বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/একবিংশ পরিচ্ছেদ
একবিংশ পরিচ্ছেদ
অনুসন্ধান
কেনেডি কহিলেন— “এখন কি করবে, ফার্গুসন্?”
“চল, কোথাও নামি। নেমে জো’র জন্য অপেক্ষা করবো।”
প্রায় ৬০ মাইল পথ বায়ুতাড়িত হইয়া ফার্গুসন্ অনেক চেষ্টায় চ্যাড হ্রদের উত্তর তীরে একটা জনপ্রাণীহীন স্থানে নোঙ্গর করিলেন।
অল্পক্ষণ পরই রাত্রি আসিল। জল স্থল অন্ধকারে ঢাকিল। মুক্ত পবন হ্রদের উপর দিয়া বহিতে লাগিল। জলকল্লোলরব মধ্যে ফার্গুসনের কাতর কণ্ঠের “জো—জো—” ধ্বনি মিশিয়া গেল!
প্রভাত হইতে না হইতেই তাঁহারা দেখিলেন, একটা কর্দ্দমময় বিশাল প্রান্তর মধ্যে সামান্য একটু দৃঢ় ভূমির উপর অবতরণ করিয়াছেন। বিপুলকায় বৃক্ষরাশি চতুর্দ্দিক্ অন্ধকার করিয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে।
ফার্গুসন্ বুঝিলেন, কর্দ্দমময় প্রান্তর পার হইয়া বেলুনের নিকট আগমন করা কাহারো পক্ষে সম্ভব নহে। তিনি হ্রদের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল জল থৈ থৈ করিতেছে! দূরে দিগ্বলয় চুম্বন করিয়া সেই অস্থির বারিরাশি রৌদ্র কিরণে ঝলসিয়া নৃত্য করিতেছে।
এতক্ষণ জো’র নামোচ্চারণ করিতেও তাঁহাদের সাহস হয় নাই—কি জানি পাছে শুনিতে হয় যে, জো নাই—জো মরিয়াছে! অবশেষে কেনেডি কহিলেন—“জো বোধ হয় জলে ডুবে’ মরে নাই, সে বেশ সন্তরণ-পটু। আমার মন বল্ছে, তাকে আবার ফিরে’ পাব।”
“ভগবান্ করুন যেন তাই হয়, কেনেডি। জো’কে যথাসাধ্য খুঁজতে হ’বে। বেলুনের ছিন্ন আবরণটা খুলে ফেলা যাক্। তা’ হ’লে প্রায় সাড়ে আট মণ ভারও কমে যাবে।”
প্রায় ৪ ঘণ্টা চেষ্টা করিয়া উভয়ে বহিরাবরণটী খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন ভিতরের আবরণ অক্ষতই আছে।
বেলুনের কার্য্য শেষ করিয়া বিশ্রাম করিতে করিতে ফার্গুসন্ বলিলেন—“জো যখন লাফিয়ে পড়ে, তখন আমরা একটা দ্বীপের কাছে ছিলাম।”
“সাঁতার দিয়ে জো হয়ত সে দ্বীপে উঠতে পারবে।”
“তা’ পারবে বটে—কিন্তু ও সব দ্বীপ জলদস্যুর আবাসভূমি। তাদের হাতে পড়লে কি জো আত্মরক্ষা করতে পারবে।”
“জো যেরূপ চতুর—তা’ সে পারবে।”
কেনেডি বন্দুক লইয়া খাদ্য সংগ্রহ করিবার জন্য বাহির হইলেন, ফার্গুসন্ সেই অবসরে বেলুনটীকে কার্য্যক্ষম করিয়া তুলিলেন।
সে রজনী সেইখানে কাটিয়া গেল।
প্রভাতে ফার্গুসন্ বলিলেন—“কেমন করে’ জো’র সন্ধান করতে হ’বে, তা’ আমি ভেবে ঠিক করেছি।”
“কি করতে চাও?”
“আমরা যে কোথায় আছি, আগে সেইটা তাকে জানিয়ে দিতে হ’বে।”
“তা হ’লে ত ভালই হয়। আমাদের না দেখে সে হয় ত ভাবতে পারে, আমরা তাকে মৃত মনে করে’ ছেড়ে চলে গেছি।”
“এমন কথা সে ভাববে না, ডিক্। জো আমাদের খুব ভাল জানে।”
“কেমন করে’ তাকে জানাবে?”
“বেলুনে উঠে উড়বো।”
“যদি বাতাসে ঠেলে নিয়ে যায়!”
“অন্যদিকে নিবে না। দেখছ না, বাতাসটা হ্রদের দিকেই বয়ে যাচ্ছে। আমরা সারা দিন হ্রদের উপরেই থাকবো। তা’ হ’লে জো নিশ্চয়ই দেখতে পাবে। সে যে কোথায় আছে, তাও আমাদের জানিয়ে দিতে পারবে।”
“যদি সে বন্দী হ’য়ে থাকে?”
