বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ
কাফ্রির আক্রমণ
রজনী নির্ব্বিঘ্নে অতিবাহিত হইল। কিন্তু প্রভাতে কেনেডি অত্যন্ত অসুস্থ হইলেন। তাঁহার ভয়ানক জ্বর হইল। দেখিতে দেখিতে আকাশ নিবিড় মেঘে সমাচ্ছন্ন হইল। মনে হইতে লাগিল যেন প্রলয়ের বারি বর্ষিত হইবে। ভিক্টোরিয়া তখন জাঙ্গেমেরো জনপদের উপর উড়িতেছিল। জানুয়ারি মাসের এক পক্ষ ভিন্ন সে দেশে সর্ব্বদাই বৃষ্টি হইয়া থাকে। সকলেই গন্ধকের গ্যাসের ন্যায় এক প্রকার গ্যাসের গন্ধ পাইতে লাগিলেন। ফার্গুসন্ কহিলেন—
“বার্টন্ ঠিকই বলেছেন, এ প্রদেশে প্রত্যেক ঝোপের আড়ালেই যেন মানুষ মরে’ আছে বলে’ বোধ হয়। এখানকার বাতাস এমনি বিষাক্ত। তোমার ভয় নাই ডিক। আমি এখনই উপরে উঠে যাচ্ছি। বিষাক্ত হাওয়া থেকে উপরে গেলেই তোমার অসুখ সারবে।”
ভিক্টোরিয়া ক্রমেই উচ্চে উঠিতে লাগিল। ঊর্দ্ধে ঊর্দ্ধে আরও উর্দ্ধে উঠিয়া মেঘলোকের অন্তরালে লুক্কায়িত হইল । দূরে রুবেহো পর্ব্বতের সমুজ্জ্বল উচ্চ শিখরাবলী তখন তপনকিরণে ঝলসিতেছিল। এইরূপে তিন ঘণ্টা কাল গমন করিবার পর কেনেডি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, “ফার্গুসন্ তোমার এ ঔষধ দেখছি কুইনাইনের চেয়ে ঢের ভাল।”
বেলা দশটার সময় মেঘ অল্পে অল্পে কাটিতে লাগিল। একস্থান হইতে সম্পূর্ণই সরিয়া গেল। পর্য্যটকগণ দেখিলেন পৃথ্বিতল দেখা যাইতেছে। পদনিম্নে শত শত পর্ব্বতচূড়া রৌদ্রে জ্বলিতেছে। ফার্গুসন্ বিশেষ সতর্কতার সহিত ভিক্টোরিয়াকে পরিচালিত করিতে করিতে বলিলেন—
“যদি জঙ্গেমেরোর কর্দ্দমাক্ত সিক্ত ভূমি পদব্রজে অতিক্রম করে’ আসতে হতো, তা’ হ’লে এতক্ষণ কষ্টের অবধি থাকতো না। আমাদের ভারবাহী পশুগুলির অর্দ্ধেক হয় ত এতক্ষণ মরে’ যেত। আমরাও জীবন্মত হ’য়ে পড়তেম। নিরাশা, শ্রান্তি, ক্ষুধা, পিপাসা, জ্বর এতক্ষণ আমাদের বুক ভেঙ্গে দিত। পথ-প্রদর্শকেরা সুযোগ পেয়ে লুণ্ঠন করতে আরম্ভ করতো। তাদের সে নিষ্ঠুরতা অবর্ণনীয়। দিবসে সূর্যকিরণ অসহা জ্বালাময়—রাত্রে নিদারুণ শীত। সে শীতে যেন অস্থি পর্য্যন্ত, চূর্ণ হ’য়ে যায় । এ দেশে এমন কতকগুলি পোকা মাকড় আছে যে, যতই কেন মোটা কাপড় পর না, সে সব ভেদ করে’ তারা তোমাকে কামড়াবেই কামড়াবে। উঃ সে দংশনের কি দুঃসহ জ্বালা! মানুষ যেন পাগল হয়। তা’ ছাড়া হিংস্র পশু,আরণ্য মনুষ্য—এ সব ত আছেই! এ অঞ্চলে যাঁরা ভ্রমণ করে’ গেছেন তাঁদের কাহিনী যদি পড়, তা’ হ’লে চোখের জল রাখতে পারবে না!”
