজিয়া যেন বিনামেঘে মেঘগর্জ্জনের ন্যায় অবিরত ধ্বনিত হইতে লাগিল। আজ অকস্মাৎ বিনামঘে হৃদয়কম্পন, বজ্রধ্বনির ন্যায় ভীমনাদ শ্রবণে নগরবাসীরা ভয়াকুলচিত্তে বাহিরে অসিয়া দেখিলেন: গগনে মেঘের সঞ্চারমাত্র নাই, কিন্তু রাজপথ প্রস্তররেণু ও বালুকাকণাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন; অসংখ্য সেনা রণবাদ্যে মাতিয়া শুভসূচক বিজয়-নিশান উড়াইয়া মদিনাভিমুখে চলিয়াছে। নগরবাসিগণের মধ্যে কাহারও মনে ব্যথা লাগিল, কাহারও চক্ষু জলে পূর্ণ হইল, কেহ কেহ এজিদের জয়ধ্বনি করিয়া আনন্দ অনুভব কবিল।

 এজিদ মহোৎসবে নগরের অন্তঃসীমা পর্য্যন্ত সৈন্যদিগের সঙ্গে সঙ্গে যাইয়া মারওয়ান, সৈন্যগণ ও সৈন্যাধ্যক্ষ অলীদের নিকটে বিদায় লইয়া নগরে ফিরিয়া আসিলেন।

 মদিনাবাসীরা কিছু দিন এজিদের কথা লইয়া বিশেষ আলোচনা করিলেন। সর্ব্বসাধারণের অন্তরেই এজিদের পত্রের প্রতি ছত্র, প্রতি অক্ষর, সুতীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় বিঁধিয়াছিল। হাসান-হোসেনের প্রতি এজিদ যেরূপ অপমানসূচক কথা ব্যবহার করিয়াছে, তাহার শাস্তি কোথায় হইবে, ঈশ্বর যে কি শাস্তি প্রদান করিবেন, তাঁহারা তাহা ভাবিয়াও স্থির করিতে পারিলেন না। প্রবীণেরা দিবারাত্র হাসান-হোসেনের মঙ্গলকামনায় ঈশ্বরসমীপেও প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। পূর্ণবয়স্কেরা বলিতে লাগিলেন, “আমরা বাঁচিয়া থাকিতে কাহার সাধ্য যে, এমাম হাসান হোসেনের প্রতি দৌরাত্ম্য করে? আমরা বাঁচিয়া থাকিতে যে নরাধম এমামের প্রতি অযথা ব্যবহার করিবে, তাহাকে শীঘ্রই নরকের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে জ্বলিতে হইবে।” নব্য যুবকেরা বলিতে লাগিলেন, “দামেস্কের কাসেদকে একবার দেখিতে পাইলে মদিনার খাজানা দিয়া বিদায় করিতাম। এত দিতাম যে, বহন করিয়া লইয়া যাইতে তাহার শক্তি থাকিত না। দেহটি এখানে রাখিয়া শুধু প্রাণ লইয়া দামেস্কে ফিরিয়া যাইতে হইত।” স্ত্রী-পুরুষমাত্রেই এজিদের নামে শত শত পাদুকাঘাত করিলেন। কিছু দিন গত হইলে, দামেস্কের আর কোন সংবাদ নাই। এজিদের সম্বন্ধে আন্দোলন ক্রমে ক্রমে অনেক পরিমাণে কমিয়া আসিল।

 মদিনাবাসীরা আপন গৃহে শুইয়া আছেন, নিশা প্রায় অবসান হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় সহসা নাকাড়ার শব্দ শুনিতে পাইয়া অগ্রে নগর-প্রান্তের অধিবাসীরা জাগিয়া উঠিলেন, অসময়ে রণবাদ্যের কোন কারণই নির্ণয় করিতে পারিলেন না। প্রভাত নিকটবর্ত্তী। ইহার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনাও নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। সূর্য্যোদয় পর্য্যন্ত নগরের প্রায় সমস্ত লোকের কাণেই সেই তুমুল ঘোর রণবাদ্য প্রবেশ করিয়া দীর্ঘসূত্রীরও নিদ্রাভঙ্গ করিল। অনেকে নগরের বাহির হইয়া দেখিলেন যে, বহুসংখ্যক সৈন্য বীরদর্পে গম্যপথ অন্ধকার করিয়া নগর-অভিমুখে আসিতেছে। সূর্য্যদেব সহস্র কিরণে মদিনাবাসীকে নিজ মূর্ত্তি দেখাইয়া এজিদের চিহ্নত পতাকা এবং সৈন্যদিগের নূতন সজ্জা দেখাইলেন। সকলেই স্থিরসিদ্ধান্ত করিলেন যে, হাসান-হোসেনকে নির্য্যাতন এবং তাঁহাদের প্রাণহরণ-মানসে এজিদ সসৈন্যে সমরে আসিতেছেন।

