বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
মরু ঝটিকা
রাত্রি কিরূপে অতিবাহিত হইল, তাহা কেহ জানিল না। প্রভাতে প্রখর সূর্য্যের তাপে যখন হস্তপদ দগ্ধ হইতেছিল, তখন জো এবং কেনেডির মূর্চ্ছা ভঙ্গ হইল। তাঁহাদের মনে হইতে লাগিল, যেন পাদাঙ্গুলি হইতে ক্রমেই শুষ্ক হইয়া উঠিতেছে— দেহ পুড়িয়া ছাই হইতেছে। জো উঠিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, ফার্গুসন্ বেলুন মধ্যে পুত্তলিকাবৎ স্থির হইয়া বসিয়া একদৃষ্টে সুদূর আকাশ প্রান্তে চাহিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার বাহুযুগ বক্ষোপরি স্থাপিত, চক্ষু পলকহীন, নিশ্চল।
কেনেডিকে তখন অতিশয় ভীষণ দেখাইতেছিল। পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের ন্যায় তিনি ইতস্ততঃ মস্তক নাড়িতেছিলেন। অকস্মাৎ বন্দুকের উপর তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। কেনেডি উন্মত্তের ন্যায় উহা তুলিয়া লইলেন এবং নলটী মুখের ভিতর দিয়া যেই আত্মহত্যা করিবেন, অমনি জো তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল। চীৎকার করিয়া কহিল—“মিঃ কেনেডি করেন কি— করেন কি?
“ছেড়ে দাও—ছেড়ে দাও—দূর হও।”
কেনেডি জোকে সজোরে ধাক্কা দিলেন।
জো তাঁহাকে ছাড়িল না।
তখন উভয়ের মধ্যে মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হইল। কেনেডি পণ করিয়াছিলেন আত্মহত্যা করিবেনই। তাহা নিবারণের জন্য জো প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিল। ফার্গুসন্ এ সব কিছুই দেখিতেছিলেন না। তখনো তিনি প্রস্তরগঠিতবৎ বসিয়া আকাশ-প্রান্তে চাহিয়াছিলেন।
মল্ল-যুদ্ধ করিতে করিতে কেনেডির বন্দুক হস্ত-চ্যুত হইল এবং ভূতলে পতিত হইবামাত্র সশব্দে আওয়াজ হইয়া গেল।
বন্দুকের শব্দে ফার্গুসনের চমক ভাঙ্গিল। তিনি হস্ত প্রসারণ পূর্ব্বক আকাশ দেখাইয়া বজ্রকণ্ঠে কহিলেন—
“দেখ—দেখ—ওই দূরে চেয়ে দেখ।”
ফার্গুসন্ এরূপ উত্তেজিতভাবে এই কথা কয়েকটা বলিলেন যে, জো এবং কেনেডি পরস্পর পরস্পরকে ছাড়িয়া দিয়া সেই দিকে চাহিলেন। দেখিলেন মরুক্ষেত্র যেন সহসা সজীব হইয়া উঠিয়াছে। বিশাল ঝটিকার সময় সমুদ্র যেমন পর্ব্বতপ্রমাণ তরঙ্গ তুলিয়া ছুটিতে থাকে, মরুসমুদ্রও তখন যেন তেমনি ছুটিয়া আসিতেছিল। বায়ুতাড়িত বালুকারাশি ভীষণ তরঙ্গের ন্যায় অগ্রসর হইতেছিল। দেখিতে দেখিতে ধূলিপটলে সমগ্র আকাশ সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল—সূর্য্য আবৃত হইল।
ফার্গুসনের নয়নদ্বয় তখন অগ্নির ন্যায় ধক্ ধক্ জ্বলিতেছিল। তিনি উচ্চকণ্ঠে কহিলেন— “মরু ঝটিকা আস্ছে।”
জো চীৎকার করিয়া উঠিল—“ওই—ওই—মরুঝটিকা।”
কেনেডি কুপিত কণ্ঠে কহিলেন “বেশ হয়েছে! বেশ হয়েছে! আমাদের যম আস্ছে!”