তখন অদূরে বহু উচ্চে রুবেহো শৈলমালা দেখা যাইতেছিল। আফ্রিকার ভাষায় রুবেহো অর্থে বাতাসের গতি বুঝায়। এই পর্ব্বতমালা এত উচ্চ যে, বায়ুপ্রবাহ এখানে প্রতিবাহিত হ’য়ে অন্য দিকে ধাবিত হয়। ফার্গুসন্ কহিলেন, “হুসিয়ার, আমরা রুবেহো পর্ব্বতের আতি নিকটে এসেছি। পর্ব্বতাশখর ছেড়ে অনেকটা উঁচু দিয়ে যেতে হ’বে।” বেলুনের গ্যাস উত্তপ্ত হইয়া ক্রমেই বিস্তার লাভ করিতে লাগিল, বেলুন ক্রমেই উপরে উঠিতে আরম্ভ করিল। কেনেডি জিজ্ঞাসা করিলেন,
“এত উপরে কি বেশীক্ষণ থাকা চলে?”
“বেলুন বড় হ’লে খুব উপরেও যাওয়া যেতে পারে। পর্য্যটক ব্রিয়োসি এবং গেফুসাকের নাম কি শোন নি? তাঁরা এত উপরে উঠেছিলেন যে, কান দিয়ে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল। আমরা এখন প্রায় ছ’হাজার ফিট উঠেছি। দেখছ না কোন জিনিষ আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।”
বাতাস প্রবল বেগে বহিতেছিল। ভিক্টোরিয়া অল্পকাল মধ্যেই তুষার-মণ্ডিত শৈলশৃঙ্গ অতিক্রম করিল। ফার্গুসন্ পর্ব্বতের চিত্র অঙ্কিত করিয়া লইলেন। রুবেহো পর্ব্বতের পর পারে পৃথ্বিতল কানন-সমাচ্ছন্ন—পত্রবহুল বৃক্ষলতায় সুশোভিত। তাহার পরই একটি মরুভূমি। দূরবিস্তৃত তপ্ত বালুকারাশির মধ্যে স্থানে স্থানে নৃত্যশীলা পার্ব্বত্যতরঙ্গিণী প্রবাহিতা। আরও দূরে ঘন কণ্টক বন ও লবণাক্ত বৃক্ষলতা। কেনেডি ধীরে ধীরে নিম্নে নামিতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ মধ্যেই একটা প্রকাণ্ড বৃক্ষের সুদৃঢ় শাখার সহিত বেলুনের নোঙ্গর আবদ্ধ হইল। জো অবিলম্বে রজ্জু-মই বাহিয়া বৃক্ষোপরি অবতরণ করিল এবং শাখার সহিত নোঙ্গর দৃঢ়রূপে বন্ধন করিয়া দিল।
ফার্গুসন্ কহিলেন, “তোমরা দুইজনে বন্দুক নিয়ে নাম। দেখ যদি কিছু পাও।”
মৃগয়ালোলুপ কেনোড বিপুল আনন্দে অবতরণ করিলেন। জো সঙ্গে সঙ্গে চলিল। ফার্গুসন্ বন্ধুকে সতর্ক করিয়া দিয়া কহিলেন; “বেশী বিলম্ব করো না। আমি উপর থেকে অনেক দূর পর্য্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। যদি কোনো বিপদের সম্ভাবনা দেখি, বন্দুক আওয়াজ করবো।”
সানুচর কেনেডি শিকারের সন্ধানে বন মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন সেই পথে বহুদিন পূর্ব্বে কোনো যাত্রীর দল গিয়াছে। কোথাও মৃত মনুষ্যের কঙ্কাল, কোথাও পশুর কঙ্কাল তাহার চিহ্নস্বরূপ পড়িয়া রহিয়াছে। তাঁহারা একটা অপেক্ষাকৃত নিবিড় বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং অল্পক্ষণ মধ্যেই অব্যর্থ-সন্ধান কেনেডির গুলি একটী মৃগের বক্ষ ভেদ করিয়া দিল। তখন জো মৃগমাংস দগ্ধ করিতে করিতে কহিলেন—
“আমার মনটা বড় অস্থির হয়েছে।”
“কেন?”
“ভয় হচ্ছে, আমরা ফিরে যেয়ে যদি বেলুন দেখতে না পাই।”
“পাগল আর কি! তুমি কি মনে কর ফার্গুসন্ আমাদের এখানে ফেলেই চলে’ যাবে?”