 আবদুর রহমান আর বিলম্ব করিলেন না। দ্রুত গমন করিয়া হাসানহোসেনের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত জানাইলেন; তাঁহারা আর কালবিলম্ব না করিয়া এজিদের বিরুদ্ধে জেহাদ (ধর্ম্মযুদ্ধ) ঘোষণা করিয়া যুদ্ধের আয়োজনে ব্যস্ত হইলেন। মুহূর্ত্তমধ্যে মদিনার ঘরে ঘরে জেহাদ-রবের প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। মোহাম্মদীয়গণ জেহাদের নাম শুনিয়া আহ্লাদে নাচিয়া উঠিলেন। বিধর্ম্মীর অস্ত্রাঘাতে প্রাণত্যাগ করিলেই শহীদ (ধর্ম্মযুদ্ধে শোণিতপাতে প্রাণত্যাগে মুক্ত) হয়, স্বর্গের দ্বার শহীদদিগের নিমিত্ত সর্ব্বদাই খোলা রহিয়াছে,—ধর্ম্মযুদ্ধে বিধর্ম্মীর অস্ত্রাঘাতের রক্তপ্রবাহে মোহাম্মদীয়গণের সমুদয় পাপ বিধৌত হইয়া পবিত্রভাবে পুণ্যাত্মা রূপধারণে শহীদগণ নির্ব্বিচারে যে স্বর্গসুখে সুখী হন, ইহা মুসলমানমাত্রেরই অন্তরে অনন্তকাল পর্য্যন্ত জাগিবে।

 মদিনার বালক, বৃদ্ধ, পূর্ণরয়স্ক সকলেই রণবেশে সুসজ্জিত হইতে লাগিলেন। নগরবাসীরা হাসান-হোসেনকে প্রাণাপেক্ষাও ভালবাসিতেন। ঘোষণা প্রচার হইতে না হইতেই সহস্রাধিক লোক কাহারও আদেশের অপেক্ষা না করিয়া যাহার যে অস্ত্র আয়ত্তে ছিল, যাহার যে অস্ত্র সংগ্রহ ছিল, যে যাহা নিকটে পাইল, তাহাই লইয়া বেগে শত্রুর উদ্দেশে ধাইয়া চলিল। তদৃষ্টে এজিদের সৈন্যগণ আর অগ্রসর হইল না; গমনে ক্ষান্ত দিয়া শিবির-নির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইল। নগরবাসীরও শত্রুপক্ষকে নিরুদ্যম দেখিয়া আর অগ্রসর হইলেন না, নগরেও আর ফিরিলেন না; বৃক্ষমূলে প্রস্তরোপরি স্ব স্ব সুবিধামত স্থান নির্ণয় করিয়া হজরত হাসানের অপেক্ষায় রহিলেন। এবং এজিদের সৈন্যগণ বহুমূল্য বস্ত্রাদি দ্বারা শিবির রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে, এ সংবাদ হোসেনের নিকট পাঠাইলেন।

 হোসেন ও আবদর রহমান প্রভৃতি আত্মীয়-স্বজন সমভিব্যাহারে রওজা মোবারকে যাইয়া, হাসান প্রথমেই ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন— “দয়াময়! আমার ধনবল, বুদ্ধিবল, সৈন্যবল কিছুই নাই। তোমার আজ্ঞানুবর্ত্তী দাসানুদাস আমি। তুমি দয়া করিয়া এ দাসের অন্তরে যে বল দিয়াছ, সেই ধর্ম্মবলই আমার সাহস এবং উৎসাহ। দয়াময়! সেই বলের বলেই আমি এজিদকে—এক এজিদ কেন, শত শত এজিদকে তোমার কৃপায় তুচ্ছ জ্ঞান করি। কেবল তোমার নাম ভরসা করিয়াই দুর্গম শত্রুপথে পা বাড়াইয়াছি। তুমিই সহায়, তুমিই রক্ষাকর্ত্তা।” সকলেই “আমিন—আমিন” বলিয়া, পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া একে অশ্বারোহণে রাজপথে অসিয়া উপস্থিত হইলেন। নগরবাসীরা ব্যগ্রতাসহকারে তাঁহাদের চারিদিকে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা বাঁচিয়া থাকিতে আপনাকে শত্রুসম্মুখে যাইতে দিব না। অমরা এই চলিলাম, পৃষ্ঠে আঘাত লইয়া আর ফিরিব না। আঘাতিত দেহ আর মদিনাবাসীকে দেখাইব না। হয় মারিব, নয় মরিব!!”