ফার্গুসন্ ক্ষিপ্রহস্তে বেলুনের ভার ফেলিতে ফেলিতে বলিলেন—“যম নয় ডিক্—যম নয়! আমাদের পরম বন্ধু! আমাদের রক্ষার জন্যই বুঝি আজ মরুঝটিকা উঠেছে। এস—সত্বর হও। ভার ফেল।”
ফার্গুসন্ কহিলেন—“জো পঁচিশ সের।”
জো এবার বিনা বাক্যব্যয়ে পঁচিশ সের সোণার ভার নিক্ষেপ করিল! দেখিতে দেখিতে সেই প্রবল বালুকা-তরঙ্গ নিকটে আসিল—দেখিতে দেখিতে বাতাহত বেলুন কাঁপিয়া উঠিল, দুলিল এবং পরক্ষেণেই বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে উল্কার ন্যায় ছুটিতে লাগিল।
“জো—ফেল—ফেল—আরও ভার ফেল।”
ফার্গুসনের আদেশ মাত্র জো অনেকটা ভার ফেলিয়া দিল। বেলুন মুহূর্ত্তে সেই উত্তপ্ত বায়ুস্তরের উপরে উঠিল এবং বাত্যাতাড়িত বালুকার উপর দিয়া নক্ষত্রবেগে চলিতে লাগিল!
ফার্গুসন্, কেনেডি এবং জো নির্ব্বাক্ হইয়া বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। আশায় ও উৎসাহে তিন জনেরই বদনমণ্ডল উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
বেলা ৩টার সময় ঝড় থামিল। আকাশ শান্ত মূর্ত্তি ধারণ করিল। ভিক্টোরিয়া তখন অচল হইয়া একটী উর্ব্বর ক্ষেত্রের শত হস্ত উপরে ভাসিতেছিল। তাঁহারা দেখিলেন বায়ুতাড়িত বালুকারাশি নানাস্থানে পুঞ্জীভূত হইয়া বেলুনের দক্ষিণে, বামে ও সম্মুখে শত সহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বতের সৃষ্টি করিয়াছে। অদূরে পত্রে পুষ্পে শোভিত বৃক্ষাদি পরিপূর্ণ উর্বর ক্ষেত্রগুলি সমুদ্র মধ্যে দ্বীপবৎ দেখা যাইতেছে।
ফার্গুসন্ কহিলেন—“নিশ্চয়ই এখানে জল আছে।”
তিনি খানিকটা গ্যাস ছাড়িয়া দিয়া বেলুনকে নামাইলেন। কেনেডি এবং জো মূহূর্ত্তে লম্ফ দিয়া নিম্নে অবতরণ করিলেন। ফার্গুসন্ কহিলেন—“মরু-ঝটিকার কি দারুণ বেগ! আমরা ৪ ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ মাইল পথ এসেছি!”
কেনেডি এবং জো জলের সন্ধানে যাইতেছিলেন দেখিয়া ফার্গুসন কহিলেন—“বন্দুক নিয়ে যাও! খুব সাবধানে যেও, ডিক্। চারিদিকে চোখ রেখো।”
তাঁহারা উভয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িলেন। জল— জল—একবিন্দু জল। সম্মুখে বৃক্ষ-লতা-পরিবেষ্টিত স্থান দেখিয়াই তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন, এখানে জল আছে। পিপাসায় কণ্ঠনালী পর্য্যন্ত তখন শুষ্ক, জিহ্বায় ক্ষত হইয়াছে—শরীর জ্বলিয়া যাইতেছে। তখন কি আর ধীর বিবেচনার সময় থাকে। কেনেডি এবং জো প্রাণপণে দৌড়াইলেন! যদি তাঁহারা ধীরে যাইতেন, তাহা হইলে দেখিতেন যে, সেই সিক্ত ভূমির উপর বৃহৎ বৃহৎ পদচিহ্ন বর্তমান রহিয়াছে।!
ও কিসের গর্জ্জন? তাঁহারা থমকিয়া দাঁড়াইলেন। সে ভীষণ গর্জ্জনে বৃক্ষ লতা গুল্ম সমস্তই যেন কম্পিত হইয়া উঠিল আবার—আবার—সেই ভীষণ গর্জ্জন!
জো কহিল—“নিকটেই সিংহ ডাকছে!”
কেনেডি তখন মরিয়া হইয়াছিলেন। আর একটু অগ্রসর হইলেই যথেচ্ছা শীতল বারি পান করেন, অথচ এ কি বিঘ্ন উপস্থিত হইল! তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে কহিলেন—
“বেশ হয়েছে—চল—এগিয়ে চল!”!