“না তা’ নয়। মনে করুন যদি কোন কারণে নোঙ্গরটা খুলে যায়।”
“সেটা সম্ভব নয়—অমন শক্ত করে বাঁধা আছে। আর ধরই না যদি খুলে যায়, ফার্গুসন্ ইচ্ছা করলেই নামতে পারবে।”
“নামতে পারবেন—তা’ ঠিক। কিন্তু যদি প্রবল বাতাসে বেলুনটা ভাসিয়ে নিয়ে যায়—তা’ হ’লে ত আর তিনি এদিকে ফিরতে পারবেন না।”
“ও সব অশুভ কথায় কাজ নাই—”
বাধা দিয়া জো কহিল, “সকল বিপদের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়।”
কেনেডি চমকিয়া কহিলেন, “ওই না ফার্গুসনের বন্দুকের শব্দ?”
“হাঁ তাই ত! বুঝি কোন বিপদ্ ঘটেছে!” জো আর কাল বিলম্ব করিল না। দগ্ধ মাংসখণ্ডগুলি ক্ষিপ্রহস্তে সংগ্রহ করিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ভিক্টোরিয়ার দিকে ছুটিল। কেনেডিও দৌড়াইলেন। ঘন বন—তাঁহারা বেলুন দেখিতে পাইতেছিলেন না। আবার বন্দুকের শব্দ হইল। তাঁহারা আরও দ্রুত দৌড়াইলেন। কাননপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াই দেখিলেন, বেলুন স্থানভ্রষ্ট হয় নাই। কেনেডি তখন বিস্মিত হইয়া কহিলেন,
“ব্যাপার কি! বেলুন ত ঠিকই আছে।”
ইতস্ততঃ চাহিয়া জো বলিয়া উঠিল “সর্বনাশ!”
“কি! কি! কি হয়েছে?”
“ওই দেখুন কাফ্রিরা এসে বেলুন আক্রমণ করেছে।”
ভিক্টোরিয়া তখনো অনেক দূর ছিল। তাঁহারা দেখিলেন প্রায় ৩০টী প্রাণী উহার তলদেশে নৃত্য করিতেছে—চীৎকার করিতেছে—অঙ্গভঙ্গী করিতেছে। কেহ বা বৃক্ষের উপর আরোহণ করিয়া সর্বোচ্চ শাখায় উঠিয়াছে। এমন সময় আবার বন্দুকের শব্দ হইল। তাঁহারা দেখিলেন আক্রমণ-কারীদিগের মধ্যে যে বেলুনের বন্ধনরজ্জু বাহিয়া উপরে উঠিতেছিল, সে আহত হইয়া পড়িতে পড়িতে ভূমি হইতে প্রায় ১০।১২ হস্ত উপরে বৃক্ষশাখায় ঝুলিয়া রহিল।
জো কহিল, “কি আশ্চর্য্য, কাফ্রিটা পড়ছে না কেন—গুলি বুঝি লাগে নাই।”
পরক্ষণেই সে উচ্চহাস্য করিয়া কহিল “দেখেছেন ওটা কেমন করে’ লেজ দিয়ে গাছের ডাল জড়িয়ে ধরেছে। আমরা ভেবেছিলাম কাফ্রি-কিন্তু এখন দেখছি তা নয়! সবগুলোই হনুমান!”
আশ্বস্ত হইয়া কেনেডি কহিলেন, “যাক, বাঁচা গেল! কাফ্রি না হ’লেই ভাল।”
গোটাকতক পিস্তলের আওয়াজেই শাখামৃগের দল পলায়ন করিল। জো এবং কেনেডি বেলুনে উঠিলেন। জো কহিল, “কি ভয়ানক আক্রমণ!”
“ফার্গুসন্, আমরা মনে করেছিলাম তোমাকে বুঝি কাফ্রিরাই আক্রমণ করেছে!”
“আমাদের সৌভাগ্য যে ওগুলো সব হনুমান—কাফ্রি নয়। দেখতে বড় বেশী তফাত নাই! যদি নোঙ্গরটা হঠাৎ ছিড়ে দিত তা’ হ’লেই বিপদে পড়েছিলাম আর কি!”
জো তখন গম্ভীর ভাবে কহিল, “কেমন মিঃ কেনেডি, মাংস পোড়াতে পোড়াতে এ কথা আমি বলেছিলাম কি না।”
বেলুন নির্ব্বিঘ্নে চলিতে লাগিল। সন্ধার পূর্ব্বে মাবুংগুরু নামক পার্ব্বত্য প্রদেশ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা জিহোলামোরা গিরিশ্রেণীর পশ্চিম পারে রাত্রি যাপন করিলেন। প্রভাতে মানচিত্র দেখিয়া ফার্গুসন্ কহিলেন——
“ডিক, কাজে নগর এখান থেকে প্রায় ১০০ মাইল হইবে। বাতাস যদি ঠিক থাকে, তা’ হ’লে আমরা আজই সেখানে যেতে পারবো।”