 হাসান অশ্ব হইতে নামিয়া বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! ঈশ্বরের রাজ্যে বাস করিয়া ঈশ্বরের কার্য্যে জীবন শেষ করাই জীবের কর্ত্তব্য। লোকে আমাকে মদিনার রাজা বলে। কিন্তু ভ্রাতৃগণ! তোমরা তাহা কখনই কর্ণে স্থান দিও না। এ জগতে কেহ কাহারও রাজা নহে, সকলেই সেই মহারাজাধিরাজ সর্ব্বরাজাধিরাজ ওয়াহ্‌দাহুলা শরীকালাহু (একমেবাদ্বিতীয়ম্) দয়াময়ের রাজ্যের প্রজা। সকলেই সেই মহান রাজার সৃষ্ট, তাঁহার শক্তি মহান্‌, আমরা সেই রাজার প্রজা। সাধ্যানুসারে সেই সর্ব্বশক্তিমান অদ্বিতীয় মহারাজের ধর্ম্মরাজ রক্ষণাবেক্ষণ করাই আমাদের সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য এবং তাহাই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই ধর্ম্মরাজ্যের বিরোধী হইয়াও অনেক নরাধম অস্থায়ী রাজ্যে বাস করিতেছে। আজ তোমরা যে নরাধমের বিরুদ্ধে একাগ্রচিত্তে অগ্রসর হইয়াছ, তাহার ধনবল, সৈন্যবল এত অধিক যে, মনে ধারণ করিতেও শঙ্কা বোধ হয়। যদিও আমাদের অর্থ নাই, যুদ্ধের উপকরণ নাই, বাহ্য আড়ম্বর নাই, তথাপি আমদের একমাত্র ভরসা—সেই অদ্বিতীয় ভগবান। তাঁহার নামই আমাদের আশ্রয়। সেই নাম অবলম্বন করিয়াই তাঁহার ধর্ম্মরাজ্য রক্ষা করিব। ভ্রাতৃগণ! যে পাপাত্মার সৈন্যগণ এই পবিত্রভূমি— আমাদের জন্মভূমি আক্রমণ করিবার আশায় নগরের বাহিরে শিবির স্থাপন করিয়া রহিয়াছে, সেই বিধর্ম্মী এজিদ মদিনার খাজনা আমার নিকট চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন। আমি তাহার উত্তর দিই নাই; সেই আক্রোশে এবং বিবি জয়নাব আমার সহধর্ম্মিণী হইয়াছেন, সেই ক্রোধে এজিদ আমার প্রাণবধ করিবে। তাহা হইলে এজিদের উভয় উদ্দেশ্যই সাধিত হইবে; কারণ, আমার মদিনার সিংহাসন তাহারই অধিকৃত হইবে মনে করিয়াছে। সেই বিধর্ম্মী এজিদ নূরনবী হজরত মোহাম্মদের বিরােধী, ঈশ্বরের বিরােধী, পবিত্র কোর-আণের বিরােধী। নরাধম এমনই পাপী যে, ভ্রমে কখনও ঈশ্বরের নাম মুখে আনে না। ভাই সকল! আমরা যে রাজ্যে বাস করি, যে রাজা আমাদের সুবিধার জন্য কত উপকরণ, কত সুখসামগ্রী সৃষ্টি করিয়াছেন—বিনা স্বার্থে, বিনা প্রত্যুপকারের আশায় যে রাজা অকাতরে কত কি দান করিয়াছেন, আমরা আজ পর্য্যন্ত সে দানের উদ্দেশ্যের কণামাত্রও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। সেই অদ্বিতীয় রাজার বিরুদ্ধাচারী আজ পুণ্যভূমি মদিনা আক্রমণ করিতে—আমাদের স্বাধীনতা হরণ করিতে, —ধর্ম্মপথে কাঁটা ছড়াইতে, মূল উদ্দেশ্য—আমার জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণ করিতে অগ্রসর হইয়াছে। মহাশক্তিসম্পন্ন মহাপ্রভু জগৎপিতার নামে সে কত কলঙ্ক রটাইয়াছে। জগদীশ্বর মহান্, তাঁহার মহিমা অপার, তাঁহাতে ক্রোধ, বিরাগ, দুঃখ, অপমান কিছুই নাই। কিন্তু আমরা সহ্যগুণবিহীন মানব,—আমাদের রিপু-সংযম অসাধ্য। যে কেহ ঈশ্বরের বিরােধী, আমরা তাহার বিরোধী। আমরা কি সেই বিরোধীর প্রতিবিধান করিব না? আমাদের অস্ত্র কি চিরকালই কোষে আবদ্ধ থাকিবে? বিধর্ম্মীর মুণ্ডপাত করিতে সেই অস্ত্র কি নিষ্কোষিত হইয়া কাফেরের রক্তে রঞ্জিত হইবে না? ঈশ্বরের প্রসাদে জয়-পরাজয় উভয়ই আমাদের মঙ্গল। যদি তাঁহার কৃপায় বিধর্ম্মীর রক্ত আজ মদিনা-প্রান্তরে বহাইতে পারি, ভাল, তাহা না হইলে ধর্ম্মরক্ষা, জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিতে বিধর্ম্মীর অস্ত্রে যদি আত্মবিসর্জ্জন করিতে হয়, তাহাতেও অক্ষয় স্বর্গলাভ। ভ্রাতৃগণ! আজ আমাদের এই স্থির প্রতিজ্ঞা যে, হয় জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া মােহাম্মদীয় ধর্ম্মের উৎকর্ষ সাধন করিব, না হয়, অকাতরে রক্তস্রোতে আমাদের এই অস্থায়ী দেহ খণ্ডে খণ্ডে ভাসাইয়া দিব।”