“মিঃ কেনেডি আপনি একজন বিখ্যাত শিকারী, মনে রাখবেন আপনার উপরেই আমাদের জীবন নির্ভর করছে। একটু সাবধানে চলুন।”
কেনেডি সে কথায় কর্ণপাত করিলেন না।
দুই চারি পদ অগ্রসর হইয়াই তাঁহারা দেখিলেন, একটী তাল-বৃক্ষের নিম্নে প্রকাণ্ড একটা সিংহ লাঙ্গুল আস্ফালন করিতেছে। তাহার কৃষ্ণ বর্ণ কেশরগুলি দুলিতেছে, চক্ষু অগ্নিপিণ্ডবৎ জ্বলিতেছে, রসনা রসনা লক্লক্ করিতেছে! পলক ফেলিতে না ফেলিতে সিংহ তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া লম্ফ প্রদান করিল!
গুড়ুম্—কেনেডির বন্দুকের ধ্বনি হইল গুড়ুম্!
তাঁহার গুলির আঘাতে পশুরাজ একটী বিকট চিৎকার করিয়া ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল এবং তম্মুহূর্ত্তেই প্রাণ ত্যাগ করিল।
কেনেডি সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করিলেন না। একদৌড়ে নিকটস্থ কূপের নিকট গমন করিলেন এবং পিচ্ছিল প্রস্তর সোপানাবলী বহিয়া নিম্নে নামিয়াই প্রাণ ভরিয়া জল পান করিতে লাগিলেন। জোও তদ্রূপ করিল।
জল পান করিতে করিতে নিশ্বাস লইবার জন্য মুখ তুলিয়া জো কহিল—“সাবধান! অত খাবেন না। এখনই অসুখ করবে।”
কেনেডি শুনিলেন না। যদৃচ্ছা জল পান করিতে লাগিলেন। জলে হস্ত পদ ডুবাইলেন। মস্তক ধুইয়া ফেলিলেন—সর্ব্বাঙ্গ সিক্ত করিলেন।
জো কহিল— “ডাক্তার ফার্গুসন্ জলের আশায় বসে আছেন। চলুন—চলুন জল নিয়ে যাই।”
কেনেডি তাড়াতাড়ি বোতল পূর্ণ করিয়া জল লইলেন এবং সোপান বহিয়া উপরে উঠিতে লাগিলেন।
ও কি? কেনেডি অর্দ্ধ পথে থামিয়া গেলেন।
দেখিলেন আর একটা প্রকাণ্ড সিংহ কূপের মুখে দণ্ডায়মান রহিয়াছে!
সিংহ একটা বিকট গর্জ্জন করিয়া উঠিল!
কেনেডি কহিলেন—“এটা সিংহিনী! দাঁড়াও—দেখাচ্ছি!” তাঁহার নয়নদ্বয় জ্বলিয়া উঠিল। তিনি বন্দুকে গুলি পূরিলেন। চক্ষের পলক ফেলিতে না ফেলিতে আওয়াজ করিলেন। সিংহিনী আহত হইয়া সরিয়া গেল।
কেনেডি অগ্রসর হইলেন। কহিলেন—“পালিয়েছে জো, চলে এস।”
“না—না—যাবেন না। সিংহিনী মরে নাই। নিশ্চয়ই মুখের কাছে লুকিয়ে আছে। যিনি আগে উঠবেন তাঁর ঘাড়েই লাফিয়ে পড়বে।”
“ফার্গুসন্ যে এক ফোঁটা জলের জন্য পথ চেয়ে আছে! তার প্রাণ যে যায়! চল—যেতেই হ’বে।”
“সিংহিনীটাকে বধ করে’ এখনি যাচ্ছি চলুন।”
এই বলিয়া জো তাহার জামা খুলিয়া বন্দুকের নলের সঙ্গে বাঁধিয়া তুলিয়া ধরিল। বলিল—“মিঃ কেনেডি, আপনি প্রস্তুত থাকুন—”
মুহূর্ত্ত মধ্যে কুপিতা সিংহিনী বন্দুকের উপর লাফাইয়া পড়িল। কেনেডি প্রস্তুত ছিলেন, গুলি করিলেন। সিংহিনী চীৎকার করিতে করিতে কূপ মধ্যে গড়াইয়া পড়িল। ধাক্কা লাগিয়া জোও পতিত হইল। তাহাকে আঘাত করিবার জন্য সিংহিনী তাহার বৃহৎ ‘থাবা’ তুলিল। জো চক্ষু মুদিল!
পরক্ষণেই আর একটী বন্দুকের শব্দ হইল। সিংহিনী শেষ আর্ত্তনাদ কূপের ভিতরে ঘুরিয়া ঘুরিরা ফিরিতে লাগিল। জো পলক মধ্যে লম্ফ দিয়া উঠিল এবং সেই বারিপূর্ণ বোতলটা ফার্গুসনের হস্তে প্রদান করিল!