“তা’ হ’লেও পারবে। এ দেশে বন্দীদের আবদ্ধ করে’ রাখে না। যেমন করে’ই হোক, আমরা জো’র সন্ধান না করে ফিরবো না।”
নোঙ্গর তুলিয়া তাঁহারা জো’র সন্ধানে বাহির হইলেন। ফার্গুসন্ বেলুনকে ভূমি হইতে অল্প উপরে রাখিলেন; কেনেডি মধ্যে মধ্যে বন্দুক আওয়াজ করিতে লাগিলেন। যখন দ্বীপের নিকটবর্ত্তী হইলেন, তখন এত নিম্নে নামিলেন যে, দ্বীপের ক্ষুদ্র ঝোপ পর্য্যন্ত বেলুন স্পর্শ করিতে লাগিল। এইরূপে তাঁহারা কত কানন কত প্রান্তর কত শৈলগুহা সন্ধান করিলেন, কিন্তু জো’র দেখা মিলিল না!
এইভাবে দুই ঘণ্টা গেল। কেনেডি বলিলেন—
“এদিকে আর খুঁজে ফল নাই।”
“অধৈর্য্য হ’য়ো না, ডিক্। যেখানে জো পড়েছিল, আমরা সেখান থেকে বড় বেশী দূরে নাই।”
বেলা ১১টার সময় দেখা গেল, বেলুন প্রায় ৯০ মাইল পথ অতিক্রম করিয়াছে। তখন বাতাস অপেক্ষাকৃত বেগে বহিতেছিল। বেলুন সেই পবন-প্রবাহে ফারম-নামক দ্বীপের নিকটবর্ত্তী হইল। তাঁহাদের ভরসা ছিল, জো নিশ্চয়ই কোন ঝোপের অন্তরালে লুকাইয়া রহিয়াছে, বেলুন দেখিবামাত্র দৌড়াইয়া, আসিবে।
হায় দুরাশা!
বেলা ২টা বাজিল। বাতাসের গতি তখনো ফিরিল না দেখিয়া ফার্গুসন চিন্তিত হইলেন। আবার কি তবে বেলুন সেই ভীষণ মরুমধ্যে চলিয়া যাইবে, তবেই ত সর্বনাশ!
ফার্গুসন বলিলেন—
“কেনেডি, আর আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। কোথও নেমে বিপরীত বাতাসের জন্য অপেক্ষা করাই উচিত। পুনরায় যাতে হ্রদে ফিরে যেতে পারি, তাই করতে হ’বে।”
ক্রমে উপরে উঠিতে উঠিতে ভিক্টোরিয়া যখন ভূমি হইতে প্রায় সহস্র ফিট উপরে উঠিল, তখন ফার্গুসন্ দেখিলেন, উত্তরপশ্চিমগামী বায়ুস্রোত প্রবল বেগে বহিতেছে। বেলুন সেই বাতাসে ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
জোর কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না।
রজনী সমাগমে একস্থানে নোঙ্গর করিয়া তাঁহারা প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। নিরাশায় বুক ভাঙ্গিয়া গেল। চক্ষু ফাটিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। দুই বন্ধু সমস্ত রজনী জাগিয়া কাটাইলেন।
রাত্রি ৩টার সময় বাতাসের বেগ অত্যন্ত প্রবল হইল। নলবনের উপর বেলুন ভাসিতেছিল। প্রতিমুহূর্ত্তেই নলের আঘাত লাগিতে লাগিল। বেলুনের তখন একটী মাত্র আবরণ ছিল। কোনক্রমে ছিন্ন হইলেই সর্বনাশ! ফার্গুসন্ বলিলেন—
“ডিক্, এখানে আর থাকা যায় না। বেলুন ছাড়।”
“জো যে থাকলো!”