 এই পর্য্যন্ত শুনিয়াই শ্রোতৃগণ সমস্বরে “আল্লাহো আকবর” বলিয়া পাগলের ন্যায় কাফেরের মুণ্ডপাত করিতে ছুটিলেন। হাসান সকলকে একত্র শ্রেণীবদ্ধ করিয়া লইয়া সমরক্ষেত্রে যাইতে মনস্থ করিয়াছিলেন; তাহা আর হইল না, কেহই তাঁহার কথা শুনিল না।

 হাসান-হোসেন এবং আবদর রহমান পুনরায় অশ্বারোহণে কিছু দূর গমন করিয়া যে দৃশ্য দর্শন করিলেন, তাহাতে হাসান আর অশ্রুসম্বরণ করিতে পারিলেন না; আবদর রহমানকে বলিলেন, “ভাই! তুমি যত শীঘ্ন পার, হোসেনের সহিত যাইয়া মদিনাবাসীদের পৃষ্ঠপোষক হও। আমি অবলাগণকে বিদায় দিয়া আসিতেছি। ইঁহাদের এ বেশ আমার চক্ষে বড়ই কষ্টকর বোধ হইতেছে। আমি বাঁচিয়া থাকিতে ইঁহাদের হস্তে অস্ত্রসম্ভার দেখিতে হইল! ভাই! ইহা অপেক্ষা আর দুঃখ কি? তোমর যাও, আর অপেক্ষা করিও না।”

 এই বলিয়া অশ্ব হইতে নামিয়াই এমাম হাসান অতি বিনীতভাবে নারিগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগ্নীগণ! নগরের প্রান্তভাগে মহাশত্রু! নগরবাসীরা আজ শত্রুবধে উন্মত্ত, জন্মভূমি রক্ষা করিতে মহাব্যস্ত। এই বিপদ সময়ে আপনারা এ বেশে কোথায় যাইতেছেন?

 স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে একজন বলিলেন, “হজরত! আর কোথায় যাইব? আপনাদের এই মহাবিপদকালেও কি আমরা অবলাচারের বাধ্য হইয়া অন্তঃপুরেই আবদ্ধ থাকিব? ভ্রাতা, পুত্র, স্বামী, সকলকেই শত্রুমুখে পাঠাইয়াছি, ফিরিয়া আসিতে পাঠাই নাই—একেবারে চিরবিদায় প্রদান করিয়াছি।—আর আমাদের পৃথিবীতে থাকিবার প্রয়োজন কি? আপনার জন্য স্বামী, পুত্র ভ্রাতা যে পথে যাইবে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব; বিপদ সময়ে অবশ্যই কিছু না কিছু সাহায্য করিতে পারি। আর তাহারাই যদি বিধর্ম্মীর রক্তে রঞ্জিত হইয়া ধর্ম্মরক্ষা ও জন্মভূমি রক্ষা করিতে পারে, তবে আমরাই বা কাফেরের মাথা কাটিতে অস্ত্রগ্রহণ করিব না কেন? নূরনবী হজরত মোহাম্মদের পবিত্র দেহ যে মদিনা ক্রোড়ে ধারণ করিয়া রহিয়াছে, রোজ-কেয়ামত পর্য্যন্ত থাকিবে, সেই মদিনা এজিদ অধিকার করিবে? যে মদিনার পবিত্রতা গুণে জগতের চারিদিক হইতে কোটি কোটি ভক্ত কত কষ্ট স্বীকার করিয়া শুধু একবার রওজা শরীফদর্শন করিতে আসিতেছে, সেই পবিত্র ভূমি কাফেরের পদস্পর্শে কলঙ্কিত হইবে? এ কথা শুনিয়া কে স্থির হইয়া ঘরে থাকিতে পারে? আরও দেখুন—আমরা অবলা, পরাধীন, যাহাদের মুখাপেক্ষী, তাহারাই যখন অস্ত্র-সম্মুখে, তখন আমরা শূন্যদেহ লইয়া কেন আর ঘরে থাকিব?”

 আর একটি স্ত্রীলোক কহিলেন, “হজরত! আমরা যে কেবল সন্তানসন্ততি প্রতিপালন করিতে শিখিয়াছি, তাহা মনে করিবেন না। এই হস্ত বিধর্ম্মীর মস্তক চূর্ণ করিতে সক্ষম, এই হস্তে কাফেরের মুণ্ডপাত করিতেও আমরা জানি। সামান্য রক্তবিন্দু দেখিলেই আমাদের মন কাঁপিয়া উঠে, অঙ্গ শিহরিয়া উঠে, হৃদয়ে বেদনা লাগে, কিন্তু কাফেরের লোহিত রক্ত-তরঙ্গের শোভা দর্শনে আনন্দে ও উৎসাহে আমাদের মন যেন নচিতে থাকে।”

 বিস্মিত হইয়া হাসান বলিলেন, “আমি আপনাদের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ, আমি বাঁচিয়া থাকিতে বিধর্ম্মীবধে আপনাদিগকে অস্ত্র ধরিতে হইবে না। আমার বংশ বাঁচিয়া থাকিতে আপনাদিগকে এ বেশ পরিতে হইবে না। ভগ্নীগণ! আপনার ঘরে বসিয়া ঈশ্বরের নিকট ধর্ম্ম ও জন্মভূমির রক্ষার জন্য কায়মনে প্রার্থনা করুন। আমরা অস্ত্রমুখে দাঁড়াইব। আপনারা ঈশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমাদিগকে রক্ষা করিবেন। আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আপনারা শত্রু-সম্মুখীন হইয়া আমার মনে বেদনা প্রদান করিবেন না।”

 প্রথম নারী সবিনয়ে বলিলেন, “আপনার আদেশ প্রতিপালন করিলাম; কিন্তু ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন যে, মদিনার একটি অবলার দেহে প্রাণ থাকিতে এজিদ কদাপি নগরের সীমায় আসিতে পারিবে না।” এই কথা বলিয়া স্ত্রীলোকের দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন,—“এলাহি! আজ আপনার নামের উপর নির্ভর করিয়া হাসানকে শত্রুসম্মুখে দিলাম। হাসানের প্রাণ, পবিত্র ভূমি, মদিনার স্বাধীনতা এবং ধর্ম্মরক্ষা করিতে ভ্রাতা, পুত্র ও স্বামীহারা হইলেও আমরা কাতর হইব না। এলাহি! স্বামী, পুত্র, ভ্রাতৃগণ বিধর্ম্মীর অস্ত্রে প্রাণত্যাগ করিলে আমাদের চক্ষে কখনই জল আসিবে না। কিন্তু মদিনা নগর কাফেরের পদস্পৃষ্ট হইলেই আমরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জ্জন করিব। এলাহি! হাসানের প্রাণ আমাদের প্রার্থনীয়। সে প্রাণ রক্ষা হইলে সমস্তই রক্ষা হইবে। এলাহি! হাসানের প্রাণ রক্ষা কর; মদিনার পবিত্রতা রক্ষা কর; নূরনবী হজরত মোহাম্মদের রওজার পবিত্রতা রক্ষা কর!”