“আমি তাকে ছেড়ে যাব না। যদি এই ঝড়ে আমি একশ’ মাইল উত্তরেও চলে’ যাই, তা’ হ’লেও আবার ফিরব। এখানে থাকলে যে বেলুন পর্য্যন্তও যাবে।”
কেনেডি বেলুনের নোঙ্গরটা টানিয়া তুলিতে চেষ্টা করিলেন, পারিলেন না। উহা নড়িল না। বায়ুতাড়িত বেলুনের টানে টানে নোঙ্গরটী এত দৃঢ়রূপে ভূপ্রোথিত হইয়াছিল যে, উহা উঠিল না। ফার্গুসন্ দড়ি কাটিয়া দিলেন। বেলুন এক লম্ফে ভূমি হইতে ৩০০ ফিট উপরে উঠিয়া উত্তরদিকে ছুটিতে লাগিল। বায়ুপ্রবাহ ফিরাইবার সাধ্য ফার্গুসনের ছিল না। তিনি নীরবে বসিয়া রহিলেন।
কেনেডি বলিলেন—
“ফার্গুসন্ ফিরতেই হ’বে।”
“নিশ্চয়। বেলুন ছেড়ে যদি পদব্রজেও চ্যাড-হ্রদের কাছে আসতে হয়, তা’ও স্বীকার —তবুও ফিরতে হ’বে।”
“আমি ছায়ার মত তোমার অনুবর্ত্তী হ’ব। আমাদের জন্য জো আত্মবলি দিয়েছে—আমরাও তার জন্য তাই করব।”
ঝড় এমন প্রবল হইয়াছিল যে, বেলুন গুণমুক্ত সায়কের ন্যায় বোনাদ্-উল্-জেরিদ নামক মরুভূমির উপর দিয়া যাইতেছিল। এ প্রদেশে সর্ব্বদাই ঝড় হয়—তখনো হইতেছিল। দেখিতে দেখিতে বৃক্ষলতাদির চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়া গেল।
ফার্গুসন্ বলিলেন—
“ডিক্, প্রকৃতির পরিহাস দেখ! আর আমাদের নামার উপায় নাই, আমারও উপায় নাই—যেতেই হ’বে। যতদূর চক্ষু চলে, সব বালু—নীরস—তপ্ত—জ্বালাময়! আমরা সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে চলেছি।”
ফার্গুসন্ যখন এইরূপে হতাশ হৃদয়ে কেনেডির সহিত কথা কহিতেছিলেন, তখন দেখিলেন, মরুভূমির উত্তর দিকে বালুকারাশি উড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। উহা উড়িতে উড়িতে ঘুরিতেছে, ঘুরিয়া ঘুরিয়া উড়িতেছে। সেই উৎক্ষিপ্ত ঘুর্ণ্যমান বায়ুতাড়িত বালুরাশির তরঙ্গমধ্যে তখন একদল পথিকের জীবন্ত সমাধি ঘটিতেছিল! উষ্ট্রগণ যন্ত্রণায় চীৎকার করিতে লাগিল।
মুহূর্ত্তে সব শেষ হইয়া গেল! উষ্ট্র আরোহী বণিকগণ সমস্তই বালুকা-গর্ভে সমাহিত হইল! কেবল উন্মত্ত পবন তখনো সেই স্থানে সাহারার বালু লইয়া ক্রীড়া করিতে লাগিল—ঘুরাইতে লাগিল—ইতস্ততঃ চালিত করিতে আরম্ভ করিল! যে স্থান সমতল ক্ষেত্র ছিল, তাহা মুহূর্ত্তমধ্যে বালুকার উচ্চ পর্ব্বতে পরিণত হইল। সেই পর্ব্বতের পাদমূলে জীবন্ত মানব জীবন্ত পশু চিরদিনের জন্য সমাহিত হইয়া গেল!
এই লোমহর্ষণ দৃশ্য দেখিয়া ফার্গুসন ও কেনেডির হৃদয় স্তব্ধ হইল! বেলুন তখন তাঁহাদের আয়ত্তের বাহিরে গিয়াছিল। বিপরীতগামী বায়ুরাশি কর্ত্তৃক প্রহত হইয়া উহা ঘুরিতে লাগিল, উড়িতে লাগিল, প্রবল বেগে ধাবিত হইতে লাগিল!
বেলুন এত দুলিতে লাগিল যে, উহার ভিতর বসিয়া থাকা অসম্ভব হইল। জলের বাক্স নড়িতে লাগিল, গ্যাস-নল বক্র হইয়া গেল। দোলনাটী কখন বা ছিঁড়িয়া পড়ে, তাঁহারা সেই চিন্তায় আকুল হইলেন!
অকস্মাৎ বেলুন থামিল। বাতাসের গতি ফিরিল। প্রবল বেগে বিপরীতগামী বায়ু বহিতে লাগিল। বেলুন নক্ষত্র-বেগে ছুটিতে আরম্ভ করিল।
কেনেডি জিজ্ঞাসা করিলেন—
“আমরা আবার কোন্ দিকে যেতে আরম্ভ করলেম?”
“যে দেশ আর দেখতে পাব না বলে’ ভয় হয়েছিল, সেই দিকেই চলেছি।”
বেলা ৯টা বাজিল। তখনো তাঁহারা চ্যাড-হ্রদের নিকটবর্ত্তী হইতে পারিলেন না। অঙ্গুলী-সঙ্কেতে কেনেডি দেখাইলেন, দূরে মরুভূমি ধূ ধূ করিতেছে! ফার্গুসন্ বলিলেন—
“তা’ হোক্। প্রধান কথা দক্ষিণ দিকে যাওয়া। তা’ আমরা যাচ্ছি। আমরা বোর্ণোউ, কৌফা প্রভৃতি নগর নিশ্চয়ই দেখতে পাব। তুমি দূরবীক্ষণ নিয়েই বসে’ থাক। দেখো, যেন তোমার চোখে কিছু বাদ যায় না।”
কেনেডি সতর্ক হইয়া চতুর্দ্দিক্ দেখিতে লাগিলেন।