 এই প্রকারে উপাসনা শেষ করিয়া নগরবাসিনী কামিনীগণ হাসানকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন,—“এলাহির অনুগ্রহ-কবচ আপনার শরীর রক্ষা করুক। বাহুবলে হজরত আলীর দৃষ্টিপাত হউক। বিবি ফাতেমা খাতুনে জেন্নাত আপনার ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের প্রতি দৃষ্টি রাখুন। শক্রবিজয়ী হইয়া আপনি নির্ব্বিঘ্নে নগরে আগমন করুন।

 এইরূপ আশীর্ব্বাদ করিয়া কামিনীগণ স্ব স্ব নিকেতনে চলিয়া গেলেন। হাসানও বিস্‌মিল্লাহ্ বলিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন। মুহূর্ত্ত-মধ্যে নগরপ্রান্তে অসিয়া ভীষণতর শব্দ শুনিতে পাইয়া তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটস্থ হইলেন। দেখিলেন যে, বিষম বিক্রমে মদিনাবাসীরা বিপক্ষগণকে আক্রমণ করিয়াছে। যুদ্ধের রীতিনীতির প্রতি কাহারও লক্ষ্য নই। কেরল ‘মার মার’ অস্ত্রের ঝন্‌ঝন্‌ ও মুহূর্ত্তে মুহর্ত্তে “আল্লাহ” রবে চতুর্দ্দিক কাঁপাইয়া তুলিতেছে, রণভূমিতে শোণিতের প্রবাহ ছুটিয়াছে। সেই অভাবনীয় ভয়ানক দৃশ্য দেখিয় হাসান নিস্তব্ধভাবে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট রহিলেন, যুদ্ধে ব্যাপৃত হইলেন না।

 মদিনাবাসীরা শত্রুদিগকে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। বিধর্ম্মীর মস্তকচ্ছেদন করিয়া শেষে নিজে নিজে “শহীদ” হইতেছে। কেহ কাহারও কথা শুনিতেছে না, কাহাকেও কিছু বলিতেছে না, বা জিজ্ঞাসাও করিতেছে না। হোসেনের চালিত তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকিতেছে। শত্রুপক্ষীয়েরা যে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করবে, তারও উপায় নাই। তবে বহু দূর হইতে যাহারা সেই ঘূর্ণিত তরবারির চাক্‌চিক্য দেখিয়াছিল, কেবল তাহারাই কেহ জঙ্গলে, কেহ পর্ব্বতগুহায় লুকাইয়া প্রাণরক্ষা করিল।

 হোসেনের অশ্ব শ্বেত বর্ণ; তাহার শরীর ও শ্বেত বসনে আবৃত। এক্ষণে বিধর্ম্মী বিপক্ষদের রক্তে তাহা একেবারে লোহিতবর্ণে পরিণত হইয়াছে; কিন্তু স্থানে স্থানে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ্রাংশে আরও অধিক শোভা হইয়াছে।

সেই শোভা বিধর্ম্মীর চক্ষে ভীষণভাবে প্রতিফলিত হইতেছে। অশ্বের পদনিক্ষিপ্ত রক্তমাখা বালুকার উৎক্ষিপ্ততা দেখিয়াই অনেকে ছিন্ন দেহের অন্তরালে লুকাইয়া হোসেনের তরবারি হইতে প্রাণ বাঁচাইতেছে। বামে দক্ষিণে হোসেনের দৃষ্টি নাই। যাহাকে সম্মুখে পাইতেছেন, তাহাকেই নরকে পাঠাইতেছেন।

    প্রতি শুক্রবারে দুই প্রহরের পর হইয়া থাকে, ঐ তিন উপাসনার পর আরবী ভাষায় ঈশ্বরের গুণানুবাদের পর উপাসনা বর্ণনা, পরে স্বজাতীয় রাজার নাম উচ্চারণ করিয়া তাঁহার দীর্ঘায়ু ও রাজ্যের স্থায়িত্ব কামনা করা হয়। ভারতীয় মুসলমানগণ পুর্ব্বে দিল্লীর মোগল সম্রাটগণের নামে খোৎবা পাঠ করিতেন।

  1. উক্ত হইয়াছে, হিজরী ১১ সনের ১২ই রবিয়াল আউয়ল সোমবার দিবা ৭ম ঘটিকার সময় ৬৩ বৎসর বয়সে প্রভু মোহাম্মদ পবিত্র ভূমি মদিনায় মানবলীলা সংবরণ করেন। তাঁহার পিতার নাম আবদুল্লাহ্‌, মাতার নাম আমেনা খাতুন। প্রভুর দেহত্যাগের পর কোথায় সমাধি হইবে, এই বিষয়ে অনেক বাদানুবাদ হইলে, হজরত আবুবকর এই মীমাংসা করেন যে, পয়গম্বর সাহেব জীবিতাবস্থায় যে স্থানকে প্রিয় মনে করিতেন, সেই স্থানে সমাধি হওয়া আবশ্যক। সকলে ঐ মতের পোষকতা করায় বিবি আয়েশার ঘরে সমাধি দেওয়া সুস্থির হইল। বিবি আয়েশা হজরত আবুবকরের কন্যা এবং হজরত মোহাম্মদের সহধর্ম্মিণী। মোহাম্মদের সমাধিস্থানকে রওজা কহে। হজরত ওমর প্রথমতঃ কঁচা ইটের দ্বারা রওজা গাঁথুনী করেন। তৎপরে অলিদ চতুঃসীমাবন্দী করিয়া নক্সাদার প্রস্তর দ্বারা উহা প্রস্তুত করেন। রওজার চতুষ্পার্শ্ব প্রাচীরে পরিবেষ্টিত। হিজরী ৫৫০ সালে ইস্পাহান নিবাসী জামালদ্দিন, চন্দন কাষ্ঠের ঝাজুরিদার রেল দ্বারা রওজার চতুর্দ্দিক আবদ্ধ করিয়া দেন। সেই সময়ে এবনে আবুয়ল হাজী শরীফ মিশরের বহুমূল্য শ্বেতবর্ণ চাদর আনাইয়া, উক্ত চাদরের উপরে লোহিতবর্ণ রেশমসূত্রে কোর-আন শরীফের সুরা ইয়াসীন লিখাইয়া তদ্দারা ঐ পবিত্র সমাধি আবৃত করেন, সেই সময় হইতে আবরণপ্রথা প্রতি বৎসর প্রচলিত হইয়াছে। যিনি মিশরের রাজসিংহাসনে উপবেশন করেন, তিনি বহুমূল্য নূতন বস্ত্র দ্বারা প্রতি বৎসর ঐ সমাধিমন্দির আবৃত করিয়া থাকেন। বিনা বাক্যব্যয়ে সেই প্রথা আজও পর্য্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। ৬৭৮ হিজরীতে কালাউন সালেহীর রাজত্বকালে মদিনার মসজিদের ছাদ হইতে উচ্চ সবুজ রঙ্গের “কোব্বা” (চূড়া) সমাধি মন্দিরের উপর স্থাপিত হইয়াছে। সেই সুরঞ্জিত উচ্চ চূড়া আজও পর্য্যন্ত অক্ষয়ভাবে রহিয়াছে। হিজরী এক হাজার (১০০০) সালে সুলতান সোলেমান খাঁরুম রওজা শরীফের প্রাঙ্গণ শ্বেতবর্ণ প্রস্তর দ্বারা মণ্ডিত কৱাইয়াছেন, ওমর এব্‌নে আদুল আজিজ খানের শাসন-কালের পর রওজা প্রাঙ্গণের মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিবিদ্ধ হইয়াছে। যাত্রীরা চতুষ্পার্শ্বস্থ রেলিংয়ের বাহিরে থাকিয়া দর্শনলাভ করে। চতুষ্পার্শ্বস্থ রেলিং বস্ত্রাবরণে সদাসর্ব্বদা আবৃত থাকে।